ইভিএমের বিরোধিতার কারণ ‘মনস্তাত্ত্বিক’: ইসি

দিন গড়াতে থাকলে রাজনৈতিক দলগুলোর আস্থা অর্জনও হবে বলে আশাবাদী ইসি।

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 14 Sept 2022, 05:34 PM
Updated : 14 Sept 2022, 05:34 PM

রাজনৈতিক অঙ্গনে মতানৈক্যের মধ্যেও ইভিএম নিয়ে এগিয়ে যাওয়া নির্বাচন কমিশনের যুক্তি, যন্ত্রে ভোট দিয়ে অহেতুক সন্দেহ অনেকের মনে গেঁথে আছে, যদিও তার কোনো ভিত্তি নেই।

দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে বুধবার ইসির প্রকাশিত রোডম্যাপে ইভিএম নিয়ে নিজেদের অবস্থান তুলে ধরা হয়।

এতে বলা হয়, “ইভিএমে ভোট ম্যানিপুলেশনের বিষয়ে কেউ এ পর্যন্ত প্রমাণ করতে পারে নাই। এ বিষয়ে বিভিন্ন সময়ে নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে ইভিএমে কারচুপি করা সম্ভব, এমন প্রমাণ করার জন্য বিশেষজ্ঞ ও রাজনৈতিক দলগুলোকে আহ্বান করা হয়েছে। কিন্তু তারা কেউ এ অভিযোগটি প্রমাণ করতে পারেননি। তাই দেখা যাচ্ছে, শুধু মনস্তাত্বিক ধারণা থেকে এ অভিযোগটি করা হয়।”

দেশে ইভিএমে ভোটগ্রহণ শুরুর যুগ পেরোলেও এখনও তা সর্বজনগ্রাহ্যতা পায়নি। বিএনপিসহ তাদের মিত্র দলগুলোর প্রবল আপত্তি ইভিএম নিয়ে; তাদের ভাষ্য, এতে ভোটের ফল বদলে দেওয়া সহজ।

ইভিএমে নিয়ে ইসি যে সংলাপ ডেকেছিল, তাতে ৩৯টি দলের মধ্যে বিএনপিসহ ১০টি অংশই নেয়নি। অংশ নেওয়াদের মধ্যে জাতীয় পার্টিসহ কয়েকটি দল ইভিএমের বিপক্ষে মতামত দেয়।

ইসির রোডম্যাপে বলা হয়, সংলাপে অংশগ্রহণকারী ২৯টি দলের মধ্যে ইভিএমের পক্ষে মত দিয়েছে ১৭টি রাজনৈতিক দল। বিপক্ষে মত দিয়েছেন ১২টি দল।

‘বেশিরভাগ’ রাজনৈতিক দলের মত ইভিএমের পক্ষে থাকায় ইভিএম ব্যবহার না করা যুক্তিসঙ্গত হবে না বলে ইসি মনে করছে।

“উভয় পক্ষের প্রতি গুরুত্ব দিয়ে তাই কমিশন অনূর্ধ্ব ১৫০টি আসনে ইভিএম ব্যবহার করা যুক্তিসঙ্গত মনে করেন। ইভিএমগুলো সিটি কর্পোরেশন ও জেলা সদরের আসনগুলোতে অগ্রাধিকারে ব্যবহার করা হবে। অবশিষ্ট ১৫০ আসনে ব্যালটের মাধ্যমে ভোট গ্রহণ করা হবে।”

Also Read: ইসির রোডম্যাপ: মহানগর ও জেলা সদরে ইভিএমে ভোট

ইভিএম ব্যবহার নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মতানৈক্যের বিষয়টি স্বীকার করে রোডম্যাপে বলা হয়েছে, এর ব্যবহারের পক্ষে যেমন যুক্তি রয়েছে, তেমনি এর বিপক্ষে যারা রয়েছেন তারাও কিছু যুক্তি তুলে ধরেছেন। পক্ষে যে সকল যুক্তি রয়েছে তা হচ্ছে- বায়োমেট্রিক যাচাই করে ভোট দেওয়ার সিস্টেম থাকায় জাল ভোট অর্থাৎ একজনের ভোট অন্যজনের দেওয়ার সুযোগ নেই। ওয়ান টাইম চিপ ব্যবহার ও এমবেডেড পার্টস থাকায় একই সাথে একজন ভোটার একাধিক ভোটও দিতে পারেন না। একই ইভিএম বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন ধরনের নির্বাচনে ব্যবহার করা হয় বিধায় প্রোগ্রামের মাধ্যমে জালিয়াতি করা সম্ভব নয়। বিল্টইন ঘড়ি থাকায় নির্বাচন সময় আরম্ভ হবার আগেও ভোট দেওয়া যায় না, একইভাবে ভোট সময় শেষ হলে প্রিজাইডিং অফিসার বন্ধ বাটনে চাপ দিলে এর পরে ভোট দেবার কোন সুযোগ  থাকে না। ভোট গণনা করতে হয় না, বাটনে চাপ দিলেই ফলাফল পাওয়া যায়।

ইভিএমের বিরোধিতা নিয়ে বলা হয়, যারা এর বিপক্ষে যুক্তি দেখান, তারা বলেন যে ইভিএমে ভোট ম্যানিপুলেশন করা সম্ভব অর্থাৎ একজনকে ভোট দিলে মেশিন গণনায় ভোট অন্যকে দিতে পারে। ভোটাররা এখনও ইভিএমে ভোট দিতে অভ্যস্ত নয়। মহিলা বিষেশত, যারা বৃদ্ধ/কম শিক্ষিত তাদের ভোট দিতে অসুবিধা হয়। বায়োমেট্রিক দিতে বিশেষকরে শ্রমজীবী শ্রেণীর ভোটারদের আঙ্গুলের ছাপ না মেলায় তারা ভোট দিতে পারেন না।

ইভিএম ব্যালটের চেয়ে শ্রেয়তর দাবি করে ইসি বলছে, “পক্ষান্তরে ব্যালটে ভোট হলে কেন্দ্র দখল করে ভোটের আগে পরে ইচ্ছামতো বাক্সে ব্যালট ভর্তি করা সম্ভব। কিন্তু ইভিএমে এ ধরনের অন্যায় করার কোনো সুযোগ নাই। এ সকল সুবিধা থাকার কারণে সুষ্ঠু ভোট গ্রহণ ও ফলাফল প্রদান করা যায়।”

পক্ষে কারা, বিপক্ষে কারা

  • ইভিএমের পক্ষে যে ১৭ দল: বিএনএফ, জাকের পার্টি, জেপি, ন্যাপ, এনপিপি, ইসলামিক ফ্রন্ট বাংলাদেশ, বাংলাদেশ ইসলামী ফ্রন্ট, বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলন, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস, আওয়ামী লীগ, গণতন্ত্রী পার্টি, সাম্যবাদী দল, জাসদ, তরীকত ফেডারেশন, বিকল্পধারা, ওয়ার্কার্স পার্টি ও মুক্তিজোট।

  • বিপক্ষে যে ১২ দল: বাংলাদেশ কংগ্রেস, জাতীয় পার্টি, এনডিএম, গণফ্রন্ট, বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি, বাংলাদেশ মুসলিম লীগ, খেলাফত মজলিশ, ইসলামী ঐক্যজোট, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম, গণফোরাম, বাংলাদেশ ন্যাপ ও কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ।

  • শর্ত সাপেক্ষে ইডিএমের পক্ষে ১১টি রাজনৈতিক দল মত দিয়েছে বলে ইসি জানিয়েছে।

  • শর্ত দুই ধরনের: ইভিএমে ভিভিপ্যাট বা এ জাতীয় কিছুর সংযোজন, যাতে ভোটাররা বুঝতে পারেন তারা কোন মার্কায় ভোট দিয়েছেন।

  • এ নিয়ে ইসির বক্তব্য হচ্ছে, বর্তমান ইভিএমে ভিভিপ্যাট সংযোজন করার সুযোগ নেই। তবে ভিভিড্যাট রয়েছে, যাতে কে কত ভোট পেয়েছেন, তার হিসাব থাকে।

সংলাপ চলবে, আস্থাও ‘ফিরবে’

ইসি আশাবাদী, সংলাপের মধ্য দিয়ে তাদের উপর অনাস্থা কেটে যাবে।

অসুস্থ থাকায় সিইসি কাজী হাবিবুল আউয়াল ‘দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের কর্মপরিকল্পনা’ প্রকাশ অনুষ্ঠানে অনুপস্থিত ছিলেন। তবে চার নির্বাচন কমিশনার, ইসি সচিব, অতিরিক্ত সচিবসহ সংশ্লিষ্টরা উপস্থিত ছিলেন।

রোডম্যাপে বলা হয়, নির্বাচন সংশ্লিষ্ট সবার অভিজ্ঞতা ও জ্ঞানকে কাজে লাগিয়ে একটি যুগোপযোগী আইনি কাঠামো ও প্রক্রিয়া চূড়ান্ত করতে ইসির সঙ্গে বিভিন্ন অংশীজনের সংলাপ চলমান থাকবে।

সংবাদ সম্মেলনে এক প্রশ্নের জবাবে নির্বাচন কমিশনার মো. আলমগীর বলেন, “নির্বাচনের পথে এখনও এক বছর চার মাস বাকি। একটি রাজনৈতিক দলের যদি আমাদের প্রতি অনাস্থা থাকে; আমরা যে কর্মপরিকল্পনা করেছি, এগুলো তো বাস্তবায়ন করতে পারিনি। এগুলো বাস্তবায়ন করার পর আর কোনো অনাস্থা থাকবে না।

“দলগুলো দেখবে আমাদের কার্যক্রম। আমাদের কর্মকাণ্ড যদি হয় নিরপেক্ষ, সুষ্ঠু; তাহলে অবশ্যই আস্থা ফিরে আসবে।”

আরেক প্রশ্নের জবাবে এ নির্বাচন কমিশনার জানান, ২০২৩ সালের ডিসেম্বরের শেষ দিকে বা ২০২৪ জানুয়ারির শুরুতে নির্বাচন হবে। সেক্ষেত্রে ২০২৩ সালের নভেম্বরে হতে পারে তফসিল।

তিনি বলেন, “আমাদের চ্যালেঞ্জগুলো কর্মপরিকল্পনায় অন্তর্ভুক্ত করেছি। এগুলো মোকাবেলা করে সুষ্ঠু, গ্রহণযোগ্য ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনে সক্ষম হব বলে আশা করি।”

রোডম্যাপ প্রকাশের সংবাদ সম্মেলনে সিইসির অনুপস্থিতিতে নির্বাচন কমিশনার আহসান হাবিব খান ছিলেন প্রধান অতিথি।

তিনি বলেন, “আমাদের কর্মপরিকল্পনা আগের চেয়ে ব্যতিক্রম। আমরা সব চ্যালেঞ্জ উত্তরণ ঘটিয়ে সুষ্ঠু, অবাধ, নিরপেক্ষ উপহার দেব। লক্ষ্য একটাই।”