রাত পৌনে ১১টায় তার গাড়িবহর বিমানবন্দরে পৌঁছায়, ১১টা ১০ মিনিটে তিনি এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে ওঠেন।
Published : 07 Jan 2025, 11:32 PM
চিকিৎসার জন্য যুক্তরাজ্যের উদ্দেশে রওনা হওয়ার আগে বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে বিদায় জানাতে ঢাকার শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর এলাকায় জড়ো হয়েছেন বিএনপি ও দলটির অঙ্গসংগঠনের হাজারো নেতাকর্মী।
মঙ্গলবার সন্ধ্যার কিছু আগে থেকেই দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে বাস ও পিকআপসহ নানা যানবাহনের করে নেতাকর্মীরা বনানী থেকে বিমানবন্দর পর্যন্ত সড়কের দুই পাশে অবস্থান নেন।
নেতাকর্মীদের ভিড়ে বনানী থেকে বিমানবন্দর পর্যন্ত সড়কে ব্যাপক যানজট লেগে যায়।
কাতারের আমিরের পাঠানো বিশেষ এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে এদিন রাত ১০টায় বিমানবন্দর থেকে লন্ডনের উদ্দেশ্যে যাত্রা করার কথা ছিল খালেদা জিয়ার। কিন্তু যানজটের কারণে রাত পৌনে ১১টায় তার গাড়িবহর বিমানবন্দরে পৌঁছাতে পেরেছে। ১১টা ১০ মিনিটে তিনি এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে ওঠেন।
এদিন রাত সোয়া ৮টায় তার গাড়িবহর গুলশানের বাস ‘ফিরোজা’ থেকে বিমানবন্দরের উদ্দেশে যাত্রা করে। যাত্রাপথে তাকে বিদায় জানাতেই মূলত সড়কের দুই পাশ ও বিমানবন্দরে জড়ো হন নেতাকর্মীরা।
এ সময় তারা ‘খালেদা জিয়া, জিয়া খালেদা’, ‘তারেক রহমান, রহমান তারেক’, ‘তারেক রহমান বীরের বেশে, আসবে ফিরে বাংলাদেশে’ ইত্যাদি স্লোগান দিতে থাকেন।
খালেদা জিয়ার আগমন ঘিরে বিমানবন্দর এলাকাজুড়ে সেনাবাহিনী, আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন, আনসার, গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যদের সতর্ক উপস্থিতি দেখা গেছে।
বিমানবন্দরের সবগুলো প্রবেশমুখে যাত্রী এবং তাদের সঙ্গে আসা স্বজনদের তল্লাশির মুখে পড়তে হয়েছে।
বিএনপি চেয়ারপারসনের সুস্থতা কামনা করে তাকে একনজর দেখতে কুমিল্লা শহর থেকে এসেছেন আনোয়ার হোসেন। তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “প্রিয় নেত্রীকে কয়েক বছর ধরে দেখি না। আজ স্বচক্ষে দেখার জন্যই এখানে এলাম। আল্লাহর কাছে দোয়া করি, তিনি যেন পরিপূর্ণ সুস্থ হয়ে দেশে ফিরে আসেন।”
রাজধানীর দক্ষিণখান থেকে এসেছেন রাহাত হোসেন। তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “দেশনেত্রী খালেদা জিয়াকে চিকিৎসাসেবার মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করেছে ফ্যাসিস্ট আওয়ামী সরকার। আজ তিনি দেশের বাইরে যাচ্ছেন। এটা জনতার বিজয়। তাকে বিদায় জানাতেই আমরা এখানে এসেছি।”
পল্টন এলাকা থেকে আসা মো. রুবেল বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ”আমরা সন্ধ্যার পর থেকেই এখানে দাঁড়িয়ে আছি নেত্রীকে এক নজর দেখার অপেক্ষায়।”
যুক্তরাজ্যে গিয়ে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ভর্তি হবেন ‘লন্ডন ক্লিনিকে’, যেখানে ব্রিটিশ রাজপরিবারের সদস্যদের পাশাপাশি ধনাঢ্য ব্যক্তিরা চিকিৎসা নিতে যান।
কাতারের আমিরের পাঠানো বিশেষ এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে কাতারের চারজন চিকিৎসক ছাড়াও কয়েকজন প্যারামেডিক রয়েছেন।
খালেদা জিয়ার সঙ্গে যাচ্ছেন তার মেডিকেল বোর্ডের ছয় সদস্য হলেন- অধ্যাপক শাহাবুদ্দিন তালুকদার, অধ্যাপক এফ এম সিদ্দিক, অধ্যাপক নরুদ্দিন আহমেদ, ডা. জাফর ইকবাল, অধ্যাপক এ জেড এম জাহিদ হোসেন ও ডা. মোহাম্মদ আল মামুন।
এছাড়া বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গে যাবেন তার ছোট ছেলের স্ত্রী সৈয়দা শামিলা রহমান সিঁথি, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য এনামুল হক চৌধুরী, নির্বাহী কমিটির সদস্য তাবিথ আউয়াল ও খালেদা জিয়ার একান্ত সচিব এ বি এম আবদুস সাত্তারসহ ব্যক্তিগত কয়েকজন কর্মকর্তা-কর্মচারী।
দেশের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের প্রায় পাঁচ মাস বাদে চিকিৎসার জন্য বিদেশে যাচ্ছেন বিএনপি চেয়ারপারসন। প্রাথমিক পরিকল্পনায় তার লন্ডন হয়ে যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়ার কথা বলা হলেও এখন যুক্তরাজ্যের হাসপাতালে চিকিৎসা নেওয়াই চূড়ান্ত হয়েছে।
সবশেষ সাড়ে সাত বছর আগে যুক্তরাজ্যেই চিকিৎসা নিতে গিয়েছিলেন ৭৯ বছর বয়সী খালেদা জিয়া। সেবার চোখ ও পায়ের চিকিৎসা নিয়েছিলেন। লিভার সিরোসিস, হৃদরোগ, ফুসফুস, আর্থ্রাইটিস, কিডনি,ডায়াবেটিসসহ নানা জটিলতায় তিনি ভুগছেন।
দীর্ঘদিন থেকে অসুস্থ খালেদা জিয়াকে বিদেশে নিয়ে যেতে গত কয়েক বছর থেকে চেষ্টা চালাচ্ছেন তার পরিবারের সদস্যরা ও বিএনপি।
২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি দুর্নীতির এক মামলায় কারাবন্দি হন সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া। ঢাকার নাজিমউদ্দিন রোডের পরিত্যক্ত ও নির্জন কারাগারে তাকে রাখা হয়।
কারাবন্দি জীবনের পর শর্তসাপেক্ষে মুক্তি মিললেও বিদেশে তার চিকিৎসার অনুমতি দেয়নি তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার। এই অনুমতির জন্য তার দল আন্দোলন-সংগ্রাম করেও সুবিধা করতে পারেনি।
সেই কারণে ২০১৭ সালের ১৫ জুলাই বিএনপি চেয়ারপারসনের লন্ডনযাত্রার পর আর কোনো বিদেশ সফর হয়নি।
কোভিড-১৯ মহামারীর পর খালেদা জিয়া ২০২০ সাল থেকে সরকারের নির্বাহী আদেশে সাময়িক মুক্ত আছেন। তখন বিশেষ শর্তে তাকে গুলশানের বাসায় থাকতে দেওয়া হয়।
সেখানে থাকা অবস্থায় তার শারীরিক অব্স্থার অবনতি হলে গত কয়েক বছরে তাকে রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালে কয়েক দফায় ভর্তি করা হয়।
পরে ছাত্র-জনতার আন্দোলনে সরকার পতন হলে অন্তর্বর্তী সরকার খালেদা জিয়াকে মুক্তি দেয়। এরপর তাকে বিদেশে নিয়ে যাওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হয়। তবে সেই সময় তার শারীরিক অবস্থা দীর্ঘ বিমান ভ্রমণের জন্য উপযোগী না হওয়ায় তাকে দেশেই চিকিৎসা দেওয়া হয়। এরপর জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে তার লন্ডন যাওয়ার দিনক্ষণ ঠিক হয়।
গতি নেই সড়কে
বনানী থেকে বিমানবন্দর পর্যন্ত সড়কে নেতাকর্মীদের এতটাই ভিড় ছিল যে, গাড়ি থেকে নেমে সবাইকে সরে যেতে অনুরোধ করেন দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।
গুলশান থেকে বিমানবন্দরের প্রায় নয় কিলোমিটার পথের পুরোটাই গাড়ি চলেছে হাঁটা গতিতে। সঙ্গে সঙ্গে হেঁটে গেছেন অনেক নেতাকর্মী আর নিরাপত্তা সদস্যরা। যে কারণে দুই ঘণ্টায়ও নয় কিলোমিটার পথ অতিক্রম করতে পারেনি খালেদা জিয়ার গাড়িবহর।
দলের নেত্রীকে বিদায় জানাতে রাস্তার পাশে নেতা-কর্মীদের অবস্থানের কারণে মঙ্গলবার বিকেল থেকেই বিমানবন্দর সড়কে যান চলাচল ব্যহত হয়।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের প্রতিবেদক সন্ধ্যা সোয়া ৬টায় মহাখালী থেকে বিমানবন্দরের উদ্দেশ্যে রওনা দেন। কিছুটা হেঁটে এক্সপ্রেসওয়ে দিয়ে একটি আন্তঃজেলা বাসে চেপে দুই ঘণ্টায় বিমানবন্দর যেতে সক্ষম হন তিনি।
এক্সপ্রেসওয়ে দিয়ে যাতায়াতকারী যানবাহনও বিমানবন্দরে নামার মুখে যানজটে পড়ে। বনানী থেকেই বিমানবন্দর পর্যন্ত রাস্তার দুই পাশে নেতা-কর্মীরা ব্যানার নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন। তারা স্লোগানও দিচ্ছিলেন।
খালেদা জিয়ার যাত্রাকে কেন্দ্র করে অবশ্য আগে থেকেই প্রস্তুতি ছিল পুলিশ ও বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষের। বিকালে ঢাকা মহানগর পুলিশের উত্তরা বিভাগের উপকমিশনার রওনক জাহান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ঢাকায় প্রবেশ কিংবা ঢাকা থেকে বের হওয়ার ক্ষেত্রে বিমানবন্দর সড়কটি গুরুত্বপূর্ণ। তাই সেখানে যেন জনদুর্ভোগ না হয় এবং কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা না ঘটে, সেটা নিশ্চিত করতে আমরা নিরাপত্তা বাড়িয়েছি।”
খালেদা জিয়াকে বিদায় জানাতে গিয়ে সড়কে যাতায়াতকারীদের যেন দুর্ভোগ না হয়, তা নিশ্চিত করতে দলের নেতাকর্মীদের নির্দেশনা দিয়েছিল বিএনপি।
তবে শেষ পর্যন্ত জনদুর্ভোগ এড়ানো যায়নি। বিমানবন্দর থেকে মহাখালী পর্যন্ত যানজট ছড়ায়। ঠাঁয় দাঁড়িয়ে থাকা যানবাহনগুলোতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে বিরক্ত হন মানুষ। ফেইসবুকের বিভিন্ন ট্রাফিক গ্রুপে নিজেদের নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া জানান তারা।
রাতে ডিএমপি ট্রাফিক উত্তরা বিভাগের উপকমিশনার আনোয়ার সাঈদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “বিমানবন্দর গোলচতত্বর এলাকায় বিপুল সংখ্যক মানুষের জমায়েত হয়েছে।
“উৎসুক জনতার ভিড় রাস্তার কিছু অংশে চলে এসেছে। তবে আমরা কোথাও রাস্তা বন্ধ করিনি। দুই-তিন লেনে গাড়ি চলাচল করছে, ধীরগতি হলেও দুইপাশে যান চলাচল করছে। আমরা সবাই মাঠে থেকে সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি।”
ট্রাফিক গুলশান বিভাগের উপকমিশনার মল্লিক আহসান উদ্দিন সামী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ওনার (খালেদা জিয়া) প্রচুর নেতাকর্মী রাস্তায় ভিড় করেছেন। ফলে যান চলাচল ব্যহত হচ্ছে। আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছি যেন ওনি নির্বিঘ্নে যেতে পারেন। উনি বিমানবন্দরে পৌঁছানোর পর আশা করি সড়কের পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে যাবে।”