Published : 04 May 2025, 08:29 PM
সংবিধান ও রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি পরিবর্তনের প্রস্তাবের বিরোধিতা করেছে বাংলাদেশ সমাজতান্ত্রিক পার্টি।
দলটির নেতারা বলছেন, সংবিধানের চারটি মূলনীতি বাদ দিয়ে এখন যে বিষয়গুলো আসছে, সেখানে তাদের দ্বিমত রয়েছে।
রোববার জাতীয় সংসদ ভবনের এলডি হলে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে আলোচনায় অংশ নেয় বাংলাদেশ সমাজতান্ত্রিক পার্টির ৭ সদস্যের প্রতিনিধিদল।
দলের নির্বাহী সভাপতি আব্দুল আলীর নেতৃত্বে প্রতিনিধি দলে ছিলেন সাধারণ সম্পাদক বাবুল মোল্যা, মজিবুর রহমান, রুবেল শিকদার, ফখরুদ্দিন রিয়াদ, রাজিব আহমেদ, মিজানুর রহমান এবং আব্দুর রাজ্জাক।
প্রায় তিন ঘণ্টার আলোচনা শেষে দলের সাধারণ সম্পাদক বাবুল মোল্যা বলেন, “১৬৬টি প্রস্তাবে আমরা কিছু বিষয়ে একমত হয়েছি, কিছু বিষয়ে একমত হতে পারিনি এবং কিছু বিষয়ের আমরা বিকল্প প্রস্তাব করেছি। বাংলাদেশের নাম পরিবর্তনের যে একটি বিষয় এসেছে, সেই বিষয়টিতে আমরা দ্বিমত পোষণ করেছি।
“আগে সংবিধানের চারটি মূলনীতি ছিল। সেই চারটি বাদ দিয়ে এখন যে বিষয়গুলো আসছে, সেখানে আমরা দ্বিমত পোষণ করেছি। এই কারণে করেছি, সংবিধানের অনুচ্ছেদ ২(ক) রেখে কীভাবে বহুত্ববাদ প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব? অনুচ্ছেদ ২(ক) এটা বাদ দিতে হবে এবং এর সাথে রিলেটেড যে ৮, ৯, ১০ বহাল রাখতে হবে। ১০২ অনুচ্ছেদের সপ্তম তফসিল বহাল রাখতে হবে।”
সংবিধানের অনুচ্ছেদ ২(ক) এ প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম, তবে হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রীষ্টানসহ অন্যান্য ধর্ম পালনে রাষ্ট্র সমমর্যাদা ও সমঅধিকার নিশ্চিত করার কথা বলা হয়েছে।
আর সংবিধান সংস্কার কমিশন সংবিধানের মূলনীতি হিসেবে ‘সাম্য, মানবিক মর্যাদা, সামাজিক সুবিচার, বহুত্ববাদ এবং গণতন্ত্র’ অন্তর্ভুক্ত করার সুপারিশ করেছে।
এ ব্যাপারে কমিশনের প্রস্তাবে বলা হয়েছে, “বাংলাদেশ একটি বহুত্ববাদী, বহুজাতি, বহুধর্মী, বহুভাষী ও বহু সংস্কৃতির দেশ, যেখানে সব সম্প্রদায়ের সহাবস্থান ও যথাযথ মর্যাদা নিশ্চিত করা হবে।”
কমিশনের এই প্রস্তাবের সঙ্গে ভিন্নমত পোষণ করে দলটি বলেছে, সংবিধানের ৮, ৯, ১০ অনুচ্ছেদ বহাল রাখতে হবে।
সংবিধানের ৮ অনুচ্ছেদে জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার কথা বলা হয়েছে। আর অনুচ্ছেদ ৯, ১০ -এ জাতীয়তাবাদ, সমাজতান্ত্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা ও ধর্মনিরপেক্ষতা নীতি বাস্তবায়নের কথা বলা হয়েছে।
এছাড়া প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতির মেয়াদ চার বছর এবং একজন প্রধানমন্ত্রী সর্বোচ্চ দুই বার দায়িত্ব পালনের প্রস্তাবে দ্বিমত হয়নি বলে জানান বাবুল মোল্যা।
তিনি বলেন, “আমরা উচ্চকক্ষ-নিম্নকক্ষে একমত না, আমরা চলমান সংসদ ব্যবস্থার সাথেই আছি। আমরা চাই সংখ্যানুপাতিক হারে নির্বাচন হবে। ৪০০ আসন এর মধ্যে ১০০ আসন মহিলাদের জন্য, এতে আমরা একমত হয়েছি।
“৩০ ভাগ বা ৪০ ভাগ ভোট পেয়ে সংসদে সিদ্ধান্ত নেয়, তাহলে বাকি ৭০ ভাগ বাদ থেকেই গেল। এই কারণে আমরা চাই সংখ্যানুপাতিক নির্বাচন। জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সংসদ সদস্য সংখ্যানুপাতিকভাবে সংসদ সদস্য নির্বাচনে আসবে।”
স্বতন্ত্র প্রার্থীর ক্ষেত্রে শতকরা ১ ভাগ ভোটারের বিষয়ে বিরোধিতা করে বাবুল মোল্যা বলেন, “গোপন ব্যালটের মাধ্যমে নির্বাচন হলে স্বতন্ত্র প্রার্থীর জন্য যে ১ ভাগ ভোট, সেই ভোটাররা তো জীবনের ঝুঁকিতে পড়ে যায়। আমরা সেই পদ্ধতিতে একমত হতে পারি না।
“নির্বাচনের ব্যপারে আমরা বলেছি, নির্বাচনের সকল ব্যয় নির্বাচন কমিশনকে বহন করতে হবে। একই মঞ্চে সকল প্রার্থীরা তাদের বক্তব্য প্রদান করবেন এবং প্রচারপত্র নির্বাচন কমিশন থেকে ছেপে দেবে। প্রার্থীরা তাদের নির্বাচনি ইশতেহার ঘোষণা করবেন, সেই আলোকে নির্বাচন হবে।”
নির্বাচনের তারিখ নিয়ে কোন কথা হয়েছে কি না জানতে চাইলে বলেন, “আমরা কোনো সুনির্দিষ্ট তারিখ দেই নাই, তবে আমরা বলেছি নির্বাচন যাতে দ্রুত সময়ের মধ্যে হয়। নির্বাচন কাজ করার জন্য সংস্কার কাজ যতটুকু প্রয়োজন সেটুকু করে দ্রুত নির্বাচন দেওয়ার ব্যবস্থা করা যেন হয়।
“অন্যান্য সংস্কার যেমন, সংবিধান সংস্কার সেখানে জনসম্পৃক্ততা প্রয়োজন, এখন জনসম্পৃক্ততা করেই এই সংস্কার করতে হবে। সেটার পদ্ধতি হলো নির্বাচনের মাধ্যমে জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত হবে এবং জনপ্রতিনিধিরা জাতীয় সংসদে এই সংস্কারগুলো প্রস্তাব আকারে করবেন।”
গণভোটের মাধ্যমে সংবিধান সংস্কারের প্রস্তাবের বিষয়ে বাবুল বলেন, “গণভোটের সাথে আমরা আলোচনায় যাইনি। নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণের প্রতিনিধি নির্বাচন করলেই তো জনগণের সংশ্লিষ্টতা হয়ে গেল।”
রাষ্ট্র সংস্কারের লক্ষ্যে গঠিত সংস্কার কমিশনগুলোর একীভূত সুপারিশ চূড়ান্ত করার পাশাপাশি এ বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঐকমত্য তৈরির জন্য কাজ করছে ঐকমত্য কমিশন।
পাঁচটি সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনের গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশের ওপর ৩৯টি রাজনৈতিক দলের মতামত জানতে চেয়েছিল ঐকমত্য কমিশন। এরপর সেই মতামত ধরে সংশ্লিষ্ট দলের সঙ্গে সংলাপ করছে কমিশন।
প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মনির হায়দারের সঞ্চালনায় আরও উপস্থি ছিলেন কমিশনের সদস্য সফর রাজ হোসেন, বদিউল আলম মজুমদার, ইফতেখারুজ্জামান।
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে গঠিত এ কমিশন গত ১৫ ফেব্রুয়ারি কাজ শুরু করে।
রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে শুরু হওয়া সংলাপের অংশ হিসেবে রোববারের সংলাপের শুরুতে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ বক্তব্য রাখেন।
আলী রীয়াজ আলোচনার সূচনায় বলেন, “জুলাই-অগাস্টের গণঅভ্যুত্থান গত ৫৩ বছরের গণতান্ত্রিক সংগ্রামের একটি রূপ। এতদিনের সংগ্রামকে ব্যর্থ হতে দেওয়া যাবে না। আমাদের লক্ষ্য হল একটি জাতীয় সনদ তৈরি করা৷ যার মাধ্যমে একটি ভবিষ্যৎ বাংলাদেশকে জবাবদিহিমূলক রাষ্ট্র তৈরি করতে পারব।”