‘কুত্তা’ বলায় কালামের কামড়ে দেওয়া ও আমাদের স্বভাব

চিররঞ্জন সরকারচিররঞ্জন সরকার
Published : 29 April 2022, 03:36 PM
Updated : 29 April 2022, 03:36 PM

"কুকুরের কাজ কুকুর করেছে কামড়ে দিয়েছে পায়ে/ তা বলে কুকুরে কামড়ানো কি মানুষের শোভা পায়…" কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত বহুবছর আগে লিখে গিয়েছেন সেকথা। কিন্তু কবির কথার একেবারে বিপরীত কাজ করেছে এক যুবক। তবে ঘটনা কিছুটা আলাদা। কারণ, কুকুরকে নয়। 'কুত্তা' বলে কটাক্ষের প্রতিবাদে একই পরিবারের ৬ জনকে কামড়ে দিয়ে আলোচিত হয়েছে এক যুবক।

ঠিক কী হয়েছিল? এক দৈনিকে 'কুত্তা কালাম' বলায় ছয়জনকে কামড়ে জখম' শিরোনামে প্রকাশিত খবরের সারাংশ হলো: পটুয়াখালীর দুমকি উপজেলার আঙ্গারিয়া ইউনিয়নের পশ্চিম ঝাঁটরা গ্রামে কালাম সর্দার ও আনোয়ার শিকদারের পরিবারের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে জমিজমা নিয়ে বিরোধ চলে আসছে। সম্প্রতি এক বিকেলে কালাম সর্দারবাড়ির পাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় প্রতিপক্ষের ১০ বছরের একটি ছেলে তাকে 'কুত্তা কালাম' বলে ডাক দেয়। কালাম সর্দারের ধারণা, আনোয়ার শিকদারের পরিবার ওই ছেলেকে তাকে কুত্তা বলে ডাকা শিখিয়ে দিয়েছে। তাই ক্ষিপ্ত হয়ে স্ত্রী-সন্তানসহ লোকজন নিয়ে আনোয়ার শিকদারের বসতঘরে ভাঙচুর চালানো হয়। একপর্যায়ে পরিবারের ছয়জনকে কামড়ে আহত করা হয়েছে। এ ঘটনায় ভুক্তভোগীদের পক্ষ থেকে আটজনের নামে থানায় একটি লিখিত অভিযোগ দেওয়া হয়েছে।

আমাদের দেশের মানুষের মধ্যে অদ্ভূত কিছ ব্যাপার আছে। কাউকে আপনি বাঘ বা বাঘের বাচ্চা বলুন, সে খুব গর্বিত ও খুশি হবে। কিন্তু কুত্তা, কুকুর বা তার বাচ্চা বললে সে রেগে যায়। অথচ কুকুর নিয়ে মনীষীরাও অনেক ভালো ভালো কথা বলেছেন। অ্যালডাস হ্যাক্সলি বলেছিলেন, প্রত্যেক কুকুরের কাছে তার প্রভু হলো নেপোলিয়ন, তাই কুকুর এত জনপ্রিয়। মার্ক টোয়েন তো আমাদের মতো 'দ্বিপদী'-দের সঙ্গে এই 'চতুষ্পদী'-র তুলনা পর্যন্ত করেছেন। তার মতে, যদি আপনি ক্ষুধার্ত কুকুরকে খাবার দেন, ভালো করে তোলেন– সে আপনাকে কামড়াবে না। বরং সেটাই হচ্ছে একটি কুকুরের সঙ্গে মানুষের প্রধান পার্থক্য।

'সারমেয় সমাচার' নামে এক কবিতায় কবি শামসুর রাহমান মারাত্মক কিছু কথা লিখেছিলেন, 'ইদানীং কুকুর এবং মানুষের মধ্যে জোর/ প্রতিযোগিতার স্পৃহা বেড়ে গ্যাছে অতিশয়,/ কেউ কেউ নেড়ী কুকুরের চেয়েও অনেক বেশি ঘেউ ঘেউ করে,/ কামড়াতে আসে, নোংরা করে ঘরদোর।/ লেজ নাড়া আর পা চাটার কাজে এখন কুকুর/ মানুষ অপেক্ষা ঢের পেছনে রয়েছে,/ লজ্জা পেয়ে কুকুরেরা মধ্যপথে থেমে গিয়ে/ 'মনুষ্য হুজুর অনেক কামেল আপনারা', ব'লে ঠুংরি ওঠে গেয়ে।/ জগতে প্রসিদ্ধ বটে কুকুরকুলের প্রভুভক্তি;/ প্রভুর জীবন রক্ষা করার তাগিদে অকাতরে প্রাণ দ্যায় ওরা,/ কিন্তু মানুষেরা হুজুরের শক্তি থাকে যতদিন ততদিন তাবেদার,/ তোলে ঘরে সোনা দানা, আরো কত কিছু; প্রভুর গর্দান গেলে,/ পেছন দরজা দিয়ে পালায় কৌশলে লাশ ফেলে।'

তবে যে যা-ই বলুক, কুকুর যতই খ্যাতিমান, মহানুভব, পরোপকারী হোক না কেন, আমরা কেউই কুকুর হতে চাই না। আমরা চাই মানুষ হতে, মানুষের মতো বাঁচতে! আমরা কামড় খেতেও চাই না, দিতে চাই না। উল্লেখ্য, অভিধানে 'কামড়' শব্দটির বিভিন্ন মানে দেওয়া আছে, যেমন : কামড় বি. ১ দংশন, দন্তাঘাত (বিড়ালের কামড়); ২ দাঁত দিয়ে আঁকড়ে ধরা (মরণকামড়); ৩ নির্দয় বা অত্যধিক দাবি (মহাজনের সুদের কামড়); ৪ বেদনা, যন্ত্রণা (পেটের কামড়); ৫ তীব্রতা (শীতের কামড়)। [দেশি]। কামড়া, কামড়ানো ক্রি. বি. দংশন করা, দাবি করা; সবলে চেপে ধরা (মেশিনটা তার হাত কামড়ে ধরেছে); দৃঢ়সংলগ্ন হয়ে থাকা (মাটি কামড়ে থাকা)। কামড়ানি, কামড়ি1 বি. কামড়ের ভাব বা যন্ত্রণাবোধ। কামড়া-কামড়ি বি. ১ পরস্পর ক্রমাগত দংশন; ২ মারামারি।

আমাদের জীবনে সব ধরনের কামড়ের অভিজ্ঞতাই কম-বেশি আছে। তবে আমরা সবচেয়ে বেশি অভ্যস্ত মশা, কুকুর ও সাপের কামড়ে। এর বাইরে মৌমাছি, পিঁপড়া, বোলতা, বিড়াল, শেয়াল, বিভিন্ন কীটপতঙ্গ ও বন্য জন্তুজানোয়ারও কামড় দিয়ে থাকে। জন্তুজানোয়ার-কীটপতঙ্গের কামড়কে স্বাভাবিক মনে করলেও আমরা কেন জানি মানুষের কামড় দেওয়াকে স্বাভাবিক হিসেবে নিতে পারি না। অথচ শিশুরা কিন্তু নিয়মিত কামড় দেয়। শিশুদের কামড় মেনে নিলেও আমরা বড়দের কামড় দেওয়াকে মেনে নিতে পারি না। আমাদের দেশে কামড়ানোকে 'পশুস্বভাব' মনে করা হয়। পশুর হিংস্রতা, কাম-ক্রোধ ধারণ করলেও আমরা পশুর কামড়ানোর স্বভাবকে সাধারণত সযতনে এড়িয়ে চলি। এটা মানবমনের এক বিরাট রহস্য।

আমাদের মধ্যে কামড়ের ঘটনা কম ঘটলেও, কামড়াকামড়ি কিন্তু কম ঘটে না। জমিজমা নিয়ে বা অন্য কারণে আত্মীয়স্বজন এমনকি পাড়া-প্রতিবেশীদের মধ্যে বিরোধ আমাদের দেশে নতুন কিছু নয়। এসব বিরোধের জের ধরে বছরের পর বছর মামলা-মোকদ্দমা চলে, আবার কখনো কখনো খুনোখুনির ঘটনাও ঘটে। কেউ কেউ আছেন, বিরোধ জিঁইয়ে না রেখে সমাধানের পথে হাঁটেন। আবার যুগ যুগ ধরে বিরোধ চলতে থাকতেও দেখা যায়। বিরোধের ফলে আত্মীয়দের মধ্যে মুখ দেখাদেখি না হওয়ার নজিরও কম নেই।

তবে দুমকির ঘটনাটিতে একটু নতুনত্ব আছে। একটা শিশু যে একজনের নামের আগে 'কুত্তা' অভিধাটি জুড়ে দিয়েছে, এর নিশ্চয়ই কারণ আছে। পরিবারের বড়রা শিখিয়ে না দিলে এমনটা হওয়ার কথা নয়। আমাদের দেশে মানুষের নামের সঙ্গে বিশেষণ যোগ করা একটা খুব সাধারণ প্রবণতা। বাইট্টা খোকন, লম্বা আরিফ, শুকনা মদন, ধুমসি মালা, রগচটা বশীর, কানকাটা রমজান ইত্যাদি আমাদের দেশে খুব পরিচিত নাম। মানুষ তার নামে পরিচিত হবে, নাম দিয়েই সবাই তাকে চিনবে, এমটাই হওয়ার কথা। কিন্তু আমাদের দেশে কাউকে কাউকে চেনার জন্য নামের আগে একটি অন্য শব্দ জুড়ে দেওয়া হয়। যেমন 'মুরগি মিলন', 'ডগ শিশির', 'টাকলা মুরাদ', 'পিচ্চি শামীম', 'চিটার হারুন', 'বাস্টার্ড মানিক', 'ল্যাংটা করিম', 'ক্ষুর খোকন', 'কালা জাহাঙ্গীর', 'বাটপার শরীফ', টোকাই সাগর', 'চামড়া আব্বাস.' 'কুইড়া কবীর', 'শুটার রফিক' ইত্যাদি। এগুলো সমাজের সুস্থ ও স্বাভাবিকতার চিত্র নয়। সমাজ যে ক্রমেই রুগ্‌ণ হয়ে পড়ছে, তা-ই সম্ভবত এসব নামের মধ্য দিয়ে ফুটে উঠছে। তবে সবচেয়ে হতাশার ব্যাপার হলো, ইদানীং কি এক অজ্ঞাত কারণে আমাদের মধ্যে জন্তু-জানোয়ারের স্বভাব প্রকট হয়ে উঠেছে। কামড়ে দেওয়ার ঘটনা আশঙ্কাজনকভাবে বেড়ে গেছে। আক্ষরিক অর্থে হয়তো 'কুত্তা কালাম'-এর মতো মানুষ মানুষকে কামড়াচ্ছে না, কিন্তু নানাভাবেই একে-অপরকে কামড়ে দেওয়ার প্রবণতা বাড়ছে। পরিবারে, অফিসে, ফেইসবুকে, গণমাধ্যমে, সমাজে, রাষ্ট্রে সবখানে কামড়ানোর প্রবণতা। কামড়াকামড়ি এখন রাজনীতির গণ্ডি পেরিয়ে পুরো সমাজকে গ্রাস করছে। অবস্থা যা দাঁড়াচ্ছে, তাতে করে আগামী দিনে মানুষের আকার-আকৃতি বদলে গেলেও অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না।

ডারউইন সাহেবের ভাষ্য মতে, বিবর্তনের নিয়মেই জগৎ চলছে। প্রয়োজন এবং বাস্তবতা মেনে সব কিছু বিবর্তিত হচ্ছে। গাছের উঁচু ডাল থেকে পাতা পেড়ে খাওয়ার চেষ্টায় নাকি জিরাফের গলা লম্বা হয়েছে। শীতের কবল থেকে বাঁচার চেষ্টায় শীতপ্রধান দেশের প্রাণীদের গায়ে লোম বেরিয়েছে। মরু অঞ্চলের প্রাণী উট পেয়ে গেছে গলায় পানি ধরে রাখার গলকম্বল। কালে কালে আমাদেরও হয়তো তাই হবে। হয়তো কপালের দু'পাশে দুটি শিং গজাবে। হাতের সব নখ সরু সরু হয়ে আগা বেঁকে হুকের মতো হবে। ক্যানাইন টিথ বড় হয়ে যাবে। স্বভাবও পাল্টে যাবে। শূকর ও সারমেয় স্বভাব প্রবল হবে। দলবহির্ভূত কারোর সঙ্গে দেখা হলেই আস্ফালন, তর্জন-গর্জন খেয়োখেয়ি শুরু হয়ে যাবে। সবারই তখন আলাদা আলাদা বেশ থাকবে। কেউ হয়তো ন্যাড়া হয়ে ঘুরে বেড়াবে, আবার কেউ লাদেন সাজে। ধর্ম হবে বুলি, স্বার্থসিদ্ধির হাতিয়ার। 'জিহাদ' 'জিহাদ' করে একশ্রেণির মানুষ মুখে ফেনা তুলবে। কিন্তু আসল ধর্মের ধারেকাছেও ঘেঁষবে না। জনপদ বলে কিছু থাকবে না। কমিউনাল ভায়োলেন্স আর পলিটিক্যাল ভেনডেটা-য় সব মাঠ-ময়দান সয়লাব হয়ে যাবে। এ-ওর তাড়া খেয়ে ভীত মানুষ যখন যেখানে সুবিধা সেখানেই আশ্রয় নেবে।

চতুষ্পদের জগতে যেমন কিছু প্রাণী হিংস্র, কিছু আবার নিরীহ, দ্বিপদের জগতেও তাই হবে। একদল বাঁচবে গর্দভের মতো, গরুর মতো। আরেক দল হায়েনার মতো, বুনো কুকুরের মতো। মগজহীন বুদ্ধিহীন এ শ্রেণির থাকবে শুধু অ্যাকশন আর রিঅ্যাকশন। থিংকিং অ্যানিমেল বলে কোথাও কেউ থাকবে না!