Published : 24 Dec 2017, 08:04 PM
নভেম্ববের ১৪ তারিখ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম এর একটি সংবাদে আমার মনোযোগ আকৃষ্ট হয়। সংবাদ শিরোনামটি ছিলো, 'প্রশ্ন ফাঁস: পরীক্ষার সকালে প্রশ্ন ছাপানোর পরামর্শ'।
পেশাগত কারণে স্বাভাবিকভাবেই বিষয়টির প্রতি আমার দৃষ্টি আকৃষ্ট হয়। আমার কাছে মনে হয়, প্রশ্নপত্র ফাঁস এটি একটি নৈতিকতা স্খলনজনিত অপরাধ। যে বা যারাই এর সাথে যুক্ত থাকুক না কেন, চিহ্নিত হলে এদের সংশ্লিষ্ট জায়গা থেকে চিরতরে বিতারণ ও আইনানুগ শাস্তি নিশ্চিত করা জরুরী।
এক্ষেত্রে কঠোর আইন প্রণয়নও সময়ের দাবী। শুধু তাই নয়, সংশ্লিষ্টদের ব্যর্থতার দায় নিয়ে সরে পরাও উচিৎ কারণ এর সাথে গোটা দেশের আগামী প্রজন্মের সার্থকতা-ব্যর্থতার উপযোগ বর্তমান। সাথে সাথে এমন ভাবনাও আসে যে বিগত দশক ধরে এই যে ক্রমাগত অভিযোগ উঠছে অথচ এর লাগাম টেনে ধরা যাচ্ছে না, এর কারণ কি?
বরং প্রায়ই সরকার এবং সংশ্লিষ্ট তরফে দাবী করা হয়েছে প্রশ্ন-ফাঁসের তথ্য মিথ্যে। স্বয়ং মাননীয় শিক্ষামন্ত্রীকেও একাধিকবার বলতে শোনা গেছে যে প্রশ্ন-ফাঁসের ঘটনা আদৌ সত্য নয়। কিন্তু পত্র-পত্রিকায় যে সব সংবাদ তথ্য সমেত ছাপা হয়েছে, সেসব অমূলক বা বিশ্বাসযোগ্য বলে মনে হয়নি এমনটি মোটেও নয়। প্রকৃত অর্থে আমি এবিষয়ে বিশেষজ্ঞ না হলেও এটুকু বুঝতে অসুবিধা হয়নি যে প্রশ্ন-ফাঁসের ঘটনাটি আদৌ মিথ্যে নয়।
তাহলে সেই চক্র ধরা ছোঁয়ার বাইরে কি করে থাকছে দীর্ঘকাল ধরে? আমাদের দেশ সমাজ কি তবে আপাদমস্তক নষ্টই হয়ে গেছে? কর্মসূত্রে অর্জিত সামান্য অভিজ্ঞতা এবং আমাদের বর্তমান সামাজিক ও রাষ্ট্রিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় নিয়ে আমি সামান্য আলোচনায় প্রবৃত্ত হবো।
প্রশ্ন-ফাঁস সংক্রান্ত বিষয়ে কোন সঠিক তদন্ত হয়েছে কিনা বা হয়ে থাকলেও তার ফলাফল বিস্তারিত ভাবে পত্র-পত্রিকায় তেমন ভাবে দেখা যায়নি। তাহলে স্বাভাবিকভাবেই মনে হতে পারে, হয় এ-ধরনের নৈতিকতা স্খলনজনিত অপরাধের বিষয়ে সরকার তরফে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে না, নতুবা সরকারের কোন নিয়ন্ত্রণই নেই এই সব অপরাধী চক্রের ওপরে।
প্রকৃত সত্য জানা যায়নি এবং সেটা নিশ্চিত হওয়া সাম্প্রতিক সময়ে যেনো অসম্ভব। অসম্ভব কারণ দেশ, সরকার ও দেশের প্রশাসন পদ্ধতিটি এমনভাবে জনগণের মাঝে দেয়াল হয়ে দাঁড়িয়েছে যে প্রকৃত অবস্থা বোঝার সংগত কোনও উপায় নেই। অর্থাৎ জবাবদিহিতার রাস্তাগুলো ক্রমশঃ সংকীর্ণ করে আনা হয়েছে।
আমরা আশা করতে পারি অফিস টেবিল চেয়ার আর পদবী যারা অলঙ্কৃত করে আছেন তাদের প্রধানতম দায়িত্ব হচ্ছে সমস্যা চিহ্নিত করা এবং এর সমাধান খুঁজে বের করা।
কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমাদের দেশে এসব আসবাব হিসেবে শোভা পায় এবং পদাধিকারী শুধু আসবাবে স্থাপিত শোভনীয় অলঙ্কার! ক্ষেত্র বিশেষে এসব অলঙ্কারও সমস্যার আঁতুর ঘর বলে মনে হয়।
এই হলো আমাদের বাস্তবতা ও হতাশার কারণ ও একই সাথে অপকর্ম সংঘটনের ক্ষেত্র। কিন্তু এসবের উপরেও তো দেশের চালিকাশক্তি আছে। সংসদ আছে, সরকার আছে, মন্ত্রণালয় আছে, আছে বিচার বিভাগ, আছে শিক্ষাবিদদের একটা আপাত: আলাদা জগত। সেখানে আলোচনা হতে পারে, সমাধান খোঁজার চেষ্টা হতে পারে, আইন করা যেতে পারে, বদলানো যেতে পারে কিংবা শক্তিশালী করা যেতে পারে।
কিন্তু দুর্ভাগ্য যে, সে সবও আমাদের নজরে আসেনি। তাহলে কি করণীয়? সংশ্লিষ্ট সংবাদে সমাজের বিশিষ্টজনদের মূল্যবান মতামত এবং সমাধানের আপাত: উপায়গুলো ধারণা আকারে বিবৃত হয়েছে।
কিন্তু সেসব নিয়ে কারা বসবেন ঠিক কোন বিষয়গুলোর উপরে জোর দেওয়া উচিৎ, কী ধরনের সংশোধন কল্যাণকর বিবেচিত হতে পারে কিংবা আমাদের পরীক্ষা সংক্রান্ত প্রচলিত দৃষ্টিভঙ্গিকে বদলে দিতে পারে, আরও আধুনিক ও সংবেদনশীল করে তুলতে পারে তা নির্ধারণ করা জরুরী। আমরা যদি সত্যিই আধুনিক ডিজিটাল যুগে প্রবেশ করতে চাই, একে অর্থবহ করে তুলতে চাই, তাহলে এর বিকল্প নেই।
প্রশ্ন-ফাঁস সংক্রান্ত সমস্যার সমাধান কল্পে সর্বজন শ্রদ্ধেয় অধ্যাপক আনিসুজ্জামান পরীক্ষা বাতিলের পরামর্শ দিয়েছেন। কিন্তু ঠিক বুঝতে পারিনি যে তিনি কি সংশ্লিষ্ট পরীক্ষাটির বাতিল চেয়েছেন নাকি সমগ্র পরীক্ষা পদ্ধতিটির বাতিল কিংবা রূপান্তর চেয়েছেন।
সমগ্র পরীক্ষা পদ্ধতির বাতিলের কথা বলে থাকলে মান যাচাইয়ের বিকল্প অনুসন্ধান কর্তব্য। সেখানে গবেষণা এবং গ্রহণযোগ্য প্রক্রিয়ার বিষয় নিহিত। একটি যুগোপযোগী শিক্ষামান নির্ধারণী প্রক্রিয়ার প্রতিষ্ঠা সহজ কাজ নয় এবং এর জন্যে বিশ্বব্যাপী গবেষণা হচ্ছে, হচ্ছে আধুনিকায়নের নানা পদ্ধতির প্রয়োগ এবং তা যাচাই করার ও উন্নয়নের একটা ধারাবাহিক প্রক্রিয়া। এটি আমাদের দেশে আপাতত দৃশ্যমান নয়।
প্রশ্ন-ফাঁস রোধে সরকারের পরামর্শক হিসেবে নিয়োজিত বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মোহাম্মদ কায়কোবাদ প্রশ্নপত্র পরীক্ষার অনতিপূর্বে কেন্দ্রে ছাপাবার পরামর্শ দিয়েছেন, কিছু শর্ত সাপেক্ষে। কিন্তু তারপরেও বোধকরি সমস্যার সমাধা হবে সুদূর পরাহত। কেননা, একই কেন্দ্রে একই সময়ে একাধিক বিষয়ের পরীক্ষা হবে, নিদেন পক্ষে হাজার খানেক পরীক্ষার্থী পরীক্ষায় বসবেন।
বিদ্যুৎ বিভ্রাটকে অতিক্রম করার ব্যবস্থা থাকলেও অন্যান্য কৌশলগত সমস্যা তখনও বিদ্যমান থাকবে। যেমন, প্রভাবশালীদের দৌরাত্ম্য, কিছু কিছু কর্তাব্যক্তি এবং এমনকি কিছু কিছু শিক্ষকবৃন্দের অসাধুতা রোধ করা এক ধরনের বিড়ম্বনা সৃষ্টি করবে, তার সাথে রয়েছে প্রচলিত ধারার ছাত্র সংগঠনগুলোর হীন তৎপরতা এবং ক্ষেত্র বিশেষে প্রভাবশালীদের ছত্রছায়ায় দুর্বৃত্তপরায়নতা ও দস্যুতা।
ধরা যাক মূল প্রশ্নপত্রটি অনলাইন ডাটা ট্রান্সফার পদ্ধতিতে কেন্দ্রে আনা হল। যে কম্পিউটারে তা ডাউন-লোড করা হল সেটা যে হ্যাক করা হবে না কিংবা ওয়্যার বা অনলাইন ডাটা ট্রান্সফারের মাধ্যমে অন্যত্র সরিয়ে নেওয়া হবে না এর নিশ্চয়তা কে দেবে? এরকম হাজারো সমস্যা বিদ্যমান থাকবে।
অধ্যাপক কায়কোবাদের মতো রাজধানীর গভর্নমেন্ট ল্যাবরেটরি স্কুল ও কলেজের অধ্যক্ষ মো. আব্দুল খালেকও মনে করেন ইন্টারনেট ব্যবহার করে পরীক্ষার সকালে কেন্দ্রে প্রশ্ন পাঠিয়ে তাৎক্ষণিকভাবে প্রিন্ট করে পরীক্ষার ব্যবস্থা করা। প্রশ্নপত্র বহন ও সংরক্ষণ একটি জটিল ও সময় সাপেক্ষ বিষয় সন্দেহ নেই। কিন্তু মূল সমস্যা কি তাতে কমবে? আমরা কি নিশ্চিত জানি যে প্রশ্ন ছাপাখানা থেকে ফাঁস হচ্ছে? আমরা আসলে জানিই না কি করে কি ঘটছে। অথবা জানলেও তা ঘাটাতে চাই না।
স্বার্থান্বেষী মহল তৎপর এবং এদের দৌরাত্ম্য রীতিমতো অতি উচ্চ পর্যায় পর্যন্ত সম্ভবত বিস্তৃত। নতুবা তা নিয়ন্ত্রনহীন হবার কথা নয় এবং ঠিক এই আকারে তা হবার কথা নয় অন্তত। কিন্তু একজন শিক্ষক কিংবা অভিভাবক বা দেশের ন্যূনতম দায়িত্বশীল নাগরিক হিসেবে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের গড়ে উঠা যাতে প্রতিবন্ধকতার জালে জড়িয়ে সম্পূর্ণ ধ্বংস না হয় সে ব্যাপারে সচেতন আমরা হতেই পারি। দাবী তুলতেই পারি এসব প্রতিহত করার কিংবা সম্পূর্ণ বন্ধ করার পদক্ষেপের। কিন্তু কি উপায়ে হবে সেটি নিয়ে ভাবতে হবে বিস্তর।
রাজউক উত্তরা মডেল কলেজের অধ্যক্ষ একটি মূল্যবান ইস্যু তুলে বলেছেন যে জেএসসি ও পিএসসি পরীক্ষাগুলোর আদৌ প্রয়োজন আছে কিনা। আমাকে জিজ্ঞেস করলে আমি বলবো, প্রয়োজন আছে। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে স্কুলের প্রত্যেক স্তরের ফলাফলগুলোকে গণ্য করা হয়। সেক্ষেত্রে এর আন্তর্জাতিকীকরণ কিংবা ন্যূনতম পক্ষে প্রশ্নাতীতভাবে গ্রহণযোগ্য মান নির্ধারণের জন্যে উপযুক্ত করে গড়ে তোলাও একটি আশু পদক্ষেপ হতে পারে।
তবে স্কুল গুলোতে যে পরীক্ষাগুলো হয়, যেমন ক্লাশ টেস্ট, হোম-ওয়ার্ক, সাপ্তাহিক পরীক্ষা, ত্রৈমাসিক, ষাণ্মাসিক বা বার্ষিক পরীক্ষা; এগুলোর ভার কিছুটা লাঘব করা যেতে পারে, অন্তত শিক্ষার্থীদের সহনীয় শিক্ষা-বান্ধব করে গড়ে তোলা যেতে পারে সহজেই।
যাতে শিক্ষার্থীরা আত্মশিক্ষা মূলক, সৃষ্টিশীল কর্মকাণ্ডে আরোও বেশী সময় ব্যয় করতে পারে। সে জন্যে এ সব বিষয় গুলোতে সংশ্লিষ্ট শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং শিক্ষকদের নিয়োজিত থাকার প্রয়োজন আছে। চিত্তবিনোদন এবং তাদের প্রতিযোগিতা মুখর করে তুলতে এর বিকল্প নেই।
অধ্যাপক সালেহীনের প্রশ্ন-ফাঁস সংক্রান্ত প্রশ্নের উত্তরটি আরোও চিত্তাকর্ষক। তিনি সম্ভবতঃ এ সংক্রান্ত প্রশ্নোত্তরের কোন দায় নিতে চান নি। অর্থাৎ প্রশ্নের উত্তর নেতিবাচক হলে বিব্রত হবার সমূহ সম্ভাবনা আছে। যা চাক্ষুষ না হলেও যে ঘটেছে বলে নিশ্চিত হওয়া যায় সেটাকে এড়িয়ে গিয়ে বিষয়টি বিতর্কিত প্রমাণ করার চেষ্টা করলেন কি তিনি? সেটা তিনি ইঙ্গিতে বলেছেনও, তবে অস্পষ্টতা রেখে। শিক্ষাবোর্ডগুলোতে যে জনবল রয়েছে তাতে বছরে তিন-চারটি পরীক্ষা মনিটর করা কষ্টকর, বোর্ডের তরফে জোরালোভাবে এমন দাবী তোলা হয়েছে বলে শোনা যায়নি বোধ হয়। তবে শেষে তিনি সংশ্লিষ্টদের মোটিভেশন ও প্রণোদনার বিষয়ে যা বলেছেন তা সমর্থনযোগ্য এবং গুরুত্বপূর্ণ অস্বীকার করবো না।
মনিপুর উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজের অধ্যক্ষ মো. ফরহাদ হোসেন প্রশ্ন-ফাঁসের সাথে জড়িত কোচিং সেন্টার ও শিক্ষকদের কঠিন শাস্তির আওতায় আনতে দাবী জানিয়েছেন। যদিও এরকম অভিযোগ আগেও শোনা গিয়েছিলো কিন্তু তার প্রতিরোধ করা যায়নি।
অর্থাৎ আজও সে ধরনের অপ-তৎপরতা চলমান, যদি অধ্যক্ষ হোসেনের তথ্য বাস্তবতা বিবর্জিত না হয়। সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞ মহোদয় বৃন্দের অভিজ্ঞতা, উপলব্ধি, অনুসন্ধান থেকে যা বোঝা যাচ্ছে তা হল, সমস্যা আছে। মানে প্রশ্ন-ফাঁস একটি নিয়মিত বাস্তবতা এবং কার্যত: অপ্রতিরোধ্য। বিষয়টি বিবেচনার জন্যে এবার কয়েকটি উপাত্তে বরং যাওয়া যাক, এ সম্পর্কে জেনে নিয়ে এগোলে মূল আলোচনায় সমস্যার গুরুত্ব বুঝতে আমাদের সুবিধে হবে।
আমাদের প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উপাত্ত অনুযায়ী ২০১৬ সালে প্রাথমিক স্তরে অংশগ্রহণকারী শিক্ষার্থীদের সংখ্যা ছিল ৯৭ দশমিক ৯৪ শতাংশ। এ বিপুল অংশগ্রহণ থেকে স্পষ্ট হয় যে, দেশে ছেলে-শিশু ও মেয়ে-শিশুদের প্রাথমিক স্তরে অংশগ্রহণ প্রায় শতভাগ নিশ্চিত হয়ে এসেছিল।
এই নিশ্চিতকরণের সাথে দেশের নীতি নির্ধারণী অংশ, অর্থনীতির যোগ নিশ্চয়ই আছে। এটি শুধু শিক্ষামন্ত্রণালয়ের একক কৃতিত্ব বলে দাবী করা কখনোই চলবে না, সামগ্রিক ভাবে সরকারের চলমান সাফল্য। ২০০৫ সালে এ স্তরে ঝরে পড়ার হার ছিল ৪৭ দশমিক ২ শতাংশ যেখানে ২০১৫ সালের পরিসংখ্যান বলছে তা হ্রাস পেয়ে উন্নীত হয়েছে ২০ দশমিক ৪ শতাংশে। এ বছরের জুনে মাননীয় শিক্ষামন্ত্রীর সংসদে দেওয়া তথ্য অনুযায়ী দেশের স্বাক্ষরতার হার ৭০ শতাংশ। যা বেড়েছে এবং আশাব্যঞ্জক।
এ তথ্যগুলো একারণে সন্নিবেশিত হল যে, এসবই বলে দিচ্ছে, দেশের প্রান্তিক পর্যায় পর্যন্ত সাম্প্রতিককালে শিক্ষার প্রতি আগ্রহ সঞ্চারিত হয়েছে। কারণ সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি ও ব্যক্তি উদ্যোগ তো আছেই। তবুও সরকারের সদিচ্ছা ও পরিকল্পনা ব্যতিরেকে তা সফল হবার নয়। কিন্তু সাথে সাথে কি এসব উদ্যোগ এবং সামগ্রিক সফলতার ওপরে কেউ জল ঢেলে দিচ্ছে কিনা, নাকি সরকার এক পা এগিয়ে কোন কারণে দু'পা পেছনে পিছিয়ে দাঁড়াতে চাইছেন, সেটাও সমান গুরুত্বে বিবেচনায় নিতে হবে।
তা যদি নাই হবে, তাহলে এতসব অগ্রগতির খতিয়ানের সাথে পাল্লা দিয়ে এই প্রশ্ন-ফাঁস অপ্রতিরোধ্য কেন? এবং এই সাম্প্রতিক কালে? উপরের খতিয়ানের দিকে তাকালে সেটাকে কোন ভাবেই সামান্য বলা চলে না আমাদের বাস্তবতায়। যদিও প্রত্যাশিত মান অর্জনের জন্যে যে পাদপীঠ রচনার দরকার হয়, সেই ক্ষেত্র বিনির্মাণে আমরা এখনো সফল হই নি। বিপুল সংখ্যক শিক্ষার্থীর ভার ছাড়াও নানাবিধ অন্তরায় রয়েছে এর পেছনে।
বাংলাদেশের শিক্ষা তথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য মতে ২০১৬ সালে সাধারণ শিক্ষা ও ধর্মীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চস্তর মিলিয়ে দেশে শিক্ষার্থীর সংখ্যা ছিল সাড়ে তিন কোটিরও বেশী। কওমি মাদ্রাসা সহ অপরাপর বেসরকারি (বিদেশি পাঠ্য সূচীর আওতায় পরিচালিত) প্রতিষ্ঠানকে একত্রিত করলে এই সংখ্যা বাড়বে আরোও অনেক বেশি। এ বিশাল শিক্ষার্থীর ভার নিয়ন্ত্রণ অবশ্যই কোন সহজ কাজ বলে মনে করার কারণ নেই। কিন্তু কিছু কিছু বিষয়কে দেশের স্বার্থে, দেশের ভবিষ্যতের স্বার্থে সমন্বয় করে অপেক্ষাকৃত সরল, গঠনমূলক, দীর্ঘমেয়াদী একটি পরিকল্পনা এবং শিক্ষা-বান্ধব ক্ষেত্র প্রস্তুত হয়তো এখনই আংশিকভাবে সম্ভব। কেননা, সুযোগকে যথাসময়ে সদ্ব্যবহারে পরবর্তী গঠনমূলক পদক্ষেপেরই দ্বার মূলতঃ উন্মোচিত হয়।
আমাদের শিক্ষাখাতের সুষ্ঠ বিকাশের অন্তরায় হিসেবে বিশ্বব্যাংকের ২০১৩ সালের একটি পরিপত্রে দেখা যায় কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ পর্যবেক্ষণ। অধিক জনগোষ্ঠীর এই দেশে যেখানে শ্রমশক্তি বিপণন বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের একটি অবশ্যম্ভাবী মাধ্যম, সেখানে ৯৬ শতাংশ শ্রমিকের শিক্ষাগত যোগ্যতা মাধ্যমিকের নীচে।
দুই-তৃতীয়াংশের নীচে রয়েছে প্রাথমিকের চেয়ে কম। তার মধ্যে যারা প্রাথমিক স্তর সম্পন্ন করেছেন, তাদের এক-তৃতীয়াংশের রয়েছে মাত্র সাধারণ গণনা ও স্বাক্ষরতার প্রত্যাশিত জ্ঞান! ঠিক এরকম এক পরিস্থিতিতে দেশের সাধারণ পরীক্ষাগুলো যদি হয়ে পরে প্রশ্নবিদ্ধ এবং এর প্রধান কারণ যদি হয় প্রশ্ন-পত্র ফাঁস তাহলে আমাদের সামনে এগোবার পথটিই কি ক্রমশঃ সংকীর্ণ হয়ে রুদ্ধ হয়ে পড়বে না? সুতরাং এ বিষয়ে আমার দৃষ্টিভঙ্গি ও প্রত্যাশাই বরং সংক্ষেপে আলোচনা করি।
শিক্ষা বিস্তারের (বাণিজ্যেরও বটে!) এই যুগে আমাদের পুরনো ধ্যানধারণার পদ্ধতিগত দিকগুলোর পরিবর্তন আসলে দরকার। দরকারটি এজন্যে যে কৌশলগত উন্নয়নের সাথে সাথে পুরনো পরীক্ষা পদ্ধতিতে কিছু প্রগাঢ় ত্রুটি রয়েছে যা আসলেই সম্ভবপর নয় সদিচ্ছায়ও অপসারণের।
অতীতে আমার কর্মক্ষেত্রে প্রশাসনের অনুমতিক্রমে এবং নিজ দায়িত্বে কিছু পরীক্ষাও আমি করেছিলাম। যার পরিসংখ্যান নেই, তবে দৃশ্যত ফলাফল ছিলো অভিনব। সেসব অভিজ্ঞতার আলোকেই সামান্য কিছু বিষয় এখানে তুলে ধরার চেষ্টা থাকবে। একজন কম্পিউটার অপারেটর যখন প্রশ্নপত্রটি টাইপ করেন তখন তিনি সহজেই এর একটি অনুলিপি রেখে যেতে পারেন কিংবা রেখে দিতে পারেন অনবধানতায়; কিংবা অন্তত অন্য কারও অনুলিপিটি হস্তগত হবার নানাবিধ কৌশলী উপায় বর্তমান থেকে যেতে পারে। এর জন্যে দরকার শিক্ষা, সতর্কতা এবং দায়িত্ববোধ। যা আসলে আমাদের অধুনা ক্ষয়িষ্ণু সমাজে বিরল। বিপত্তিটা সেখানেও।
অতএব, আমাদের প্রয়োজন বিকল্প অনুসন্ধানের। পাশাপাশি এও দরকার, আগামী দিনের একটি দায়িত্বশীল সমাজ বিনির্মাণের কাজে হাত দেওয়া। কারণ আমরা আমাদের ভবিষ্যৎকে যথাযথভাবে টিকে থাকতে দেখতে চাই। প্রতিযোগিতাময় বিশ্বে নানাবিধ জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চার সাথে সাথে এই দায়িত্ববোধের উন্মেষ একটি জরুরী উপাদান।
সাম্প্রতিককালে অর্থাৎ বিগত এক দশকে এমন কোন পাবলিক পরীক্ষা নেই যার প্রশ্ন-পত্র ফাঁস হয়নি বলে শুনেছি। আমার আপাত ভাবনায় এর সহজ সমাধান নেই। এমনকি এর বিরুদ্ধে যে সরকার লড়াই করছে, তারও কোন নজির নেই। তবে মাঝে মাঝে কর্তাবৃন্দের হুমকি ও বক্তব্য থেকে বোঝা যায় যে কিছু একটা ভেতরে ভেতরে চলছে।! এর অর্থ দাঁড়ালো, গোপনে কোন জাদুমন্ত্রের অনুসন্ধানে প্রশাসন! ওটি পেলেই পিলে চমকানো ম্যাজিক নিয়ে তাঁরা আমাদের সামনে হাজির হবেন! তা হোন। আপত্তি নেই। তবে ততদিনে ছারখার হবে এ মাতৃভূমি। একটা ছোট্ট হিসেবে তবে যাই। বিগত দশ বছরে যে বিশাল সংখ্যক শিক্ষার্থীরা মাধ্যমিক স্তর পার হয়ে এসেছে, তারা আজ বিশ্ববিদ্যালয়য়ের গ্র্যাজুয়েশন পর্ব শেষ করে কর্ম ক্ষেত্রে ঢুকছে।
শিক্ষামন্ত্রনালয়ের ওয়েব সাইট থেকে ২০১৬ সালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী দেখা যায় প্রায় ৪৬ লক্ষ শিক্ষার্থী কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় গুলো থেকে গ্রাজুয়েশন শেষ করে কর্ম ক্ষেত্রে এসে ঢুকছে। বিগত দশ বছরে প্রতিটি স্তরে প্রশ্ন-ফাঁসের মাধ্যম দিয়ে যারা এসেছে তাদের অন্তত তিন থেকে চারটি ব্যাচ এখন কর্মক্ষেত্রে! এর সংখ্যা দাঁড়ায় অন্তত দেড়কোটি! এই শিক্ষার্থীদের সবাই একটি অসুস্থ প্রতিযোগীতার মধ্য দিয়ে আজকে কর্মস্রোতে! একবারও কি ভেবেছেন তাদের হাত দিয়ে পরিচালিত প্রশাসন, ব্যবসা, শিক্ষা, চিকিৎসা, আইন, শৃঙ্খলা রক্ষা, রাজনীতি এবং শিক্ষা ঠিক কোন পর্যায়ের মানে গিয়ে দাঁড়াতে পারে? এবং এটি তাদের দোষ নয়, বরং তারা আমাদের উদাসীনতার শিকার! দেশে ক্রমাগত ছড়িয়ে পড়া খুন, গুম, ছিনতাই, ধর্ষণ সহ নানা ধরনের অপরাধ প্রবণতা বৃদ্ধির সাথে কি এসবের যোগ নেই? আজকের তরুণদের ক্রমাগত সহিংসতার মনোভাব বৃদ্ধি, জঙ্গি মনোভাব পোষণে, মাত্রাতিরিক্ত মৌলবাদীতার এবং সাম্প্রদায়িক মনোভাব-বৃদ্ধির সাথে এসবের যোগ নেই? এরা সবাই নিজ নিজ গুনগত মান ও যোগ্যতা সম্পর্কে সচেতন। যেখানে হতাশা দানা বাঁধা বিচিত্র নয়। আর এই হতাশা-বোধ থেকেই জন্ম নেবে প্রতিশোধ পরায়ণ মন, যুক্ত হবে অনৈতিক কার্যকলাপে। কারণ তারা জানে, সমাজে এই অনৈতিকতার চাহিদা আছে এবং এটি একটি সিদ্ধ প্রক্রিয়া; পরিবার, সমাজ ও সরকার একে প্রশ্রয় দেয়। এখানে কোন প্রতিবন্ধকতা নেই। বরং তাদের এই অনৈতিকতাকে স্বার্থান্বেষী মহল লুফে নেবে, এ জাতিকে চিরতরে বিনাশের ছক কষবে সহজেই। এসব তরুণদের একটা অংশ এখন বিদেশমূখী। ইদানীং দেশের বাইরেও নানা ধরনের জঙ্গি তৎপরতায় বাংলাদেশীদের যুক্ত হয়ে পড়া আমাদের বাংলাদেশী পরিচয়কে প্রশ্নবিদ্ধ করছে। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে আমরা ক্রমাগত সংকটে নিপতিত হতে চলেছি। কাজেই অনেক দেরী হলেও আর উপায় সম্ভবত নেই। এর একটা বিহিত জরুরী। দরকার জরুরী পদক্ষেপের।
তাই সম্ভবত প্রশ্নপত্র-ফাঁস এবং নকল প্রতিরোধে নিম্নলিখিত বিকল্পকে এক সাময়িক বিধি হিসেবে ভাবা যেতে পারে। তবে তার জন্যে দেশের বরেণ্য শিক্ষাবিদদের সমন্বয়ে যথাযথ প্রায়োগিক কৌশল বিনির্মাণ জরুরী। তাতে বিষয়টির আমূল পরিবর্তন, নতুন আঙ্গিক প্রণয়ন এবং একটি সুষ্ঠ সু-সমন্বিত পদ্ধতির গোড়াপত্তনও বিচিত্র নয়। সরকার গোপনে কোন সমাধানে উপনীত, আমজনতার অজানা। এমনকি আমাদের সন্দেহ যে সরকার এ বিষয়ে যথেষ্ট সচেতন কিনা। কেননা ক'দিন আগেই স্বয়ং মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী প্রকাশ করেছেন তার অসহায়ত্ব! এ আমাদের জন্যে অশনি সংকেত বই কিছু নয়। এর সমাধান আমাদের পেতে হবেই।
তবে কেমন হয় যদি পরীক্ষা গুলোকে আমরা এভাবে গ্রহণের ব্যবস্থা করি প্রচলিত পদ্ধতিকে কিছুটা পাশ কাটিয়ে? প্রথমত দেশের সবক'টি শিক্ষা বোর্ডকে একই ব্যবস্থার (একীভূত করা নয়) আওতায় আনতে হবে। অর্থাৎ একি ধরনের পদ্ধতি প্রয়োগের মাধ্যমে দেশ ব্যাপী পরীক্ষা অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করতে হবে যা আসলে বর্তমান। অবশ্যই অনলাইন ব্যবস্থাপনার মাধ্যমেই তা করতে হবে তবে পদ্ধতিটি গতানুগতিকতার বদলে হতে হবে সৃষ্টিশীল বিকল্প। পর্যায়ক্রমে বিষয়টি এরকম যদি হয় —
১। শিক্ষা বোর্ডগুলো তাদের অধীনস্থ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে দুটো প্রশ্নপত্র প্রণয়ন সংক্রান্ত কমিটি করবেন। একটি বিষয়ভিত্তিক এগারো সদস্যের বিশেষজ্ঞ কমিটি এবং অন্যটি পাঁচ সদস্যের উচ্চ-ক্ষমতা সম্পন্ন চূড়ান্ত কমিটি (সদস্য সংখ্যার রদবদল সুবিধানুযায়ী হতে পারে)। উচ্চ-ক্ষমতা সম্পন্ন চূড়ান্ত কমিটির একজন সদস্য বিষয় ভিত্তিক বিশেষজ্ঞ কমিটির প্রধান থাকবেন। প্রত্যেক বছর শিক্ষক বৃন্দের মান যাচাইয়ের মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট শিক্ষা বোর্ড সম্মানজনক প্রণোদনার বিনিময়ে প্রত্যেক বিষয়ে এগারো জনের কমিটি পূর্বেই চূড়ান্ত করবেন। অন্যদিকে চূড়ান্ত কমিটির চারজন সদস্য পূর্বনির্ধারিত থাকবেন একটি বিশেষ পরীক্ষার ( যেমন, এসএসসি কিংবা এইচএসসি) জন্যে।
২। জাতীয় শিক্ষা বোর্ডে স্থাপিত হবে নিয়ন্ত্রণ কক্ষ। এখানেই দুটি কক্ষে দুটি কমিটি যুগপৎ কাজ করবেন।
৩। এগারো সদস্যের বিশেষজ্ঞ কমিটির প্রধান নিযুক্ত থাকবেন চূড়ান্ত কমিটিতে। বাকী দশজন সদস্য প্রস্তাব আকারে তুলে দেবেন দশটি সৃজনশীল প্রশ্ন-পত্র। তাৎক্ষণিকভাবে কমিটি প্রধান উক্ত দশ সেট প্রশ্ন-পত্রের সমন্বয় করবেন সকলের সহযোগিতায়। সকল প্রশ্ন-সমূহ এক বা একাধিক সেট আকারে তিনি তা পৌঁছাবেন চূড়ান্ত কমিটিতে।
৪। চূড়ান্ত কমিটি সেখান থেকে অনধিক পাঁচটি সরল প্রশ্ন সমন্বয়ে স্থির করবেন একটি সৃজনশীল প্রশ্ন-পত্র, এবং অনলাইন মাধ্যমে তা তাৎক্ষণিকভাবে সকল পরীক্ষা কেন্দ্রের প্রজেক্টরে প্রদর্শিত হবে একযোগে। প্রশ্নপত্র ছাপা কিংবা বিতরণের প্রক্রিয়াগত ব্যবস্থাকে এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব এক্ষেত্রে। শিক্ষা বোর্ড কর্তৃপক্ষকে শুধু মাত্র প্রয়োজনীয় নীতি অনুযায়ী অনুমোদিত উত্তরপত্র ও সংশ্লিষ্ট দলিল সমূহ মুদ্রিত করতে হবে। আর যেসব বিদ্যালয়ে প্রজেক্টর নেই, সেসব বিদ্যালয় গুলোকে শিক্ষা বোর্ড কর্তৃক বা মন্ত্রণালয় থেকে সহযোগীতা করা যেতে পারে। এখানে পরীক্ষা কেন্দ্রের ইনভিজিলেটর সহ অন্যান্য প্রশাসনিক ব্যয়ের মাত্রা কমিয়ে আনারও সুযোগ সৃষ্টি হবে। সিসি-ক্যামেরার আওতায় পরীক্ষা কেন্দ্র থাকলে তদারকির কাজ আরোও সহজতর হবে বলে আশা করা যায়।
৫। পরীক্ষাটি পরিচালিত হবে ওপেন-বুক পদ্ধতিতে। তিনঘণ্টা ব্যাপী (তবে পরীক্ষাটি দুই ঘণ্টার উপযোগী থাকা উচিৎ বলে আমার মনে হয়, বাকি একঘণ্টা শিক্ষার্থীদের সৃজনশীলতার প্রকাশে ব্যবহৃত হবে) লিখিত পরীক্ষার উপযোগী সৃষ্টিশীল প্রশ্ন-পত্র প্রণয়ন অবশ্যই সহজ কাজ নয়। প্রশ্নপত্র মূলতঃ হবে বাস্তব সমস্যা ভিত্তিক। শিক্ষার্থীকে প্রস্তাব করতে হবে যথাযথ সমাধান তার অধীত বিষয়ের তত্ত্বের আলোকে। সেজন্যে অধীত বিষয়ে ব্যাপক তথ্য সমৃদ্ধ হওয়া ছাড়াও ব্যাপক ভিত্তিক ধারণা প্রয়োজন শিক্ষার্থী এবং শিক্ষকবৃন্দের। যেহেতু প্রশ্ন-পত্রে কোন ধরনের বিকল্প প্রশ্নের ব্যবস্থা থাকবে না সুতরাং প্রত্যেক পরীক্ষার্থীকেই যথাযথ জ্ঞান থাকা সাপেক্ষেই প্রশ্নের উত্তর লিখতে হবে। অর্থাৎ ওপেন-বুক পদ্ধতিতে একজন শিক্ষার্থী সাথে বই পরীক্ষা কেন্দ্রে রাখতে পারবে সন্দেহ নেই, কিন্তু বিষয়ের বিস্তারিত জানা না থাকলে তার পক্ষে যথা সময়ে যথাযথ উত্তর সম্পাদনা সহজ হবে না। এমনকি তথাকথিত নকল কিংবা কারো সহযোগিতা অকার্যকর বলে প্রতীয়মান হবে। এক্ষেত্রে প্রশ্ন-পত্র ফাঁস হবার সুযোগ যেমন নেই তেমনি ধারণা প্রকাশ হলেও প্রকৃতপক্ষে কেউ লাভবান হবেন না। আমাদের উদ্দেশ্য, শিক্ষার্থীদের প্রচলিত প্রাইভেট কোচিং, কোচিং সেন্টার নির্ভরতা, গাইড বই নির্ভর শিক্ষা ব্যবস্থা এবং সর্বোপরি জিপিএ-৫ এর মতো অসুস্থ প্রতিযোগীতার বাইরে স্বশিক্ষায় অভ্যস্ত করে তোলা। শিক্ষার্থীদের কোচিং এবং গাইডের মার্কেট থেকে ফিরিয়ে এনে টেক্সট বই, রেফারেন্স বই সহ অনলাইন মাধ্যমে আত্মনির্ভর করে তোলা। তবে এক্ষেত্রে আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত তরুণ প্রজন্মের শিক্ষার্থীদের অনুজদের প্রশিক্ষণে এবং সৃষ্টিশীল ভাবে গড়ে তোলার সহযোগী হিসেবে আবির্ভূত হবার সুযোগ সৃষ্টি হবে। এটি অবশ্যই আমাদের সমাজে বাড়তি উপযোগ হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। শিক্ষকবৃন্দের যোগ্যতা বিবেচিত হতে পারে প্রশ্নপত্র বিনির্মাণের যোগ্যতার উপরেও।
৬। উত্তর পত্রের চূড়ান্ত মূল্যায়নেও বিশেষজ্ঞ কমিটির যাচাই বাধ্যতামূলকভাবে আরোপিত হবে।
৭। তার আগে বিশেষজ্ঞ কমিটি একটি মান সম্পন্ন উত্তর পত্র তৈরি করবেন। যা বিতরণ করা হবে সংশ্লিষ্ট পরীক্ষক বৃন্দের কাছে। কৃত উত্তর পত্রটির মান নির্ধারিত থাকবে ৮০ – ৭০ শতাংশের মধ্যে। এর আলোকে পরীক্ষার্থীদের উত্তর পত্রের মূল্যায়ন সহজতর হবে।
৮। শিক্ষকবৃন্দের মান যাচাইয়ে তাঁদের কর্মঘন্টা এবং একাডেমিক তৎপরতাসহ শিক্ষার্থীদের অনলাইন মূল্যায়ন পদ্ধতি চালু করতে হবে। সেই সাথে প্রত্যেক শিক্ষক যে সৃজনশীল প্রশ্ন উপস্থাপন করলেন তার মানও যাচাই করা যেতে পারে। অবশ্য এক্ষেত্রে শিক্ষক প্রশিক্ষণ এবং শিক্ষাদান প্রকল্পের আওতায় বিশেষ প্রশিক্ষণের ব্যবস্থাও প্রযোজ্য বলে বিবেচিত হতে পারে।
৯। পরীক্ষাটি ক্লোজ-বুক পদ্ধতিতেও হতে পারে। তবে ওপেন বুক পদ্ধতিটি অপেক্ষাকৃত কঠিন এবং এর ব্যাপ্তি অনেক বেশী থাকে বলে শিক্ষার্থীদের অধীত বিষয়ের প্রতি প্রকৃত আগ্রহ সৃষ্টি হয় অনেক বেশী। সুতরাং অধ্যবসায় ও যথেষ্ট তথ্যসমৃদ্ধ ও বিশ্লেষণী ক্ষমতার অধিকারী না হলে ভাল উত্তর লেখা সত্যিই দুরূহ। সেই সাথে থাকা চাই সৃষ্টিশীলতা। থাকা চাই বিষয় সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারনা এবং তার গভীরতম প্রদেশ পর্যন্ত বিচরণের সক্ষমতা। আমি ওপেন বুক পদ্ধতিতে জোর দেবার পক্ষে এই জন্যে যে, এক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের চাইতে পরীক্ষার চাপটি মূলতঃ থাকে শিক্ষকবৃন্দের উপড়ে বেশী। শিক্ষাদানের মানের উপড়ে শিক্ষার্থীদের ফলাফল নির্ভর করে। প্রাইভেট কোচিং এর যথার্থতা হারায়। শিক্ষার্থীদের ফলাফলের উপরেই শিক্ষকবৃন্দসহ প্রতিষ্ঠানের মান যাচাই সম্ভব হয়। আরও একটি কারণে এর প্রতি আমার আগ্রহ, সেটা হল শিক্ষার্থীবৃন্দের কাছে তথ্যের দিগন্ত উন্মোচিত করা সম্ভব হয়। তাদের প্রশ্ন করা, নিজের ভেতরে প্রশ্ন জাগা এবং সমাধান খুঁজে বের করার স্বপ্রনোদিত প্রয়াস থাকে। এর প্রয়োগ মাধ্যমিক পর্যায় থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত প্রযোজ্য হতে পারে। পঞ্চম শ্রেণীর বৃত্তি পরীক্ষার ক্ষেত্রেও এটি প্রযোজ্য হতে পারে, তবে শিক্ষার্থীদের বয়েস বিবেচনায় পরীক্ষাটি আনন্দ-মুখর, শিক্ষণীয় এবং জীবনের স্মৃতিময় একটি অধ্যায় হিসেবে এর সামগ্রিক পরিকল্পনা নিশ্চিত করতে হবে।
আমার আশঙ্কা এই যে, এ মানের শিক্ষাদান বর্তমান পরিস্থিতিতে দূরূহ এবং মান সম্মত শিক্ষক সংকটও যথেষ্ট।তবুও শুরু তো করতে হবে কোথাও না কোথা হতে। সেখানে গণিত, ছড়া, চিন্তা, চিঠি, আঁকিবুঁকি, জ্ঞান ও রীতি সবই অন্তর্ভুক্ত হতে পারে। বিগত পাঁচ বছর ধরে শিক্ষক সাহচর্যে তার জানার আকাঙ্ক্ষাটি জানাই হবে উদ্দেশ্য। এগুলো শিল্প সমৃদ্ধ কৌশল। সেজন্যে শিক্ষকেরও যথেষ্ট বুৎপত্তি থাকা চাই। উন্নত বিশ্বে এসব নিয়েই চলছে নিরন্তর গবেষণা। ইংরেজিতে যাকে এডুকেশন (Education) বলা হচ্ছে। সোজা কথা হচ্ছে শিক্ষাকে প্রায়োগিক পর্যায়ে উন্নীত করা। একটি বিশেষ পরীক্ষাকে কেন্দ্র করে সাময়িক মুখস্থ ধরনের বিদ্যাভ্যাস পরিত্যাগ করে সৃষ্টিশীল প্রায়োগিক চিন্তার ভেতর দিয়ে সমস্যার সমাধানে পৌঁছানোর চেষ্টা। অনেকটা এরকম যে এ ধরনের পরীক্ষার ক্ষেত্রে কোন উত্তরই আসলে ভুল নয় তবে উত্তরের মান ও গ্রহণযোগ্যতা শিক্ষার্থীর বিশেষ বিষয়ে ধারনার গভীরতার উপড়ে এবং উপস্থিত বুদ্ধিমত্তায় চৌকস উত্তর বিনির্মাণের উপরে নির্ভর করে।
১০। আর একটি উপকার হবে এই যে, শিক্ষকবৃন্দের মধ্যে শিক্ষাবোর্ড কর্তৃক মূল্যায়নের জন্যে একধরনের মনস্তাত্ত্বিক চাপ সৃষ্টি হবে, যা তাঁদের পেশাগত সৌকর্য বাড়াতে এবং নিজ কর্মক্ষেত্রে আরও অধিকতর যত্নবান হবার প্রেরণা জোগাবে বলে আমার মনে হয়।
কিছুটা স্বতাড়িত হয়েই আমার আপাত ভাবনার বোনা জাল থেকে উপরোক্ত কথাগুলো বললাম। হয়তো এ কোন কার্যকর সমাধান নয়, তবুও দেশ শুদ্ধ কতিপয় মানুষ যে শঙ্কিত, কতিপয় মানুষ যে এ সমস্যার আশু সমাধান চান, লেখাটি তারই এক প্রতীক হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। তাই সব কিছু ভেঙ্গে পড়ার আগেই দেশের বরেণ্য শিক্ষাবিদ, সংশ্লিষ্ট শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, দায়িত্বশীল শিক্ষক সমাজ, অভিভাবকবৃন্দ, শিক্ষাবোর্ড, শিক্ষামন্ত্রণালয় এবং সদাশয় সরকার তরফে এর যুক্তিযুক্ত সমাধান এবং আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের অস্বাস্থ্যকর শিক্ষণ পরিবেশ থেকে পরিত্রাণের উপায় বের করার সবিনয় অনুরোধ রইলো।