Published : 02 Apr 2021, 12:01 AM
২ এপ্রিল আন্তর্জাতিক অটিজম সচেতনতা দিবস। প্রতিবছর জাতিসংঘের উদ্যোগে দিবসটি পালিত হয়ে আসছে অটিজমের বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন মানুষের জীবনমানের উন্নয়ন ও সমাজে তাদের কার্যকর একীভূতকরণের উদ্দেশ্যে। জাতিসংঘের সাথে তাল মিলিয়ে বাংলাদেশেও 'সমবেত মমতা গড়ি, অন্তর্ভুক্তির শপথ করি'- এই প্রতিপাদ্যকে সামনে রেখে পালিত হচ্ছে ১৪তম অটিজম সচেতনতা দিবস। স্বাভাবিকভাবেই মহামারীর কারণে অটিজমের বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন শিশু ও ব্যক্তিদের চাহিদায় স্বাভাবিকের থেকে ভিন্ন মাত্রা যুক্ত হয়েছে। অন্য সবার মতো অটিজমের বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন মানুষদের ক্ষেত্রেও কোভিড-১৯ এর কারণে সবচেয়ে বেশি পরিবর্তন এসেছে দৈনন্দিন জীবন-যাপন পদ্ধতিতে। ঘরে থাকা, স্কুল ও বিশেষ সেবা সেন্টার বন্ধ থাকা, সামাজিক দূরত্ব অনুসরণ করা, বারবার হাত ধোয়া, মাস্ক ব্যবহারসহ নানাবিধ পরিবর্তনের সাথে তারাও খাপ খাওয়ানোর চেষ্টা করছে বিগত এক বছরেরও বেশি সময় ধরে। অথচ বেশিরভাগ অটিজমের বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন মানুষের জন্য জীবন-যাপন পদ্ধতিতে পরিবর্তন আনা খুব কঠিন। তারা নির্দিষ্ট রুটিনে থাকতেই পছন্দ করে। তাই সহজেই অনুমান করা যায়, অটিজমের বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন শিশুর বাবা-মাকে তাদের পরিবর্তিত রুটিনের সাথে মানিয়ে নিতে বেশ বেগ পোহাতে হচ্ছে। পাশাপাশি স্কুল ও সেন্টারে না যাওয়ার ফলে তাদের আচরণ ও অন্যান্য বিকাশও বিঘ্নিত হচ্ছে। বিশেষ শিক্ষা ও থেরাপি না পাওয়ার ফলে অনেক অটিজমের বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন শিশুর সার্বিক অবস্থা যে আগের থেকে খারাপ হয়েছে তা ধারণা করাই যায়। এমন পরিস্থিতিতে এসব শিশুর অভিভাবকদের স্কুলের সহযোগিতা ছাড়া শিশুদের লেখাপড়া শেখানো, স্বাভাবিক বিকাশ অব্যাহত রেখে স্বাস্থ্যবিধি মানার বিষয়গুলো রপ্ত করানোর কাজ করতে হচ্ছে। অথচ বাসায় রেখে অটিজমের বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন শিশুর যত্ন নেওয়া এবং পরিবর্তিত অবস্থার সঙ্গে খাপ খাওয়ানোর বিষয়ে অভিভাবকদের কোনো প্রশিক্ষণ নেই।
ঢাকাসহ অন্যান্য বিভাগীয় শহরের হাতেগোনা কয়েকটি অটিজম স্কুল অনলাইনে ক্লাস নেওয়া শুরু করেছে বলে জেনেছি। তবে দেশের বেশিরভাগ অটিজম স্কুলেই অনলাইন কার্যক্রম চলছে না। তাছাড়া অটিজমের বৈশিষ্ট্য থাকার ফলে এসব শিশুদের শেখাতে হয় হাতেকলমে, বাস্তব অভিজ্ঞতার মাধ্যমে। তাই অনলাইনে কার্যক্রম চালানোও বেশ কঠিন। দেশের অধিকাংশ অটিজম স্কুল ও সেবা সেন্টার বেসরকারি। এসব স্কুল ও সেন্টার মূলত অটিজমের বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন শিশুদের বাবা-মায়ের ব্যক্তি উদ্যোগে গড়ে উঠেছে। তাদের বেশিরভাগেরই কোনো ধরনের প্রশিক্ষণ নেই, শুধু অভিজ্ঞতার উপর ভিত্তি করে তারা কাজ করে যাচ্ছিলেন। স্কুল বন্ধ থাকায় এসব প্রতিষ্ঠান তীব্র আর্থিক সঙ্কটের মধ্যে পড়েছে। অনেক শিক্ষকদের বেতন-ভাতাও বন্ধ। পাশাপাশি অটিজমের বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন শিশুরাও সেবা পাচ্ছে না। তাই অটিজমের বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন শিশুদের সেবা না পাওয়া ও শিক্ষকদের আর্থিক সঙ্কট- এ দুটি বিষয়ের মধ্যে সমন্বয় করার বিষয়টি গুরুত্বের সাথে ভাবা দরকার।
গতবছর মহামারী শুরুর প্রায় প্রথম দিকেই জাতিসংঘ 'প্রতিবন্ধী ব্যক্তি ও কোভিড-১৯ সম্পর্কিত পলিসি' প্রকাশ করে, যেখানে 'মহামারী প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের প্রতি বিদ্যমান অসমতা আরও তীব্রতর করছে এবং নতুন নতুন হুমকি সৃষ্টি করছে' বলা হয়। তাই চলমান পরিস্থিতিতে প্রতিবন্ধীদের বিকল্প স্বাস্থ্যসেবা, সাহায্য, থেরাপি ও শিক্ষা প্রদানের প্রয়োজনীয়তা থেকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা একটি গাইডলাইন (Disability considerations during the COVID-19 outbreak) প্রকাশ করে। বাংলাদেশের স্বাস্থ্য অধিদপ্তরও ২০২০ সালের মার্চ মাসে 'অটিজম এর বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন শিশুদের করোনা ভাইরাস সংক্রমণ থেকে নিরাপদ রাখতে কী করবেন' নামে একটি গাইডলাইন প্রকাশ করে। কিন্তু বাস্তবে এসব গাইডলাইন সম্পর্কে মানুষ কতটুক জানে সে সম্পর্কে প্রশ্ন রয়েছে। স্কুল এবং থেরাপি সেন্টার বন্ধ থাকায় বাড়িতে এসব শিশুদের বিকাশ কীভাবে চলমান রাখা যায়, শিক্ষক এবং থেরাপিস্টসহ অন্যান্য সেবা প্রদানকারীরা মহামারী চলাকালীন কীভাবে ভূমিকা রাখতে পারেন সে বিষয়গুলো নিয়ে কোনো নির্দেশনা দেখতে পাইনি।
কেন্দ্রীয়ভাবে একটি ওয়েবসাইট তৈরি করে সেখানে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর কর্তৃক প্রকাশিত গাইডলাইনের অডিও-ভিডিও ভার্সন তৈরি করা যেতে পারে। এখানে গল্প, ছবি এবং কার্টুন সংযোজন করলে স্বাস্থ্যবিধি মানার বিষয়গুলো বুঝতে অভিভাবক ও অটিজমের বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন শিশুদের সুবিধা হবে। পাশাপাশি বাবা-মা কীভাবে বাড়িতে অটিজমের বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন শিশুদের সেবা ও পড়ালেখার বিষয়টি চালিয়ে যাবেন সে সম্পর্কিত অনলাইন টিউটোরিয়াল তৈরি করে ওয়েবসাইটে রাখা যেতে পারে। সবচেয়ে ভাল হবে যদি পোর্টেজ পদ্ধতিতে সেবা দেওয়ার পদ্ধতি চালু করা যায়। পোর্টেজ পদ্ধতিতে একজন বিশেষ সেবা প্রদানকারী ব্যক্তি/শিক্ষক সপ্তাহে একদিন অটিজমের বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন শিশুর বাড়িতে যান এবং ১৫-২০ মিনিটের একটি সেশন নেন। এই সময় শিশুর বাবা/মা সাথে থাকেন। শিক্ষক দেখিয়ে দেবেন পরবর্তী এক সপ্তাহ বাবা/মা শিশুর সাথে কী কী কাজ করবেন এবং কীভাবে করবেন। প্রয়োজনে শিক্ষক শেখানোর জন্য উপকরণও সরবরাহ করবেন। এক সপ্তাহ পর শিক্ষক নির্দিষ্ট দিন ও সময়ে আবার যাবেন ও ফলোআপ করবেন। পরবর্তী এক সপ্তাহের করণীয় শিখিয়ে দিয়ে আসবেন। এভাবে স্কুলগুলো তাদের কার্যক্রম চলমান রাখতে পারে ও অটিজমের বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন শিশুর বাড়িতে গিয়ে সেবা দিয়ে আসতে পারে। তাতে পরিবার ও শিশু উপকৃত হবে। অটিজমের বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন শিশুর বিকাশ চলমান থাকবে এবং পরিবর্তিত জীবন ব্যবস্থার সাথে খাপ খাওয়াতে সুবিধা হবে। পুরো প্রক্রিয়ায় সাধারণ স্কুলের চেয়ে কম মানুষ একসাথে হবে বলে স্বাস্থ্যবিধি মানার বিষয়টিও সহজ হবে বলেই মনে হয়। অটিজম স্কুলগুলো তাদের শিক্ষকদের রোস্টার করে দিতে পারে এবং বাড়ি ও শিশু নির্ধারণ করে দিতে পারে। শিক্ষকরা সে অনুযায়ী বাড়ি বাড়ি গিয়ে এসব শিশুদের শিক্ষা, সেবা, থেরাপিসহ অন্যান্য সেবা বাড়িতে গিয়ে দিয়ে আসবে।
একথা অনস্বীকার্য যে, বর্তমান সরকারের ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি থাকার কারণে 'স্নায়ুবিকাশগত প্রতিবন্ধী সুরক্ষা ট্রাস্ট আইন-২০১৩ পাস হয়েছে এবং তার ফলাফল হিসেবে নিউরোডেভলপমেন্টাল সুরক্ষা ট্রাস্ট গঠন করা হয়েছে, অটিজম রিসোর্চ সেন্টার স্থাপিত হয়েছে। পাশপাশি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব পেডিয়াট্রিক নিউরোডিজঅর্ডার অ্যান্ড অটিজম (ইপনা)-এর কার্যক্রম সম্প্রসারিত হয়েছে। বেশিরভাগ বড় সরবারি হাসপাতালে শিশু বিকাশ কেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছে। বর্তমানে মিডিয়াতেও অটিজম বিষয়টি গুরুত্ব পাচ্ছে। ফলশ্রুতিতে অটিজম শব্দটি আগের থেকে অনেক বেশি পরিচিত হয়েছে। তবে যথেষ্ট পরিমাণ সচেতনতা তৈরি হয়নি। অটিজম সম্পর্কে বিভিন্ন ভ্রান্ত ধারণা দূর হয়নি এবং সমাজে তাদের স্বাভাবিক গ্রহণযোগ্যতা তৈরি হয়নি। অটিজমের বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন ব্যক্তিদের ন্যায্য অধিকার প্রদান করে শিক্ষা, কর্মস্থানসহ সমাজের সকল ক্ষেত্রে সম্মানজনক অংশগ্রহণ নিশ্চিত করণের মাধ্যমেই কেবল প্রকৃত অটিজম সচেতনতা তৈরি হয়েছে বলা যাবে।