আওয়ামী লীগের চমকহীন সম্মেলন

এ বাস্তবতায় আওয়ামী লীগের পক্ষে কি সম্ভব দেশে গণতান্ত্রিক ধারা প্রতিষ্ঠিত করা? গণতান্ত্রিক সমাজ বিনির্মাণ করা? সম্ভব কি দলের ভেতর গণতন্ত্রচর্চার একটি অবাধ ধারা প্রতিষ্ঠা করা?

চিররঞ্জন সরকারচিররঞ্জন সরকার
Published : 25 Dec 2022, 04:45 PM
Updated : 25 Dec 2022, 04:45 PM

বড় কোনো পরিবর্তন ও চমক ছাড়াই শেষ হলো দেশের সবচেয়ে পুরনো রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের ২২তম জাতীয় সম্মেলন। নানা দিক থেকেই এবারের সম্মেলনটি ছিল গুরুত্বপূর্ণ। বিশ্বব্যাপী করোনার অভিঘাত এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রতিক্রিয়ায় দেশ এক নজিরবিহীন সংকটকাল পার করছে। এই সংকট থেকে উত্তরণ পাশাপাশি আগামী নির্বাচনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার জন্য যোগ্য নেতৃত্ব বাছাইয়ের বাধ্যবাধকতার এই সম্মেলন ছিল সেই দিক থেকে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। দলের কাউন্সিলররা কোনো রকম পরীক্ষা-নিরীক্ষায় না গিয়ে পুরনো নেতৃত্বের প্রতি আস্থা রেখেছে। এতে করে দলের মূল নেতৃত্বে কোনো পরিবর্তন হয়নি। 

এবারের সম্মেলনের প্রাক্কালে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে স্মার্ট বাংলাদেশের নির্মাণের ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, “প্রধানমন্ত্রী আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা ও তার তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ক উপদেষ্টা সজিব ওয়াজেদ জয়ের তত্ত্বাবধানে আমরা ডিজিটাল বাংলাদেশ নির্মাণ করেছি। এখন আমাদের লক্ষ্য হচ্ছে স্মার্ট বাংলাদেশ। ২০৪১ পর্যন্ত আমাদের যে ভিশন, উন্নত ও সমৃদ্ধ স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ে তোলা আমাদের লক্ষ্য।”

যদিও এ জন্য দলের মূল নেতৃত্বে কোনো পরিবর্তন আনার প্রয়োজনীয়তা তারা অনুভব করেননি। পরবর্তী তিন বছরের জন্য আওয়ামী লীগের সভাপতি পদে শেখ হাসিনা থাকছেন। দশমবারের মতো তিনি সভাপতি নির্বাচিত হয়েছেন। আর সাধারণ সম্পাদক পদে তৃতীয়বারের মতো ওবায়দুল কাদেরই দায়িত্ব পালন করবেন। আওয়ামী লীগের ২২তম কাউন্সিলে প্রায় ৭ হাজার কাউন্সিলরদের ভোটে এ দুজন নির্বাচিত হন। 

উল্লেখ্য, আমাদের দেশে কী পরিবারে, কী প্রতিষ্ঠানে, কী রাষ্ট্রীয় পরিমণ্ডলে- গণতন্ত্র চর্চার অভ্যাস খুব একটা নেই। অনেকে অবশ্য এ কথাও বলেন যে, এখানে ‘গণতন্ত্রচর্চার সুফল’ও তেমন দেখা যায় না। এখানে সাধারণ মানুষকে সুযোগ দিলে ‘নরঘাতক’ কিংবা ‘সমাজবিরোধীদের’ই বিপুল ভোটে নির্বাচিত করে (অনেকে অবশ্য এর জন্য অর্থ ও পেশিনির্ভর ব্যবস্থাকে দায়ী করেন, সেটা ভিন্ন আলোচনা)। পরিবারতন্ত্রের বাইরে দল চালানোর চেষ্টা করা হলে সবাই ‘রাজা’ হয়ে যান। কেউ কাউকে নেতা মানেন না। সবাই নিজেকে শ্রেষ্ঠ এবং যোগ্য মনে করে দল ও নেতৃত্বের দখল নিতে চান। এতে দল হয় বহুবিভক্ত। জিয়াউর রহমান বিহীন বিএনপি এবং বঙ্গবন্ধুহীন আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব নিয়ে ‘কামড়াকামড়ি’র ইতিহাস আমরা কম-বেশি সবাই জানি। কাজেই যতদিন বেঁচে থাকবেন, শেখ হাসিনাই যে আওয়ামী লীগের অবিকল্প ও অনিবার্য প্রধান থাকবেন- এটা বলাই যায়।

যাহোক, আমাদের দেশের রাজনৈতিক বাস্তবতায় গণতান্ত্রিক আবহেই এক ধরনের কর্তৃত্ববাদী ব্যবস্থা গড়ে ওঠে। সাধারণ নেতাকর্মীরাই এমন নেতৃত্বের প্রতি অকুণ্ঠ সমর্থন জানান। যুগ যুগ ধরে সাধারণ নেতাকর্মীদের সমর্থন নিয়েই কেউ কেউ শীর্ষ নেতৃত্বের পদে বহাল থাকেন। যদিও শীর্ষ পদে একই ব্যক্তি অনির্দিষ্টকাল ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থাকলে তার একচ্ছত্র আধিপত্য প্রতিষ্ঠা হয়। তার ইচ্ছা ও সিদ্ধান্ত অনুযায়ী দল পরিচালিত হয়।

আওয়ামী লীগ বাংলাদেশের নয়, গোটা উপমহাদেশের প্রাচীন একটি দল। ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন দলটির জন্ম হয়েছিল একটি গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায়। গণতান্ত্রিকভাবে সবার সঙ্গে আলোচনা করে কমিটি গঠন করা হয়েছিল। আওয়ামী লীগের গঠনতন্ত্রের কাঠামো ও দিকনির্দেশনা সাধারণভাবে গণতান্ত্রিক। আওয়ামী লীগের বয়স এখন ৭০ পেরিয়েছে। এ সময়ের মধ্যে দলের অভ্যন্তরে অনেক পরিবর্তন হয়েছে। কিন্তু গণতন্ত্রচর্চার প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তি দলটিতে তেমনভাবে প্রতিষ্ঠা পায়নি এখনো। বিশেষ বা নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি ছাড়া স্বাভাবিক অবস্থায়ও যথাসময়ে কাউন্সিল অনুষ্ঠান, সভাপতিমণ্ডলীর বৈঠক, কার্যনির্বাহী সংসদ বা পার্লামেন্টারি বোর্ড প্রভৃতির কার্যক্রম কোনোটাই ঠিকমতো হয় না। সদস্য অনুমোদনের জন্য গঠনতন্ত্রে যে নিয়ম আছে, তা মানা হয় না। কেন্দ্র থেকে তৃণমূল পর্যন্ত কোথাও সদস্য তালিকার সঠিক হিসাব নেই। 

বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে নেতৃত্বদানকারী দলটি গত ৪৮ বছরের মধ্যে ক্ষমতায় ছিল ২০ বছরেরও কম সময়। এর মধ্যে ২০০৯- এর জানুয়ারি থেকে একটানা প্রায় ১৪ বছর ক্ষমতায়। দীর্ঘদিন রাজপথে থাকা এবং ‘মার খাওয়া’ দল বিএনপি এবার ক্ষমতায় যেতে মরিয়া চেষ্টা চালাচ্ছে। সম্প্রতি দলটি দেশের সবকটি বিভাগীয় শহরে ও রাজধানীতে বড় বড় সমাবেশ করে ক্ষমতাসীনদের চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছে। সামনে জাতীয় নির্বাচন। আওয়ামী লীগ ছলে-বলে-কৌশলে এই নির্বাচনে জিততে না পারলে ‘রাজনৈতিক রায়ট’-এর শিকার হতে পারে। ৭৩ বছরের ঐতিহ্যবাহী দলটির জন্য আগামী বছরটি বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ, সন্দেহ নেই। তাই কি নেতৃত্ব অপরিবর্তিত রাখা হয়েছে?

আওয়ামী লীগের নতুন কমিটি নিয়ে দলের মধ্যে তেমন কোনো প্রতিক্রিয়া দেখা যায়নি। তবে নতুন প্রজন্মের কর্মীদের মান নিয়ে অনেক প্রবীণ নেতার অসন্তোষ রয়েছে। এ কালের কর্মীরা দল বা অঙ্গ-সংগঠনের কমিটি হলে কেবল পদ-পদবি পেতে তৎপর হন। কিন্তু তারা বঙ্গবন্ধুর আদর্শের কথা বলেন না। জানেনও না। কেবল দলের পদ নয়, জাতীয় সংসদ বা স্থানীয় সরকারের বিভিন্ন স্তরের মেয়র-কাউন্সিলর-চেয়ারম্যান-সদস্য পদ পেতেও তারা ব্যাকুল। এখন জাতীয় সংসদ, সিটি করপোরেশন, পৌরসভা, জেলা পরিষদ, উপজেলা পরিষদ, ইউনিয়ন পরিষদ- সর্বত্র আওয়ামী লীগের জয়জয়কার। কিন্তু তারা বেশিরভাগই কোনো নীতি-আদর্শের ধার ধারেন না। আওয়ামী লীগের মূলনীতি কী, সেটাও অনেকে বলতে পারবেন না। এসব নেতাকর্মীর ব্যাপারে কাউন্সিলে তেমন কোনো আলোচনা হয়েছে বলে জানা যায় না। 

আওয়ামী লীগের এবারের সম্মেলনে দল ও সরকারকে পৃথক করার ব্যাপারেও কোনো আলোচনার কথা শোনা যায়নি। আওয়ামী লীগ ও সরকার বর্তমানে একাকার হয়ে গেছে। দলটির পৃথক অস্তিত্ব অনেক ক্ষেত্রেই খুঁজে পাওয়া যায় না। বিষয়টি নিয়ে নানা সময়ে দলের মধ্যেও আলোচনা হয়েছে। যারা সরকারে যোগ দেবেন তারা দলে থাকবেন না। কারণ, সরকার দেশের সকলের। দল সরকার চালাবে পেছন থেকে, সরকারে থেকে দল চালানো নয়। এটা গণতান্ত্রিক রীতি। দলনেত্রী, প্রধানমন্ত্রী এবং ছাত্র সংগঠনের উপদেষ্টা- এই তিনটি পদ কোনো অবস্থাতেই সমান্তরাল নয়। প্রধানমন্ত্রী দেশের সকলের। তিনি গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী। সরকার দেশের প্রতিটি নাগরিকের। তিনি দলের এবং দলের ছাত্র সংগঠনের উপদেষ্টা হয়ে বিশেষ কোটারিভুক্ত হতে পারেন না। এতে প্রধানমন্ত্রীর পদটির মর্যাদাহানি ঘটে, বিশেষত গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায়। অন্য মন্ত্রীদের ক্ষেত্রেও এ কথা প্রযোজ্য। দলের গুরুত্বপূর্ণ পদে থেকে মন্ত্রিত্ব চালিয়ে যাওয়াটা নৈতিকতার মানদণ্ডে কতটা যৌক্তিক- সেটিও ভেবে দেখা দরকার। এই সম্মেলনে জেলার নেতাদের কী কার্যক্রম হবে বা তারা তাদের আগামী দিনের রাজনীতিকে কীভাবে দেখতে চান, তার কোনো প্রতিফলন দেখা যায়নি। আমাদের দেশে ‘জোর যার মুল্লুক তার’ নীতিতেই ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীরা দাপিয়ে বেড়ান। জোর-জুলুম-চাঁদাবাজি, হুমকি-ধমকি, কেড়ে খাওয়া, মেরে খাওয়া, দাপট দেখানো- এ সবই বৈশিষ্ট্য হয়েছে ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীর। এ অবস্থা থেকে বের হয়ে পশ্চাৎপদ সমাজটাকে কীভাবে আলোকিত সমাজে পরিণত করা যায়, তৃণমূলের নেতাকর্মীরা এ ব্যাপারে কে কী করতে পারেন, নিজে লাভবান হওয়ার বেপরোয়া নেশা থেকে নেতাকর্মীদের কীভাবে বের করে আনা যায়, তার ন্যূনতম কোনো আলামত সম্মেলনে দেখা যায়নি। 

শেখ হাসিনা প্রায় সাড়ে চার দশক ধরে দলীয় প্রধানের পদে থাকলেও বিকল্প নেতৃত্ব তৈরি হয়নি। তিনি না থাকলে আওয়ামী লীগের হাল কে ধরবেন- এটা এখনো অনিশ্চিত। নানা মহল থেকে প্রধানমন্ত্রীতনয় সজীব ওয়াজেদ জয়কে আওয়ামী লীগের ভবিষ্যৎ কাণ্ডারি মনে করা হয়। কিন্তু তিনিও কোনো কমিটিতে নেই। প্রধানমন্ত্রীর তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি উপদেষ্টা হিসেবে তিনি দায়িত্ব পালন করছেন। এর বাইরে দলের কোনো পর্যায়ের কোনো কমিটিতে তাকে দেখা যায়নি। ভবিষ্যৎ নেতৃত্বের ব্যাপারে এবারের সম্মেলনে কোনো ধরনের আলাপ-আলোচনার আভাস পাওয়া যায়নি। এ বাস্তবতায় আওয়ামী লীগের পক্ষে কি সম্ভব দেশে গণতান্ত্রিক ধারা প্রতিষ্ঠিত করা? গণতান্ত্রিক সমাজ বিনির্মাণ করা? সম্ভব কি দলের ভেতর গণতন্ত্রচর্চার একটি অবাধ ধারা প্রতিষ্ঠা করা? আওয়ামী লীগে বিকল্প নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করা?

নীতি, কর্মসূচি, নেতৃত্ব, স্লোগান, গঠনতন্ত্র, রণনীতি সব কিছু যদি অপরিবর্তিতই থাকে, তাহলে আর কোটি কোটি টাকা ব্যয় করে, এই শীতের ঋতুতে হাজার হাজার কর্মীকে ঢাকায় এনে এমন একটা জাতীয় সম্মেলন আয়োজনের মানে কী?