ঋণ করে ঘি খাওয়ার উন্মাদনা

বিভিন্ন দেশ ও সংস্থার কাছে বাংলাদেশের বিপুল পরিমাণ ঋণ গ্রহণের বিষয়টি নিয়ে ইদানীং ব্যাপক আলোচনা হচ্ছে। জাতীয় সক্ষমতা অর্জিত না হওয়ায় বিগত বছরগুলোতে বাংলাদেশের ঋণ বেড়েছে লাফিয়ে লাফিয়ে। বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার শুরু থেকে এ যাবৎ বৈদেশিক ঋণের মোট পরিমাণ দাঁড়িয়েছে চার হাজার ৪০২ কোটি ৩০ লাখ মার্কিন ডলার।

চিররঞ্জন সরকারচিররঞ্জন সরকার
Published : 10 August 2022, 11:38 AM
Updated : 10 August 2022, 11:38 AM

প্রাচীন ভারতীয় চার্বাক দর্শনের এই কথাটি বেশ প্রচলিত যে ‘ঋণং কৃত্বা ঘৃতং পিবেৎ, যাবৎ জীবেৎ সুখং জীবেৎ’। যার অর্থ, ঋণ করে হলেও ঘি খাও, যত দিন বাঁচো সুখে বাঁচো। ট্যাঁকে টাকা নেই বলে বিলাস-ব্যসন বন্ধ থাকবে কেন? এই দর্শনে ধার করে ঘি খাওয়ায় উৎসাহ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু বর্তমান পৃথিবীর অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে চার্বাকবর্ণিত নীতি বেশ বিপজ্জনক। করোনাভাইরাস মহামারীর মধ্যে তো আরও বেশি। বিশ্বজুড়েই সামগ্রিক অর্থনীতিতে মন্দাভাব দেখা দিয়েছে। এমন অবস্থায় ধার করে ঘি খেলে পরিণতি কী হতে পারে আমাদের চোখের সামনে শ্রীলঙ্কা তার দৃষ্টান্ত হয়ে দেখা দিয়েছে।

প্রাচীন চার্বাক দর্শনে ঋণ করে ঘি খাওয়ার কথা বলা হলেও পৌরাণিক গ্রন্থ মহাভারতে এর বিপরীত কথা বলা হয়েছে। বকরূপী ধর্ম এ সংক্রান্ত প্রশ্ন করলে, যুধিষ্ঠির বলেছেন, দিনান্তে যে পরম নিশ্চিন্তে শাক-ভাত খায়, সে-ই সুখী। অর্থাৎ, ধার-দেনা-ইএমআই মেটানোর টেনশন নেই। সুদ গোনার ঝক্কি নেই। অল্পতে সন্তুষ্টিই আসল কথা। যদিও আধুনিক মানুষের প্রবণতার সঙ্গে ‘শাক-ভাত খেয়ে অল্পতে সন্তুষ্ট হওয়ার ব্যাপারটা বড় বেশি যায় না। এ যুগে ভালো খেয়ে পরে, বিলাসী জীবনযাপন করাটাই ‘সুখ’। আধুনিক উন্নয়ন দর্শন মানুষকে ভোগবাদী হতে প্রতিনিয়ত প্ররোচনা যুগিয়ে যাচ্ছে। মোবাইল ফোনের কথাই ধরা যাক। এ যুগে আপনাকে শুধু মোবাইল ফোনে কথা বলার সুযোগ পেলেই হবে না। ফোনটা হতে হবে দামী। এখানে থাকবে নানা ফিচার। চকচকে ঝকঝকে ছবি তোলার সুযোগ থাকতে হবে। ব্যাটারির আয়ু দীর্ঘস্থায়ী হতে হবে। ওজনে হাল্কা হতে হবে। ওয়াটার রেসিস্ট হতে হবে। স্লিম হতে হবে। আওয়াজ হতে হবে মোলায়েম, সুরেলা ও স্পষ্ট। খুব সহজে পরিচালনা করা যায়, এমন হতে হবে। দ্রুতগতির ইন্টারনেট ব্রাউজিংয়ের সুযোগ থাকতে হবে। সবচেয়ে বড় কথা এমন লেটেস্ট মডেলের মোবাইল ফোন কেনার আগ্রহ, সুযোগ ও সামর্থ্য অর্জন করতে হবে। তবেই আপনি উন্নয়নের ড্রয়ইংরুমের একজন সুখী বাসিন্দা হিসেবে চিহ্নিত হবেন! আর এ জন্য ঋণ করাকে প্রতিনিয়ত উৎসাহ দেওয়া হয়। ঋণ প্রদানের বহু প্রতিষ্ঠান এখন নাগরিকদের দরজায় সব সময় কড়া নাড়ে।

ঋণের আরবি প্রতিশব্দ কর্জ। এর বাংলা প্রতিশব্দ হচ্ছে দেনা, ধার, হাওলাত ইত্যাদি। অভিধান মতে, ‘ঋণ হলো শুধু সহযোগিতার জন্য অন্যকে কোনো অর্থ-সম্পদ দেওয়া, যেন গ্রহীতা এর মাধ্যমে উপকৃত হয়, পরে দাতাকে সেই সম্পদ কিংবা তার অনুরূপ ফেরত দেওয়া।’

পৃথিবীতে সবার অর্থনৈতিক অবস্থা সব সময় অনুকূল থাকে না। কখনও কখনও সমস্যা ও প্রয়োজন মানুষকে ঋণ করতে বাধ্য করে। বাধ্য হয়ে অন্যের সহযোগিতার মুখাপেক্ষী হতে হয়। তাই জীবন চলার পথে ঋণ গ্রহণ ও পরিশোধ করা খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। সামাজিক-আর্থিক ও ধর্মীয় বিধানেও ঋণ গ্রহণ করার পক্ষে বলা হয়েছে। একইসঙ্গে যথাসময়ে ঋণ পরিশোধের ব্যাপারে কঠোর নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।

ঋণ যোগ্য লোকের উৎপাদনশীলতা বাড়ায়। যখন একজন মানুষের অধিক কিছু করার যোগ্যতা এবং সামর্থ্য আছে কিন্তু পর্যাপ্ত মূলধন নেই তখন যদি তিনি ঋণ করে তার সক্ষমতা বৃদ্ধি করেন। তিনি তার সামর্থ্যকে পুরোপুরি কাজে লাগিয়ে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বাড়াতে পারেন। ঋণ গ্রহণের সময় খেয়াল রাখতে হয় যে, ঋণ নেওয়ার জন্য যে সক্ষমতা দরকার তা আছে কি-না, ঋণ নিয়ে আসলেই তিনি আরও বেশি পণ্য উৎপাদন বা সেবা প্রদান করতে পারবেন কি-না এবং যে বাড়তি উৎপাদন তিনি করবেন তার অর্থনৈতিক মূল্য দিয়ে তিনি ঋণের শর্তানুযায়ী সুদাসল পরিশোধ করতে পারবেন কি-না। যদি এই শর্তগুলো ঋণ গ্রহীতা পূরণ করতে পারেন তবে অবশ্যই তিনি ঋণ গ্রহণ করবেন নিজেকে ছাড়িয়ে যাবার জন্য। এ কথা যেমন একজন ব্যক্তির ক্ষেত্রে প্রযোজ্য তেমনি তা ব্যবসা প্রতিষ্ঠান এবং রাষ্ট্রের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। বুঝে শুনে নেওয়া ঋণ সবসময় উপকারী।

ঋণ কেবল দরিদ্র দেশগুলোই নেয় না, ধনী দেশগুলোও নেয়। পৃথিবীর সবচেয়ে ধনী দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় ঋণ এখন ৩০ লাখ কোটি ডলারের বেশি। এ ছাড়া চীন, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, অস্ট্রেলিয়া, স্পেনের মতো ধনী দেশেরও প্রচুর ঋণ আছে। কাজেই বর্তমান আর্থিক ব্যবস্থায় ঋণ গ্রহণ খুবই স্বাভাবিক ঘটনা।

বিভিন্ন দেশ ও সংস্থার কাছে বাংলাদেশের বিপুল পরিমাণ ঋণ গ্রহণের বিষয়টি নিয়ে ইদানীং ব্যাপক আলোচনা হচ্ছে। জাতীয় সক্ষমতা অর্জিত না হওয়ায় বিগত বছরগুলোতে বাংলাদেশের ঋণ বেড়েছে লাফিয়ে লাফিয়ে। বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার শুরু থেকে এ যাবৎ বৈদেশিক ঋণের মোট পরিমাণ দাঁড়িয়েছে চার হাজার ৪০২ কোটি ৩০ লাখ মার্কিন ডলার। টাকার অবমূল্যায়নের কারণে বর্তমানে বৈদেশিক ঋণ টাকার অঙ্কে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮ লাখ ৬০ হাজার কোটি টাকা। বিগত ৭ মাসের ব্যবধানে শুধু টাকার অবমূল্যায়নজনিত কারণে ৮১ হাজার কোটি টাকা বৈদেশিক ঋণ বেড়েছে। এই ঋণের বেশিরভাগের জন্যই বাংলাদেশ সরকার বৈশ্বিক নানা উন্নয়ন সংস্থার কাছে দায়বদ্ধ। এর ৩৭ শতাংশ বিশ্ব ব্যাংকের, ২৪ দশমিক ৪৬ শতাংশ এডিবির এবং ১৭ দশমিক ৯ শতাংশ জাইকার। এছাড়া ৬ দশমিক ৮১ শতাংশ চীনের, ৬ দশমিক ১৪ শতাংশ রাশিয়ার, এক দশমিক ৩ শতাংশ ভারতের এবং অন্যান্য সংস্থা থেকে নেওয়া ঋণের অংশ ৬ দশমিক ৪ শতাংশ।

ডলারের বিপরীতে টাকার বিনিময় হার স্থিতিশীল না থাকলে বৈদেশিক ঋণ সব সময়ই ঝুঁকিপূর্ণ। টাকার মান কমে গেলে ঋণের অঙ্ক বেড়ে যায়। ডলারের দাম বাড়ার কারণে ঋণ শোধের সময় যে হারে ডলারের দাম বেড়েছে ওই হারে বাড়তি ঋণ শোধ করতে হবে। সম্প্রতি দেশে স্বল্পমেয়াদি ঋণ বেশি বেড়েছে। যা ঝুঁকিপূর্ণ। কারণ স্বল্পমেয়াদি ঋণ একসঙ্গে বেশি অঙ্কে পরিশোধ করতে হবে, যা রিজার্ভের ওপর বেশি চাপ তৈরি করবে।

বৈদেশিক ঋণ ও সাহায্যের প্রধান চ্যালেঞ্জটাই হলো কোন খাতে তা ব্যবহার করা হয় সেটার মূল্যায়ন। ঋণের টাকা কীভাবে কাজে লাগানো যায়, সেটাও একটা চ্যালেঞ্জ। আমাদের দেশে ঋণ ব্যবহারে দক্ষতার অভাব রয়েছে। আমাদের প্রকল্প বিলম্ব হয় এবং সময়মতো বাস্তবায়িত হয় না, যার ফলে খরচ বেড়ে যায়। আরেকট হলো দুর্বল বাস্তবায়ন। প্রকল্পের ফলপ্রসূতা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। বিভিন্ন প্রকল্পে অনেক সময় টাকা-পয়সা খরচ করা হয় বটে; কিন্তু বাস্তবিক উন্নতি খুব কম। প্রকল্পের সবচেয়ে বড় দুর্বলতা হলো দুর্নীতি। দুর্নীতির কারণে প্রকল্প অনেকটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এক্ষেত্রে জবাবদিহির অভাব আরেকটা সমস্যা। কেউ যদি দুর্নীতি করে, চুরি করে বা মানসম্পন্ন জিনিস না কেনে এবং তা যদি ধরাও পড়ে, বাংলাদেশে তার জন্য জবাবদিহির বিষয়টা সন্তোষজনক নয়।

একথা ঠিক যে, ঋণ নেওয়া কোনো অন্যায় নয়। তবে কোন কাজে, কীভাবে, কার স্বার্থে তা ব্যবহৃত হলো, সেটাই প্রধান বিবেচ্য। আমাদের দেশে সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয় হলো, অর্থ পাচার। দুর্নীতিতে আকণ্ঠ নিমজ্জিত ব্যাংকগুলো খালি হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু এসবের তেমন কোনো প্রতিকার হচ্ছে না। অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির আওতায় আনা হচ্ছে না। ফলে একটা বিশেষ সুবিধাভোগী শ্রেণি ঋণের টাকায় ফুলে-ফেঁপে উঠছে। ঋণের বেশিরভাগটা তাদের পেটে চলে যাচ্ছে।

চলমান আর্থিক সংকট থেকে মুক্তি পেতে সরকার বিভিন্ন শর্ত মেনে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ৪৫০ কোটি ডলার ঋণ পাবার চেষ্টা করছে। অভিযোগ রয়েছে যে, ঋণ পাবার শর্ত হিসেবে জ্বালানি, সারের ক্ষেত্রে ভর্তুকি কমানো হচ্ছে। ইতোমধ্যেই দেশে ইউরিয়া সারের দাম কেজিতে ছয়-টাকা করে বাড়ানো হয়েছে। বৃদ্ধি করা হয়েছে ডিজেল, কেরোসিন, পেট্রল ও অকটেনের দাম। এবার বিদ্যুতের ক্ষেত্রে যে ভর্তুকি দেওয়া হয় তা কমানো নিয়েও আলোচনা চলছে।

এতে করে দেশ প্রবল মূল্যস্ফীতির মুখে পড়তে যাচ্ছে। বাংলাদেশ যে সব প্রকল্পের জন্য যেসব শর্ত মেনে ঋণ নিচ্ছে অনেক এটাকে ‘ঋণ করে ঘি খাওয়া’ হিসেবে চিহ্নিত করছেন।

এ অবস্থায় সাবধানতা অবলম্বন ও ব্যয় সংকোচন নীতির বিকল্প নেই। নতুন করে ঋণ গ্রহণের ক্ষেত্রে চিন্তা-ভাবনা করে এগুনো দরকার। মনে রাখা দরকার যে, ওষুধ রোগ সারায়। তেমনই সেই একই ওষুধ মাত্রাছাড়া খেলে তা মৃত্যুও ডেকে আনতে পারে। ধারের ক্ষেত্রেও এই একই কথা খাটে। ঋণ পাওয়া গেলেই যে তা নিতে হবে, এমন কথা নেই। দেখতে হবে, সত্যিই তা প্রয়োজন কিনা।

সবচেয়ে ভালো হয় বৈদেশিক ঋণ না নেওয়া। আমরা যদি কৃচ্ছ্রতা সাধন করে, জ্বালানির ব্যবহার কমিয়ে, ব্যবসা-বাণিজ্য বাড়িয়ে, রপ্তানি বাড়িয়ে, রেমিটেন্স বাড়িয়ে বৈদেশিক মুদ্রা আহরণ করতে পারি, ফরেন ডাইরেক্ট ইনভেস্টমেন্ট এবং ফরেন পোর্টফোলিও ইনভেস্টমেন্ট যদি আনতে পারি, সে ক্ষেত্রে বৈদেশিক সাহায্য ও ঋণের পরিমাণ কমে আসবে এবং স্বয়ংসম্পূর্ণ টেকসই উন্নয়নের পথে দ্রুত এগিয়ে যেতে পারব। এর জন্য প্রয়োজন সুচিন্তিত ও দৃঢ় পদক্ষেপ। ঋণ করে ঘি খাওয়াটা এক ধরনের উন্মাদনা, এই উন্মাদনা থেকে আমাদের বের হয়ে আসতে হবে।

শাক-ভাত খেয়ে অল্পতে সন্তুষ্ট ও সুখী হওয়ার মডেলে ফিরে যেতে না পারলে আমাদের সামনে সমূহ বিপদ!