খালেদা জিয়ার নির্দেশে দেশ চললে কি দেশের আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক কাঠামোতে কোনো মৌলিক পরিবর্তন ঘটবে? চুরিধারি বন্ধ হবে? ঘুষ, দুর্নীতি, পুঁজি পাচার বন্ধ হবে?
Published : 11 Dec 2022, 05:00 PM
বিএনপির ঢাকা বিভাগীয় সমাবেশকে কেন্দ্র করে দু-তিন সপ্তাহ ধরে দেশের রাজনীতিতে যে গরম হাওয়া বইতে শুরু করেছিল, তাতে এখন শীতের আমেজ। ১০ ডিসেম্বর নয়াপল্টনে দলীয় কার্যালয়ের সামনে সমাবেশ করার জেদ বহাল রাখতে পারেনি বিএনপি। তবে গোলাপবাগ মাঠে সমাবেশের অনুমতি পাওয়ার আগে ৭ ডিসেম্বর নয়াপল্টনে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়িয়ে মকবুল হোসেন নামের একজন সাধারণ মানুষকে জীবন দিতে হয়েছে। আহত হয়েছেন অনেকে। বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে ঢুকে পুলিশ অনেক নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করেছে। এমনকি গভীর রাতে নিজ নিজ বাসা থেকে তুলে নেওয়া হয়েছে দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ও স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাসকে। নয়াপল্টনে সমাবেশ করার জন্য বিএনপি কেন জেদ ধরে ছিল এবং সরকার পক্ষই বা কেন বিএনপিকে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে নিতে চেয়েছিল, সে রহস্য আর হয়তো ভেদ হবে না।
এটা ঠিক, ঢাকা শহরে বড় সমাবেশ করার মতো উন্মুক্ত স্থান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান ছাড়া আর নেই। বিএনপি বড় সমাবেশ করতে চেয়ে কেন সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে যেতে চায়নি, তার সন্তোষজনক ব্যাখ্যা বিএনপির পক্ষ থেকে পাওয়া যায়নি। আবার জন-চলাচলের রাস্তা বন্ধ করে জনসভা বা সমাবেশ করা অনুচিত হলেও এই অনুচিত কাজটি দেশে এর আগে বহুবার হয়েছে। এমনকি ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগও করেছে। তাহলে এবার কেন সরকার এতটা অনড় থাকল নয়াপল্টনের ব্যাপারে? হয়তো নয়াপল্টন ঘিরে বিএনপির কোনো গোপন পরিকল্পনা ছিল। তাই তারা নয়াপল্টন ছাড়তে চায়নি। বিএনপি হয়তো কয়েক ঘণ্টার সমাবেশকে কয়েকদিনের সমাবেশে পরিণত করে সরকারের ওপর বাড়তি চাপ সৃষ্টি করার পরিকল্পনা করেছিল। ১০ ডিসেম্বর ঘিরে বিএনপির যে বড় কোনো পরিকল্পনা ছিল সেটা দলের কয়েকজন নেতার বক্তব্য থেকেও বোঝা গেছে। খালেদা জিয়ার নির্দেশে দেশ চলবে, তারেক রহমান দেশে ফিরবেন, খালেদা জিয়া সমাবেশে যোগ দেবেন– এসব হুমকি দিয়ে সরকারের মাথায় চাপ বাড়িয়ে দিয়ে বিএনপির কতটুকু লাভ বা ক্ষতি হলো, সে আলোচনায় এখনই না গিয়ে এটুকু বলা যায় যে, বিএনপি ও সরকার তথা আওয়ামী লীগ মুখোমুখি হয়ে শক্তি পরীক্ষায় নেমে গোলশূন্য ড্র করেছে।
আওয়ামী লীগ সরকারের পায়ের নিচে মাটি নেই বলে বিএনপি নেতাদের বক্তব্য যেমন হাস্যকর, তেমনি বিএনপিকে একেবারে দুর্বল ভেবে আওয়ামী লীগও ঠিক করছে না। বিএনপির পেছনেও জনসমর্থন আছে। তবে মাঠে খেলা গড়ালেও জয়-পরাজয় নির্ধারণের জন্য আরও অনেক ম্যাচ খেলতে হবে। ততদিনে বিএনপি দম রাখতে পারবে কিনা, দেখার বিষয় সেটাই। বিএনপি দীর্ঘবছর ধরে ক্ষমতার বাইরে আছে। আর আওয়ামী লীগ টানা তিন মেয়াদে ক্ষমতায় আছে। প্রশাসনে এখন আওয়ামী লীগের নিয়ন্ত্রণ একচ্ছত্র। সরকারের পক্ষে দল যেমন আছে, তেমনি আছে প্রশাসনযন্ত্র। বিএনপি নিজেদের শক্তির উৎস-উপকরণ সম্পর্কে যথার্থ ধারণা নিয়ে মাঠে নেমেছে কিনা তা স্পষ্ট নয়। তবে সরকারের পদত্যাগ কিংবা দলনিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবি আদায়ের মতো শক্তির ঘাটতি যে বিএনপির আছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। বিএনপির ৭ জন সদস্য সংসদ থেকে পদত্যাগ করায় সরকারের ওপর নতুন কোনো চাপ তৈরি হবে বলে মনে হয় না। বরং বিএনপির মধ্যে ভাঙন ধরানোর সুযোগ এর ফলে আরও বাড়ল বলে মনে হয়। সরকার চাইলে বিএনপির সুযোগ সন্ধানীদের সুযোগ করে দিতে পারে।
বিএনপির জন্ম থেকে বেড়ে ওঠার বিষয়টি একটু ফিরে দেখা যেতে পারে। বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান। ১৯৭১ সালের মার্চ মাসে ‘আমি মেজর জিয়া বলছি' বলে বেতার ঘোষণা দেওয়ার আগ পর্যন্ত যার নাম জানত খুব কম লোকই। সেনাবাহিনীর একজন মেজরের পক্ষে ব্যাপক জনগণের কাছে পরিচিত হওয়াও সম্ভব ছিল না। কিন্তু ঘটনার আকস্মিকতাই মেজর জিয়াকে বিখ্যাত করে তোলে। একাত্তরে ওই ঘোষণাদানের মধ্য দিয়ে মেজর জিয়ার নাম স্বাধীনতাকামী বাঙালির হৃদয়ে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। স্বাধীনতার পর সামান্য বিরতি। ১৯৭৫ সালের ১৫ অগাস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার মধ্যদিয়ে রাজনৈতিক ক্ষমতার পালা বদলের পটভূমিতে জিয়াউর রহমান আবার আসেন রাজনীতির সামনের কাতারে। প্রথমে নেপথ্যে, পরে প্রকাশ্যে।
জিয়াউর রহমানই প্রথম ব্যক্তি যিনি স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথম সেনাপতি থেকে রাষ্ট্রপতি হওয়ার সৌভাগ্যের অধিকারী। শুধু তাই নয়, ’৭৫-পরবর্তী সময়ে দেশে যে ধারার রাজনীতি চলছে, বলতে গেলে তার প্রায় সবকিছুর সূচনা করেছেন তিনি। তিনিই প্রথম ব্যক্তি যিনি একজন অরাজনৈতিক ব্যক্তি হয়েও বিভিন্ন বিপরীতমুখী আদর্শে বিশ্বাসী রাজনৈতিক দলমতের লোক নিয়ে একটি রাজনৈতিক ‘ককটেল’ পার্টি গড়ে তোলেন, যার নাম বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল, (বিএনপি)। তিনিই প্রথম নানা ধরনের সুবিধাবাদীদের ধরে এনে বসান রাজনৈতিক উচ্চাসনে। রাজনীতিকে পরিণত করেন ক্যারিক্যাচারে।
ক্ষমতার কেক-চকোলেট বিলি করে নানা ধরনের লোকজনকে সমবেত করেছিলেন জিয়াউর রহমান তার রাজনৈতিক দলে। স্বাধীনতাবিরোধী দক্ষিণপন্থী মুসলিম লীগ, সাবেক মাওবাদী প্রগতিশীল বলে দাবিদার ইউপিপি, ভাসানী ন্যাপ ইত্যাদি বিচিত্র চেহারার লোকদের তিনি ক্ষমতার মূলো অথবা সুযোগ-সুবিধার মোহ দেখিয়ে বিএনপিতে সমবেত করেছিলেন।
একটা কথা আছে, চোখ দেখে নাকি মানুষের মনের ভাব বোঝা যায়। অর্থাৎ চোখ মনের কথা বলে। ক্ষমতাসীন হওয়ার পর জিয়াউর রহমান সম্ভবত তার মনের প্রকৃত ভাবটা মানুষকে বুঝতে দিতে চাইতেন না। হয়তো এই জন্যই তিনি প্রায় সবসময় কালো চশমায় ঢেকে রাখতেন তার দুই চোখ। তার মনের প্রকৃত ভাব থাকত মানুষের দৃষ্টির আড়ালে।
মানতেই হয় যে, জিয়াউর রহমানের চাতুর্য ছিল প্রখর। তাই রাষ্ট্রপতির দায়িত্বভার গ্রহণ বা বিএনপি দল গঠন কোনোটাই রাতারাতি করেননি। ’৭৫ সালের ১৫ অগাস্ট বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার পর খন্দকার মোশতাক তাকে সেনাবাহিনীর প্রধান বানান। তারপর ৩ নভেম্বর থেকে ৭ নভেম্বর অনেক ঘটনা। খুব ধীরস্থিরভাবে অগ্রসর হতে থাকেন জিয়া। খালেদ মোশাররফের ব্যর্থ অভ্যুত্থানের পর রাষ্ট্রপতির পদে থেকে যান বিচারপতি সায়েম। এমনকি প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকও হন সায়েম। কালো চশমায় চোখ ঢেকে জিয়া থাকেন আড়ালে। এরপর নিজেকে প্রস্তুত করতে থাকেন জিয়া। ধীরে ধীরে অগ্রসর হতে থাকেন। ’৭৬ সালের ৩০ নভেম্বর তিনি প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের পদ গ্রহণ করেন। তারও কয়েকমাস পরে ’৭৭ সালের ২১ এপ্রিল তিনি রাষ্ট্রপতি পদ গ্রহণ করেন, বিদায় করে দেন বিচারপতি সায়েমকে। আর আড়ালে আবডালে নয়। সায়েম হয়তো স্বগতোক্তি করেছেন– ‘এই কি ছিল তোমার মনে?' আসলে তাই ছিল। একই বছর ৩০ মে তিনি তার পক্ষে ‘হ্যাঁ, না’ ভোট গ্রহণ করেন। এই ভোটের মধ্য দিয়েই শুরু হয় বাংলাদেশে নির্বাচনের নামে তামাশা, ভোটের বাক্সের যাদু।
জিয়া রাষ্ট্রপতি হিসাবে জনগণের ভোটে নির্বাচিত হন ’৭৮ সালের ৩ জুন জেনারেল ওসমানীকে পরাজিত করে। সেই ভোটেও কারচুপি হয়েছিল। তবে কারচুপি না হলেও জিততেন হয়তো জিয়াই। কারণ ততদিনে দেশবাসীর কাছে ভারসাম্যের নীতির মানুষ হিসাবে একটি বিশেষ ‘ইমেজ’ সৃষ্টি করে ফেলেছেন জিয়া। এয়ার ভাইস মার্শাল এম. জি তোয়াব দেশকে ইসলামী রাষ্ট্রে পরিণত করার দাবি তোলায় তাকে চাকরিচ্যুত করা হয়, দেশ ছাড়া করা হয়। এইভাবে কৌশলী জিয়া কমিউনিস্টদের পর্যন্ত বিভ্রান্ত করতে সক্ষম হন। একদিকে তিনি মুক্তিযুদ্ধের ভাবমূর্তিকে পুরোপুরি ব্যবহার করেন অন্যদিকে দেশে সাম্প্রদায়িক রাজনীতি প্রসারের দুয়ার খুলে দেন। রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হয়েই তিনি সংবিধান সংশোধন করেন। রাষ্ট্রীয় মূলনীতি থেকে ধর্মনিরপেক্ষতা বাতিল হয়ে যায়। বাঙালি থেকে বানানো হয় বাংলাদেশি। মুক্তিযুদ্ধের ঘোষক দাবিদার জিয়াউর রহমানই মুক্তিযুদ্ধের ঘোরতর বিরোধিতাকারী প্রতিক্রিয়াশীল সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক শক্তিগুলোকে প্রকাশ্যে রাজনীতি করার সুযোগ করে দেন। শাহ আজিজুর রহমানের মতো চিহ্নিত স্বাধীনতাবিরোধীকে প্রধানমন্ত্রীর পদে বসান। জিয়াউর রহমানের শাসন আমলেই আমাদের জাতীয় সঙ্গীত ও জাতীয় পতাকা পরিবর্তনের দাবি তোলার ধৃষ্টতা দেখানো হয়। বিএনপির মধ্যে ঘটে বিচিত্র সব রাজনৈতিক-সামাজিক শক্তির সমাবেশ। জিয়াউর রহমানের এই জগাখিচুড়ির রাজনীতির নাম দেওয়া হয়েছিল ভারসাম্যের রাজনীতি।
কারও কারও ধারণা ছিল জিয়াউর রহমানের পতন হলে তার গড়া বিচিত্র রাজনৈতিক দল বিএনপিও বালুর বাঁধের মতো রাজনীতির স্রোতে ভেসে যাবে। ভেঙ্গে যাবে বিএনপির তাসের ঘর।
অদ্ভুত ঘটনা হলো, জিয়ার মৃত্যুর পর এত বছর বাদেও কিন্তু বিএনপি দলটি একেবারে নিঃশেষ হয়ে যায়নি। এখনো আছে।
তবে প্রশ্ন হলো, জিয়াউর রহমান সম্পর্কে যে ইমেজ মানুষের মনে ছিল তা কি এখনো সমান অক্ষুণ্ণ আছে? জিয়া কি মানুষের স্মৃতিতে ক্রমশ ধূসর হয়ে আসছেন না? মৃত্যুর পর তার সঙ্গে পাওয়া ভাঙ্গা টিনের সুটকেস ও ছেড়া গেঞ্জির গল্প কি এখন আর কেউ বলে?
সব থেকে বড় প্রশ্ন জিয়াউর রহমানের রাজনৈতিক আদর্শটাই বা কি? জিয়ার আদর্শ নিয়ে যে টানাটানি সেটা কি? এরশাদের আদর্শের সাথে জিয়ার রাজনৈতিক আদর্শের বড় অমিলটা কোথায়?
জিয়াউর রহমানের রাজনৈতিক আদর্শের বিষয়টি একটু খতিয়ে দেখা যাক। প্রথমেই মনে রাখতে হবে স্বাধীনতা-উত্তর সমাজে দেশের ভবিষ্যৎ নির্মাণের জন্য পথ বাছাইয়ের ক্ষেত্রে তৎকালীন জাতীয় রাজনৈতিক দলগুলোর দুর্বলতা এবং বিশেষত শাসক দল হিসাবে আওয়ামী লীগের কিছু ব্যর্থতা, কিছুক্ষেত্রে বাড়াবাড়ি আচরণ সমাজে রাজনৈতিক পরিবর্তনের একটি ভিত্তি তৈরি করেছিল। মূলত এই ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়েই জিয়া তার রাজনৈতিক সৌধ রচনা করছেন।
কি করছেন তিনি?
১. বহুদলীয় গণতন্ত্রের কথা বলে প্রকৃতপক্ষে দেশে গণতান্ত্রিক পরিবেশ নস্যাৎ করেছেন। দল ভাঙ্গা, দল থেকে লোক ভাগানোর কাজে ইন্ধন জুগিয়েছেন সরকারি বিভিন্ন এজেন্সি দিয়ে। দেশের প্রচলিত গণতান্ত্রিক-প্রগতিশীল রাজনৈতিক দলগুলোর ওপর এক ধরনের নিয়ন্ত্রণ বা চাপ রেখে প্রতিক্রিয়াশীল সাম্প্রদায়িক দলগুলোকে রাজনীতি ক্ষেত্রে চলার পথ সুগম করে দিয়েছেন। রাজনৈতিক ক্ষেত্রে হিংস্রতা-অসহিষ্ণুতা তার আমলেই বেড়েছে। বিরোধী দলকে ‘উৎখাত কর’ ‘খতম কর’– ইত্যাদি আওয়াজ তিনি নিজেও মাঝেমধ্যে তুলেছেন।
২. বিভিন্ন দল থেকে সুবিধাবাদী রাজনৈতিক ব্যক্তিদের ভাগিয়ে এনে অথবা দল ভেঙ্গে রাষ্ট্রীয় বা প্রশাসনিক পৃষ্ঠপোষকতায় নানা প্রলোভন দেখিয়ে রাজনৈতিক দল গঠনের প্রক্রিয়া শুরু করেন জিয়াউর রহমান। বিএনপি এমনই একটি রাজনৈতিক দল যা গড়ে উঠেছে জিয়ার ব্যালান্স নীতির ভিত্তিতে সম্পূর্ণ অগণতান্ত্রিক এবং অরাজনৈতিক প্রক্রিয়ায়। বিএনপি ত্যাগ করে একবার ওবায়দুর রহমান বলছিলেন, বিএনপির মধ্যে অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্র নেই। কিন্তু প্রশ্ন হলো, কোনো দিন কি সেটা ছিল বা এখনো কি আছে?
৩. জিয়াউর রহমান দেশের অভ্যন্তরীণ এবং বিদেশ নীতির ক্ষেত্রে মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে যা কিছু নতুন অর্জন হয়েছিল তা বাতিল করার পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। এর ফলে মুজিববিরোধী সকল পর্যায়ের রাজনৈতিক শক্তি জিয়ার রাজনৈতিক শক্তির ভিত্তি হিসাবে কাজ করতে এগিয়ে আসে।
৪. মিশ্র অর্থনীতির নামে জিয়া দেশে লুটপাটের অর্থনীতি তিনি চালু করেন। একশ্রেণির মানুষকে অবাধে ব্যাঙ্ক ঋণ দিয়ে ফুলেফেঁপে ওঠার সুযোগ দিয়ে দেশে ধন বৈষম্যের পথ তিনি সুগম করে দেন। নিজে ‘দুর্নীতিমুক্ত’ এমন একটি ভাবমূর্তি গড়ে তুলে সকল প্রকার দুর্নীতিবাজ, ধড়িবাজ ব্যক্তিদের তিনি প্রশ্রয় দিয়েছেন।
৫. অরাজনৈতিক ব্যক্তি, সামরিক বাহিনীর সাবেক কর্মকর্তা, সরকারি আমলাদের মন্ত্রী বানানোর প্রক্রিয়া তিনিই শুরু করেন। যারা জীবনের কোনোদিন মন্ত্রী হওয়ার স্বপ্ন দেখত না, রাজনীতির ময়দানে বিচরণ করবে বলে ভাবত না– জিয়াউর রহমান তাদের কুড়িয়ে এনে মন্ত্রী বানিয়েছেন, রাজনৈতিক নেতা বানিয়েছেন। আবার সময় বুঝে কাউকে কাউকে ছুঁড়ে ফেলেছেন। অজ্ঞাত-অখ্যাত ব্যক্তিদের মন্ত্রী হওয়ার স্বপ্ন পূরণের জন্যই হয়তো জিয়া অনেকের কাছে স্মরণীয় হয়ে থাকবেন। দূতপুল গঠন, জেলা সমন্বয়কারী বানানো, মন্ত্রিসভার কলেবর বৃদ্ধি ইত্যাদি নানা উপায়ে অসংখ্য মানুষকে ক্ষমতার প্রসাদ বিতরণ করে তিনি সবকিছু ‘ম্যানোভার’ করার নীতি নিয়ে চলেছেন। এইভাবে জিয়াউর রহমানই দেশের রাজনীতিতে প্রায় নিরাময়-অযোগ্য এক ক্ষত সৃষ্টি করে গেছেন।
লক্ষণীয় যে, জিয়ার ঘনিষ্ঠ সহকর্মীদের অনেকেই এরশাদ সরকারে যোগ দিয়েছেন। কারণ জাতীয় পার্টির নীতি ও আদর্শের মধ্যে ইসলাম, বাংলাদেশি জাতীয়বাদ, ফ্রি-ইকনমি, সরকার পদ্ধতি, বহুদলীয় গণতন্ত্র ইত্যাদি বিএনপির অনেক পছন্দনীয় বিষয় একীভূত হয়েছে। এরশাদ নিজেও কখনো জিয়ার প্রতি এতটুকু অশ্রদ্ধার মনোভাব দেখাননি। তাই প্রশ্ন আসে, তাহলে জাতীয় পার্টির সাথে বিএনপির বিরোধ কোথায়? কেন বিএনপি বিশেষ করে বেগম জিয়া এরশাদ সরকারের বিরুদ্ধে আপোসহীন মনোভাব নিয়ে সংগ্রাম করেছেন?
এরশাদ এবং বেগম জিয়ার মধ্যে রাজনৈতিক বা আদর্শগত বিরোধ খুঁজে বের করা সহজ নয়। যদিও এই কথায় বিএনপি নেতাদের কেউ কেউ বেশ চটে যাবেন। তবু এটা সত্য, বাস্তব। উভয়ের মধ্যে মূল পার্থক্য বা দ্বন্দ্ব-বিরোধ হলো ক্ষমতাকে কেন্দ্র করে। বেগম জিয়া এরশাদকে কোনোভাবেই ক্ষমতায় অর্থাৎ প্রেসিডেন্ট হিসাবে বরদাশত করতে চাননি। বেগম জিয়া ক্ষমতায় এসে দেশের রাজনীতি-অর্থনীতি-বিদেশনীতির ক্ষেত্রে কোনো আমূল পরিবর্তন ঘটাননি।
আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে বিএনপির জেহাদের মূল কারণ কি?
রাজনৈতিক নীতি আদর্শের পরিবর্তন নয়, ক্ষমতার পরিবর্তনটাই বেগম জিয়ার কাছে মুখ্য বিষয়। বেগম জিয়ার নির্বাচন নিয়ে আগ্রহ সব সময়ই কম। যেকোনো উপায়ে যেকোনো মহলের সহায়তায় ক্ষমতায় যাওয়াটাই যেন বেগম জিয়া তথা বিএনপির প্রধান কাম্য।
খালেদা জিয়ার নির্দেশে দেশ চললে কি দেশের আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক কাঠামোতে কোনো মৌলিক পরিবর্তন ঘটবে? চুরিধারি বন্ধ হবে? ঘুষ দুর্নীতি পুঁজি পাচার বন্ধ হবে? রাজনীতির মূল সংকট কি আওয়ামী লীগ বা বিএনপির ক্ষমতায় থাকা না থাকা? জিয়ার আদর্শে দেশ চালিয়ে কি বিএনপি দেশের মানুষের ভাগ্য পরিবর্তন করতে পেরেছিল? জিয়া প্রবর্তিত রাজনৈতিক ধারা অব্যাহত রেখে সংকট থেকে রেহাই পাওয়া সম্ভব নয়। বিএনপি ক্ষমতা চায় কিন্তু নতুন রাজনৈতিক কোনো পথের কথা মুখে আনে না। গণতন্ত্রের কথা বলা সহজ কিন্তু গণতন্ত্র চর্চা কি বিএনপির ভেতরে আছে?