হাওরের ফসল রক্ষায় বাঁধ ব্যবস্থাপনা

নীতিমালা অনুযায়ী ১৫ ডিসেম্বর শুরু হয়ে ২৮ ফেব্রুয়ারির মধ্যে বাঁধের কাজ শেষ হওয়ার কথা। কিন্তু কোনো বছরই নির্ধারিত সময়ে কাজ শেষ হয় না। এবছরও হয়নি। সুনামগঞ্জের জামালগঞ্জে এপ্রিল মাসেও বাঁধে মাটি ফেলতে দেখা গেছে। দেরিতে বাঁধ নির্মাণ হলে বাঁধের মাটি নরম থাকে। বন্যার পানির তোড়ে সহজে ভেঙে যায়।

কাসমির রেজাকাসমির রেজা
Published : 7 April 2023, 06:44 AM
Updated : 7 April 2023, 06:44 AM

প্রাকৃতিক সম্পদের ভান্ডার হাওরে মাছের উৎপাদন কমেছে আশঙ্কাজনক হারে। ধানের ফলন ভালো হলেও সব বছর কৃষক গোলায় ধান তুলতে পারে না। প্রকৃতি দয়াপরবশ হলে কোনো কোনো বছর ঝঞ্ঝাট ছাড়াই ধান পাওয়া সম্ভব হয়। কিন্তু দু-এক বছর পর পর প্রকৃতি রুদ্ররূপ ধারণ করে। অকাল বন্যা ভাসিয়ে নিয়ে যায় হাওরের কৃষকের বহুল কাঙ্ক্ষিত সোনার ফসল। তাই অকাল বন্যার হাত থেকে ফসল রক্ষায় টেকসই বাঁধ নির্মাণ জরুরি। প্রতি বছর সরকার বাঁধ নির্মাণে শত কোটি টাকা খরচ করে থাকে। এই অর্থের যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করা যায় না বললেই চলে। যদি তা করা যেত তাহলেই অকাল বন্যার হাত থেকে হাওরের ফসল রক্ষা পেত।

শস্যভান্ডার খ্যাত হাওরের ফসল রক্ষা বর্তমান বিশ্ব বাস্তবতায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। করোনাভাইরাস মহামারীর প্রভাবে এবং রাশিয়া-ইউক্রেইন যুদ্ধের কারণে বিশ্বব্যাপী খাদ্য সংকট দেখা দিয়েছে। যা আরও প্রলম্বিত এবং ভয়াবহ হওয়ার আশঙ্কা করছেন বিশ্বের খ্যাতিমান অর্থনীতিবিদেরা। উৎপাদন বাড়াতে এক ইঞ্চি জমিও অনাবাদি না রাখার কথা বলছেন প্রধানমন্ত্রী। হাওর ও জলাভূমি উন্নয়ন অধিদপ্তর প্রকাশিত হাওর মহাপরিকল্পনার তথ্যানুযায়ী দেশে উৎপাদিত মোট ধানের ২০ ভাগ আসে হাওরাঞ্চল থেকে। এমন বাস্তবতায় এবছর হাওরের ফসল রক্ষা করা আরও গুরুত্ব বহন করে। কৃষি অধিদপ্তর বলছে, এ বছর হাওরে লক্ষ্যমাত্রা থেকে বেশি ধান উৎপাদিত হবে। তবে ইতোমধ্যে ব্লাস্ট রোগে ও শিলাবৃষ্টিতে টাঙ্গুয়ার হাওর এলাকার বেশ কিছু জমির ফসল নষ্ট হয়েছে।

২০১৭ সালে অকাল বন্যায় হাওরে ব্যাপক ফসলহানি হওয়ার পরে বাঁধ ব্যবস্থাপনায় পরিবর্তন আসে। প্রণীত হয় সংশোধিত কাজের বিনিময়ে টাকা (কাবিটা) নীতিমালা ২০১৭। হাওরের বাঁধ নির্মাণে ঠিকাদারি প্রথার অবসান হয়। সংশ্লিষ্ট হাওরের কৃষকরা প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটির (পিআইসি) মাধ্যমে বাঁধ নির্মাণ করেন। কিন্তু নীতিমালা অনুযায়ী পিআইসি গঠন হয়নি অনেক ক্ষেত্রে। জানতে পেরেছি, প্রভাবশালী মহলের দাপটে এসব পিআইসিতে প্রকৃত কৃষকের বদলে ঢুকে পড়েছে স্বার্থান্বেষীরা। নীতিমালা অনুযায়ী ১৫ ডিসেম্বর শুরু হয়ে ২৮ ফেব্রুয়ারির মধ্যে বাঁধের কাজ শেষ হওয়ার কথা। কিন্ত কোনো বছরই নির্ধারিত সময়ে কাজ শেষ হয় না। এবছরও হয়নি। নির্ধারিত সময়ে ৫০ থেকে ৬০ ভাগ কাজ শেষ হয়। এ বছর সুনামগঞ্জের জামালগঞ্জে এপ্রিল মাসেও বাঁধে মাটি ফেলতে দেখা গেছে। দেরিতে বাঁধ নির্মাণ হলে বাঁধের মাটি নরম থাকে। বন্যার পানির তোড়ে সহজে বাঁধ ভেঙে যায়।

কাবিটা নীতিমালা ২০১৭ অনুযায়ী বাঁধের অন্তত ৫০ মিটার দূর থেকে মাটি আনতে হবে। বাস্তবে সব বাঁধে তা মানা হচ্ছে না। পরিবেশ ও হাওর উন্নয়ন সংস্থার জরিপ হতে দেখা যায় ২০২২ সালে অন্তত ৩৫ ভাগ বাঁধে ৫০ মিটারের কাছ থেকে মাটি আনা হয়েছে। এত কাছ থেকে মাটি আনায় বাঁধের কাছে গর্তের সৃষ্টি হয়। এতে বাঁধ দুর্বল হয়।

অন্যদিকে কৃষকরা জানান, অনেক অপ্রয়োজনীয় বাঁধ হচ্ছে হাওরে। এসব বাঁধের মাটি আবার নদীতে পড়ায় নদীর নাব্য কমে যাচ্ছে। অন্যদিকে টপ সয়েলও ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে। এতে গবাদি পশুর খাদ্য সংকট দেখা দিচ্ছে। শত বছরের ধারাবাহিকতায় গড়ে ওঠা কান্দা (হাওরে উঁচু ভূমি) কেটে মাটি নেওয়ায় প্রকৃতির ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে। কিছু অসাধু ব্যক্তি নিজেদের স্বার্থ হাসিল করার জন্য এসব অপ্রয়োজনীয় বাঁধ নির্মাণ করছেন।

হাওরাঞ্চলে জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিকর প্রভাব ক্রমেই মারাত্মক আকার ধারণ করছে। এখন অনেক হাওর থেকে পানি নামতে দেরি হয় বলে দেরিতে ধানের চারা রোপন করা হচ্ছে। এতে ধান কাটার সময় পিছিয়ে যাচ্ছে। অন্যদিকে অকাল বন্যা ক্রমেই এগিয়ে আসছে। বছর দশেক আগেও অকাল বন্যা আসত এপ্রিলের মাঝামাঝি। ২০১৭ সালে অকাল বন্যা আঘাত হানে মার্চের ২৮ তারিখে। এতে কৃষক এখন উভয়-সংকটে। না আগে ধান রোপন করতে পারছেন, না আগে কাটতে পারছেন। তাই স্বল্প জীবনের ধান আবিষ্কার এবং এসব ধান ব্যবহারে কৃষকদের উৎসাহিত করতে হবে। আশার বিষয় হলো, এবছর সুনামগঞ্জের মধ্যনগরে কিছু কৃষক মার্চের শেষদিকে আগাম জতের ধান কাটতে সক্ষম হয়েছেন। তবে এসব ধানের ব্যবহারে কৃষকরা ততটা আগ্রহ দেখাচ্ছেন না। এজন্য কৃষকদের উদ্বুদ্ধ করতে হবে।

হাওরে কিছু কিছু ক্লোজার স্থায়ীভাবে নির্মাণ করা যায়। স্থায়ী ক্লোজার নির্মাণের প্রকল্পের কথা অনেকদিন থেকেই শুনছি; কিন্তু এর বাস্তবায়ন দেখছি না। এতে এককালীন খরচ একটু বেশি হলেও দীর্ঘমেয়াদে খরচ বেঁচে যায়। কৌশলগত গুরুত্ব বিবেচনা করে কিছু স্থানে স্লুইস গেট নির্মাণ করা দরকার। এতে হাওরে পানি প্রবেশ রোধ করা যায় এবং প্রয়োজনে হাওরের পানি বাড়ানো বা কমানো যায়। তবে স্লুইস গেটের ব্যবস্থাপনা যথাযথ হতে হবে। বেশিরভাগ হাওরের স্লুইস গেট অকেজো হয়ে পড়ে আছে। স্থানীয় অনেকের অভিমত কালভার্ট দিয়েও পানির হ্রাসবৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণ করা যাবে। এতে প্রয়োজনে কালভার্টের মুখ বন্ধ করতে হবে এবং প্রয়োজনে খুলে দিতে হবে।

যুগ যুগ ধরে বাঁধ ভেঙ্গে গেলে আপদকালীন বাঁশ, টিন দিয়ে যেভাবে বাঁধ রক্ষা করা হতো, এখনও কৃষকরা তার থেকে বের হয়ে আসতে পারছেন না। প্রযুক্তি উৎকর্ষের এই যুগে কোথাও বাঁধ ভেঙে গেলে তাৎক্ষণিক ফসল রক্ষায় কীভাবে উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করা যায় তা ভেবে দেখতে হবে। এজন্য গবেষণা জরুরি।

তবে শুধু বাঁধ দিয়ে ফসল রক্ষা করা যাবে না। সমস্যার স্থায়ী সমাধানের জন্য হাওর এলাকার নদীগুলো খনন করা আবশ্যক। ভাটি এলাকা হওয়ায় উজানের ঢল আমাদের মোকাবিলা করতেই হবে। এই ঢলের পানিকে তার স্বাভাবিক পথে চলতে দিলে এই পানি ক্ষতির কারণ হবে না। কিন্তু পলি পড়ে নদীর তলদেশ উঁচু হওয়ার কারণে নদীতে পানির ধারণ ক্ষমতা কমে গেছে এবং পানির স্বাভাবিক প্রবাহ ব্যাহত হচ্ছে। তাই পাহাড়ি ঢলের পানি ছড়িয়ে পড়ে খেতে-খামারে। তলিয়ে যায় ফসল। পুরো হাওর এলাকার পানি ভৈরবের দিকে মেঘনা হয়ে সাগরে পতিত হয়। মেঘনায় জেগে ওঠা চর পানি প্রবাহে বাধা সৃষ্টি করছে। এই চরসহ হাওরের নদীগুলো খনন করতে হবে। পাশাপাশি খালগুলো খনন করে হাওরের সঙ্গে নদীর সংযোগ স্থাপন করতে হবে। হঠাৎ ধেয়ে আসা পাহাড়ি ঢলকে সামাল দিতে কয়েকটি হাওর খনন করে পানির রিজার্ভার সৃষ্টি করাও প্রয়োজন। এই খননকার্য নিয়মিতভাবেই পরিচালনা করা দরকার।

অকাল বন্যার হাত থেকে ফসল রক্ষা করতে হলে আগাম জাতের ধান উদ্ভাবন করতে হবে। এজন্য বিস্তর গবেষণা প্রয়োজন। একই সঙ্গে হাওরের জলাবদ্ধতা নিরসন করা গেলেও আগেভাগে ধানের চারা রোপণ করা যায়। এতেও ফসল হারানোর ঝুঁকি কমে।

সুষ্ঠুভাবে ও সময়মত বাঁধের কাজ শেষ করার জন্য বাঁধের কাজ রাজনৈতিক প্রভাব থেকে মুক্ত রাখতে হবে। সর্বোপরি এই বাঁধ বা ফসলের ওপর যাদের জীবন ও জীবিকা নির্ভর করে ওই কৃষকদের অধিকার সচেতন করা গেলে তারা নিজেরাই নিজেদের অধিকার আদায় করে নেবেন। এজন্য কৃষকদের সচেতনতা অত্যাবশ্যক।

হাওরে শুধু ধান নয়, মাছের উৎপাদন বাড়াতে হবে। এজন্য হাওরে মৎস্য গবেষণাগার নির্মাণ, হ্যাচারি নির্মাণ, মৎস্য প্রক্রিয়াজাতকরণসহ নানামুখী পদক্ষেপ নিতে হবে।

হাওর রক্ষা বাঁধ নিছক একটি বাঁধ নয়। এর সঙ্গে দুই কোটি হাওরবাসীর অস্তিত্বের প্রশ্ন জড়িত। বাঁধ না টিকলে হাওরের ফসল ঘরে তোলা যায় না। ফসল ঘরে তোলা না গেলে তাদের জীবনের নিত্যনৈমিত্তিক চাহিদা পুরণ হয় না। মেটে না ধার-দেনা। এতে হাওরবাসীর ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক, রাজনৈতিক সর্বোপরি অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সৃষ্টি হয় নানা সমস্যা। এর প্রভাব পড়ছে দেশের সামগ্রিক অর্থনীতিতে। হাজার কোটি টাকার ফসল পানিতে তলিয়ে গেলে দেশের খাদ্যের জোগান হ্রাস পায়। কৃষকের আয় কমে যাওয়ায় দেশের সামগ্রিক চাহিদায়ও নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। আর বছরের পর বছর ফসলহানি ঘটলে এ সমস্যা হয় গভীর থেকে গভীরতর। তাই এ সমস্যার মূলোৎপাঠন করতে হবে। বাঁধের অনিয়মের সঙ্গে জড়িতরা যতই শক্তিশালী হোক না কেন আমাদের সম্মিলিত প্রয়াস এদের রুখে দিতে পারে।