যুদ্ধ করেছেন, স্বীকৃতি পাননি থপাল কড়ারা

সমতলের আদিবাসীরা আনুপাতিক হারে অধিক সংখ্যায় মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়েছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ ও আদিবাসী বিষয়ক গবেষণায় এমন তথ্যই উঠে এসেছে বারবার।

মুস্তাফিজুর রহমান রূপমমুস্তাফিজুর রহমান রূপম
Published : 27 March 2024, 03:12 PM
Updated : 27 March 2024, 03:12 PM

বাংলাদেশের উত্তর জনপদের আদিবাসীদের মধ্যে যারা মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছেন তাদের অধিকাংশই মুক্তিযোদ্ধা `সনদ’ বা `প্রমাণক’ যথাযথভাবে সংরক্ষণ করতে পারেননি। যেমন অধিকাংশ ক্ষেত্রে তারা পারেননি নিজেদের জমিজমার কাগজাদি সঠিকভাবে সংরক্ষণে রেখে নিজেদের নামজারি করতে। সনদ না থাকলেও অন্য যে প্রক্রিয়ায় নিজেকে মুক্তিযোদ্ধা প্রমাণ করা সম্ভব, সেটা অক্ষরজ্ঞানহীন একজন আদিবাসীর পক্ষে তা অত্যন্ত দুরূহ এবং অসম্ভব প্রমাণিত হয়েছে দিনাজপুর অঞ্চলের অনেক আদিবাসী মুক্তিযোদ্ধার ক্ষেত্রে। এই রকম স্বীকৃতি না পাওয়া একজন আদিবাসী মুক্তিযোদ্ধা থপাল কড়া। তিনি আর এই পৃথিবীতে নেই, মারা গেছেন ২০২১ সালের ৬ জুলাই। তার উত্তরাধিকারীদের মধ্যেও কেউ নেই, যে স্বীকৃতি আদায়ের লড়াইটা করতে পারবে। 

দিনাজপুরের বিরল উপজেলার ১০ নং রানী পুকুর ইউনিয়নের হালজাই মৌজার ঝিনাইকুড়ি গ্রামে কড়াদের বাস। বাংলাদেশ সরকারের ‘ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর তালিকা’য় থাকা ৫০টি জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে কড়ারা সংখ্যায় সবচেয়ে কম। ২৪টি পরিবারের মাত্র ৯৮ জন মানুষ বাস করে সেখানে। 

মুক্তিযুদ্ধ এবং আদিবাসী বিষয়ক গবেষক সালেক খোকনের ২০১১ সালে প্রকাশিত একটি নিবন্ধে থপাল কড়াকে নিয়ে লিখেছেন, “মুক্তিযুদ্ধের পর যুদ্ধে অংশগ্রহণের যেসব কাগজপত্র তার কাছে ছিল সেগুলো দিয়ে পরে মুক্তিযোদ্ধা সনদ গ্রহণের নিয়ম, পদ্ধতি ও সুবিধা লাভের বিষয়টি ছিল তার কাছে বেশ অস্পষ্ট। সীমান্তবর্তী গ্রামের এই মুক্তিযোদ্ধা ভাবতেন, ‘কাগুজে এই সনদ দিয়ে কী হবে’। তাই অযত্নে পড়ে থাকা কাগজগুলো বন্যার পানিতে ভেসে যায়। শুধু মুক্তিযুদ্ধ আর বঙ্গবন্ধু বেঁচে থাকে থাপলের মনে। আজও এই স্বাধীন দেশে প্রতিটি দিনই তার কাটাতে হয় জীবনযাপন আর গোত্র টিকিয়ে রাখার যুদ্ধে। নিজেকে পরিচয় দেন না মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে। মুক্তিযুদ্ধ করার বিপরীতে সুবিধা লাভে তিনি আগ্রহী নন। তিনি বলেন, ‘যুদ্ধ করেছি দেশের জন্য, শুধু চাই স্বাধীন দেশে নিজের অধিকারটুকু নিয়ে বেঁচে থাকতে।’

 “মুক্তিযোদ্ধা এই আদিবাসীর সঙ্গে যতই কথা বলছিলাম ততই তার প্রতি শ্রদ্ধায় আমাদের মাথা নত হচ্ছিল। কাগুজে সনদ না থাকায় কোন ডিসেম্বরেই থপালের মতো মুক্তিযোদ্ধারা সম্মানিত হন না। এদেশে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা তৈরি হয়নি অদ্যাবধি। যার উদ্যোগ নেয়ার প্রয়োজন ছিল যুদ্ধের পর পরই। অথচ অবাক আর লজ্জিত হতে হয় যখন দেখা যায় অমুক্তিযোদ্ধা আর রাজাকাররাও মুক্তিযোদ্ধা ভাতা নিচ্ছেন, পাচ্ছেন মুক্তিযোদ্ধার সম্মান।”

জন্মসনদ অনুযায়ী থপাল কড়ার জন্ম ১৯৫২ সালে। বাবা পাকুয়া কড়া ও মা ফাগনি কড়া। ১৯৭১ সালে ১৯ বছর বয়সী থপাল মুক্তিযুদ্ধে যোগদান করেন। বঙ্গবন্ধুর সাতই মার্চের ভাষণ রেডিওতে শোনার মধ্য দিয়ে তার মনে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেওয়ার সংকল্প দানা বাধে। সাতই মার্চের ভাষণের একটি পংতি ‘তোমাদের যার যা আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করতে হবে’। সমতলের আদিবাসীদের দৈনন্দিন জীবনের একটি উপকরণ তীর-ধনুক। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তারা তাদের তীর-ধনুক নিয়ে প্রস্তুত হন প্রতিরোধ যুদ্ধের জন্য। দিনরাত পালা করে নিজেদের এলাকা পাহারা দিতে থাকেন শত্রুর অনুপ্রবেশ রোধ করার জন্য। আধুনিক সমরাস্ত্রে সজ্জিত একটি প্রশিক্ষিত সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে তীর-ধনুক নিয়ে টিকে থাকা সম্ভব নয় এই উপলব্ধি থেকেই থপাল কড়ার মতো আদিবাসী তরুণরা ভারতে মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ গ্রহণের সঙ্গে যুক্ত হন। 

শিববাড়ি ইয়ুথ ক্যাম্পে জর্জ দাসের অধীনে প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন থপাল কড়া। জর্জ দাস দিনাজপুরে বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে অতি পরিচিত একটি নাম। দীর্ঘদেহী, সুঠাম স্বাস্থ্যের অধিকারী, অকুতোভয় সেই সঙ্গে বিনয়ী এই বীর মুক্তিযোদ্ধা সকলের জর্জ ভাই। খ্রিস্ট ধর্মালম্বী ছিলেন। তিনি ২০০৯ সালে মৃত্যুবরণ করেন। থপাল কড়া দিনাজপুর সদরের রামসাগর হামজাপুর সীমান্তসহ হিলি সীমান্তের বেশ কয়েকটি জায়গায় মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন। ১৬ ডিসেম্বর মুক্তিযুদ্ধে চূড়ান্ত বিজয় অর্জনের পর তিনি দিনাজপুর স্টেডিয়ামে আনুষ্ঠানিকভাবে অস্ত্র জমা দেন। মৃত্যুর আগে তার গ্রামে আরো অনেকের সঙ্গে মুজিববর্ষ উপলক্ষে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু কন্যার উপহারের ঘর তার একমাত্র প্রাপ্তি। ৬ জুলাই ২০২১ সালে এই বীর মুক্তিযোদ্ধা মারা যাওয়ার আগে অনেক বার দেখা হয়েছে তার সঙ্গে। কিন্তু কিছুই করা হয়ে ওঠেনি তার জন্য। থপাল কড়ার মতো দিনাজপুর সদর উপজেলার আরো বেশ কয়েকজন আদিবাসী মুক্তিযোদ্ধার কথা জানা যায় যারা পাকিস্তানি বাহিনী এবং তাদের দোসর রাজাকারদের বিরুদ্ধে সম্মুখযুদ্ধে অংশ নিয়েও মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পাননি। 

যেমন দিনাজপুর শহর থেকে রামসাগর যাওয়ার পথে সিকদার এলাকায় সাঁওতাল আদিবাসী লক্ষণ মার্ডি। ৭০ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেছেন তিনি কোনো স্বীকৃতি ছাড়াই। মুক্তিযুদ্ধের শুরুতেই দিনাজপুর কুঠিবাড়ি বলে পরিচিত তৎকালীন ইপিআর ক্যাম্পের বাঙালি সদস্যদের সহযোগিতায় দিনাজপুরের ছাত্র, শ্রমিক, জনতা ইপিআর ক্যাম্পের অস্ত্র ভাণ্ডার লুট করে। এই ঘটনায় লক্ষণ মার্ডি অংশগ্রহণ করেন এবং কুঠিবাড়ি এলাকাতেই অবস্থান করেন পাকিস্তানি বাহিনী দিনাজপুর শহর আক্রমণ করা পর্যন্ত। পরে প্রশিক্ষণ শেষে স্টেশন কমান্ডার আশরাফ সিদ্দিকীর অধীনে যুদ্ধ করেন রানীপুকুর, ঘুঘুডাঙাসহ দিনাজপুর সদর উপজেলার দক্ষিণ অংশের রণাঙ্গনে। তার অতি প্রিয় সহযোদ্ধা ছিলেন রফিকুল ইসলাম, যিনি পরে দিনাজপুরের একজন বিশিষ্ট ব্যবসায়ী নেতা হিসেবে পরিচিত লাভ করেন এবং দিনাজপুর শিল্প ও বণিক সমিতির সভাপতি নির্বাচিত হন। রফিকুল ইসলাম লক্ষণ মার্ডিকে বিভিন্ন সময় সহযোগিতা করেছেন বলে তার পরিবারের সদস্যদের কাছে জানা যায়। 

লক্ষণ মার্ডির কথাই শেষ নয়। দিনাজপুর সদরের ২ নং সুন্দরপুর ইউনিয়নের খোশালপুর গ্রামের সাঁওতাল আদিবাসী নরেশ মুর্মু, ৩ নং ফাজিলপুর ইউনিয়নের লালদিঘী গ্রামের রবিন সরেন, রানীগঞ্জ এলাকার সুকু সরেন (মৃত) ও সমেন্দ্র টুডু,৩ নং চেহেলগাজী ইউনিয়নের ভিন্সেন্ট টুডুসহ দিনাজপুর শহরের রাজবাটি এলাকার ভিন্সেন্ট মার্ডি ৭নং সেক্টরে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়ে বাংলাদেশ স্বাধীন করেছেন। কিন্তু তাদের ভাগ্যে প্রাপ্য স্বীকৃতি ও সম্মান জোটেনি। 

এ তো শুধু দিনাজপুর সদর উপজেলার হারিয়ে যাওয়া আদিবাসী মুক্তিযোদ্ধাদের কথা।দিনাজপুর জেলার অন্তর্গত আরো বারটি উপজেলা রয়েছে উত্তরে কাহারোল-খানসামা আর পুর্বে হাকিমপুর(হিলি) ও ঘোড়াঘাট।সবখানেই সাঁওতাল, ওরাঁও, মুন্ডা, পাহান, তুরিসহ অন্যান্য আদিবাসী জনগোষ্ঠীর বাস। ১৯৭১-এ আরো অধিক সংখ্যক ছিল এই আদিবাসীরা। আর সেই সময় ঠাকুরগাঁও এবং পঞ্চগড় জেলাও দিনাজপুর জেলার অন্তর্গত মহকুমা ছিল। এই ভৌগোলিক এলাকা বিবেচনায় নিয়ে স্বীকৃতি না পাওয়া আদিবাসী মুক্তিযোদ্ধাদের সংখ্যা অনুমান করতে গেলেও তা অনেক কষ্টসাধ্য হয়ে পড়ে।

সমতলের আদিবাসীরা আনুপাতিক হারে অধিক সংখ্যায় মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়েছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ ও আদিবাসী বিষয়ক গবেষণায় এমন তথ্যই উঠে এসেছে বারবার। যুদ্ধ চলাকালীন সময়ের কিছু আলোকচিত্রও দেখা যায় তীর-ধনুক হাতে যুদ্ধ প্রস্তুত আদিবাসীদের। বর্তমানে সমগ্র দিনাজপুর জেলার মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকায় বাঙালি খ্রিস্টান ও আদিবাসী মিলিয়ে মোট ২৪ জনের নাম পাওয়া যায়। সেই ২৪ জনের মধ্যে সবার উপরে রয়েছে দিনাজপুর শহরের মির্জাপুর মৌজার জোসেফ গোমেজের নাম। সুইহারী মির্জাপুর নভেরা টেকনিক্যাল স্কুলের বিপরীত দিকের গলির শেষ প্রান্তে ছোট আধা পাকা এক চালা টিনের বাড়িতে জোসেফ গোমেজ থাকেন স্ত্রীসহ। বারান্দার একদিকে খাবার টেবিল পাতা আর অন্যদিকে একরকম বৈঠকখানার মতো ব্যবস্থা করা হয়েছে। সেখানে পুরনো কাঠের সোফা, একটি পুরনো রঙিন টিভি রয়েছে। বারান্দার সামনের আঙিনায় গাঁদা ফুলের গাছে ফুল ফুটেছে। এই মার্চেই কয়েক দফায় কথা হয় তার সঙ্গে, কখনো দাওয়ায়, কখনো বৈঠকখানায় বসে।

জোসেফ গোমেজের জন্ম ১৯৫০ সালে। গত ১৯ মার্চ ২০২৪ তিনি ৭৫ বছরে পা রেখেছেন। ওপেন হার্ট সার্জারি করা আছে তার। তথাপি তাকে অনেক সুঠাম পুরুষ বলে মনে হয় চোখের দেখায়। পিতা-মাতা সহ তার পরিবারের বসবাস ছিল নাটোর জেলার বনপাড়ায়। তিনি ১৯৬৩ সালে তার কাকার সঙ্গে দিনাজপুর চলে আসেন। দিনাজপুর কসবা মিশন (সেন্ট ফিলিপস স্কুল) থেকে মেট্রিক পাশ করেন ১৯৬৯ সালে। ওই বছরই দিনাজপুর সুইহারি মির্জাপুরে নভেরা সেন্টার (টেকনিক্যাল স্কুল) স্থাপন করেন ফাদার সেস্কাতো নামে একজন ইতালীয় ফাদার। জোসেফ শিক্ষানবিশ হিসেবে সেখানে যোগ দিয়ে কাঠের আসবার তৈরির কাজ শিখতে থাকেন। একাত্তরের শুরুতে তিনি নভেরা সেন্টারে অন্যদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার কাজ পান এবং সেখানেই বসবাস করতে থাকেন।১৯৭১ সালে ১৩ এপ্রিল দিনাজপুর দশ মাইল প্রতিরোধ যুদ্ধের পর পাকিস্তানি বাহিনী শহরে প্রবেশ করে। শহরের প্রবেশ মুখেই নভেরা সেন্টার এবং প্রাথমিক স্কুল। সেখানে অনেক পরিবার আশ্রয় গ্রহণ করেছিল। ১৪ এপ্রিল ১৯৭১, পাকিস্তানিরা এবং তাদের এদেশীয় অবাঙালি সাথীরা মিলে দিনাজপুর শহরে ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ চালায় এবং অগ্নিসংযোগ করে। জোসেফের সহকর্মী প্যাট্রিক পাকিস্তানিদের গুলি হজম করে দীর্ঘকাল বেঁচে থেকে সম্প্রতি মৃত্যুবরণ করেছেন।

১৫ এপ্রিল দিনাজপুর শহরের পশ্চিম দিকে পুনর্ভবা নদী পার হয়ে জোসেফ আরো অনেকের সঙ্গে ভারতের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হন। পথ চেনা না থাকায় ভুল পথে কয়েকবার ঘুরপাক খেতে হয়েছিল তাকে। তিন দিন তিন রাত হেঁটে শেষ পর্যন্ত তিনি পৌঁছান পশ্চিমবঙ্গের কুশমন্ডি এলাকায় আত্মীয় বাড়িতে। সেখানে কয়েকদিন থেকে চলে যান রানাঘাট আশ্রয় কেন্দ্রে। সেখানেও অবস্থান না করে চলে যান কলকাতায়। কাজ পেয়ে যান পার্ক হোটেলে।১৯ দিন কাজ করার পর রেডিওতে পাকিস্তানিদের অত্যাচারের বর্ণনা শুনে তিনি যুদ্ধে যাবেন বলে মনস্থির করেন। তিনিও জর্জ দাসের মাধ্যমেই রায়গঞ্জের কর্ণজোড়া প্রশিক্ষণ শিবিরে প্রথমে আরো ২১ জনসহ সাতদিন যুদ্ধের প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। তারপর তাদের নিয়ে যাওয়া হয় পাহাড়ি এলাকা শিলিগুড়ির পানিঘাটা শিবিরে। প্রথমে তারা আশেপাশের জঙ্গল পরিষ্কার করে শিবিরটিকে আরো বড় করে গড়ে তোলেন।পানিঘাটা প্রশিক্ষণ শিবিরে প্রায় দুমাস অবস্থান করেছিলেন। সেখানে প্রশিক্ষণ দিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের পাঁচটি প্লাটুন যুদ্ধর জন্য প্রস্তুত করা হয়। প্রতি প্লাটুনে ২০০ জনের মতো মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। জোসেফকে আবার ফিরিয়ে নিয়ে আসা হয় রায়গঞ্জের বরাহার শিবিরে। সেখান থেকে সরাসরি যুদ্ধে নামা। প্রথম অপারেশনে দিনাজপুর মোহনপুরের পাকিস্তানিদের ঘাঁটি আক্রমণ করেছিলেন। ইপিআরের বাঙালি সৈনিক শহীদুল্লাহর নেতৃত্বে। মোট ৩৩ জন মুক্তিযোদ্ধা ১১ জন করে তিনটি ছোট দলে বিভক্ত হয়ে আক্রমণ করেছিলেন। তারা পাকিস্তানিদের মতো খাকি পোশাকের ছদ্মবেশ ধারণ করেছিলেন। গুলি চালাতে চালাতে পাকিস্তানি সেনাঘাঁটির ৫০ গজের মধ্যে পৌঁছে গিয়েছিলেন। জোসেফের হাতে হালকা মেশিনগান ছিল। তিনটি ম্যাগাজিন শেষ করার পর তার অস্ত্র সাময়িক বিকল হয়ে যায় এবং তার বাম হাতের কব্জির ওপরে গুলি লাগে। হাত ছিদ্র করে বেরিয়ে কাঁধ ছুঁয়ে গুলি চলে যায়। আহত জোসেফ অস্ত্র বহন করে আত্রাই নদী ধরে ফিরে আসেন রায়গঞ্জে সেখান থেকে কলেজপাড়া ক্যাম্প হাসপাতালে ৯ দিন চিকিৎসা নিয়ে মোটামুটি সুস্থ হন। পরের অপারেশনে অংশ নেন দিনাজপুর জেলার চিরিরবন্দরের কালীগঞ্জ হাইস্কুলের পাকিস্তানি এবং রাজাকারদের আস্তানায়। এই যুদ্ধে সফল হয়ে তার দল সেখান থেকে তিনজন বীরাঙ্গনাকে উদ্ধার করে রায়গঞ্জে আশ্রয় শিবিরে পৌঁছে দেন। জোসেফ গোমেজ মোট নয়টি অপারেশনে অংশ নিয়েছিলেন। ঘুঘুডাঙ্গা হাইস্কুলে হানাদারদের আস্তানায় আক্রমণে গিয়ে তার সহযোদ্ধা সিকান্দার শহীদ হন। তাকে স্কুল মাঠেই দাফন করা হয়।

রেকি করতে গিয়ে ল্যান্ড মাইন বিস্ফোরণে তার সাথী যোদ্ধার পা দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। তিনি তাকে বহন করে রায়গঞ্জ ফিল্ড হাসপাতালে নিয়ে এসেছিলেন। এমন আরো অনেক যুদ্ধকালীন ঘটনার স্পষ্ট বর্ণনা করেন জোসেফ। শুধু নামগুলো স্মরণ করতে গিয়ে তার কিছুটা সমস্যা হয়। রায়গঞ্জেই অস্ত্র জমা দিয়ে এই বীর মুক্তিযোদ্ধা দেশে ফিরে আসেন।

জোসেফ গোমেজ নিয়মিত মুক্তিযোদ্ধা ভাতা পেয়ে আসছেন। স্পষ্ট করে বলতে না চাইলেও তার কথাতেই ফুটে ওঠে। প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা না হয়েও অনেকে ভোগ করছে মুক্তিযোদ্ধা ভাতা, পেতে যাচ্ছে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য নির্মিত বাড়ি আর অনেক আদিবাসী মানুষ মুক্তিযুদ্ধে সম্মুখ সমরে অংশ নিয়েও ভাতা তো দূরের কথা স্বীকৃতি,সম্মান পর্যন্ত পাননি। কালক্রমে হারিয়ে গেছেন বিস্মৃতির অতলে।