মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য একটি কার্যকর পরিকল্পনা প্রণয়ণ করতে হলে ঝুকিপূর্ণ জনগোষ্ঠীর স্বাস্থ্য চাহিদার বিষয়টি আলাদাভাবে বিবেচনা করার পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট সকল খাতের মধ্যে সমন্বয় নিশ্চিত করতে হবে।
Published : 13 Oct 2022, 07:58 PM
[দুই পর্বের প্রবন্ধের ২য় পর্ব]
মানসিক স্বাস্থ্য এবং মানসিক স্বাস্থ্যের চিকিত্সা শুধু ব্যক্তির নিজের চিন্তাভাবনা, আবেগ, আচরণ এবং অন্যদের সাথে পারস্পরিক সম্পর্ক বজায় রাখতে সহায়তা করার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। একইসাথে কার্যকর জাতীয় নীতি, সামাজিক সুরক্ষাবলয়, পর্যাপ্ত জীবনযাত্রার মান, কাজের অবস্থা, কমিউনিটিভিত্তিক সামাজিক সহায়তা এবং চিকিৎসাসেবার একটি শক্তিশালী স্তরভিত্তিক নেটওয়ার্কের মাধ্যমে বিরাজমান সামাজিক, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক এবং পারিপার্শ্বিক পরিবেশেগত অবস্থার ওপরেও নির্ভর করে। এ বিষয়গুলো মাথায় রেখেই জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য আইন ২০১৮ এবং জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য নীতি ২০২১ প্রস্তুত করা হয়েছে। এই আইন এবং নীতিমালাই বাংলাদেশের জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক কৌশলগত পরিকল্পনা প্রণয়নের দিকে পরিচালিত করেছে। স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অসংক্রামক ব্যাধি বিভাগের অনুরোধে এই কৌশলগত পরিকল্পনা পত্রটি প্রস্তুত করা হয়েছে। এটি তৈরিতে অর্থায়ন করেছে যুক্তরাজ্য সরকারের আন্তর্জাতিক উন্নয়ন বিভাগ এবং কারিগরি সহায়তা প্রদান করেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় আঞ্চলিক কার্যালয় ও সূচনা ফাউন্ডেশন। প্রত্যাশা করা হচ্ছে যে, কৌশলগত পরিকল্পনাটি সরকারের প্রয়োজনীয় অগ্রাধিকারগুলোকে জাতীয় নীতিমালার বৃহত্তর কাঠামোতে অন্তর্ভুক্ত করবে। যেখানে কার্যকর পর্যবেক্ষণ ও মূল্যায়ন ব্যবস্থা নিশ্চিত করার মাধ্যমে প্রয়োজনীয় অর্থ, উপকরণ এবং লোকবল বরাদ্দ দেয়ার বিষয়টিও থাকবে।
প্রয়োজনীয় সকল খাতের মধ্যে সমন্বয় প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে মানসম্মত মানসিক ও মনোসামাজিক সেবা এবং তথ্যের যথাযথ ব্যবহার ও এসবের সহজলভ্যতা নিশ্চিত করতে সংশ্লিষ্ট সকল বিষয়ের প্রতি সংবেদনশীল থেকে জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক কৌশলগত পরিকল্পনা ২০২০-২০৩০ তৈরি করা হয়েছে। এ পরিকল্পনাটির উদ্দেশ্য হচ্ছে একটি টেকসই, অধিকারভিত্তিক, সামগ্রিক, অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং আন্তঃখাত সমন্বয় বিবেচনায় অবকাঠামো প্রতিষ্ঠা করা। এটি বাংলাদেশের মানুষদের জন্য মানসম্পন্ন মানসিক ও মনোসামাজিক স্বাস্থ্য সুরক্ষা, প্রতিরোধ, চিকিৎসা এবং একইসাথে মানসিক স্বাস্থ্য সংকটে থাকা মানুষদের পুনর্বাসনের পাশাপাশি তথ্যের সরবরাহ ও নিশ্চিত করবে।
কৌশলগত পরিকল্পনাটি চূড়ান্ত করার পূর্বে জরুরি বিষয়গুলো সম্পর্কে ঐকমত্য গড়ে তোলার লক্ষ্যে মাঠ পর্যায়ে পরিদর্শন এবং অংশীদারদের নিয়ে পরামর্শমূলক কর্মশালা করা হয়েছে। পরামর্শকগণ গবেষণালব্ধ তথ্য উপাত্ত সংগ্রহ করেন, অনেকগুলো কর্মসূচি মূল্যায়ন প্রতিবেদন ও কৌশলগত এবং নীতিমালা বিষয়ক নথিসমূহ পর্যালোচনা করেন। সংশ্লিষ্ট পেশাজীবী, মন্ত্রণালয় এবং অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের সাথে ফোকাস গ্রুপ আলোচনা করা হয়েছে, বিশেষজ্ঞদের সাক্ষাৎকার নেয়া হয়েছে ও কারিগরি দলের সদস্যদের সাথে সভা করা হয়েছে। এই কৌশলগত পরিকল্পনাটির মূলনীতিগুলো তৈরি করার ক্ষেত্রে অন্যান্য যেসকল নীতিমালাকে ভিত্তি হিসেবে নেওয়া হয়েছে তার মধ্যে রয়েছে, জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য নীতি ২০২১ (চূড়ান্ত অনুমোদনের বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন আছে), মানসিক স্বাস্থ্য আইন ২০১৮ এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সমন্বিত মানসিক স্বাস্থ্য কর্ম পরিকল্পনা ২০১৩-২০২০, মানসিকভাবে অসুস্থ ব্যক্তিদের সুরক্ষা ও মানসিক স্বাস্থ্য সেবা উন্নয়নের জন্য জাতিসংঘের নীতিসমূহ এবং প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অধিকার বিষয়ক নীতিমালা যা বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃত।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সমন্বিত মানসিক স্বাস্থ্য কর্ম পরিকল্পনা ২০১৩-২০২০ থেকে চারটি সাধারণ উদ্দেশ্য বাংলাদেশের কৌশলগত পরিকল্পনাটিতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে:
১) মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য কার্যকর নের্তৃত্ব ও পরিচালনা ব্যবস্থা জোরদার করা।
২) কমিউনিটি পর্যায়ে বিস্তৃত, সমন্বিত এবং সংবেদনশীল মানসিক স্বাস্থ্যসেবা এবং সামাজিক সহায়তা প্রদান করা।
৩) মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নয়ন এবং প্রতিরোধের কৌশলগুলি বাস্তবায়ন করা।
৪) মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য তথ্য ব্যবস্থা, প্রমাণাদি এবং গবেষণা শক্তিশালী করা।
মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক কৌশলগত পরিকল্পনাটি এমনভাবে সাজানো, যেখানে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক কর্ম পরিকল্পনা ২০২০-৩০ এর প্রতিটি লক্ষ্য অনুযায়ী সুনির্দিষ্ট কিছু উদ্দেশ্য সন্নিবেশ করা হয়েছে। একইসাথে দেশ হিসেবে বাংলাদেশের জন্য আলাদা সূচক ও লক্ষ্যমাত্রা, প্রতিটি লক্ষ্য অর্জনের জন্য মূল দায়িত্ব কী হবে, কারা অংশীদার হবে, প্রত্যাশিত ফলাফল ও কার্যক্রম কেমন হবে, কী ধরনের লোকবল ও উপকরণ লাগবে এবং তহবিল যোগান বিষয়ে বিস্তারিত দিক-নির্দেশনা রয়েছে।
জীবনব্যাপী যে বিষয়গুলো মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর প্রভাব রাখে এবং এ উপাদানগুলো কীভাবে পরস্পর সম্পর্কযুক্ত তার ওপরও কৌশলগত পরিকল্পনায় আলোকপাত করা হয়েছে। এটা এখন বিশ্বজুড়েই প্রমাণিত যে মানসিক স্বাস্থ্য এবং শারীরিক স্বাস্থের মধ্যে একটি সুস্পষ্ট সংযোগ রয়েছে। শারীরিক স্বাস্থ্যের জন্য ঝুঁকির কারণগুলো একইসাথে মানসিক স্বাস্থ্যের জন্যও ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে, তা যে কেউই সহজে বুঝতে পারেন। ওই কারণে পরিকল্পনায় যে দিকগুলো প্রাধান্য পেয়েছে তার মধ্যে অন্যতম হলো অসংক্রামক ব্যাধি, দারিদ্র, পুষ্টি, সহিংসতা, শৈশব ও কৈশোরকালীন বয়স, বিভিন্ন ধরনের মানবিক বিপর্যয়, মাদকের ব্যবহার এবং আত্মহত্যা।
সবশেষে, এটা স্পষ্ট যে মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য একটি কার্যকর পরিকল্পনা প্রণয়ণ করতে হলে ঝুকিপূর্ণ জনগোষ্ঠীর স্বাস্থ্য চাহিদার বিষয়টি আলাদাভাবে বিবেচনা করার পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট সকল খাতের মধ্যে সমন্বয় নিশ্চিত করতে হবে। এ ধরনের পরিকল্পনা বাস্তবায়নযোগ্য, টেকসই ও প্রাসঙ্গিক করার জন্য অংশীজনদের বিশেষ করে যাদের মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যার অভিজ্ঞতা রয়েছে, তাদের অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞান এবং দৃষ্টিভঙ্গি সম্পর্কে অবশ্যই জানতে হবে। অনুমোদন পর্যায়ে থাকা বর্তমান পরিকল্পনাটির লক্ষ্য শুধু যারা মানসিক স্বাস্থ্য সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছেন তাদের সময়মতো এবং কার্যকর মানসিক স্বাস্থ্যসেবা প্রদান করাই নয়, একইসাথে এটাও নিশ্চিত করা যেন চিকিৎসা পদ্ধতিগুলি তাদের প্রতি নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি না করে, তাদের জন্য আরও ক্ষতির কারণ না হয়ে ওঠে এবং তাদের মৌলিক মানবিক চাহিদা এবং অধিকারকে হুমকির সম্মুখীন না করে। আশা করা যায়, যে কৌশলগত পরিকল্পনাটি তৈরি করা হয়েছে সেটি সহজেই বাস্তবায়ন করা যাবে এবং এর ফলে এমন একটি কর্মপরিকল্পনা তৈরি হবে যা জনগণকে মানসিক স্বাস্থ্য সম্পর্কে জানতে সাহায্য করবে এবং বাংলাদেশের মানুষের জন্য বৃহত্তর প্রেক্ষাপটে মনোসামাজিকভাবে ভাল থাকার সুযোগ বৃদ্ধি করবে।
এই প্রবন্ধটি সর্বপ্রথম IPS News এ প্রকাশিত হয়েছিল ২৮শে অক্টোবর ২০২১ সালে
অনুবাদে: সালওয়া সালাম শাওলী, অ্যাসিস্ট্যান্ট কো-অর্ডিনেটর, কনটেন্ট ডেভলপমেন্ট, সূচনা ফাউন্ডেশন
সায়মা ওয়াজেদ, একজন লাইসেন্সপ্রাপ্ত স্কুল সাইকোলজিস্ট; বর্তমানে ব্যারি ইউনিভার্সিটির স্কুল সাইকোলজি বিভাগে ক্লিনিক্যাল ইন্সট্রাক্টর হিসেবে নিয়োজিত আছেন; একইসাথে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মহাপরিচালকের অটিজম ও মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক উপদেষ্টা; বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক বিশেষজ্ঞ পরামর্শক প্যানেলের সদস্য; ক্লাইমেট ভালনারেবল ফোরাম এর ‘ভালনারেবিলিটি’ বিষয়ক শুভেচ্ছাদূত; অটিজম ও নিউরোডেভেলপমেন্টাল ডিসঅর্ডারস বিষয়ক বাংলাদেশের জাতীয় অ্যাডভাইজরি কমিটি এবং সূচনা ফাউন্ডেশনের চেয়ারপার্সন হিসেবে ভূমিকা পালন করছেন।সায়মা ওয়াজেদ
নাজিশ আরমান, লিড কো-অর্ডিনেটর, কনটেন্ট ডেভলপমেন্ট, সূচনা ফাউন্ডেশন@নাজিশ আরমান