নীতি-পুলিশিংয়ের মাধ্যমে আমাদের সমাজে কিছু পশ্চাৎপদ ব্যক্তির নিজস্ব চিন্তাভাবনা, নৈতিকতার ধারণা অন্যের ওপর চাপিয়ে দেওয়া বা মানতে বাধ্য করার চেষ্টা করা হয়।
Published : 15 Feb 2024, 04:20 PM
আমাদের দেশ এমনিতে ঘুষ-দুর্নীতির স্বর্গরাজ্য। এখানে লাম্পট্য, নারী নির্যাতন, কেড়ে ও মেরে খাওয়া, ঠকবাজি, প্রতারণা, অমানবিকতা, খাদ্যে ভেজাল, জিনিসপত্রের কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে, দাম বাড়িয়ে মুনাফা লাভ, অনৈতিক উপায়ে টাকা কামানো, ট্যাক্স ফাঁকি দেওয়াসহ অসংখ্যা খারাপ কাজ করার লাইসেন্স নিয়ে সবাই চলে। জাল-জোচ্চুরি-ঠকবাজি-প্রতারণা-মিথ্যাচার, অবৈধভাবে অর্থ উপার্জন নিয়ে কেউ এখানে প্রশ্ন করে না। শোষণ, বঞ্চনা, বৈষম্য, নারী ও শিশুর প্রতি সহিংসতার বিরুদ্ধেও কোনো প্রতিবাদ নেই।
কিন্তু কোনো মেয়ে একা একা তার নিজের পছন্দের পোশাক পরে হাঁটলে, প্রিয়জনের সঙ্গে পার্কে কিংবা কোনো নির্জনে গেলে, টিপ পরলে, মাথায় কাপড় না দিলে আমাদের দেশের এক শ্রেণির মানুষের মধ্যে নীতি-নৈতিকতার উথাল-পাথাল ঢেউ সৃষ্টি হয়। তারা এই ‘বেহায়াপনা’র জন্য ক্রুদ্ধ হন, পারলে পিটিয়ে-দোররা মেরে তাদের বাপের নাম ভুলিয়ে দিতে চান।
এটাকে অনেকে মরাল পুলিশিং বলে থাকে। যদিও এর মধ্যে মরালিটি কিংবা এথিক্সের খুব একটা বালাই নেই। অপ্রাপ্তি ও বঞ্চনা-ঘেরা স্থূলবুদ্ধিসম্পন্ন কিছু মানুষের অকারণ ক্রোধেরই প্রকাশ মাত্র।
হ্যাঁ, যদি আমাদের দেশের মানুষ ঘুষ-দুর্নীতি, বৈষম্য, নারী নির্যাতন, অন্যায়-অবিচার-দুঃশাসনের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতো, তা হলে বোঝা যেত, তারা মরালিটি কিংবা এথিক্স দিয়ে চালিত। এদেশে খবরদারি কিংবা পুলিশগিরি চলে কেবল দুর্বলের উপর। বড়লোক, ক্ষমতাবানদের ক্ষেত্রে তথাকথিত ‘ব্যাটা’দের ব্যাটাগিরি বা পুলিশগিরি কখনো মাথা চাড়া দিয়ে উঠে না। যখন একাকী কাউকে কিংবা কোনো দুর্বল জুটিকে পায়, তখন তাদের মধ্যে ‘নৈতিকতা’ ও ‘পুলিশি সত্তা’ জেগে ওঠে।
নিজে মানুষ হননি, সন্তানকে মানুষ বানাতে পারেননি, কিন্তু আরেকজনের পোশাক, আচরণ, করণীয় নিয়ে তাদের দুশ্চিন্তার কোনো শেষ নেই। এই ভণ্ডামি আমাদের সমাজে প্রায়ই দেখা যায়। শালীনতা, নৈতিকতা, সামাজিক রীতি-নীতির দোহাই দিয়ে হঠাৎ-হঠাৎ-ই এক শ্রেণির ‘গাঁয়ে মানে না, আপনি মোড়ল’ গোছের মানুষ ক্ষেপে ওঠে। তেতে ওঠে। যেমন সম্প্রতি একদল মানুষ ক্ষেপে উঠেছে খন্দকার মুশতাক আহমেদ ও সিনথিয়া ইসলাম তিশা নামের এক দম্পতির বিরুদ্ধে।
তাদের অপরাধ হচ্ছে, তারা বয়সে অসম এবং প্রেম করে বিয়ে করেছেন। এরপর বইমেলায় নিজেদের নিয়ে দুটো বই প্রকাশ করেছেন। এজন্য এই দম্পতিকে রীতিমতো ধাওয়া করে, তাদের বিরুদ্ধে স্লোগান দিয়ে বইমেলা থেকে বের করে দেওয়া হয়েছে। প্রশ্ন হলো, মুশতাক-তিশার বিয়ে কি আইনবিরুদ্ধ? তারা কি বই লিখতে পারবেন না? মেলায় আসতে পারবেন না? একজন মানুষ, আরেকজন মানুষের সম্মতির ভিত্তিতে যদি কোনো জীবন গড়ে তোলেন, সেখানে পাহারাদারি করার এখতিয়ার অন্য মানুষের আছে কি?
আর তারা কী বই লিখতে, সেটা প্রকাশ করতে পারবে না? স্রেফ বেশি বয়সী একজন মানুষের কমবয়সী একজন মেয়েকে বিয়ে করা যদি অপরাধ হয়, তাহলে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে না কেন? তথাকথিত নৈতিকতার দোহাই দিয়ে একজন নাগরিককে প্রকাশ্যে স্ত্রীসহ নিগৃহীত করা কোনো সভ্য সমাজের কাজ হতে পারে না। অসম বিবাহ অনৈতিক নয়। অসম বিবাহকে নিরুৎসাহিত করা যেতে পারে। মুশতাক-তিশার সঙ্গে মেলায় যা ঘটেছে তা অবশ্যই নিন্দনীয় এবং অন্যায়।
খন্দকার মুশতাক আহমেদ যা করেছেন, তার সমালোচনা হতে পারে। এভাবে একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ম্যানেজিং কমিটির প্রবীণ সদস্য হিসেবে একই প্রতিষ্ঠানের কোনো শিক্ষার্থীকে বিয়ে করা উচিত কিনা, তা নিয়েও তর্ক হতে পারে। যৌক্তিক আলোচনা হতে পারে। তাদের উপেক্ষা করা যেতে পারে। তাদের বইকেও উপেক্ষা করা যেতে পারে। কিন্তু এই দম্পতিকে অপমান-লাঞ্ছনার মাধ্যমে মেলা থেকে বের করে দেওয়া এক ধরনের অপরাধ। মস্তানি। এটা সমর্থনযোগ্য নয়।
যে সব মানুষ মুশতাক-তিশার বিরুদ্ধে মিছিল করেছে, তারা কি কখনো অনৈতিক উপায়ে আঙুল ফুলে কলাগাছ হয়ে যাওয়া কোনো ব্যক্তির বিরুদ্ধে এমন প্রতিবাদী মনোভাব পোষণ করেছেন? কখনো কোনো নারী নির্যাতনের প্রতিবাদ করেছেন? ঋণখেলাপী, দেশের টাকা বিদেশে পাচারকারী, গণতন্ত্রহত্যাকারী— কারো বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছেন? তাহলে কেন মুশতাক-তিশার বিরুদ্ধে এত ক্ষোভ? তারা দুর্বল বলে?
দুজন প্রাপ্ত বয়ষ্ক মানুষ নিজেরা বিয়ে করে সংসার করছেন। তারা কারো কোনো ক্ষতি করেননি। রাষ্ট্রীয় আইন লঙ্ঘন করেননি। এটা নিয়ে তাদেরকে অপমান করা কিংবা তাদের বই ছিড়ে ফেলার অর্থ তাদের ব্যক্তি স্বাধীনতা ও মত প্রকাশের স্বাধীনতার উপর হস্তক্ষেপ করা। এই দায়িত্ব রাষ্ট্র কাউকে দেয়নি। নিজ দায়িত্বে যারা এমন পুলিশগিরি করেছেন, সরকারের উচিত, তাদের খুঁজে বের করা। আইনের আওতায় আনা।
নীতি-নৈতিকতার নামে এ ধরনের পুলিশগিরি সমাজের জন্য ক্ষতিকর। কারণ এটা নির্যাতনের একটি হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহৃত হয়। নীতি-পুলিশিংয়ের মাধ্যমে আমাদের সমাজে কিছু পশ্চাৎপদ ব্যক্তির নিজস্ব চিন্তাভাবনা, নৈতিকতার ধারণা অন্যের ওপর চাপিয়ে দেওয়া বা মানতে বাধ্য করার চেষ্টা করা হয়। এর মাধ্যমে অন্যজনের স্বাধীনতায় ব্যাঘাত সৃষ্টি করা হয়। ওই ব্যক্তির চিন্তা, পোশাক বা জীবনযাপন নিয়ে ঠিক বা ভুল, ন্যায় বা অন্যায় শনাক্ত করার চেষ্টা করা হয়। এই পুলিশগিরি যারা করেন, তারা মূলত তাদের ক্ষমতার অপব্যবহার করে সেটা করে থাকেন।
বাংলাদেশের সংবিধানের ৩৯ অনুচ্ছেদ এ দেশের মানুষকে বাক্ ও ভাবপ্রকাশ এবং চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দিয়েছে। এই সংবিধানেই বলা আছে, জীবন ও ব্যক্তিস্বাধীনতা থেকে কোনো ব্যক্তিকে বঞ্চিত করা যাবে না। তার স্বাধীনভাবে চলাচলের, সভা–সমাবেশের অধিকার আছে। সেই অধিকার হরণ যারা করে, রাষ্ট্রকেই তার বিরুদ্ধে এগিয়ে আসতে হবে।
দেশের নানা প্রান্তে সামাজিকতার স্বঘোষিত ধ্বজাধারীরা অতিশয় সক্রিয় হয়ে উঠছেন। আইন-কানুন, সংবিধান বা সভ্য সামাজিকতার তোয়াক্কা করছেন না তারা। বেপরোয়া স্বেচ্ছাচারে মেতে উঠছেন। নিজেদের নাগরিক অধিকারের সীমা লঙ্ঘন করছেন। অন্যের নাগরিক অধিকার হরণ করছেন। সামাজিকতা বা অসামাজিকতার ব্যাখ্যা করছেন নিজেদের মতো করে।
সভ্যতা কিন্তু আমাদের এ পথে এগুনোর শিক্ষা দেয়নি। সভ্যতার সড়ক যত এগিয়েছে, তত প্রশস্ত হয়েছে। সভ্যতার শিক্ষা যত প্রসারিত হয়েছে মানবজাতি ততই উদার হয়েছে, ঋদ্ধ হয়েছে। সভ্যতার এই সুদীর্ঘ যাত্রাপথে সামাজিক অসহিষ্ণুতাও মাঝেমধ্যেই হানা দিয়েছে, কুসংস্কার মাথা চাড়া দিয়েছে, সামাজিক বিকৃতি বিচলিত করেছে, সামাজিক বিচারের নামে কখনও স্বেচ্ছাচারিতা, কখনও গোঁড়ামি, কখনও অন্ধত্বের চর্চা হয়েছে। সভ্যতার অগ্রগতির পথে সেগুলো বাধা ঠিকই। কিন্তু সে বাধা কখনোই এত বড় হয়ে উঠতে পারেনি, যে সভ্যতার অগ্রগতির প্রবাহকে সে রুখে দেবে। বাধা-বিপত্তি মাথা তুলেছে, আবার ভেসেও গিয়েছে সুশিক্ষার তোড়ে।
সভ্যতার দিশা নির্দেশ আমাদের সকলকেই পড়তে জানতে হবে। সঙ্কীর্ণতা পেছনে ফেলে উদার মানবতার মহাসড়কে উপনীত আমরা। সামাজিক মাৎস্যন্যায় এবং স্বেচ্ছাচারিতাকে পেছনে ফেলে গণতান্ত্রিক কাঠামো নির্মাণে উন্মুখ আমরা। এ কাঠামোয় আইনের শাসনই শেষ কথা। এ কাঠামোয় গণতান্ত্রিক মূল্যোবোধই সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ। স্বঘোষিত নীতি-পুলিশদের ঠাঁই এ কাঠামোয় নেই। সামাজিক নিশ্বাসে লুকিয়ে থাকা কিছু অন্ধকার এখনও লালন করে গোঁড়া, অসহিষ্ণু, মধ্যযুগীয় মানসিকতাকে। কিন্তু তার কাছে আত্মসমর্পণ করলে চলবে না। তার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হয়, সামাজিক আবর্জনাগুলোকে ভাগাড়ে নিক্ষেপ করতে হয়। না হলে পথ ভুল হওয়ার আশঙ্কা থাকে।
অনুদারতা দিয়ে মহৎ সমাজ গড়া যায় না। মানুষকে, প্রত্যেকটি সত্তাকে সম্মান করতে হবে। মনে রাখতে হবে সবার উপরে মানুষই সত্য। মানুষকে অপমান-অপদস্থ করে কোনো সভ্য সমাজ প্রতিষ্ঠিত হয় না।