Published : 22 Jul 2023, 04:15 PM
অটো ড্রাইভার খোকন মিয়ার বাড়ি ঘুলিগাঁও। সোমেশ্বরী নদী থেকে কিছুটা দূরে। কিন্তু দূরের এই নদীই আজ তাকে জমিন থেকে রাস্তায় নামিয়েছে। সোমেশ্বরীতে এখন রক্ত নাই। হাড়, মাংস, মজ্জা সব টেনে হিঁচড়ে ট্রাকের পর ট্রাকে করে নদীর লাশ যাচ্ছে শহরে। নদীর লাশের টুকরার নাম ‘বালু বাণিজ্য’। আর এই বাণিজ্যের কারণে মাছধরা ও কৃষিকাজ কমেছে চারধারে। কিছু পুরুষ মানুষের গাড়ি চালানোর নতুন কাজ জুটেছে। নেত্রকোণার দুর্গাপুরের কুল্লাগড়া ইউনিয়নের সাবেক কৃষক বর্তমানে অটোচালক খোকন মিয়াও এমনই একজন। তবে বিরিশিরির রাস্তায় এখন অটো কম। পর্যটক শূন্য। উৎরাইলের আদিবাসী পোশাক ও হস্তশিল্প আর খাবারের দোকানগুলো উঠে গেছে। কারণ বিরিশিরিতে আসা-যাওয়া এখন এক বিরক্তিকর দমবন্ধ যন্ত্রণা। বিরিশিরি থেকে ময়মনসিংহ পর্যন্ত ৫৬ কিলোমিটারের রাস্তা নিয়ন্ত্রণ করে বালুর ট্রাক। ভেজা বালু আর পানি ঝরিয়ে ওভারলোড ট্রাকগুলো রাস্তাগুলোকে চুরমার করে কাদাময় করে রাখে প্রতিদিন।
অটো চালিয়ে চলে না খোকন মিয়ার। কিন্তু আহাদ আর মাকে ফেলে যাওয়ার উপায় নেই তার। আর ওই বালুর ট্রাকের কারণেই তাদের এই দুর্দশা। ২ মাস বয়সের আহাদকে রেখে রাস্তায় মারা যান মৌসুমী। জরায়ু সমস্যার কারণে পেটে পানি এসেছিল। একটা গাড়িতে করে তাকে ময়মনিসংহ নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল। কিন্তু বালুর ট্রাকের কারণে সেই গাড়ি কোনোমতে শ্যামগঞ্জ যেতে পেরেছিল। রাস্তাতেই মারা যান মৌসুমী। স্ত্রীর মৃত্যুর পর আহাদের বাবা অন্যত্র বিয়ে করেন। অনাথ আহাদকে বাড়িতে এনে লালনপালনের দায়িত্ব নেন খোকন মিয়া। খোকন মিয়ার মায়ের পা ভেঙেছিল। ময়মনসিংহ থেকে প্লাস্টার করে ফেরার পথে বালুর ট্রাকের তৈরি খানাখন্দ ভরা রাস্তায় ঠ্যাকনা খেয়ে পায়ের প্লেট নড়ে যায়। অসুস্থ সেই মা এখন বিছানায়, আর হাসপাতাল নেয়া সম্ভব হয়নি। কেবল আহাদ বা খোকনের মা নয়, বালুর ট্রাকের কারণে খোকন মিয়ার শ্বশুর ফলাশগড়ার আবদুর রহমানও রাস্তায় মারা যান। ২০২২ সনের জুনে তার করোনা হয় এবং তীব্র শ্বাসকষ্ট শুরু হলে ময়মনসিংহ নেয়ার পথে বালুর ট্রাকে আটক রাস্তায় তারও নিদারুণ মৃত্যু ঘটে।
এমন ঘটনা বিরিশিরিতে এখন অহরহ ঘটছে। বালুর ট্রাকের কারণে সাধারণের নিরাপদ যাতায়াত দুর্বিষহ হয়েছে। রাতের যে গাড়িগুলো ঢাকা থেকে দুর্গাপুর যায় তারা ভোরে এসে ঝারিয়া আটকে থাকে। অসহায় মানুষ হেঁটে, অটোতে করে বিরিশিরি পৌঁছাতে দুপুর গড়িয়ে যায়। যদিও দুই ঘন্টা অন্তর বালুর ট্রাক এবং পাবলিক গাড়ি যাতায়াতের নিয়ম করা হয়েছে কিন্তু সেটি রাস্তায় আটকে থাকা বালুর ট্রাকের কারণে সম্ভব হচ্ছে না। এলোপাথারি বালু-পাথর উত্তোলনে ভাঙন বেড়েছে এলাকায়, বিলীন হয়েছে বহু গ্রাম। এলাকা ছাড়ছে মানুষ। পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্য পড়েছে ঝুঁকিতে।
সোমেশ্বরীকে ছিন্নভিন্ন করা এই বালু-বাহাদুরির বিরুদ্ধে নানা সময়ে স্থানীয়রা প্রতিবাদ জানিয়েছেন। গড়েছেন আন্দোলন। রাষ্ট্র নানাসময়ে বালু-উত্তোলন নিয়ন্ত্রণ করতে প্রজ্ঞাপন জারি করেছে, চালিয়েছে কিছু প্রশাসনিক তৎপরতা। কিন্তু ক্ষত-বিক্ষত সোমেশ্বরীর ওপর নির্দয় আঘাত থামছেই না। যন্ত্রণায় অতিষ্ঠ সোমেশ্বরী তীরের প্রবীণজনেরা নদীটিকে কেটে আস্ত তুলে নিয়ে যেতে বলেছেন বালু-ব্যবসায়ীদের। কিন্তু কোথায় যাবে এই ঐতিহাসিক জীবন্ত আন্তঃসীমান্ত নদী? কোথায় গেলে মিলবে নদী জীবনের নিরাপত্তা? অথচ মহামান্য হাইকোর্ট ঘোষণা করেছে, নদী এক জীবন্ত ব্যক্তিসত্তা।
সিমসাং থেকে সোমেশ্বরী
সোমেশ্বরী নদী বিষয়ে পর্যাপ্ত তথ্য বিবরণ নেই। সুসংয়ের মহারাজা ভূপেন্দ্রচন্দ্র সিংহ বাহাদুর বাংলা ১৩৩৬ সালে ‘সৌরভ’ পত্রিকায় কয়েক কিস্তিতে শিকারকাহিনি লিখেছিলেন। ওইসব শিকারকাহিনি সংগ্রহ করে ‘গারো পাহাড়ে শিকারকাহিনি’ শিরোনামে একটি বই প্রকাশিত হয়েছে ২০১৮ সালে। বইটিতে বলা হয়েছে সোমেশ্বর পাঠকের নামে নদীটির নাম হয় ‘সুমেশ্বরী’। ২০০৬ সালে বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) প্রকাশিত ‘বাংলাদেশের নদ-নদী’ পুস্তকে নদীটির নাম লেখা হয়েছে ‘সুমেশ্বরী’। এর আইডি নং-২৮০। বইটিতে উল্লেখ আছে, নেত্রকোণা ও সুনামগঞ্জ জেলার নদী সুমেশ্বরী ভারতের মেঘালয় রাজ্যের গারো পাহাড় হতে উৎপন্ন হয়ে নেত্রকোণার দুর্গাপুরে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে এবং সুনামগঞ্জের জামালগঞ্জে বাউলাই (বালই) নদীতে মিশেছে। ১১৩ কিলোমিটার দীর্ঘ এই নদীর অববাহিকা উল্লেখ করা হয়েছে ১১৯৭ বর্গকিলোমিটার।
উত্তর-পূর্ব ভারতের মেঘালয় রাজ্যের তুরা-চিকমাং পাহাড়ের রংচু মালভূমির শিজুরেওয়াক এলাকার চি-খাসিন ঝর্ণা থেকে জন্ম নিয়েছে চি-খাসিন ও সিমসাং নদী। চি-খাসিন পূর্ব-দক্ষিণে প্রবাহিত হয়ে ফান্দা গাং নামে বাংলাদেশে প্রবেশ করে। পশ্চিম দিকে সিমসাংগিরি হয়ে সিমসাং বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে এবং সোমেশ্বরী নামে প্রবাহিত হয়েছে। মান্দি নদীপুরাণ মতে, চি-খাসিন পুরুষ এবং সিমসাং নারী। এরা স্বামী-স্ত্রী। কিন্তু কোনোভাবেই এদের মিলন হচ্ছিল না। ১৯৮৮ সনের বন্যা ও পাহাড়ি ঢলে সিমসাং বা সোমেশ্বরীর একটি শাখা আত্রাখালি নামে পূর্বে প্রবাহিত হয়ে নাগাবগা বিলে ফান্দা নদী বা চি-খাসিনের সাথে মিলিত হয়। কিন্তু সিমসাং কীভাবে সোমেশ্বরী হয়ে গেল? বলা হয়, বৈশ্যা গারো একসময় ছিলেন সুসংয়ের অধিকর্তা। ১২৮০ সালের দিকে সোমেশ্বর পাঠক নামের এক ব্রাহ্মণ দলবলসহ সিমসাং তীরে সুসংয়ে আসেন। কৌশলে বৈশ্যা গারোকে আক্রমণ করে সুসং দখল করেন এবং সোমেশ্বরের নামেই সিমসাং হয়ে যায় সোমেশ্বরী। বাংলাদেশে প্রবেশের পর সোমেশ্বরী কমলাবাড়ি ও রানীখং দিয়ে সোজা দক্ষিণে প্রবাহিত হয়ে সুসং দুর্গাপুরে এসে পূর্ব-দক্ষিণে বিরিশিরিতে এসে দুটি ধারায় প্রবাহিত হয়। সোমেশ্বরীর আদি প্রবাহ বালুচরে প্রায় রুদ্ধ হয়ে যায় এবং কুমুদগঞ্জ বাজারের পশ্চিমে দু’ভাগ হয়ে আনন্দপুর সালজান বকজান এলাকায় উবদাখালী নদী নামে কলমাকান্দা দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। সোমেশ্বরীর নয়াপ্রবাহটি কুমুদগঞ্জ বাজারের পূর্ব-দক্ষিণে প্রবাহিত হয়ে সিধলীতে কংশ নদীর সাথে মিলে নেত্রকোণার বরাইলে কংশ নাম ধারণ করে প্রবাহিত হয়েছে। ষাটের দশকে সোমেশ্বরীর আদিপ্রবাহটি বিরিশিরি এলাকায় বালুচর পড়ার কারণে বন্ধ হয়ে গেছে এবং নতুন প্রবাহ শিবগঞ্জ দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। শিবগঞ্জ দিয়ে প্রবাহিত নতুন শাখাটিই একসময় আশেপাশের গ্রামবসতি চুরমার করে নতুন সোমেশ্বরী নদী হয়ে ওঠে। আগে সোমেশ্বরীতে আড়াআড়িভাবে একটা নৌকা রেখে পারাপার হওয়া যেত কিন্তু বালু উত্তোলনের ফলে নদীর প্রশস্থতা দিন দিন বেড়েছে।
সোমেশ্বরীতে কী কুমির আছে?
বহেরাতলীর জোৎস্না মানখিন কিংবা দিজারসন চাম্বুগং, কামারখালীর সেবিকা রূগা অনেকেই বলেছেন রানীখংয়ের উপরের দিকে কুমির থাকে এবং শীতকালে আগে দেখা যেত। কাউকে তিনদিন নদীতে খুঁজে পাওয়া না গেলে তারা মনে করতেন তাকে কুমিরে খেয়েছে। আচিক ভাষায় আরেংকা মানে কুমির। একসময় সোমেশ্বরীতে বর্ষাকালে পাহাড়ি ঢলের সময় কুমিরের ভয় ছিল। রানীখং গীর্জা দেশের এক প্রাচীন খ্রিস্টিয় ধর্মস্থল। বহু বিদেশি ধর্মযাজক এখানে বহুদিন কাজ করেছেন। তাদেরই একজন রেভা: ফাদার রবার্ট জে ওয়াই চেলিস সিএসসি। পাহাড়ি ঢলে ভেসে আসা লাকড়ি ধরার জন্য এই ধর্মযাজক স্থানীয় অনেকের সাথে সোমেশ্বরীতে নেমেছিলেন। দিনটি ছিল ১৯৪৮ সালের ২৩ মে দুপুরবেলা। হঠাৎ তিনি নদীতে হারিয়ে যান। তিনদিন পর তার লাশ ভেসে ওঠে। অনেকে বলে তাকে কুমিরে ধরেছিল। আবার অনেকে বলে বুগারানী তাকে ধরেছিল। বহুবছর পর বাদামবাড়ির রেখা দাজেলের ভাইকেও সোমেশ্বরীতে কুমির আক্রমণ করেছিল বলে শোনা যায়। এখনো কুমির ও বানীহর বা কারেন্ট মাছের ভয়ে অনেকে পাহাড়ি লাকড়ি ধরতে যায় না।
১৩৩৬ সালে প্রকাশিত মহারাজা ভূপেন্দ্রচন্দ্র সিংহের শিকারকাহিনি থেকে জানা যায়, এই এলাকায় বর্ষাকালে ‘কুম্ভীর’ দেখা যেত। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের মৎস্যবিজ্ঞান বিভাগের বিকে চক্রবর্ত্তী এবং এম জে এ মির্জা সোমেশ্বরী নদীর জলজ প্রাণসম্পদের ওপর করা এক গবেষণায় নদীতে ৬৬ প্রজাতির মাছ, তিন প্রজাতির চিংড়ি, এক প্রজাতির কাঁকড়া ও চার প্রজাতির সরীসৃপ শনাক্ত করেন। গবেষণাটি ২০১০ সনে ‘এশিয়ান ফিশারিজ সাইন্স’ জার্নালে প্রকাশিত হয়। উক্ত গবেষণায় কুমিরের কোনো অস্তিত্ব মেলেনি। কিন্তু আসলেই কি সোমেশ্বরীতে কুমির আছে? নিশ্চিতভাবে এখনো আমরা এর উত্তর জানি না।
রানীখংয়ের বুগারানী কোথায়?
কুমির আছে কি নেই এ নিয়ে তর্ক জারি থাকলেও সোমেশ্বরীর বুগারানীর অস্তিত্ব বিলীন হয়েছে। সোমেশ্বরীর দীর্ঘপ্রবাহে রানীখং, আগ্রং ডোবা, ভুঙ্গাই ডোবা ও গঘগাওয়ারীর মতো বহু পবিত্র ও কিংবদন্তিস্থল গড়ে উঠেছিল। মান্দিদের আচিক ভাষায় খং মানে গর্ত। রানীখং টিলার নিচে ডোবার ভেতর গর্তগুহায় বুগারানী নামের এক মৎস্যকুমারী বাস করত। বুগারানী এই খংয়ে থাকত বলেই এই টিলার নাম হয় রানীখং। প্রায়ই বুগারানী গুহা থেকে বের হয়ে রোদ পোহাত এবং কারোর ক্ষতি করত না। সোমেশ্বরীর তিন কিলোমিটার পশ্চিমে টিলাঘেরা ভুঙ্গাই ডোবা। এই ডোবায় প্রচুর মাছ ছিল, তবে কুমিরের ভয়ে কেউ মাছ ধরতে যেত না। রানীখং আর ভুঙ্গাই ডোবার ভেতর সোমেশ্বরীতে সুড়ঙ্গপথ ছিল। বুগারানী এক খং থেকে আরেক খংয়ে চলাচল করত। সোমেশ্বরীর উজানে বাঘমারা ও ভবানীপুরের কাছে আগ্রংওয়ারী। একসময় এখানে প্রচুর মাছ ও ঘড়িয়াল ছিল। গঘগাওয়ারীর অবস্থান মেঘালয় পাহাড়ের বাঘমারা অংশে। কিংবদন্তীর এই বুগারানী বিষয়ে আমাদের জানাবোঝা জরুরি।
বিলীন হয়েছে বহু আদি গ্রাম
মহারাজা ভূপেন্দ্রচন্দ্র সিংহের শিকারকাহিনি থেকে জানা যায়, বাংলা ১৩০৪ সালে এক প্রলয়ংকরী ভূমিকম্পে সুসংয়ের পূর্বদিকের অনেক বিল ভরাট হয়ে যায়। পরবর্তীতে এসব জায়গা বাইরে থেকে আসা মানুষের আবাসস্থল হয়ে ওঠে। ২০০৬ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর দৈনিক সংবাদে প্রকাশিত এক প্রতিবেদন জানায়, ...সোমেশ্বরী নদীর ভাঙ্গনে ডাকুমারা, ইসলামপুর, কামারখালীসহ পাঁচটি গ্রামের প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ বিলীন হয়ে গেছে। ‘বৃহত্তর ময়মনসিংহের বিপন্নপ্রায় পাহাড়ি নদ-নদীর কথা’ বইতে লেখক ধীরেশ চিরান গত পঞ্চাশ বছরে সোমেশ্বরীর ভাঙনে বিলীন হওয়া ২০-৩০টি বিলীন হওয়া গ্রামের নাম উল্লেখ করেছেন। কামারখালি, বিজয়পুর, বড়ইকান্দি, দেবদৈল, নললুয়া, আত্রাখালি, ভুলিপাড়া, নয়াপাড়া, কুল্লাগড়া, শিবগঞ্জ, ভবানিপুর, বারইপাড়া, বিরিশিরি, উৎরাইল, গোহালীদেউ, ভুলিগাঁও, বনগাঁও, কৃষ্ণেরচর, শ্রীপুর, ভাদুয়া, জারিয়া ঝানঝাইল এইসব নামে এখনো গ্রাম থাকলেও আদি গ্রামগুলি বিলীন হয়ে আবার নতুন গ্রাম গড়ে ওঠে।
সোমেশ্বরীর তীরেই কুল্লাগড়া ইউনিয়নের প্রাচীন মান্দি গ্রাম বড়ইকান্দি। পূর্বে গ্রামে ৫০০ পবিার থাকলেও স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে এসে বর্তমানে মাত্র ১২টি মান্দি পরিবার টিকে আছে। নদীর পাড় ভাঙনে উচ্ছেদ হয়ে কেউ কেউ পাশের কুড়ালিয়া, কামারখালী ও বুলিপাড়া গ্রামে গেছে। তবে অধিকাংশই ময়মনসিংহ, ঢাকা, চট্টগ্রাম চলে গেছে। কালাচান মিয়া ঢাকায় গার্মেন্টসে কাজ করতে যায়, নবী হোসেন চট্টগ্রামে দিনমজুরি করে, আলী হোসেন ঢাকায় গার্মেন্টসে কাজ করে। গ্রামের মেহের মানখিন ঢাকায় চলে যায়, মেয়েরা এখন পার্লারে কাজ করে। কামারখালী গ্রামের আদিনাম নিরোদগঞ্জ। গ্রামটিতে বাঙালি হিন্দু কামার ও মান্দিদের বসবাস ছিল। দেশভাগের পর কামারেরা গ্রাম ছেড়ে চলে গেলে গ্রামটি কামারখালী নাম পায়। এখনো মাটি খুঁড়লে কামারদের ব্যবহৃত বহু বাসনপত্রের নমুনা পাওয়া যায়। নদীর পাড় ভাঙনে আদি কামারখালী বিলীন হয়েছে, বদলে গেছে জনমিতির ধরন।
বর্তমানে গ্রামে বাঙালি মুসলিম বেশি, প্রায় ২১০ পরিবার। মান্দি ৪০ পরিবার ও বাঙালি হিন্দু ৫ পরিবার। বহেরাতলী গ্রামে নদীর পাড়ে একটি খেজুর গাছ শেষ চিহ্ন হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। গ্রামের শিপ্রা রিছিলদের ১ একর ৯০ শতক জমি নদীভাঙনে বালুতে তলিয়ে গেছে। ফলদ ও বনজ গাছের একটি বাগান ছিল। এই জায়গা মান্দি উত্তরাধিকার আইন অনুযায়ী পরিবারের নকনা (গোষ্ঠী মনোনীত সম্পত্তির উত্তরাধিকার হিসেবে কনিষ্ঠ কন্যা) হিসেবে তার মা মেরী রিছিল পেয়েছিলেন। ড্রেজার মেশিনের কারণে গ্রামের ৪ ভাগের এক ভাগ ভেঙে এখন বালুচর হয়ে গেছে। কয়েক বছরের ভেতর শত পরিবার উচ্ছেদ হয়েছে। কেউ কেউ বনবিভাগের টিলায় আশ্রয় নিতে পেরেছে। গ্রামের পৌঢ়জনেরা জানান, ‘আগে নদীর পাড়ে বইয়া গান কইছি, গল্প করছি, এখন আর আড্ডা মারি না, ভাল লাগে না। মন ভাইংগা গেছে গা। তারপরও নিজের ভিটাবাড়ি ছাইড়া যাইতে কার মন চায়? জীবনে কল্পনাও করি নাই নদীতে ঘরবাড়ি যাইব? অষ্টাশির বন্যায় কিচ্ছু হয় নাই, ড্রেজার মেশিন বহানোর পরে করোনার ভিতরে বন্যায় সব গেছে গা।’ বহেরাতলীর সুরমা রেমাদের ৬০ শতাংশ জমি বালুর নিচে তলিয়ে গেছে। শান্ত চাম্বুগংয়ের ২৪ শতক বালুর তলে চলে গেছে। কামারখালীর অনুপমা রিছিল নদীভাঙনের কারণে বসতভিটা তিনবার বদল করতে বাধ্য হয়েছেন।
পানির স্তর নামছে নিচে
অবিরাম বালু উত্তোলণের ফলে নদীর আশেপাশের গ্রামগুলোতে পানির আকাল তৈরি হয়েছে। অধিকাংশ নলকূপে পানি উঠছে না। আগেরদিনে ৪০-৫০ ফুট নিচে পানি পাওয়া গেলেও এখন ৯০-১০০ ফুট নিচেও পানি মিলছে না। ৩০০-৪০০ ফুট নিচে গিয়ে গভীর নলকূপে পানি মিলছে কোথাও। ড্রেজার মেশিনগুলো লম্বা পাইপ ঢুকিয়ে পানিসহ বালু টেনে তোলে, যার ফলে অনেক জায়গায় মাটির তলায় শূন্যস্থান তৈরি হয়ে ভূমি ধসে যাচ্ছে। বহেরাতলীর ২০০ শতক একটি জায়গা ৬০ ফুট গভীর হয়ে দেবে গেছে। মাটি ধসে তৈরি হওয়া এসব চোরাগর্তকে স্থানীয়ভাবে ‘চোরাবালি’ বলা হয়। এরকম চোরাবালিতে পড়ে বাইরে থেকে ঘুরতে আসা পর্যটকও মারা গেছে। অপরিকল্পিত বাণিজ্যিক বালু-পাথর উত্তোলন দেশের অন্যত্রও এমন বিপদজনক চোরাগর্ত তৈরি করেছে, যা অনেক প্রাণহানিরও কারণ হয়েছে। সিলেটের গোয়াইনঘাটের জাফলংয়ে বালু-পাথর উত্তোলনের ফলে পিয়াইন নদীতে তৈরি হওয়া বিপদজনক খাদে পড়ে বহুমানুষ মারা যায়। ২০০৩ থেকে ২০১০ পর্যন্ত যে পনের জন মারা যায় তাদের একটি স্মৃতিফলক জাফলংয়ে টানিয়েছে সিলেট জেলা প্রশাসন।
চিমুকনি চি থেপ্পা
মান্দি ভাষায় ‘চিমুকনি চি থেপ্পা’ মানে পাহাড়ের পাতাল থেকে আসা ঝিরির পানি এখন বন্ধ। প্রাকৃতিক পানিপ্রবাহ বন্ধের কারণে ঝুঁকিতে বাস্তুতন্ত্র এবং নিশ্চিহ্ন হচ্ছে প্রাণের বৈচিত্র্য। চিজং (কাছিম), চেপ্পা (কচ্ছপ), নাচিগলদ্দাং (বাইলা), নাওয়াল (চেলা), নাদাং (বাইম), চিচগুদা (পটকা), কাতলা, রুই, মহাশোল, চিন্না, লাসো, ঘাউড়া, টেংরা, পুঁটি, দাইরা (রানী), চিচুগত্যা, বামবরা, চেলা, চান্দা মাছ দেখা যেত সিমসাং নদীতে। কলংকি, ওয়ানক, ওড়া, বুড়ো, মরাল বাঁশ আগে পাওয়া গেলেও এখন কলংকি বাঁশ একেবারেই দেখা যায় না। মরাল বাঁশ দিয়ে মান্দিরা মাচাং ঘর নকমান্দি বানাত। আগেরদিনে বর্ষা মওসুমে পাহাড়িঢলের সময় পাহাইড়া লাকড়ি ধরা হতো আর শুকনো মওসুমে পাহাড় থেকে ঝরা শালপাতা ও শুকনো খড়ি সংগ্রহ হতো। শাল, কাউ, গাব, ডেউয়া, মিয়া বা বাঁশের কোড়ল, জংলী আমড়া গাছ ভেসে আসত।
সোমেশ্বরী মহাশোল মাছের ঐতিহাসিক বিচরণস্থল। কাঁঠালের কষ দিয়ে মহাশোল মাছ ধরার এক আদিপদ্ধতি চালু ছিল এখানে। সোমেশ্বরীর বহেরাতলী, শিবগঞ্জ ও কামারখালী এলাকায় গভীর পানির স্রোতে এই মাছ বেশি পাওয়া যেত। নদীর গভীরতা কমে যাওয়া, স্রোত না থাকা, অপরিষ্কার দূষিত পানি ও উজানে জাল দিয়ে মাছ ও পোণা ধরে ফেলার কারণে সোমেশ্বরীর মাছ ও জলজবৈচিত্র্য কমেছে। হরিকলী পাখি কমেছে বটগাছ না থাকার কারণে।
আগে মানুষ নদীর পানি খেত। তারপর বালু খুঁড়ে পানি তুলে সেই পানি ছেঁকে খাওয়া হতো। বাণিজ্যিক বালু উত্তোলনের ফলে এখন পানির খুব আকাল। অনেকে জানান, ‘বালি ছাঁকা পানি খাইতাম আগে, এখন সব পানি ছাঁকা বালু, বালু আর বালু।’ ২০১২ সাল থেকে দুর্গাপুরে ব্যাপকহারে বালু উত্তোলন শুরু হয়। বর্তমানে কেবল কামারখালী থেকে বহেরাতলী পর্যন্ত ১০০০ ড্রেজার মেশিন ও প্রায় ৮০০০ শ্রমিক আছে। একজন বালুশ্রমিককে জিজ্ঞেস করি, বিরিশিরি যান না? তিনি উত্তর দেন, ‘মোবাইল করবার যাই, এইখানে মেশিনের যে শব্দ কিচ্ছু শোনা যায় না’। কামারখালীর প্রনীতা মানখিন জানান, ‘পাহাড়ি এলাকাতে থাইক্যাও এখন আমরার নৌকা রাখন লাগে, অখন গরে গরে নৌকা, পাহাইড়া ঢল আইলে তহন নৌকায় রান্ধি, নৌকায় খাই’। বালু তোলার পর থেকে এলাকায় গবাদিপ্রাণি সম্পদের মহামারি শুরু হয়েছে। শূকর, হাঁস-মুরগি মারা যাচ্ছে। প্রনীতা মানখিনের উঠানভর্তি হাঁস-মুরগি ছিল। অসুখে মরেছে ৮০টি, শূকর ৩টি। জানুয়ারি-মার্চ মাসে সবচেয়ে বেশি মারা যায়। নদীর পানিতে ময়লা ফেনা দেখা গেলে বোঝা যায় খুব দ্রুত সময়ে পাহাড়ি ঢল নামবে, এটি দেখে আগে প্রস্তুতি নেয়া হতো। কিন্তু এখন পাহাড়িঢলের কোনো আগাম নির্দেশনা নাই। বোঝা যায় না কখন ঢল নামবে।
সোমেশ্বরী রক্ষা আন্দোলন
সোমেশ্বরী রক্ষায় এলাকায় গড়ে উঠেছে জনপ্রতিরোধ। রানীখং মিশন স্কুলের শিক্ষক সিস্টার লিউবা শিক্ষার্থীদের নিয়ে বালু তোলার প্রতিবাদ করে কিছুদিন স্কুলের আশেপাশে উত্তোলন বন্ধ রাখতে পেরিছিলেন। কামারখালী গ্রামের মানুষেরা ২০২০ সালে মুক্তিযোদ্ধা আবদুল হককে সভাপতি এবং মিন্টু রিছিলকে সহ-সভাপতি করে ৮ সদস্যের সোমেশ্বরী নদী ভাঙন প্রতিরোধ কমিটি’ গড়ে তোলেন। মানববন্ধন, স্মারকলিপি ও পানি উন্নয়ন বোর্ডের কার্যালয়ে সাক্ষাৎ নানাভাবে আন্দোলন জারি রাখেন। কামারখালী থেকে আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে আশেপাশে এবং ডাকুমার, বহেরাতলী, বড়ইকান্দি, শিবগঞ্জ, বিজয়পুর, নাওদাড়া গ্রামের মানুষেরাও যুক্ত হতে থাকেন। বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মের বহু শিক্ষার্থী সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করে এই আন্দোলনে এক ভিন্ন মাত্রা আনেন। আন্দোলনের ফলে পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী, জেলা প্রশাসক এবং উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ক্ষতিগ্রস্থ এলাকা পরিদর্শন করেন।
নদী রক্ষা কমিশন কী করছে?
জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন সোমেশ্বরী নদীর যেসকল সমস্যা চিহ্নিত করেছেন তার ভেতর বালুমহাল থেকে যথাযথ নিয়মে বালু উত্তোলন না করার বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ। এছাড়াও জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের ২০১৯ সালের বার্ষিক প্রতিবেদন জানাচ্ছে, সোমেশ্বরী নদী থেকে অবৈধভাবে বালু, পাথর ও কয়লা উত্তোলন করার ফলে পরিবেশ বিনষ্ট হচ্ছে। এ নদীতে জেগে ওঠা চর নদীর প্রবাহ বন্ধ করছে। নদীটি ভরাটের ফলে নাব্যতা বিলুপ্ত হচ্ছে। বালু উত্তোলনকারীগণ নদীর তীরে বালু জমিয়ে নদীর তীরভূমি তারা নিজনামে দখল করছে। সোমেশ্বরী নদী থেকে ১, ২, ৩, ৪ এবং ৫ নং বালুমহাল থেকে বালু উত্তোলনের জন্য বালুমহাল ব্যবস্থাপনা বিধি ও বলুমহাল আইন ২০১০ বাস্তবায়নের জন্য নেত্রকোণা জেলা প্রশাসনকে নির্দেশনা দিয়েছে নদী রক্ষা কমিশন। ২০১৬ সালের ২৯ জুলাই সোমেশ্বরী নদীর বালুমহাল ইজারা এবং বালু উত্তোলন বিষয়ে হাইকোর্টের ৫৩৩২/২০১৫ নং রিট মামলার আদেশ প্রতিপালনের জন্য নেত্রকোণা জেলা প্রশাসনের মাধ্যমে একটি মনিটরিং কমিটি গঠন করা হয়েছে। এই মনিটরিং কার্যক্রমের অংশ হিসেবে ২০২০ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি সোমেশ্বরী নদীর ৫টি বালুমহাল সরেজমিন পরিদর্শন করা হয়। সরেজমিনে ১, ২, ৩ নং বালুমহাল থেকে বালু উত্তোলন করতে দেখা যায় এবং ৪ ও ৫ নং বালুমহাল তখন বন্ধ ছিল। আত্রাখালীতে যে কয়টি পাম্প মেশিন ও শ্যালো ড্রেজার মেশিন বসানো ছিল মোবাইলকোর্টের মাধ্যমে সেসব জব্দ করা হয়েছিল। ২০০৯-২০১০ অর্থবছরে নদী হতে অবৈধ বালু উত্তোলন রোধে ২৪টি মোবাইলকোর্ট ও অভিযানের মাধ্যমে চল্লিশ লক্ষ তেপান্ন হাজার টাকা জরিমানা আদায় করা হয়। ২০১৯ সালের প্রথম দুই মাসেই জরিমানা আদায় হয় ১,৮৯,০০০ টাকা।
সোমেশ্বরী থেকে পাথর ও বালু উত্তোলনে অবৈধভাবে ব্যবহৃত স্টোন-ক্রাশার মেশিন অনতিবিলম্বে সমূলে বন্ধ/ধ্বংস করতে ময়মনসিংহ বিভাগীয় সংশ্লিষ্ট জেলা ও উপজেলা প্রশাসন ও নদী রক্ষা কমিটিকে কার্যকর আইন প্রয়োগের নির্দেশনা দিয়েছিল। ‘বালুমহাল ও মাটি ব্যবস্থাপনা আইন ২০১০’ এর কার্যকর ৫ ধারা অনুসারে আইন লংঘনকারী ব্যক্তি/প্রতিষ্ঠান/সংস্থার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ নিশ্চিত করতে বলা হয়েছে (পৃ. ১০১৫)। জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের বার্ষিক প্রতিবেদন (২০১৯) জানাচ্ছে, সোমেশ্বরী নদীতে ড্রেজিং/খনন প্রকল্প গ্রহণের পূর্বে পর্যাপ্ত সমীক্ষা করা হচ্ছে না এবং ভূ-গর্ভস্থ পানি অতিমাত্রায় ব্যবহারের ফলে বহুমাত্রিক সমস্যা দেখা দিয়েছে যা হ্রুাস করা জরুরি বলেও মন্তব্য করেছে নদী রক্ষা কমিশন। সোমেশ্বরী নদীর ভাঙ্গন, দখল রোধ ও নদীর সীমানাপ্রাচীর নির্ধারণের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য নেত্রকোণা জেলা প্রশাসন কর্তৃক দুর্গাপুর উপজেলা প্রশাসন ও পানি উন্নয়ন বোর্ডকে পত্র প্রেরণ করা হয়েছিল কিন্তু নদী রক্ষা কমিশনকে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে কিনা তা অবহিত করা হয়নি।
সোমেশ্বরীরে তুইল্যা নিয়া যান
মান্দিরা দাদি/নানিকে ডাকেন আম্বি। বিরিশিতে একজন আম্বিকে (নানী/দাদি) জিজ্ঞেস করি, ‘বালু কি খাওয়া যায় আম্বি?’ ক্ষোভের সাথে আম্বি উত্তর দেন, ‘বালু কি আমরা খাই, তোরাই তো বালু নিয়া খাইতাছস?’ সোমেশ্বরী নদীর ওপর অন্যায় বালু-বাহাদুরির কারণে প্রাণ-প্রকৃতি, জনজীবন-সংস্কৃতি সবই আজ বিপন্ন ও বিধ্বস্ত। অতিষ্ট অভিমানী মানুষেরা জানান, ‘... যারার কাছে নদীর কোনো মান নাই, যারার কাছে বালু বিক্রিই বড় কথা তারা এই নদীটারে কাইট্যা তুইল্যা নিয়া যাক’।
কিন্তু আমরা কি সোমেশ্বরীকে উচ্ছেদ করব তার বিচরণ-ভূবন থেকে? নদীর কি তার মতো করে বাঁচার অধিকার নাই? সংবিধান নদী সুরক্ষায় অঙ্গীকারাবন্ধ। তাহলে আমাদের সবার সামনে কেন আজ সোমেশ্বরী ক্ষতবিক্ষত? নয়াউদারবাদী বাণিজ্য দুনিয়ায় রাষ্ট্রের কাছে কে গুরুত্বপূর্ণ? প্রবহমান সোমেশ্বরী নাকি মুনাফার বালু-বাণিজ্য? সোমেশ্বরীর জীবনপ্রকৃতি সুরক্ষায় আজ এই প্রশ্নের উত্তর রাষ্ট্রকে স্পষ্ট করতে হবে।
ছবি: পাভেল পার্থ