সন্দ্বীপে জলবায়ু ক্ষতিগ্রস্তদের না বলা গল্প

জলবায়ু পরিবর্তনের জেরে বাংলাদেশের সন্দ্বীপ উপজেলা এমন এক ভয়াবহ ভবিষ্যতের দিকে আগাচ্ছে যা ইতোমধ্যে এখানকার মানুষের বাঁচামরার সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে।

শিব্বীর আহমেদ তালুকদারশিব্বীর আহমেদ তালুকদার
Published : 24 Feb 2023, 05:55 PM
Updated : 24 Feb 2023, 05:55 PM

দেশে জলবায়ু পরিবর্তনের জেরে সন্দ্বীপের জনগণ ক্ষতিগ্রস্ত ও উদ্বাস্তুদের তালিকায় শীর্ষে রয়েছে। সন্দ্বীপবাসীর গল্প এতদিন অধরাই থেকে গেছে। ‘সন্দ্বীপে জলবায়ু পরিবর্তনের শিকার মানুষের শত বছরের না বলা গল্প’ শিরোনামে মাঠ পর্যায়ে এক অনুষ্ঠান হতে যাচ্ছে (২৪, ২৫ ও ২৬ ফেব্রুয়ারি)। যার প্রেক্ষাপটেই এ লেখাটি।

জলবায়ু পরিবর্তনের জেরে বাংলাদেশের সন্দ্বীপ উপজেলা এমন এক ভয়াবহ ভবিষ্যতের দিকে আগাচ্ছে যা ইতোমধ্যে সন্দ্বীপবাসীর বাঁচামরার সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। নিরব এই ঘাতক বিগত শত বছর ধরে সাড়ে ৮ লাখ সন্দ্বীপবাসীকে গৃহহারা করেছে।

কেবল সন্দ্বীপে নয়, বাংলাদেশে জলবায়ু উদ্বাস্তুর সংখ্যা ক্রমেই বেড়ে চলছে। উপকূলীয় অঞ্চলের ১৯টি জেলার কৃষিজীবী মানুষ সবচেয়ে বেশি ঝুঁকির মধ্যে রয়েছেন। প্রায় ৩-৪ কোটি মানুষ এই প্রত্যক্ষ ঝুঁকির মধ্যে রয়েছেন। পরোক্ষভাবে দেশের জেলা শহরগুলো এবং রাজধানীও এই জলবায়ু ক্ষতিগ্রস্ত নাগরিকের চাপে ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। দেশের বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রজন্ম জলবায়ু উদ্বাস্তুজনিত কারণে নানা সমস্যার শিকার হচ্ছে। নদ-নদী ও সাগর মাতৃক বাংলাদেশের মানুষ জলবায়ু পরিবর্তনের জেরে ও এর বিরূপ প্রভাবে জলবায়ু উদ্বাস্তু হচ্ছে। বিশেষ করে বর্ষা মৌসুমে। সম্ভবত এর দায় কেউ নিতে চাইবে না।

কৃষ্টি ও সংস্কৃতিতে সমৃদ্ধ একদা সন্দ্বীপ সমগ্র বাংলাকে প্রতিনিধিত্ব করতো। ব্যবসা-বাণিজ্য ও রাজনৈতিক ইতিহাস এখানকার সমৃদ্ধ। পঞ্চায়েত ব্যবস্থা গড়ে উঠেছিল এই সন্দ্বীপে। প্রাচীন কালে সন্দ্বীপ থেকে রপ্তানি হতো পুন্ডাল তেল, লবন, ধান-চাল, সুপারি-নারিকেল ও নারিকেল তেল ও জাহাজ তৈরির কাঠ ইত্যাদি। এই রপ্তানিকে কেন্দ্র করে সন্দ্বীপ ভূ-রাজনীতি ও ব্যবসা বাণিজ্যের কেন্দ্রে পরিণত হয়। বেনিয়াদের কাছে লাভজনক অর্থকরী মোকাম হিসেবে সুপ্রসিদ্ধ ছিল সন্দ্বীপ।  

জলবায়ুর বৈরিতায় আগামী দুই-তিন দশকের মধ্যে বাংলাদেশের আরও ২-৩ কোটি মানুষ নদীর ‘সিকস্তি’ ও ‘পয়স্তি’র মাধ্যমে তাদের প্রিয় বাস্তুভিটা ছেড়ে দিতে বাধ্য হতে পারে। গ্রামীণ জীবন থেকে শহরে জীবনে পদার্পন করবে। এতে শহরের নাগরিক সুযোগ সুবিধার জন্য বাড়তি চাপ পড়বে।

এক হিসেবে দেখা গেছে, বিশ্বে প্রতি ৪৫ জনের মধ্যে এক জন জলবায়ুর বিরূপতার শিকার হয়ে উদ্বাস্তুতে পরিণত হচ্ছে। আমাদের দেশে এই হিসাবটা আরো ভয়াবহ হবে যে, উপকূলীয় অঞ্চলের মোট জনসংখ্যার ৮ ভাগের ১ ভাগ জনসংখ্যা জলবায়ু পরিবর্তনে ক্ষতিগ্রস্ত ও উদ্বাস্তুতে পরিণত হবে। ডাল-ভাতও রোজগার করে খেতে পারবে না অনেকে। অসহনীয় ও নিরব দুর্ভিক্ষের মধ্যে দিনাতিপাত করতে হবে। আয়-ব্যয়ের মধ্যে ফারাক তৈরি হবে। দেশের প্রায় ২০ শতাংশ জমি নদীগর্ভে সিকস্তি হবে বা নদীর পানির নীচে ডুবে যাবে বা লবণাক্ত পানি বেড়ে যাবে ও ব্যাপক ক্ষতি হবে ফসলের। জীবনযাত্রার মান ও জীববৈচিত্র্যের ওপর চরম প্রতিক্রিয়া হবে। 

বিপর্যস্ত সন্দ্বীপের মানুষ নিজেদের বাস্তুভিটা ত্যাগ করে প্রতিনিয়ত শহরে-বন্দরে আসছে জীবিকার তাগিদে। তাদের জীবন-ধারণের জন্য ক্রয়-ক্ষমতাও নেই অনেকের।  তারা উৎপাদন ব্যবস্থা থেকে ছিটকে পড়ছে ও অর্থ উপার্জনের উপায় না থাকার কারণে দেশ-দেশান্তরী হচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে অদম্য পরিশ্রমে পড়াশোনা করেও পরিবারের খরচ মেটানোর মতো চাকরি জোগাড় করতে না পারার কারণে কেউ কেউ কর্মী হিসেবে বিদেশ যাচ্ছেন। আর এভাবেই দেশের ট্যাক্সের পয়সায় পড়াশোনা করা শিক্ষিত মেধাবী জনসংখ্যা পাচার হচ্ছে বিদেশে।

সন্দ্বীপের বাস্তুভিটাহারা এ জনসংখ্যাকে আশ্রয় এবং বন্দোবস্ত দিতে হবে সন্দ্বীপের সীমানাভুক্ত জেগে ওঠা চরগুলোয়। নিজেদের বাপ-দাদার বাস্তুভিটায় ফিরে যাওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। এই চরগুলোকে চাষাবাদের আওতায় নিয়ে আসতে হবে। খাজনা পরিশোধের ব্যবস্থা করতে হবে। আধুনিক শহরের পরিকল্পনা করতে হবে। উপকূলে বেড়িবাঁধ তৈরি করতে হবে। (সন্দ্বীপের) ভাসানচরে ১৯ ফিট বেড়িবাঁধ তৈরি করা হয়েছে। অথচ সন্দ্বীপের চরগুলোতে বেড়িবাঁধ নির্মাণ করা হয়নি। সাইক্লোন সেন্টারও নির্মাণ করা হয়নি। এখনো সন্দ্বীপকে নদীবন্দর হিসেবেও ঘোষণা করা হয়নি। ফলে সাইক্লোনের সময় বিশেষ আবহাওয়ার সময় সিগন্যালের বাইরে থাকছে ।

এখনই আমাদের জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিকর প্রভাবগুলো বিবেচনায় এনে ভবিষ্যত পরিকল্পনা করতে হবে। সন্দ্বীপে জলবায়ু ক্ষতিগ্রস্তদের না বলা গল্পকে বিবেচনায় নিতে হবে।