মুক্তিযুদ্ধের বহুমাত্রিক বাস্তবতা এবং বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মুক্তিযোদ্ধাদের ভিন্ন ভিন্ন সংগ্রাম ও চাওয়া-পাওয়া বুঝতে না পারলে মুক্তিযুদ্ধের ‘জনযুদ্ধ’ চরিত্রটি বোঝা যাবে না।
Published : 31 Dec 2023, 10:49 AM
মুক্তিযোদ্ধা তো মুক্তিযোদ্ধাই। পুরুষ, নারী, শিশু, দেশি, বিদেশি যে-ই হোন না কেন, যিনি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে কোনো না কোনোভাবে অবদান রেখেছেন বা অংশগ্রহণ করেছেন, তিনিই মুক্তিযোদ্ধা। এতদসত্ত্বেও মুক্তিযোদ্ধার আগে নারী বা মহিলা যোগ করার প্রয়োজন পড়ছে। কেননা, মুক্তিযুদ্ধের কিছু সাধারণ বৈশিষ্ট্য চিহ্নিত করা সম্ভব যেগুলো নারী, পুরুষ, দেশি-বিদেশি নির্বিশেষে সকলের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে যারা বাংলাদেশি বাঙালির ন্যায্য যুদ্ধ মনে করেছেন, যারা বাঙালির আর্থ-সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বিকাশের তাগিদে এ জনগোষ্ঠীর জন্য একটি অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র চেয়েছেন এবং সেই রাষ্ট্র অর্জন করার জন্য এ যুদ্ধে সরাসরি অংশ নিয়েছেন, বা রাজনৈতিক, সামাজিক, কূটনৈতিক, ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে অংশ নিয়েছেন, তাদের সকলেই মুক্তিযোদ্ধা। বড় দাগে এরকম সরলীকরণ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের চরিত্রকে বুঝতে যথার্থভাবে সাহায্য করলেও মুক্তিযুদ্ধের বহুমাত্রিক ব্যাপ্তি ও ব্যঞ্জনাকে পর্যাপ্তভাবে চিহ্নিত করতে পারে না। উপরন্তু, মুক্তিযুদ্ধে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের সংগ্রামের ধরনে যে ভিন্নতা ছিল, তাদের চাওয়া-পাওয়ার মধ্যে যে বৈচিত্র্য ও বহুমুখিতা ছিল, সেটিকেও শনাক্ত করতে ব্যর্থ হয়।
মুক্তিযুদ্ধে যারা অস্ত্র হাতে সরাসরি যুদ্ধ করেছেন, তাদের লড়াই ছিল একরকম। তাদের মধ্যে আবার সামরিক বাহিনি ছিল, ছিল বেসামরিক বাহিনি। কোনো কোনো রাজনৈতিক দল তার নিজস্ব সশস্ত্র সংগঠন গড়ে তোলে। কেউ কেউ আবার নিজস্ব বাহিনি গঠন করে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। অস্ত্র হাতে যারা যুদ্ধ করেছেন তাদের সকলের যুদ্ধ একরকম ছিল না। তাদের কারও কারও লক্ষ্যও ভিন্ন ছিল। যারা অস্ত্র হাতে যুদ্ধ না করে নানাভাবে মুক্তিবাহিনিকে সাহায্য করেছেন, তাদের লড়াই ছিল অন্যরকম। যারা বিভিন্ন দেশে ঘুরে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে সমর্থন আদায় করেছেন, তাদের সংগ্রাম ছিল ভিন্নরকম।
যারা বেতারে খবর পড়ে, কবিতা আবৃত্তি করে, গান গেয়ে মুক্তিযোদ্ধা ও সমগ্র দেশবাসীকে উদ্দীপিত করেছিলেন, তাদের লড়াই ছিল অন্যরকম। শরণার্থী শিবিরের জন্য যারা অর্থ ও ত্রাণ সংগ্রহ করেছিলেন তাদেরকে এক ভিন্ন বাস্তবতার মুখোমুখি হতে হয়েছিল। পাকিস্তান থেকে পালিয়ে এসে যারা যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন, তাদের সংগ্রামও অন্যদের চেয়ে আলাদা ছিল।
যে সমস্ত নারী অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করেছিলেন, সংখ্যায় অল্প হলেও, তাদের বাস্তবতা ছিল ভিন্ন। যে সমস্ত নারী ধর্ষিতা হয়েছিলেন এবং পরবর্তীতে যুদ্ধশিশুর জন্ম দিয়েছিলেন, তাদের সংগ্রাম ছিল ভয়াবহতম। কেননা, যুদ্ধ শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তাদের কষ্ট, নিঃসঙ্গতা এবং সামাজিক বহির্ভুক্তি শেষ হয়ে যায়নি। বছরের পর বছর তাদের এ কষ্ট সহ্য করতে হয়েছে, এখনও হয়ত বা কেউ কেউ বা অনেকে নিরবে নিভৃতে সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছেন।
মুক্তিযুদ্ধের বহুমাত্রিক বাস্তবতা এবং বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মুক্তিযোদ্ধাদের ভিন্ন ভিন্ন সংগ্রাম ও চাওয়া-পাওয়া বুঝতে না পারলে মুক্তিযুদ্ধের ‘জনযুদ্ধ’ চরিত্রটি বোঝা যাবে না। বলা হয় যে, মুক্তিযুদ্ধের ওপর মানসম্পন্ন ও প্রামাণিক গবেষণা যা হয়েছে সেটি অপর্যাপ্ত। উপরন্তু, মুক্তিযুদ্ধের ৩০ লক্ষ শহীদ, প্রায় ৫ লক্ষ নারীর ওপর কৃত বহুমাত্রিক নির্যাতন, গণকবর ও টর্চার সেলের সংখ্যা নিয়ে প্রামাণিক ডকুমেন্টেশন না থাকার কারণে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও জেনোসাইড বৈশ্বিকভাবে কম আলোচিত, কম উন্মোচিত এবং বর্তমানে আমরা সকলে মিলে জাতিসংঘ কর্তৃক বাংলাদেশের জেনোসাইডের যে স্বীকৃতির জন্য কাজ করছি, তাতেও নানা প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হতে হচ্ছে।
আজকের প্রবন্ধে বিশেষ করে মুক্তিযুদ্ধে নারীদের অবদান বিষয়ে কিছুটা আলোকপাত করতে চাই। মুক্তিযুদ্ধে নারীর অবদান বিষয়ে যারা গবেষণা করেছেন এবং গ্রন্থ রচনা করেছেন, তাদের ধারণা, “ইতিহাসে নারীদের অবদান খুঁজতে গিয়ে আমরা বুঝতে পারলাম প্রচলিত অর্থে ‘মুক্তিযোদ্ধা’ শব্দটি ব্যবহারে নারীর কথা বোঝায় না। আমাদের চোখে ভেসে ওঠে একজন পুরুষ বন্দুক হাতে দাঁড়িয়ে আছেন। আমাদের ধারণা আরও বদ্ধমূল হয় নাটক দেখে, গল্প পড়ে, কবিতা পড়ে, গান শুনে কিংবা ইতিহাস পড়ে ... এই বিভাজনে আমরা একদিকে সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণকে খাটো করে ফেলি আর অন্যদিকে মহিলাদের কোন অংশগ্রহণ ছিল কিনা তা যেন স্বীকারই করতে চাই না।’ (ফরিদা আখতার সম্পাদিত ‘মহিলা মুক্তিযোদ্ধা’)।
“একইসাথে দেখা যায়, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে নারীর অবস্থান হয়ে ওঠে কেবলই নির্য়াতনের শিকার হিসেবে। একথা সর্বজন স্বীকৃত যে, একটি যুদ্ধ আক্রান্ত দেশে নারী বহন করে এক ভিন্নমাত্রার ভয়, শঙ্কা আর দায়িত্ব, বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও এর ব্যত্যয় ঘটেনি। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে নারী যেন অনেটাই অস্পষ্ট, অকীর্তিত ও অনুপস্থিত রয়েছে ইতিহাসে। অথচ বৃটিশ শাসন বিরোধী আন্দোলন থেকে শুরু করে ভাষা আন্দোলন, ৫৪-এর নির্বাচন, ৬০-এর দশকের ছাত্র-আন্দোলন, ৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান, ৭০-এর নির্বাচন, ৭১-এর অসহযোগ আন্দোলন এবং সবশেষে মুক্তিযুদ্ধে প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে নারী তাৎপর্যময় ভূমিকা পালন করে।” গত ৭ ডিসেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর জেনোসাইড স্টাডিজ-এর আয়োজনে ‘বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে নারীর অবদান’ শীর্ষক একটি বক্তৃতা ও আলোচনা সভায় মূল প্রবন্ধকার ড. রেজিনা বেগম এ কথাগুলো বলেন।
মূল প্রবন্ধকার গবেষক শাহনাজ পারভীনের উদ্ধৃতি দিয়ে বলেন, মুক্তিযুদ্ধে নারীর অংশগ্রহণকে ১০টি অংশে ভাগ করা যায়। মুক্তিযুদ্ধে নারীর এই বহুমাত্রিক অংশগ্রহণের ব্যাপ্তি ও বিভাজনটি এরকম, ১) সশস্ত্র যোদ্ধা হিসেবে নারী; ২) আশ্রয়দাত্রী, অস্ত্র সংরক্ষণ ও সরবরাহকারিণী হিসেবে নারী; ৩) মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য রান্নাবান্না, খাদ্য সংগ্রহ ও সরবরাহকারিণী হিসেবে নারী; ৪) সেবা-শুশ্রুষার কাজে নিয়োজিত নারী; ৫) তথ্য সরবরাহ ও যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে নারী; ৬) অর্থ, বস্ত্র, খাদ্য ও ঔষধ সংগ্রহ ও সরবরাহের কাজে নিয়োজিত নারী; ৭) রাজনীতিক ও সংগঠক হিসেবে নারী; ৮) অনুপ্রেরণার উৎস রূপে নারী; ৯) সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে মুক্তিযোদ্ধা ও দেশবাসীকে উজ্জীবিত করার কাজে নিয়োজিত নারী; ও ১০) শরণার্থীদের সাহায্য সহযোগিতায় বাঙালি ও প্রবাসী নারী।
ইতোমধ্যেই উল্লেখ করা হয়েছে যে, মুক্তিযুদ্ধে নারীর অংশগ্রহণের একটি টিপিক্যাল চিত্র এমন— নারী হচ্ছে নির্যাতিতা ও ধর্ষিতা; ফলে নারী হচ্ছে নির্যাতিত ও অসহায় এক সত্তা। এই ন্যারেটিভ যে সত্য নয়, সেন্টার ফর জেনোসাইড স্টাডিজ কর্তৃক আয়োজিত আলোচনা সভার মূল প্রবন্ধ ও আলোচকদের বক্তৃতায় সেটি দ্ব্যর্থহীনভাবে প্রতিভাত হয়েছে। নারীরা যে অস্ত্র হাতে সম্মুখ সমরে অংশ নিয়েছিলেন, সেটিও বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের গুরুত্বপূর্ণ এক বাস্তবতা। মূল প্রবন্ধে ড. রেজিনা বেগম সশস্ত্র নারী মুক্তিযোদ্ধাদের একটি তালিকা প্রদান করেছেন, সেই তালিকার বীর মুক্তিযোদ্ধারা হচ্ছেন তারামন বেগম, শিরিন বানু মিতিল, কাঁকন বিবি, আলমতাজ বেগম ছবি, বীথিকা বিশ্বাস, শিশির কনা দত্ত, শোভারানী মন্ডল, হালিমা খাতুন, আলেয়া বেগম, করুণা বেগম, আশালতা বৈদ্য, বকুল মোস্তফা, ফরিদা খানম সাকী, সালেহা বেগম, মিরাসী বেগম, মনোয়ারা বেগম, কাঞ্চনমালা, মহেরুন্নিসা, পেয়ার চাঁদ প্রমুখ। সমগ্র বাংলাদেশ ও ভারতের বিভিন্ন প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে অনেক বাঙালি নারী প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন এবং তারা অস্ত্র হাতে যুদ্ধও করেছিলেন। এই সশস্ত্র মুক্তিযোদ্ধাদের পূর্ণাঙ্গ তালিকা দ্রুত সম্পন্ন হবে বলে প্রত্যাশা রইল।
পুরুষতন্ত্র অথবা নারীবাদের তত্ত্ব, অথবা সমাজতত্ত্ব, আইন বা সমরবিদ্যার কোনো তত্ত্বের লেন্স দিয়ে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে দেখতে হবে বা কোনো তত্ত্বসমষ্টির মধ্যে মুক্তিযুদ্ধকে আঁটাতে হবে— এমনটি আমি মনে করি না। কিন্তু, মুক্তিযুদ্ধের মাঠপর্যায়ের বাস্তবতা বলছে যে, মুক্তিযুদ্ধকে সঠিকভাবে বুঝতে হলে এবং বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের বহুমুখী চাওয়া-পাওয়া ও আকাঙ্ক্ষার স্বরূপ সঠিকভাবে হৃদয়াঙ্গম করতে হলে আরও গভীর, সূক্ষ্ম ও প্রামাণিক গবেষণা প্রয়োজন। প্রাসঙ্গিকভাবে প্রশ্ন করা যেতে পারে যে, মুক্তিযুদ্ধে যে সকল কৃষক, শ্রমিক ও প্রান্তিক পর্যায়ের মানুষ অংশ নিয়েছিলেন, তাদের ইতিহাস কি সঠিকভাবে লিপিবদ্ধ হয়েছে?
পরিশেষে, এ কথাটি বলতে চাই যে, মুক্তিযোদ্ধা যেন কোনোভাবেই পুরুষবাচক শব্দ হয়ে না ওঠে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও জেনোসাইডের ইতিহাসে বাংলাদেশের নারী যেন কোনোভাবেই অস্পষ্ট ও অকীর্তিত না হয়। মুক্তিযুদ্ধের আগে পরে এবং মুক্তিযুদ্ধের পুরোটা সময় জুড়ে নারী যেমন বলিষ্ঠ, সমমর্যাদা, সাহস, ওজস্বিতাও প্রেরণাদায়িনী হিসেবে ছিল— ইতিহাসে যেন সেটি যথার্থভাবে প্রতিফলিত হয়। আর একটি গুরুত্বপূর্ণ কথা হচ্ছে, মুক্তিযুদ্ধে দরিদ্র ও হতদরিদ্র নারীরা সংখ্যা ও ভয়াবহতার হিসেবে যেভাবে নির্যাতিত হয়েছিলেন, এলিট ও সম্পন্ন ঘরের নারীরা সেভাবে নির্যাতিত হননি। এই নির্যাতিত হাজার হাজার প্রান্তিক নারীর ইতিহাস যেন সঠিকভাবে লিপিবদ্ধ হয়, সেই প্রত্যাশা রইল।