বিএনপির সমাবেশ নিয়ে রাজনীতিতে উত্তাপ। এরইমধ্যে ওবায়দুল কাদেরের দেওয়া 'খেলা হবে'- স্লোগান নিয়ে চলছে সমালোচনা।
Published : 06 Dec 2022, 11:35 AM
‘খেলা হবে’ এখন আলোচিত বাক্য। কে কার সাথে খেলবে, কী খেলবে জানি না- কিন্তু এটাই এখন মাঠ গরম করে রেখেছে। এ লেখা যখন লিখছি প্রবীণ জননেতা তোফায়েল আহমেদ এর একটা কথা মনে ধরেছে। তিনি বলেছেন, “খেলা হবে, এটা কোনও রাজনৈতিক স্লোগান হতে পারে না।”
তিনি বলেছেন, “পলিটিক্সে মারপিট হবে, আমার বক্তব্য আমি দিব। কিন্তু কী একটা কথা, শুনতেও কেমন শোনা যায়, খেলা হবে, খেলা হবে। কেউ অসন্তুষ্ট হতে পারেন, তবে আমার বিবেক বলে এই স্লোগানটা এভাবে না দেওয়া উচিত।”
তাকে আমি ব্যক্তিগতভাবে পছন্দ করি। তিনি দলের হয়েও অনেক সময় অপ্রিয় সত্য কথা বলেন। এই বয়সে অভিভাবকের দায়িত্ব পালন করেন, যা দল ও জাতির জন্য দরকারী। সত্যি তো ‘খেলা হবে’- এটা কেমন কথা? খেলা যদি নির্বাচন ও ভোট হয় তবে তা খোলসা করে বলা উচিৎ।
সরকারি দলের এখনকার নেতারা হয়তো তাদের ‘লিগ্যাসি’ ভুলে যান। ঐতিহ্যবাহী আওয়ামী লীগ উপমহাদেশের প্রাচীন একটি দল। শেখ হাসিনার বাইরেও আওয়ামী লীগ ধারণ করেছে তাজউদ্দীন আহমদ থেকে সৈয়দ আশরাফ পর্যন্ত বিরল নেতৃত্ব গুণসম্পন্ন ব্যক্তিদের। তারা যে ঐতিহ্য ও চেতনার পতাকা রেখে গেছেন- তার মান রক্ষা করা এখন দায়িত্ব।
খেলা হোক বা না হোক রাজনীতি উত্তপ্ত হয়ে উঠছে। প্রবাসেও সেই আঁচ টের পাওয়া যায়। প্রায় প্রতিদিনই নতুন নতুন জনসভায় উত্তাল দেশের চিত্র দেখতে পাচ্ছি। বিএনপি যে কোমর বেঁধে নেমেছে সেটা স্পষ্ট। যদিও দেশের রাজনীতি নিয়ে মানুষের তেমন কোনও আগ্রহ আছে কিনা তা প্রশ্নের উর্ধ্বে নয়। সাধারণ মানুষের ভেতর রাজনীতিবোধ কাজ করে না। তাদের মূল চিন্তা খেয়ে-পরে বেঁচে থাকা। একটা কথা মানতেই হবে মাঝে কয়েক বছর দেশের অবস্থা বেশ ভালোই চলছিল। মনে হচ্ছিল, আর কোনওকালে হয়তো বিরোধীদল নামে কিছুর দরকারই পড়বে না বা পড়লেও সেই বিরোধীদলের নাম ‘বিএনপি’ হবে না। কিন্তু এখন তা মনে হওয়ার আর কোনও কারণ নেই। এই যে বিএনপির মধ্যে হঠাৎ প্রাণচঞ্চলতার সৃষ্টি- এর পেছনে তাদের শ্রম বা রাজপথে থাকাটা যত অবদান রেখেছে, তার চেয়ে ঢের বেশি দায়ী আওয়ামী লীগ তথা সরকারি দলের ব্যর্থতা।
একের পর এক দুর্নীতির ঘটনা গণমাধ্যমে আসছে। ব্যাংকিং খাত নিয়ে নানা গুজব শোনা যাচ্ছে। বৈশ্বিক মহামারী কোভিড পরবর্তী রাশিয়া-ইউক্রেইন যুদ্ধের কারণে ডলার সংকট ও দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতির কারণেও সরকার রয়েছে নানা চাপে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ব্যতীত আর কারো প্রতি মানুষের বিশ্বাস আছে বলে মনে হয় না। তিনি একা ধরে রেখেছেন সবকিছু। বলাবাহুল্য, নানা কারণেই তাকে একা করে তোলা হয়েছে। তার সাথে চলার মতো যোগ্য নেতা বা নেতৃত্ব দলে বিরল।
অন্যদিকে লাগামহীন একমুখীনতা বিএনপি-জামায়াত জোট আমলের সব কষ্ট দুঃখ বা অনাচার ক্রমাগত বিস্মৃত হচ্ছে মানুষ। কেননা, মানুষের মস্তিষ্ক প্রিয়জনের মৃত্যুশোকও বর্তমানে বেঁচে থাকার তাগিদে ভুলে যায় সবকিছু।
আবার সুবিধাবাদীরা ঠিকই দল এবং ভোল পাল্টে আওয়ামী লীগে ঠাঁই করে নিয়েছে। আর মানুষ দেখছে, যা কিছু নষ্টের গোঁড়া তার সবগুলোর পেছনেই রয়েছে কোনও না কোনও আওয়ামী লীগের নেতা!
স্বাভাবিকভাবেই মানুষের চাওয়া-পাওয়ার ফারাক যতো বাড়ছে, ততো তারা সরকারের ওপর অসন্তুষ্ট হয়ে উঠছে। আওয়ামী লীগের নেতারা তাদের নিজেদের লাগামহীন বাক্যে জনগণের ওপর কী ধরনের নেতিবাচক প্রভাব ফেলছেন- তা তারা বোঝেন বলে মনে হয় না।
আদর্শিকভাবে বিএনপি সমর্থন করা আমাদের জন্য কঠিন। যতকাল তারা বঙ্গবন্ধু ও চার জাতীয় নেতাসহ ইতিহাসের প্রতি শ্রদ্ধাশীল না হবে, যতকাল ১৫ অগাস্টের খুনিদের নেপথ্যে মদদ বা সমর্থন দেবে ততকাল তাদের দলের জন্য অনুরাগও হারাম। মুক্তিযুদ্ধের প্রতি দায়বদ্ধতা এখন কথার কথা মনে হতে পারে। কিন্তু এটাই দেশ-জনতার ভিত্তি। সে জায়গাটুকু আপাতত অদৃশ্য বা নিষ্ক্রিয়। যার কারণ সরকারী দলের উদাসীনতা। এই যে বিএনপির প্রত্যাবর্তন এবং জেলায় জেলায় মানুষের ঢল- এর পেছনে নিজেদের ব্যর্থতা খোঁজার চেষ্টা না করলে পরিস্থিতি উত্তরণ আওয়ামী লীগের জন্য কঠিন হবে। কথা মানুষের যেমন সম্পদ, তেমনি তার বৈরীও বটে। জিভের মতো ধারালো অস্ত্র দুনিয়ায় নাই। সেজন্য কথা বলার সময় সাবধানে সতর্কভাবে বলা উচিৎ।
দুই প্রধান দলের সাধারণ সম্পাদকের কথা যদি বিশ্লেষণ করা যায়, দেখবো মির্জা ফখরুল বরং শিষ্টাচারে এগিয়ে আছেন। অথচ ওবায়দুল কাদের একজন ঝানু ছাত্র ও শ্রমিক নেতা। আমাদের যৌবনে ছাত্রলীগের হয়ে দেশ কাঁপাতেন তিনি। কাদের-চুন্নু তখন সারাদেশের পরিচিত নাম। তাদের ওপর সাধারণ ছাত্রদের ভরসা ছিল আকাশ সমান। কালক্রমে চুন্নু ছিটকে পড়লেও কাদের সাহেব আছেন। তার পরিচিতি ও ব্যক্তিত্বের প্রতি যথাযথ মর্যাদা তিনি কি আদৌ দিতে পারছেন?
জার্মান সংবাদ সংস্থা ডয়েচে ভেলে বাংলা বিভাগের আয়োজনে এক আলাপচারিতায় উপস্থাপকের নানা তির্যক প্রশ্নের জবাবে মির্জা ফখরুল প্রমিত বাংলায় শুদ্ধ উচ্চারণে যে সব উত্তর দিয়েছেন, যেভাবে রবীন্দ্রনাথের কবিতা পঙক্তি দিয়ে আলোচনা করেছেন- তাতে চমৎকৃত হবার বিকল্প নাই। বিএনপি সমর্থন না করলেও তার প্রতি, তার কথার প্রতি অনুরাগ জন্মাবে মানুষের। এটিকে ইতিবাচক হিসেবে দেখছি।
আমাদের দেশের নেতারা সাধারণত উত্তেজিত থাকেন। মাইক্রফোনের সামনে চড়া গলায় কথা বলেন, তা সে ময়দানে হোক কিংবা স্টুডিওর কন্ট্রোলড পরিবেশে।
সেই জায়গায় ফখরুল সাহেবের পরিমিত আলাপ মনে দাগ ফেলতেই পারে। আমি কারো সমালোচনা বা নিন্দা না করেই বলবো, এমন করেই দুই দলের নেতাদের কথা বলা উচিৎ। তাতে মানুষ বিচার বিবেচনা করার জন্য সুযোগ পাবে বেশি। নয়তো পাল্লা কোন দিকে ঝুঁকবে সবাই জানেন।
রাজনীতি যতোটা গরম, ততোটাই গরম বাজার। হিমশিম খাওয়া মধ্যবিত্ত ‘খেলা হবে’ শব্দ যুগলকে নেতিবাচকভাবে নেয়। তারা ভাবে অরাজকতা হবে। দ্রব্যমূল্যের এই উর্ধ্বগতির মধ্যে সরকারে থাকা আওয়ামী লীগে কোনও দায়িত্বশীল নেতা যখন এ কথা বলেন- তখন প্রথমেই সাধারণ মানুষের মাথায় আসে তাদের রুটি-রুজি আবার হুমকির মুখে পড়বে না তো!
তারা চান পণ্যের দাম কমুক, নিজেরা ভালো থাকুক। এর বেশি কিছু নয়। রাজনীতি সে-ই খেলায় মনযোগ দিলেই সকলের মঙ্গল।
সিডনি