এই তো জীবন

খরচ মেলানোর নানামুখী চাপে-তাপে পাবলিকের রুটিন বদলে গেছে। কে কোথায় গার্ডারে চিড়ে-চ্যাপ্টা হলো, পুড়ে অঙ্গার হয়ে গেল, কোন মা সন্তান বিক্রি করে দিল– এসব খবর আর আগের মতো আবেদন, দ্যোতনা, যন্ত্রণা তৈরি করে না মনে।

মোহাম্মদ জুবায়েরমোহাম্মদ জুবায়ের
Published : 17 August 2022, 02:08 PM
Updated : 17 August 2022, 02:08 PM

সময় বদলেছে। রুটিনও বদলেছে। ভাবনাগুলো, প্রতিক্রিয়া জানানোর ভাষাগুলোও নেই আর আগের মতো সুচারু, ধারালো। পাশ কাটিয়ে যাওয়ার মনোভাব, পিছে হাঁটার স্বভাব– এগুলোই এখন রুটিনমাফিক কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছে আমাদের। এমনই কি হওয়ার কথা ছিল?

ঢাকার উত্তরায় বাস র‌্যাপিড ট্রানজিট (বিআরটি) প্রকল্পের কংক্রিটের গার্ডার আছড়ে পড়ে মুহূর্তেই মরে গেছে ৫ জন মানুষ। চিরতরে থেঁতলে গেছে পাঁচটি জীবনের স্বপ্ন, আকাঙ্ক্ষা, চাওয়া-পাওয়ার হিসাব। যে দুজন বেঁচে আছে, প্রিয়হারা বেদনা বাকি জীবনের সঙ্গী হয়ে গেল তাদের। ভয়ঙ্কর এই দৃশ্য যারা টিভিতে, ইউটিউবে দেখলেন, যারা গণমাধ্যমের পাতায় পড়লেন এবং সবশেষ যারা এই ঘটনার তদন্তে ‘কমিটি’ গড়লেন, তারা আসলে কী ভাবছেন? কিংবা চকবাজারের কামালবাগের দেবী দাস ঘাট এলাকার রেস্টুরেন্টে ঘটে যাওয়া ঘটনা। চারতলা ওই ভবনের আগুন ফায়ার সার্ভিসের ১০টি ইউনিট সোয়া দুই ঘন্টার চেষ্টায় নিয়ন্ত্রণে আনতে পেরেছিল বটে, কিন্তু ততক্ষণে পুড়ে শেষ ‘বরিশাল রেস্টুরেন্ট’-এর ছাদের নিচে কাঠ দিয়ে বানানো মাচায় শুয়ে থাকা ছয় কর্মী।

স্বজন হারানোদের আর্তনাদ, কান্না একটু কান পেতে শুনুন। রেস্টুরেন্টে পুড়ে যাওয়া ১৫ বছর বয়সী কিশোর শরীফের নানা আবুল কাশেম চিৎকার করে বলছেন, “এতটুকু পোলারে এত কষ্টের কামে দিতে চাই নাই। কিন্তু কী করুম, তাগো সংসার যে চলে না। এহনে সবাই কইতাছে পুইড়া মারতে নাতিডারে ঢাকায় আনলাম। আমি কী কমু ওর বাপ-মায়েরে।” উত্তরার দুর্ঘটনায় নববিবাহিত মেয়েকে শ্বশুরবাড়ি থেকে আনতে সোমবার মিষ্টি হাতে বের হয়েছিলেন ফাহিমা বেগম। কিন্তু আনন্দের সেই যাত্রাই তার অন্তিম যাত্রা হয়ে গেল। ফাহিমার প্রতিবেশী সালমা আক্তার বলেছেন, “সোমবার দুপুরে মিষ্টি হাতে তাদের যেতে দেখলাম। পরে সন্ধ্যায় শুনি মর্মান্তিক দুর্ঘটনায় সবাই মারা গেছে। শুনে খুবই খারাপ লাগছে। অথচ দুপুরেই আমার চোখের সামনে দিয়ে গেল।” জীবন সত্যিই ঠুনকো, কিন্তু কোথাও কি এতটা নিরাপত্তাহীন?

আমাদের সকাল শুরু হয় এখন স্বস্তিহীন, আনন্দহীন, তৃপ্তিহীন গল্প দিয়ে। সপ্তাহখানেক আগে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম-এর এক সংবাদের শিরোনাম ‘সন্তানকে হাটে তুলে আলোচনায় খাগড়াছড়ির মা’। ওই মায়ের আর্তি, “বাচ্চাকে কী খাওয়াব? এলাকার সব মানুষই কমবেশি দরিদ্র। তাই সন্তানকে একটি ভাল পরিবারে দিতে চেয়েছিলাম।” পরে জনপ্রতিনিধিদের হস্তক্ষেপে বাচ্চা নিয়েই ঘরে ফিরেছেন ওই মা। কিছু সাহায্যও পেয়েছেন। এরপর একদিন হয়ত ওই শিশুটিও রেস্টুরেন্টে ঝলসে যাওয়া শরীফের মতো কাজের সন্ধানে বের হবে, কিন্তু তার মায়ের কোলে ফেরার নিশ্চয়তা কে দেবে?

অবশ্য এখন মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্ত পরিবারের যে শিশু, কিশোর মায়ের আচল ধরে ঘুরঘুর করছে, সে-ইবা কতটুকু ভালো আছে? আমার সন্তান যেন থাকে ‘দুধে-ভাতে’, সে দিন ফুরিয়েছে আগেই। ‘দুধে-ভাতে’ থেকে ‘মাছে-ভাতে’ এবং এরপর শুরু হলো বাঙালির ‘ডিমে-ভাতে’ দিন। কিন্তু জ্বালানি ও ভোজ্য তেলের দাম উসাইন বোল্টের গতিতে এক লাফে আকাশ ছোঁয়ার পর এখন তো ডিমও অস্পৃশ্য হয়ে যাওয়ার জোগাড়। একটা ডিম ১৫ কিংবা ১৬ টাকা! হালি-ডজন ডিমের দাম অঙ্ক কষে বের করার সাহস কিংবা দুঃসাহস কোনোটাই নেই সাধারণ মানুষের। এদিকে আলু-পটল-মরিচ-তেল সব কিছুর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চালের দামও চড়ছে। তাতে ভাতের আকালের দিনও আসছে। অন্তমিল প্রিয় বাঙালি লেখক, কবি-সাহিত্যিকরা এরপর কীভাবে মেলাবেন ছন্দ? লিখবেন কি আমার সন্তান যেন থাকে চাল/গমের ‘রুটি-পুটি মাছে’? কলমের ডগায় দ্রোহের আগুন না থাকায় কিংবা চাপে/ভয়ে যদি মিলিয়েও ফেলেন ‘রুটি-পুটি', কিন্তু এ ছন্দ যে টিকবে, তার নিশ্চয়তা কে দেবে?

বিষ্ণু দে ঘোড়সওয়ার কবিতায় প্রশ্ন রেখেছিলেন– এখানে কখনও বাসর হয় না গড়া? কিন্তু সত্যিই এই বঙ্গ দেশে অনেকে বাসর গড়ে, সাদ্দাদের ‘বেহেশতে’ ঘুমায়, লাখ টাকার সোনার আইসক্রিম খায়, বেগমপাড়ায় আলিশান বাড়ি করে, সুইস ব্যাংকে লুটপাটের টাকা পুতে রাখে, ‘অর্থ পাচারকারী’ পদবী নিয়ে দোর্দণ্ড প্রতাপে ঘুরে বেড়ায় বুক ফুলিয়ে। শুনেছি বেহেশতে কোনে বাধা থাকবে না, এখন দেখছি এই ‘বেহেশতে’ও তাদেরকে কিছু বলার কেউ নেই। তারা বাধাহীন। এই ‘বেহেশতের’ বাসিন্দারা কোথা থেকে পৃষ্ঠপোষকতা পায়, কাদের সঙ্গে ওঠা-বসা করে, কারা এদের লাই দিয়ে লালসার জিহ্বাটা রাক্ষসের জিহ্বার মতো দীর্ঘকায় করে দিয়েছে, সবই এই দেশের মানুষ জানে।

এই জানাজানিতে অবশ্য কোনো লাভ নেই। কারণ খরচ মেলানোর নানামুখী চাপে-তাপে পাবলিকের রুটিন বদলে গেছে। কে কোথায় গার্ডারে চিড়ে-চ্যাপ্টা হলো, পুড়ে অঙ্গার হয়ে গেল, কোন মা সন্তান বিক্রি করে দিল– এসব খবর আর আগের মতো আবেদন, দ্যোতনা, যন্ত্রণা তৈরি করে না মনে। যতটা করে চোখের আড়ালে ৫৩টি নিত্যপ্রয়োজনীয় ওষুধের ১০০ থেকে ২০০ শতাংশ দাম বেড়ে যাওয়াটা।

আমাদের ভাবুক বন্ধু ভ্যাবলা অবশ্য কিছু নিয়েই এখন আর ভাবে না। সকালে ঘুম থেকে উঠে ফেইসবুকের পাতায় ঢু মারে। ভালো মৃত্যু-অপমৃত্যু সব পোস্টে ‘ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন’ কপি-পেস্ট করে বসায়; সময় থাকলে দুঃখের ইমোজি দেয়। কোনো কিছু মানতে না পারলে রাগ-ক্ষোভের ইমোজিতে ক্লিক করে। রাষ্ট্রের উচ্চপদে আসীনরা যখন আকছার আবোল-তাবোল বলেন, তাদের পোস্টে শুধু ‘ওয়াও’ ইমোজি দেয়। আর বিরোধীদলগুলো যখন অনেক কষ্টে ‘এক-আধ বেলা’ হরতাল দেয়, প্রতিবাদ করে তাদের পোস্টে দেয় ‘হা-হা’ রিঅ্যাক্ট। এই-ই এখন ভ্যাবলার জীবন!