আজ দেশে যে হিংসার রাজনীতি দানবের মতো মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে তার বীজ রোপিত হয়েছে পঁচাত্তর-হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়েই। বঙ্গবন্ধু হত্যা ও জেলহত্যার বিচার সম্পন্ন করে জাতি কলঙ্কমুক্ত হয়েছে। তবে রাজনীতি এখনো ষড়যন্ত্র মুক্ত হয়নি।
Published : 03 Nov 2023, 10:21 PM
১৯৭৫ সালের ১৫ অগাস্ট এবং ৩ নভেম্বর যথাক্রমে ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে ও ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের অভ্যন্তরে যে নজিরবিহীন বর্বরতা সংঘটিত হয়েছিল তা সামরিক বাহিনীর কয়েকজনের জুনিয়র চাকরিরত বা চাকরিত্যুত অফিসারের হঠাৎ সিদ্ধান্তের ফল ছিল না। সপরিবারে বঙ্গবন্ধুকে ও চার জাতীয় নেতাকে হত্যা করা ছিল একটি সুদূরপ্রসারী ও গভীর রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রের পরিণতি। পরবর্তী অনেক ঘটনা থেকে দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রের বিষয়টি স্পষ্ট হয়েছে।
এটা নিয়ে বিতর্ক করা অর্থহীন যে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে যেমন অনেকেই ছিলেন, তেমনি বিপক্ষ শক্তিও ছিল। সেটা যেমন দেশের ভেতরে ছিল, তেমনি দেশের বাইরেও ছিল। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি বিজয়ী হয়েছিল, বিপক্ষ শক্তি পরাজিত হয়েছিল। বিজয়ী শক্তি আনন্দে মাতোয়ারা ছিল, পরাজিত শক্তির সাময়িক পশ্চাৎপসরণ হলেও তারা ছিল প্রতিশোধপরায়ণ এবং উপযুক্ত সময়ের জন্য অপেক্ষমাণ। বিজয়ী শক্তি ধরে নিয়েছিল যে, পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়েই আমাদের চূড়ান্ত বিজয় অর্জিত হয়েছে, সব বিপদ কেটে গেছে। স্বাধীনতা পেয়ে গেছি, এখন আর ভয় কী! পরাজিত পক্ষ যে নিজেদের শক্তি সংহত করে, দেশি-বিদেশি মিত্রদের সহযোগিতা নিয়ে স্বাধীনতার ঘরে সিঁদ কাটার পরিকল্পনা করছিল, তার নানা আলামত দেখা গেলেও প্রতিরোধের কোনো পরিকল্পনা ছিল না।
স্বাধীনতার পক্ষের যারা তারা নিজেদের শক্তি সংহত না করে বরং বিভেদ-অনৈক্যের পথে হেঁটেছে। এসবের মিলিত ফল ১৯৭৫ সালের অগাস্ট-নভেম্বরের বিয়োগাত্মক ঘটনা। ১৫ অগাস্ট সপরিবারে বঙ্গবন্ধু হত্যা এবং ৩ নভেম্বর জেলের ভেতর জাতীয় চার নেতাকে হত্যার ঘটনা বাংলাদেশের রাজনীতিতে যে গভীর ক্ষত সৃষ্টি করেছে তার যন্ত্রণা থেকে আজও আমরা মুক্ত হতে পারিনি। আমাদের দেশে এখনও যে রাজনৈতিক বিভাজন তা তৈরি হয়েছে পঁচাত্তরের অগাস্ট-নভেম্বর হত্যার পথ ধরেই।
পঁচাত্তরের অগাস্ট ও নভেম্বর ট্র্যাজেডি বাংলাদেশের রাজনীতিতে যে বিরাট শূন্যতার সৃষ্টি করেছিল, প্রায় পাঁচ দশক সময়েও তা পূরণ করা সম্ভব হয়েছে বলে দাবি করা যাবে না। আজ দেশে যে হিংসার রাজনীতি দানবের মতো মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে তার বীজ রোপিত হয়েছে পঁচাত্তর-হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়েই। বঙ্গবন্ধু হত্যা ও জেলহত্যার বিচার সম্পন্ন করে জাতি কলঙ্কমুক্ত হয়েছে। তবে রাজনীতি এখনো ষড়যন্ত্র মুক্ত হয়নি। নাগিনীর বিষাক্ত নিঃশ্বাস এখনও বাতাসে ছড়িয়ে আছে।
১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর মধ্যরাতে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে সংঘটিত হয়েছিল বর্বরোচিত ও নারকীয় হত্যাকাণ্ড। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বিশ্বস্ত চার সহযোগী সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী এবং এ এইচ এম কামারুজ্জামানকে নৃশংসভাবে জেলের ভেতর হত্যা করা হয়েছিল। পৃথিবীর ইতিহাসে এমন বর্বরতা নজিরবিহীন। আওয়ামী লীগকে নেতৃত্বশূন্য করার সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা নিয়েই খুনিচক্র এই হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছিল। ১৯৭৫ সালের ১৫ অগাস্ট সপরিবারে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে হত্যার মধ্য দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত বাংলাদেশের রাজনীতির গতিমুখ পরিবর্তনের সূচনা হয়। একাত্তরের পরাজিত শক্তি বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে, দেশের রাজনীতিকে প্রগতিবিমুখ ও পাকিস্তানমুখী করে প্রতিশোধ গ্রহণ করেছিল। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড কয়েকজন সেনা সদস্য প্রত্যক্ষভাবে নেতৃত্ব দিলেও এর পেছনে ছিল দেশি-বিদেশি নানা শক্তি। আওয়ামী লীগের ভেতরেই ছিল ঘাতকদের সহযোগীরা। কয়েকজন মাথা গরম জুনিয়র সেনা কর্মকর্তা আকস্মিক হঠকারিতাবশত ১৫ অগাস্ট হত্যাকাণ্ড ঘটিয়ে ফেলেছিল, এমনটা মনে করার কোনো কারণ নেই। এটা পূর্ব পরিকল্পিত এবং সে কারণেই ছিল যেন অনিবার্য। ১৫ অগাস্ট না হয়ে অন্য যে কোনো দিন অমন নৃশংস ঘটনা ঘটানোর চেষ্টা ও পরিকল্পনা ছিল। বঙ্গবন্ধুর উদারতা, ক্ষমাশীলতা ষড়যন্ত্রকারীদের সুযোগ করে দিয়েছে। নানা জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বাস্তবতায় অশুভ শক্তির অপতৎপরতা বন্ধ করার মতো অবস্থাও হয়তো ছিল না। একাধিক কারণে কারণে বঙ্গবন্ধু হয়ে পড়েছিলেন রাজনৈতিকভাবে নিঃসঙ্গ। ধীমান পরামর্শদাতাদের সঙ্গে তৈরি করা হয়েছিল দূরত্ব। বাকশাল তিনি করেছিলেন জাতীয় ঐক্য গড়ে তুলতে কিন্তু সেটা হয়নি। ফাঁকফোকড় ছিল বেশি। উপযুক্ততা বিচার করে পদপদবি দেওয়া হয়নি। বঙ্গবন্ধু বেঁচে থাকলে, তাঁর নেতৃত্বে বাংলাদেশ বিশ্বসভায় মাথা তুলে দাঁড়ালে যাদের গায়ে জ্বালা ধরতো তারা শুরু থেকেই সুযোগের সন্ধানে ছিল।
আওয়ামী লীগের ভেতর থেকেই বিশ্বাসঘাতক বাছাই করা হয়েছিল। খন্দকার মোশতাক, কে এম ওবায়দুর রহমান, শাহ মোয়াজ্জেম, তাহেরউদ্দিন ঠাকুররা একদিনে তৈরি হয়নি। তারা যে তলে তলে সর্বনাশের সুড়ঙ্গ তৈরি করছিলেন, সেটা বঙ্গবন্ধুরও অজানা ছিল না। তবে তিনি তাদের ষড়যন্ত্রকে খুব পাত্তা দিতেন না।
বঙ্গবন্ধু ছিলেন অত্যন্ত উদার মনের অতি মানবিক গুণসম্পন্ন একজন মানুষ। তিনি নিজে ষড়যন্ত্রের রাজনীতিতে বিশ্বাস করতেন না। কোনো ষড়যন্ত্রকারী তাঁর কোনো ক্ষতি করতে পারে সেটাও তিনি বিশ্বাস করতেন না। কোনো বাঙালি তাঁকে হত্যা করবে, এটাও ছিল তাঁর ধারণার বাইরে। তাঁর এই মানবিক দুর্বলতার সুযোগ নিয়েছে ঘাতকরা।১৫ অগাস্ট বাংলাদেশের রাজনীতির ধারাকে তছনছ করে দিয়েছে। বঙ্গবন্ধু সপরিবারে নিহত হওয়ার ঘটনায় গোটাদেশ বিহ্বল হয়ে পড়েছিল। বঙ্গবন্ধুর অনুসারীরাও ছিল হতভম্ব এবং বিভ্রান্ত। খন্দকার মোশতাক প্রেসিডেন্ট হওয়ায় এবং বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রিসভার প্রায় সবাই মোশতাককে সমর্থন করায় সাধারণ মানুষ ছিল দিশাহীন। খুনিরা অতি সহজে সব কিছু নিয়ন্ত্রণে নিতে সক্ষম হয়। তবে খুনি মেজরদের দৌরাত্ম্যে এবং বঙ্গবন্ধু হত্যার সঙ্গে সেনাবাহিনীর মধ্যে তৈরি হচ্ছিল বিরূপতা।
সেনাবাহিনীতে চেইন অফ কমান্ড ফিরিয়ে আনার তাগিদ অনুভব করতে থাকেন কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা সেনা কর্মকর্তা। তাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন তৎকালীন ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ। তিনি ছিলেন একজন মুক্তিযোদ্ধা এবং দক্ষ ও পেশাদার সেনা কর্মকর্তা। তাঁর নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধের সময় গড়ে উঠেছিল এক দুর্ধর্ষ গেরিলা বাহিনী। খালেদ মোশাররফ হয়তো আশা করেছিলেন তার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বাহিনীতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার জন্য ‘কিছু একটা’ করবেন। কিন্তু অচিরেই তিনি বুঝতে পারেন নতুন সেনা প্রধান জিয়াউর রহমানকে তিনি সঙ্গে পাবেন না। জিয়াউর রহমান ছিলেন একজন উচ্চাভিলাষী মানুষ। তার মধ্যে ছিল একধরনের অহংবোধ। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের আগে থেকেই পরিকল্পনাকারীদের সঙ্গে জিয়ার যোগাযোগ ছিল এবং হত্যা-পরবর্তী সময়ে ওই খুনি মেজরদের সহযোগিতায় উপরে ওঠার স্বপ্নও তিনি দেখতে থাকেন। জিয়াকে সামনে রেখে খুনি মেজরদের নিবৃত্ত করা সম্ভব হবে না—এই উপলব্ধি থেকে খালেদ মোশাররফ নিজে সেনা প্রধান হওয়ার কথা ভাবেন। তিনি জিয়াকে অন্তরীণ করেন। রাষ্ট্রক্ষমতা সরাসরি নিজের হাতে না নিয়ে খন্দকার মোশতাককে চাপ দিয়ে খুনি মেজরদের বাগে আনার পথ গ্রহণ করেন। তিনি বঙ্গভবনে মোশতাককে যখন ক্ষমতাহীন করতে ব্যস্ত, তখন খুনিরা জেলহত্যা পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করে ফেলেছে। রাষ্ট্র ক্ষমতা আওয়ামী লীগের হাতে যাতে আবার চলে না যায়, সাংবিধানিকভাবে বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে যাদের হাতে ক্ষমতা যাওয়ার কথা তাদের পৃথিবী থেকে বিদায় করার নিষ্ঠুর পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করেন খন্দকার মোশতাক এবং তার খুনি সহযোগীরা। জেলে চার নেতাকে হত্যা করে খুনি মেজররা নিরাপদে দেশ ত্যাগ করেন।
খালেদ মোশাররফের পরিকল্পনায় অস্পষ্টতা ও গলদ ছিল। তিনি কি বঙ্গবন্ধুর খুনিদের বিচার ও আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় আনতে চেয়েছিলেন? নাকি নিজে ক্ষমতায় বসতে চেয়েছিলেন? প্রথমটি হলে তিনি খুনিদের সঙ্গে সমঝোতা করতেন না এবং তাদের গ্রেপ্তার ও কারাগারে আটক বঙ্গবন্ধুর বিশ্বস্ত সহযোগীদের মুক্ত করার উদ্যোগ নিতেন।কিন্তু তিনি খুনিদের নিরাপদে দেশত্যাগের সুযোগ করে দিয়ে এবং খন্দকার মোশতাকের পরিবর্তে বিচারপতি সায়েমকে রাষ্ট্রপতি পদে বসিয়ে ভেবেছিলেন, অনেক বড় কাজ করেছেন।
১৫ অগাস্টের পর থেকে সেনাবাহিনীর ভেতর সক্রিয় ছিল জাসদের বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা। কর্নেল তাহের ছিলেন এই সংস্থার প্রধান। ১৫ অগাস্টের খুনিদের সঙ্গে কর্নেল তাহেরের যোগাযোগ ছিল বলে শোনা যায়। রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের জন্য সেনাবাহিনীকে ব্যবহার করার পরিকল্পনা করতে থাকেন কর্নেল তাহের। খালেদ মোশাররফ সেনা প্রধানের দায়িত্ব নেন, কিন্তু তাঁর উদ্দেশ্য ও পরিকল্পনার কথা দেশবাসীর কাছে স্পষ্ট করে না বলায় একধরনের ধোঁয়াশা তৈরি হয়। জাসদ, বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা খালেদ মোশাররফকে ‘রুশ-ভারতের এজেন্ট’ হিসেবে প্রচার করে বিভ্রান্তি তৈরি করে। তাঁর ভাই রাশেদ মোশাররফ আওয়ামী লীগের নেতা হওয়ায় এবং ৪ নভেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে একটি মিছিল বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে শ্রদ্ধা জানাতে গেলে এবং সেই মিছিলে খালেদ মোশাররফের মা অংশ নেওয়ায় এটা প্রচার হয় যে ভারতপন্থী আওয়ামী লীগ আবার ক্ষমতায় আসছে। প্রতিক্রিয়াশীল, ধর্মান্ধ এবং মুক্তিযুদ্ধবিরোধী সব শক্তি ঐক্যবদ্ধ হয়ে পড়ে। অন্যদিকে আওয়ামী লীগ এবং তার মিত্ররা তখন ছিল অসংগঠিত, বিচ্ছিন্ন এবং কিছুটা দিশাহারা। পরিস্থিতির সুযোগ নেয় জাসদ, গণবাহিনী, বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা।সামরিক বাহিনীর উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার আগেই খালেদ মোশাররফ কার্যত বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন। ব্রিগেডিয়ার থেকে মেজর জেনারেল পদে উন্নীত হওয়া ছাড়া আর কিছু তিনি দেশের মানুষের কাছে স্পষ্ট করতে পারেননি। অথচ ১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর থেকে ৬ নভেম্বর রাত পর্যন্ত কর্নেল তাহেরের উদ্যোগে সেনানিবাসসহ বিভিন্ন স্থানে অসংখ্য সভা হয়েছে। কর্নেল তাহের একটি পাল্টা অভ্যুত্থানের পরিকল্পনা করেছিলেন। তিনি সৈনিকদের অস্ত্র হাতে বেরিয়ে আসার আহ্বান জানিয়েছিলেন। বাইরে অপেক্ষা করবে জাসদ সমর্থক শ্রমিক-ছাত্ররা আর সেনানিবাস থেকে বেরিয়ে আসবে সশস্ত্র সৈনিকরা। এভাবেই সৈনিক-জনতার অভ্যুত্থানের পরিকল্পনা করে তা বাস্তবায়ন করেছিলেন কর্নেল তাহের।
কিন্তু খালেদ মোশাররফ আসলে কী করতে চেয়েছিলেন, তিনি কী বঙ্গবন্ধুর ঘাতকদের বিচারের আওতায় আনতে চেয়েছিলেন, নাকি সাংবিধানিক সরকার প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন, তা কারও পক্ষে জানা সম্ভব হয়নি। দীর্ঘ অপেক্ষার পর বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ কয়েক দফায় সরকার গঠন করায় পর্যায়ক্রমে বঙ্গবন্ধু হত্যা এবং জেলহত্যার বিচার সম্পন্ন হয়েছে। দণ্ডপ্রাপ্ত কয়েকজনের শাস্তি কার্যকর হয়েছে। কয়েকজন পালিয়ে আছে। জাতি কলঙ্কমুক্ত হয়েছে। দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার পথ কিছুটা সুগম হয়েছে। তবে পঁচাত্তরের হত্যাকাণ্ডের নেপথ্য পরিকল্পনাকারীরা এখনও কোনো পূর্ণাঙ্গ তদন্তের মাধ্যমে শনাক্ত না হওয়ায় রাজনীতিতে এখনও মুখোশধারীদের আনাগোনা বন্ধ হয়নি। তাছাড়া নভেম্বর ট্রাজেডির একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা খালেদ মোশাররফ হত্যার বিচারও হয়নি। জেলহত্যা দিবসের করুণ ও দুঃখজনক স্মৃতি আমাদের কাতর করে, বিষণ্ণ করে। আমাদের রাজনীতিতে হত্যা-ষড়যন্ত্রের যে ধারা তৈরি হয়েছিল তার বীজ সমূলে উৎপাটিত হয়েছে বলেও মনে হয় না। কারো কারো উদাসীনতা ও অবহেলা অনেকের জন্য বড় ক্ষতির কারণ হয়। তাই আর উদাসীনতা ও অবহেলা নয়। রাজনীতি থেকে সব ধরনের হিংসার উপাদান ঝেটিয়ে বিদায় করতে হবে। একদিকের জঞ্জাল পরিষ্কার করতে না করতেই অন্যদিকে জঞ্জাল জমছে। যে অসাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক এবং সব শ্রেণি-পেশা ও ধর্ম-বর্ণের মানুষের জন্য বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছিল, আজ আমরা বেদনার সঙ্গে লক্ষ্য করছি তার বিপরীত যাত্রা। ধর্মীয় উগ্রবাদ মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে। অসহিষ্ণুতা বাড়ছে। আওয়ামী লীগ এবং বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা এখনো ক্ষমতায় আছেন—এতেই কী দেশের মানুষ স্বস্তি বোধ করবে, যদি সব ধরনের অপরাধের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে, অপরাধীদের শাস্তির আওতায় এনে বাংলাদেশকে সব মানুষের বাসযোগ্য করে তুলতে পারা না যায়? মুক্তিযুদ্ধের চেতনার নামে লুটপাটের রাজনীতি চললে, গণতন্ত্রের কথা বলে অংশগ্রহণমূলক ও প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নির্বাচন ব্যবস্থা দৃশ্যমান না হলে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা নিয়ে অহংকার করার নৈতিক শক্তি থাকে কি?