ফিরতে হবে শিকড়ে

দীর্ঘ বক্তৃতা বা কোনো লেখা বা মিছিল-মিটিং করে যে বার্তা মানুষের কাছে পৌঁছানো যায় না, সেই একই বার্তা একটি গান, কবিতা, নাটক বা নৃত্যের মাধ্যমে অনেক বেশি সহজে এবং দ্রুত মানুষের হৃদয়ে পৌঁছে দেয়া যায়।

কংকন নাগকংকন নাগ
Published : 7 March 2024, 12:09 PM
Updated : 7 March 2024, 12:09 PM

লেখার শুরুতেই গত কয়েক বছরে ‘ভাইরাল’ তথা ‘জনপ্রিয়’ হওয়া কিছু গানের একটা তালিকা তৈরি করে নেয়া যাক। ‘যদি থাকে নসিবে, আপনি আপনি আসিবে’, ‘দেখা না দিলে বন্ধু কথা কইও না’, ‘আমার মন বসে না শহরে, তাইতো আইলাম সাগরে’, ‘সাদা সাদা কালা কালা’, ‘আমার বন্ধু চিকন কালিয়া’, ‘সর্বতো মঙ্গল রাধে বিনোদিনী রাই’ ইত্যাদি। এই গানগুলো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অসম্ভব জনপ্রিয়তা পেয়েছে। শুধু তাই নয়, মানুষের মুখে মুখে ফিরেছে গানগুলো। এই লেখা পড়তে পড়তেও নিশ্চয়ই অনেকেই গুনগুনিয়ে এর কোনো না কোনো গান গেয়ে নিয়েছেন।

সব ধরনের গান বাদ দিয়ে কেন হঠাৎ এই গানগুলোর তালিকা করা হলো, এবার সেই প্রসঙ্গে আসা যাক। এই সবগুলো গানেরই একটি ‘কমন’ বৈশিষ্ট্য রয়েছে। আর তা হলো, গানগুলোর সুর লোকজ আঙ্গিকের বা এদেশের কোনো না কোনো অঞ্চলের প্রচলিত পল্লী সুরের সঙ্গে এসব গানের সুর মিলে যায়। শুধু সুর নয়, গানের সঙ্গে যন্ত্রানুষঙ্গ বা উপস্থাপন ভঙ্গিতেও লোকজ ধাঁচের আশ্রয় নেয়া হয়েছে। এই যে লোকজ বা মাটির সুর, এর বিশেষত্বই হলো এখানে সঙ্গীতের ব্যাকরণগত খুব বেশি কাঠিন্য নেই। সুন্দর একটি বহতা নদীর মতো এ সুর বইয়ে চলে, বলা যায় সরাসরি মানুষের হৃদয়ে গিয়ে আশ্রয় নেয়।

এবার এসব গানের শ্রোতা কারা সেদিকে দৃষ্টিপাত করা যাক। প্রায় সবগুলো গানই প্রথমে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দর্শকদের মন জয় করেছে, তারপর হয়তো কোনো কোনোটি চলচ্চিত্রে বা অন্য কোনো মাধ্যমেও ব্যবহৃত হয়েছে। বাংলাদেশে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহারকারীদের অধিকাংশই তরুণ বা নতুন প্রজন্মের। যাদেরকে শিকড়বিচ্ছিন্ন বা দেশীয় সংস্কৃতির সঙ্গে সম্পর্কহীন বলে মনে করা হয়। বর্তমানের তরুণরা অনেক বেশি পাশ্চাত্য সঙ্গীত বা রক, জ্যাজ, র‌্যাপ ইত্যাদির প্রতি আকৃষ্ট বলে অনেকেই মনে করেন। এ ধারণাটি সম্পূর্ণ অমূলক তা বলা যাবে না। কিন্তু, তারা শুধুই পাশ্চাত্য সঙ্গীতের প্রতি অনুরক্ত, লোকজ সুরের প্রতি তাদের কোনো টান নেই— এমন সহজীকরণ করা ঠিক হবে না। মাটির সুর তাদের মনেও বেশ ভালোভাবেই দোলা দেয়, তাদের চিত্ত প্রফুল্ল করে, হৃদয় আকৃষ্ট করে। আর সেকারণেই লোকজ বা মাটির সুরকে আশ্রয় করে তৈরি করা গানই বেশিরভাগ সময় ভাইরাল বা জনপ্রিয় হচ্ছে। শুধু প্রবীণরা নন, তরুণরাও লুফে নিচ্ছে এসব গান।

কিন্তু, কেন লোকজ সুরের গানকে পছন্দ করছে তরুণরা। বর্তমান বাস্তবতায় ছোটবেলা থেকেই জারি, সারি, ভাটিয়ালি, ভাওয়াইয়া, মুর্শিদী, মাইজভাণ্ডারি ইত্যাদি নানা রঙের, নানা রসের গান শোনার সুযোগ তো তারা পায় না। গ্রামাঞ্চলে সচেতনভাবেই এসব গানের চর্চা বা প্রচার-প্রসারের পথ রুদ্ধ করে দেয়া হয়েছে। ধারাবাহিক নির্যাতন-নিপীড়নের মুখেও যেসব বাউল এখনও লোকজ সংস্কৃতি চর্চার প্রচেষ্টা চালান, তাদের সুরও শহুরে তরুণ জনগোষ্ঠীর কানে পৌঁছানোর সুযোগ পায় না। তারপরও যখনই কোনো না কোনো মাধ্যমে এ সুর তরুণদের কাছে পৌঁছে যায়, তখনই তারা সেটিকে সাদরে গ্রহণ করে। তা সে যতই পাশ্চাত্য সঙ্গীত শুনে শুনে বড় হোক না কেন। একজন শিল্পী ও সংস্কৃতিকর্মী হিসেবে নিজেও বহুবার এমন অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয়েছি, যেখানে মঞ্চে পাশ্চাত্য সঙ্গীতের পরিবেশনার পরই লোকগানের পরিবেশনা হয়েছে এবং উপস্থিত তরুণ শ্রোতারা মুগ্ধ হয়ে সেগুলো উপভোগ করেছে।

জীবনে কখনো লোকজ সুরের গান না শুনেও অনেক তরুণ যে এ ধরনের গানকে পছন্দ করছে তার প্রধান কারণ, এটি তার শিকড়ের সঙ্গে সম্পর্কিত। হাজার বছর ধরে চর্চার ফলে যে সুর মানুষের ধ্যানে-জ্ঞানে বা মননের একেবারে গভীরে ঢুকে গেছে, তা থেকে বেরিয়ে আসার বা তাকে পুরোপুরি অগ্রাহ্য করার সক্ষমতা এদেশের মানুষের নেই। এই সুর মানুষ উত্তরাধিকার সূত্রে বহন করে চলেছে। আপনি সুর বা অসুর যা-ই হোন না কেন, সুরের প্রভাব অগ্রাহ্য করার সক্ষমতা আপনার নেই।

সাংস্কৃতিক আন্দোলনেও লোকজ সুরের বেশ বড় একটি প্রভাব রয়েছে। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন থেকে শুরু করে বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রাম এবং পরবর্তী সময়েও লোকজ সুরকে আশ্রয় করে অসংখ্য গান রচিত হয়েছে, যেগুলোতে অন্যায়ের প্রতিবাদ, ন্যায় প্রতিষ্ঠার তাড়না, বৈষম্য-বঞ্চনা অবসানের শপথ, স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা তথা সশস্ত্র যুদ্ধের প্রত্যয়ও ধ্বনিত হয়েছে। ‘ভয় কি মরণে’, ‘ধিতাং ধিতাং বোলে’, ‘হেই সামালো ধান হো’, ‘মাঠে মাঠে সোনালি ধান’, ‘এই না বাংলাদেশের গান গাইতে দুঃখে আমার পরান কান্দে রে’ ইত্যাদি গানের মাধ্যমে সাধারণ মানুষ বারবারই আন্দোলিত হয়েছে। গণসঙ্গীত নামে পরিচিতি পাওয়া এসব গান প্রকৃত অর্থেই হয়ে উঠেছে জনগণের সঙ্গীত।

বর্তমান সময়েও শোষণ-বঞ্চনা বা সমাজের নানা অসঙ্গতির বিরুদ্ধে রচিত গানে ঘুরেফিরে ব্যবহৃত হচ্ছে লোকজ বা মাটির সুর। ‘এমন দ্যাশে জনম মোদের বলিবো কি আর ভাই’, ‘কেহ পায় না সয়াবিন তেল, কেহ খায় ঘি’, ‘আমি হাটে মানুষ, ঘাটে মানুষ’, ‘বাড়ছে তো বাড়ছে, নিত্যপণ্যের দাম বাড়ছে মানুষের আয় কমছে’ কিংবা ‘ও সখিনা গেছস কিনা ভুইলা আমারে’ ইত্যাদি গানগুলোর বাণীতে বিভিন্ন অন্যায়-অত্যাচারের কথা উঠে এসেছে। লোকজ সুরকে আশ্রয় করে গাওয়া বলে মানুষও খুব সহজেই এগুলোকে গ্রহণ করেছে। এভাবে মানুষকে সচেতন করে তোলার চেষ্টা করেছেন শিল্পীরা।

জনমত গঠনের অনেকগুলো উপায়ের মধ্যে অন্যতম হলো সাংস্কৃতিক পরিবেশনা নিয়ে মানুষের সামনে উপস্থিত হওয়া। দীর্ঘ বক্তৃতা বা কোনো লেখা বা মিছিল-মিটিং করে যে বার্তা মানুষের কাছে পৌঁছানো যায় না, সেই একই বার্তা একটি গান, কবিতা, নাটক বা নৃত্যের মাধ্যমে অনেক বেশি সহজে এবং দ্রুত মানুষের হৃদয়ে পৌঁছে দেয়া যায়। আর সেগুলো যদি হয় লোকজ আঙ্গিককে ধারণ করে নির্মিত, তাহলে তো সেটি আরও দ্রুত কাজ করে। তাই, বর্তমান সময়ে যারা সাংস্কৃতিক আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত বা সমাজের নানা অসঙ্গতির অবসান চান, তাদেরকে লোকজ সংস্কৃতির কাছে ফিরে যাওয়ার আহ্বান জানাই। মাটির সুরকে ধারণ করেই কথার বৈচিত্র্যের মাধ্যমে পৌঁছে যেতে হবে মানুষের কাছে। কেননা, মানুষকে শেষ পর্যন্ত শিকড়ের কাছেই ফিরতে হয়।