মিখাইল গর্বাচেভ: নায়ক না প্রতিনায়ক?

ইতিহাসের এক দ্বৈত চরিত্র মিখাইল গর্বাচেভ। একদিকে যিনি হঠাৎ উদ্ভাসিত নায়ক আবার আরেকদিকে ক্রমাগত ডুবে যাওয়া বিতর্কিত রাজনীতিবিদ। তবু এমন মানুষ বারবার জন্মায় না।

অজয় দাশগুপ্তঅজয় দাশগুপ্ত
Published : 31 August 2022, 10:58 AM
Updated : 31 August 2022, 10:58 AM

১৯৯১ সালের অগাস্টে গর্বাচেভের বিরুদ্ধে অভ্যুত্থানের চেষ্টা করেন রুশ হার্ডলাইনাররা। গর্বাচেভের সংস্কার কর্মসূচির বিপরীতে তারা রুশ সাম্রাজ্যের কেন্দ্রীয় কর্তৃত্ব অক্ষুণ্ন রাখার পক্ষে ছিলেন। সংস্কার-পূর্ববর্তী সোভিয়েত ইউনিয়নে ফেরার লক্ষ্যে অগাস্টে তারা গর্বাচেভের বিরুদ্ধে অভ্যুত্থানের চেষ্টা চালায়। এরপর থেকে কার্যত অচল হয়ে পড়ে সোভিয়েত-ব্যবস্থা। ওই মাসেরই শেষের দিকে গর্বাচেভ পদত্যাগ করেন।

গুরুত্বপূর্ণ সেই অধ্যায় সম্পর্কে বিবিসির প্রতিবেদককে গর্বাচেভ বলেন, “আমাদের অজান্তেই একটি বিশ্বাসঘাতকতা সম্পন্ন হয়েছিল। একেবারেই আমার অজান্তে।” গর্বাচেভ বিবিসির প্রতিবেদককে বলেন, “কেবল একটি সিগারেট জ্বালাতে গিয়ে তারা একটা পুরো বাড়ি পুড়িয়েছিল।” এই ছিল প্রয়াত গর্বাচেভের ভাষ্য। যা ইতিহাস কখনো ভুলবে না।

যদি অতীতে ফিরে যাই, তখন আমরা যৌবনের শেষ প্রান্তে। তাসের ঘরের মতো সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন, পূর্ব ইউরোপের দেশগুলির ভোল পাল্টনোর প্রতিযোগিতা দেখে অবাক হয়ে গিয়েছিলাম। এখনকার প্রজন্ম ভাবতেও পারবে না কেমন ছিল তখনকার রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট। এখন অনেকে মনে করেন রাজনীতির দরকার নাই। রাজনীতি মানে কলহ মারামারি। কথা অসত্য নয়। কিন্তু সভ্যদেশগুলো কি আসলে রাজনীতিহীন? না রাজনীতি বাদে কোনো দেশ চলে? মূলতঃ পুঁজি ও বাজার সবকিছু গিলে নিয়ে তরুণ-তরুণীদের এমন এক হাল করেছে যে এরা না ঘুমায়, না জাগে, না ভাবে। নেশায় বুঁদের মতো সারাক্ষণ ইন্টারনেট দুনিয়ার নাগরিকদের কাছে পৃথিবী কি নিরাপদ থাকতে পারে? না তা সম্ভব?

এই বাস্তবতার জন্য দায়ীদের অন্যতম ছিলেন গতকাল প্রয়াত মিখাইল গর্বাচেভ। ওই কাহিনি যারা জানেন তারা নিশ্চয়ই ভুলে যাননি দেশের অন্যতম চালু বাংলা দৈনিকের সম্পাদকসহ অনেক বিশিষ্টজন তখন হঠাৎ ভোল পাল্টে কি লিখেছিলেন, কেন লিখেছিলেন। পরবর্তী সময়ে এদের চেহারা স্পষ্ট হবার আগেও অনেকে বুঝতে পারেননি এই গ্লাসনস্ত বা পেরেস্ত্রোইকা বিষয়গুলো কি! ঠাট্টা করে অগ্রজেরা এ দুটোকে বলতেন, গ্লাসনষ্ট ও পরস্ত্রীকা। মজার ব্যাপার এই যে, যারা রাশিয়া বা সোভিয়েত ইউনিয়নে বৃষ্টি হলেই ঢাকায় ছাতা মাথায় দিতেন তারাই উল্টে গেলেন রাতারাতি। বলাবাহুল্য মিখাইল গর্বাচেভ হয়ে উঠলেন নয়া হিরো।

এ কথা বেমালুম ভুলে গেলাম সোভিয়েত ইউনিয়ন না থাকলে মুক্তিযুদ্ধে বিজয় লাভ করা অসম্ভব ছিল। বিশেষত আমেরিকা, চীন ও পাকিস্তানের সাথে জুটে যাওয়া পশ্চিম ইউরোপের অধিকাংশ দেশ তখন যুদ্ধে পাকিস্তানের পক্ষে। আর যাই হোক পাকিস্তানবিরোধী কোনো অ্যাকশন বা ভোটে যাবে না তারা। সোভিয়েত ইউনিয়নই বাঁচিয়ে রেখেছিল আশা। একাধিক বার ভেটো না দিলে নিরাপত্তা পরিষদে ভুট্টার আগ্রাসন সামলানো যেত না।

গর্বাচেভের কারণে ধস নামা রাজনীতিতে দেশে সমাজতন্ত্র ও আদর্শের মাঠেও চলল নতুন খেলা। শক্তিশালী বাম নামে পরিচিত ভারতের রাজনৈতিক দল সিপিআই এখন উধাও। কোথাও নেই তারা। বাংলাদেশে সোভিয়েতপন্থীরা মোটামুটি ভালো অবস্থানে থাকার পরও গর্বাচেভের কারণে দিশেহারা হয়ে পার্টি অফিসের কাগজপত্র-আসবাবপত্র দু-ভাগে ভাগ করেছিল। তখন বেঁচে থাকা সাংবাদিক লেখক ওয়াহিদুল হক লিখেছিলেন, ভাগ্যিস মানুষ এক পায়ে বসে মল-মূত্র ত্যাগ করতে জানে না। নয়তো কমোডও দু-ভাগে ভাগ করত এরা।

গর্বাচেভের সমঝোতা ও আঁতাতের পর ওই দেশে লেনিনের মূর্তি ভাঙার উল্লাস দেখেছি। ঐতিহাসিক লেনিনগ্রাদের নাম বদলে দেওয়া হলো। কিন্তু গর্বাচেভ বেশিদিন টিকলেন না। বরিস ইয়েলেৎসিন নামের এক উন্মাদের ঠাঁই হয়েছিল রাশিয়ার সিংহাসনে। এই নির্মম বাস্তবতা আমেরিকাসহ ইউরোপকে খুশি করলেও দুনিয়ায় ভারসাম্য হারিয়ে গেল। একক শক্তি ও বাধাহীন হবার পর আমেরিকা দেশে দেশে যে যুদ্ধ ও অন্যায় করেছে তা সোভিয়েত ইউনিয়ন থাকলে কখনো করতে পারত না। মারা যেতেন না সাদ্দাম হোসেন। মধ্যপ্রাচ্যসহ বহু দেশে সোভিয়েত পতন হয়ে উঠেছিল অভিশাপ।

সমাজতন্ত্রের কথিত ফেরিওয়ালাদের কপাল খুলে দিয়ে গেছেন গর্বাচেভ। দেশে দেশে বহু পরিবর্তন ও বদলে যাওয়ায় সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে গর্বাচেভ নোবেল পেয়েছিলেন বটে একই সাথে তাকে পিৎজা বিক্রির বিজ্ঞাপনেও ব্যবহার করেছিল পুঁজিবাদ। তিনি ব্যক্তিগত ভাবে কি লাভ বা ক্ষতি করেছেন সেটা এখন অপ্রাসঙ্গিক। কিন্তু এখনো কি রাশিয়া যুদ্ধ করছে না? ইউক্রেইনে রুশ হামলা কি পুরনো ঘটনা? যার মানে এই, সময় ও পশ্চিমাদের চাওয়া মেটানোর কারণেই অকস্মাৎ হিরো হয়ে উঠেছিলেন মিখাইল গর্বাচেভ।

বিপুলা পৃথিবীর কতটুকু জানি, এ বলে আক্ষেপ করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। জটিল রাজনৈতিক সমীকরণে কে কোথায় থাকে বলা মুশকিল। তবে এটাও মানতে হবে অবরুদ্ধ, শাসনের ঘেরাটোপে আবদ্ধ রুশদের মুক্তি দিয়ে গেছেন তিনি। কিন্তু বাস্তবতা কি বলছে?

রাশিয়ার নেতৃত্বাধীন ১৫ প্রজাতন্ত্রের পরাশক্তি ইউনিয়ন অব সোভিয়েত সোশ্যালিস্ট রিপাবলিক-এর পতনকে ‘অপরাধ’ এবং ‘অভ্যুত্থান’ আখ্যা দিয়েছেন ইউনিয়নের শেষ নেতা মিখাইল গর্বাচেভ। দাবি করেছেন, তার অজান্তে ‘বিশ্বাসঘাতকতা’র মধ্য দিয়ে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন ঘটানো হয়েছিল। সোভিয়েত ইউনিয়ন নামে পরিচিত এই জোট ১৯৯১ সালে ভেঙ্গে পড়ার সময় গর্বাচেভ ছিলেন অবিভক্ত সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট। গুরুত্বপূর্ণ সেই অধ্যায় সম্পর্কে মস্কোতে বিবিসির সংবাদদাতা স্টিভেন রোজেনবার্গের সাথে কথা বলেন তিনি।

স্নায়ুযুদ্ধ শেষ করার জন্য ওই সময়ে পশ্চিমাদের বাহবা কুড়িয়েছিলেন গর্বাচেভ। তাকে দেওয়া হয়েছিল নোবেল শান্তি পুরস্কার। তবে বিবিসি প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে ২৫ বছর আগের সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের ঘটনায় তাকে অনুশোচনায় ভুগতে দেখা যায়।

যখন তার অনুশোচনা ফিরে এসেছিল তখন সময় অনেকদূর গড়িয়ে গিয়েছে। স্নায়ুযুদ্ধের অবসান নামের উৎসবের মাজেজা টের পেয়ে গেছে দুনিয়া। এমনই হয়। সময় থাকতে যারা অনুশোচনা ভোগ করেন না সময় তাদের কাউকে ছেড়ে কথা বলে না। আমি মনে করি ইতিহাস তার গতিপথ নিজেই ঠিক করে নেয়। বাঁকে বাঁকে সে এমন সব মহাজনদের তৈরি করে রাখে যারা সময়ে নায়ক আবার অসময়ে খলনায়ক। গর্বাচেভ নায়ক না খলনায়ক তার বিচার এখনো হয়নি। যখন হবে বা সময় করে দেবে তখন আর যাই হোক এটাত অন্তত বলা যাবে না তিনি যা করেছিলেন তা ছিল একশ ভাগ সঠিক। ওই সময় কাউবয় হ্যাট মাথায় গর্বাচেভকে হিরো বানিয়ে তোলা পশ্চিমা গণমাধ্যম এখন কি বলে সেটাও দেখার বিষয়। ইতিহাস নিশ্চয়ই এটাও মনে রাখবে যে, তিনি ১৯৯৬ সালে রাজনৈতিক জীবনে ফিরে আসার একটি দুর্ভাগ্যজনক প্রচেষ্টা নিয়েছিলেন। ওই সময় অনুষ্ঠিত রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে মাত্র ০.৫ শতাংশ ভোট পেয়েছিলেন। রাজনীতির মারপ্যাঁচ যাই বলুক এই ভদ্রলোক একসময় ত্রাতা বা গণতন্ত্রের প্রবক্তা নামে পরিচিত ছিলেন। যদিও ওই ধারণা পরে আর কাজ করেনি। যদি কোনো লোকসান হয়ে থাকে তা হয়েছে আপামর দরিদ্র আর হতাভাগ্য জনগোষ্ঠীর। যারা সোভিয়েত ইউনিয়ন ভাঙ্গার কুফল আজও ভোগ করছেন।

সবমিলিয়ে ইতিহাসের এক দ্বৈত চরিত্র মিখাইল গর্বাচেভ। একদিকে যিনি হঠাৎ উদ্ভাসিত নায়ক আবার আরেকদিকে ক্রমাগত ডুবে যাওয়া বিতর্কিত রাজনীতিবিদ। তবু এমন মানুষ বারবার জন্মায় না। এটাই সত্য বলে মানি।