যদি টাঙ্গাইলের তাঁতশিল্পীদের দেশত্যাগ করতে না হতো বা তাদের এদেশেই সংসার নিয়ে স্বাচ্ছন্দ্যে বসবাসের নিশ্চয়তা দেয়া যেত, তাহলে হয়তো আজ টাঙ্গাইল শাড়ির বৈশ্বিক স্বীকৃতি অন্য দেশের কাছে যেতে দেখতে হতো না।
Published : 13 Feb 2024, 05:41 PM
বেশ কিছুদিন ধরেই টাঙ্গাইলের তাঁতের শাড়ির জিআই বা ভৌগোলিক নির্দেশক পণ্যের স্বীকৃতি ভারতের কাছে যাওয়া নিয়ে ব্যাপক আলোচনা চলছে। যে শাড়িটি বাংলাদেশের একান্ত নিজস্ব সংস্কৃতির অংশ, সেটি ভারতের পণ্য হিসেবে বিশ্ব দরবারে স্বীকৃতি পাওয়ার বিষয়টি কেউই মেনে নিতে পারছেন না। প্রতিবাদ, সমালোচনা আর বিতর্কের কারণে দেরি করে হলেও বিষয়টি নিয়ে তৎপর হয়েছে বাংলাদেশ সরকার।
ভারতের পাওয়া জিআই স্বীকৃতি সনদে বলা হয়েছে, মূলত ভারতের পশ্চিমবঙ্গের পূর্ব বর্ধমান জেলায় প্রথম উৎপত্তি হয় এ শাড়ির। পূর্ব বর্ধমানের যে কয়েকটি গ্রামে এ শাড়ির উৎপত্তি বলে দাবি করা হচ্ছে, তার মধ্যে অন্যতম সমুদ্রগড়। শুধু সমুদ্রগড়ই নয়, আশপাশের আরও ৩০-৪০টি গ্রামজুড়েই বসবাস করেন তাঁতশিল্পীরা। এ লেখার শিরোনামে ‘দেশত্যাগের যন্ত্রণা’ শব্দবন্ধটি দেখে অনেকেই হয়তো কিছুটা অবাক হয়েছেন। আসুন, এবার এর ব্যাখ্যা দেয়া যাক।
আমরা জানি, টাঙ্গাইল শাড়ির উৎপত্তি মূলত বাংলাদেশের টাঙ্গাইল জেলা এবং এর আশপাশের অঞ্চলে (ঐতিহাসিকভাবেও এটি সত্য)। এক সময় ওই অঞ্চলের প্রায় প্রতিটি বাড়িতেই ছিল তাঁতশিল্পীদের বসবাস, পুরো অঞ্চলটি বিশেষ ভূমিকা রাখত এ ভূখণ্ডের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধিতে। তবে, রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক-সামাজিক নানা কারণে তাঁতশিল্পীরা স্বদেশ ছেড়ে বিদেশে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছেন। দেশভাগের পর থেকেই শুরু, তবে একটি বড় অংশ দেশত্যাগ করতে বাধ্য হন একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময়।
১৯৭১ সালের আগে এবং সবশেষ ২০০০ সাল পর্যন্ত যেসব তাঁতশিল্পী দেশত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছেন তাদের বেশিরভাগই (প্রায় শতভাগই বলা যায়) ভারতের পশ্চিমবঙ্গে পূর্ব বর্ধমান জেলার সমুদ্রগড় এবং আশপাশের গ্রামগুলোতে গিয়ে আবাস গড়েছেন। দীর্ঘ কয়েক দশক ধরে চলতে থাকা এ দেশত্যাগের করুণ বাস্তবতায় ধীরে ধীরে সমুদ্রগড়সহ পুরো অঞ্চলটির সংখ্যাগরিষ্ঠ বাসিন্দা হয়ে ওঠেন এদেশের টাঙ্গাইল ও আশপাশের অঞ্চলে একসময় দাপটের সঙ্গে বসবাস করা তাঁতশিল্পীরা। কয়েক প্রজন্ম ধরে তারাই হয়ে উঠেছেন সেখানকার অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি। আর এই বিষয়টিরই সুফল ভোগ করেছে ভারত সরকার। সমুদ্রগড়ের তাঁতশিল্পীদের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকে দেখিয়ে আদায় করে নিয়েছে বৈশ্বিক জিআই স্বীকৃতি।
এ প্রসঙ্গে কথা হচ্ছিল বাংলাদেশ থেকে ভারতে চলে যেতে বাধ্য হওয়া একজন তাঁতশিল্পী বিষ্ণু বসাকের সঙ্গে। গত শতাব্দীর নব্বইয়ের দশকের শেষভাগে বাবা-মায়ের সঙ্গে সমুদ্রগড়ে চলে যেতে বাধ্য হন তিনি। বিষ্ণু বলেন, “আমাদের আদি নিবাস ছিল টাঙ্গাইলের নাগরপুর উপজেলার পাকুড়দিয়া পাচরাইল এলাকায়। সেখানে কয়েক প্রজন্ম ধরে আমাদের বসবাস ছিল। তবে, প্রথমে রাজনৈতিক কারণ এবং পরবর্তীতে তাঁত শাড়ি বিক্রি করে সংসার চালানো অসম্ভব হয়ে পড়ায় দেশ ছাড়তে বাধ্য হন আমার বাবা-মা।” তিনি আরও জানান, সমুদ্রগড় অঞ্চলের পুরোনো বাসিন্দা যারা, তাদের বেশিরভাগই একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময় দেশত্যাগ করেন। সবশেষ ২০০৫-০৬ সালের দিকেও অনেকে দেশ ছেড়েছেন।
তবে, সমুদ্রগড়েও এখন হাতে বুনে তাঁতের শাড়ি তৈরি করার মতো শিল্পী প্রায় নেই বললেই চলে। সেখানকার বেশিরভাগই এখন মেশিনে তাঁতের শাড়ি তৈরি করেন। যদিও, এ বিষয়টিকে ভালোভাবে নেন না বিষ্ণু। তিনি জানান, “মেশিনে প্রতিদিন গড়ে ১৫টি শাড়ি তৈরি করা যায়। কিন্তু হাতে বুনলে সারাদিনে খুব বেশি হলে একটা শাড়ি তৈরি করা সম্ভব। তাই, করোনা মহামারীর সময় যে লকডাউন দেওয়া হয়েছিল, তারপর থেকেই হাতে বোনা প্রায় শেষ।” তবে, মানের দিক থেকে হাতে বোনা তাঁতের শাড়ির থেকে অনেকটাই পিছিয়ে মেশিনে তৈরি শাড়ি। মেশিনের শাড়ি টেকসই কম, কিন্তু হাতে বোনা শাড়ির স্থায়িত্ব অনেক বেশি।
দু-দেশের তাঁতের শাড়ির পার্থক্য বলতে গিয়ে তরুণ প্রজন্মের তাঁতশিল্পী বিষ্ণু জানান, “বাংলাদেশে তাঁতের শাড়ি তৈরি করা হয় সুতির সুতো দিয়ে। আর ভারতে তাঁতের শাড়ি তৈরি হয় পলেস্টার সুতোর মিশ্রণে তৈরি এক ধরনের সুতো দিয়ে। তাই দুটির মানের পার্থক্য অনেকটাই। বাংলাদেশের মতো তাঁতের শাড়ি ভারতে তৈরি করা সম্ভব না। তবে, ভারত থেকে সুতো আমদানি করেই শাড়ি তৈরি করেন বাংলাদেশের তাঁতশিল্পীরা।”
যদি টাঙ্গাইলের তাঁতশিল্পীদের দেশত্যাগ করতে না হতো বা তাদের এদেশেই সংসার নিয়ে স্বাচ্ছন্দ্যে বসবাসের নিশ্চয়তা দেয়া যেত, তাহলে হয়তো আজ টাঙ্গাইল শাড়ির বৈশ্বিক স্বীকৃতি অন্য দেশের কাছে যেতে দেখতে হতো না। শুধু টাঙ্গাইল শাড়িই নয়, বাংলাদেশের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির আরও একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ ‘ঢাকাই মসলিন’-এরও জিআই স্বীকৃতির জন্য আবেদন করেছে ভারত।
ভবিষ্যতে হয়তো এ ভূখণ্ডের এমন আরও অনেক ঐতিহ্যবাহী, সাংস্কৃতিক পণ্যেরই জিআই স্বীকৃতির দাবি জানাতে পারে ভারত। সেটি প্রতিরোধ করা এবং বাংলাদেশের নিজস্ব সাংস্কৃতিক উপাদানগুলোকে সংরক্ষণের জন্য আগে প্রয়োজন নিজের সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্য সম্পর্কে সম্যক ধারণা রাখা। আর এরপর উদ্যোগ নিতে হবে দেশীয় সংস্কৃতির বৈশ্বিক স্বীকৃতি আদায়ের। তাহলেই শুধু সংস্কৃতি সংরক্ষণই নয়, একইসঙ্গে বিশ্ববাসীকেও জানানো যাবে বাংলাদেশের বর্ণাঢ্য, বৈচিত্র্যময় সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের কথা।