আর্থিক অন্তর্ভুক্তির ভিত্তি প্রস্তুত, এবার উড়বার পালা

যারা ডিজিটাল সেবা দিচ্ছেন– বিশেষ করে অনলাইন ব্যবসা করছেন, তাদেরকে কিছু প্রণোদনা যদি নাও দেওয়া যায়, তারা যাতে নিয়ম-নীতির কড়া বেড়াজালে আটকে না পড়ে সে দিকে নজর দিলেই লেনদেন ক্যাশলেস করার কাজটা অনেকখানি সহজ হয়ে যাবে।

তানভীর এ মিশুকতানভীর এ মিশুক
Published : 30 March 2023, 01:07 PM
Updated : 30 March 2023, 01:07 PM

আগামী চার বছরের মধ্যে সরকার দেশের ৭৫ শতাংশ লেনদেনকে ক্যাশলেস করার লক্ষ্য ঠিক করেছে, সংবাদ মাধ্যমে তেমন খবরই বেরিয়েছে। আমি বা আমরা যারা প্রচলিত লেনদেনকে ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে তুলে আনার কাজ করছি, তাদের জন্যে এটি খুবই সুখের একটা খবর। আমি তো স্বপ্ন দেখি প্রত্যন্ত গ্রামে, যেখানে ত্রিসীমানায়ও কোনো ব্যাংক নেই, সেখানেও ডিজিটালি লেনদেন জনপ্রিয় হবে। এটি কিন্তু আমার কোনো দূরবর্তী স্বপ্ন নয়। সকলকে নিয়ে খুব অল্প সময়েই এই লক্ষ্য অর্জন করতে চাই আমি।

সকল সেবা সহজেই মানুষের হাতের মুঠোয় রাখতে ডিজিটাল বা ক্যাশলেস লেনদেন ছাড়া সহজ তো আর কোনো পথ নেই। আবার লেনদেনকে স্বচ্ছ-পরিচ্ছন্ন করার জন্যে ক্যাশলেস সমাজ প্রতিষ্ঠারও বিকল্প নেই। তবে আমরা যারা ডিজিটাল লেনদেনকে সার্বজনীন করতে কাজ করছি– তারা ভালো করেই জানি কাজটা সহজ নয়। অন্যদিকে আবার কঠিন লক্ষ্য বাস্তবায়নই তো আসল অর্জন, সাধারণ কিছু করা তো কোনোভাবেই অর্জনের পরিতৃপ্তি দিতে পারে না। তবে ২০২৭ সালের মধ্যে বাংলাদেশের তিন চতুর্থাংশ লেনদেন ক্যাশলেস করার যে লক্ষ্য সেটি আবার কঠিনও।আমার বিবেচনায় ছোট্ট কিছু নীতি সহায়তা দিলেই লেনদেনকে ক্যাশলেস করার যে লক্ষ্য তার পথে অনেকখানি অগ্রগতি হবে। সকল ক্ষেত্রে ‘ক্যাশলেসই প্রাধান্য পাবে’, টপ টু বটম– এটিই হতে হবে সামগ্রিক লক্ষ্য।

তাছাড়া যারা ডিজিটাল সেবা দিচ্ছেন– বিশেষ করে অনলাইন ব্যবসা করছেন, তাদেরকে কিছু প্রণোদনা যদি নাও দেওয়া যায়, তারা যাতে নিয়ম-নীতির কড়া বেড়াজালে আটকে না পড়ে সে দিকে নজর দিলেই লেনদেন ক্যাশলেস করার কাজটা অনেকখানি সহজ হয়ে যাবে। যেমন– ফেসবুকে ব্যবসা করছেন এমন উদ্যোক্তা আছে এখন লাখের ওপরে। কিন্তু তাদেরকে সঠিক উপায়ে ডিজিটাল লেনদেনের মধ্যে আনা যাচ্ছে না। ট্রেড লাইসেন্স না থাকায় তারা কেউ মোবাইল লেনদেনের মার্চেন্ট অ্যাকাউন্ট খুলতে পারছেন না। ফলে ক্যাশলেস লেনদেন বৃদ্ধি পাচ্ছে না। বরং অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ক্যাশ অন ডেলিভারিতেই ব্যবসা পরিচালিত হচ্ছে। ফলে ছাপা টাকার চাহিদা কমছে না।

এটা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, এই সব ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা অর্থনীতিতে প্রবৃদ্ধি যোগ করছে কিন্তু তাদের অবদান হিসেবের খাতায় যুক্ত হচ্ছে না। আমি নিশ্চিত করে জানি, এই খাতগুলোকে হিসেবের মধ্যে আনতে পারলে প্রবৃদ্ধির খাতায় সমৃদ্ধি ঘটবে যা অর্থনীতিকে দেবে বাড়তি গতিশীলতা।

পারা না পারার এই খচখচানির মধ্যেই আমাদের সবচেয়ে বড় অর্জন হল ক্যাশলেস লেনদেনের ক্ষেত্রে যে প্রাথমিক ভিত্তি লাগে সেটা আমরা তৈরি করে ফেলেছি। সারা দেশের আনাচেকানাচে ইন্টারনেট ছড়িয়ে পড়েছে। ডিজিটাল বাংলাদেশ বাস্তবায়নের পথরেখা ধরেই রচিত হয়েছে এই সফল্য। মোবাইল আর্থিক সেবা চলে গেছে হাতে হাতে। সব ব্যক্তির কাছে না হলেও অন্তত প্রতিটি পরিবারে নগদ পৌঁছে গেছে, এমন দাবি করাটা অমুলক কিছু নয়। মাত্র চার বছর আগে যাত্রা করেও এখন আমাদের নিবন্ধিত গ্রাহক সাড়ে সাত কোটি ছুঁই ছুঁই, সে হিসেবে দেশের আর একটি পরিবারও বাকি থাকার কথা নয়।

এই বাস্তবতায় আমরা এমন একটি সাফল্যের ছবিও আঁকতে সক্ষম হয়েছি, যেখানে গাড়ির চাকাও কখনো ঘুরেনি বা দেশের প্রান্তবর্তী যে গ্রামটিতে বিদ্যুতের আলোও পৌঁছায়নি, সেখানকার মানুষও সরকারি অনেক আর্থিক সেবা পাচ্ছেন নগদের মাধ্যমে। এই হলো আমাদের দেশের আর্থিক অন্তর্ভুক্তির সর্বশেষ চেহারা। এর মানে এই নয় যে, দেশের সব মানুষকে আমরা আর্থিক অন্তর্ভুক্তিতে আনতে পেরেছি। তবে এটা তো ঠিক যে, বড় একটি অংশকে এই সেবা নেটওয়ার্কে আনা গেছে। আর এক্ষেত্রে পেছন থেকে কিছু উদ্ভাবন আমাদেরকে সাফল্যের পেছনে ছুটতে সাহায্য করেছে।

সহজে অ্যাকাউন্ট খোলার জন্যে ইলেক্ট্রনিক কেওয়াসি’র উদ্ভাবন বা মোবাইলের পাঁচ ডিজিট (*১৬৭#) ডায়াল করে অ্যাকাউন্ট খোলা- এসবই আসলে আর্থিক অন্তর্ভুক্তিতে বড় ধাক্কা দিয়েছে। তার কারণে মোবাইল আর্থিক সেবার ওপর ভর করে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির ভাতা বা উপবৃত্তি বিতরণ হয়েছে সহজ, অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং সাশ্রয়ী। আমার বিবেচনায় একটা নীরব বিপ্লব ঘটে গেছে ভেতরে ভেতরে, হয়তো অনেকের অলক্ষ্যেই।

আর্থিক অন্তর্ভুক্তির এই যে প্রসার, সেটি বাংলাদেশকে উন্নয়নের মহাসড়কে তুলে দিয়েছে। এখন আমাদের সকলের কাজ হলো এতে গতি দেওয়া। ডিজিটাল হয়ে ওঠা সেবাকে স্মার্টনেসের পর্যায়ে নিয়ে আসতে আমাদের সম্মিলিতভাবে কাজ করতে হবে।

খুব রক্ষণাত্মকভাবে বললেও আর্থক অন্তর্ভুক্তির এই সময় পর্যন্ত যে অর্জন সেখানে খুব বড় একটা ভূমিকা রেখেছে চার বছর আগে জন্ম নেওয়া একটা মোবাইল আর্থিক সেবা প্রতিষ্ঠান। নগদের উদ্ভাবনগুলো ডিজিটাল বাংলাদেশ থেকে উত্তরণ ঘটিয়ে স্মার্ট বাংলাদেশ হওয়ার পথকে সহজ-সরল করে দিয়েছে। এই পথ রেখা ধরেই বিনির্মাণ হয়েছে ক্যাশলেস বাংলাদেশের। আধুনিক এই পৃথিবীতে ছাপা টাকা বহন করাটা আর কোনো অর্থ বহন করে না। বরং এটা নানারকম ঝুঁকি তৈরি করে। সবচেয়ে বড় কথা, ছাপা টাকা রাষ্ট্রের জন্যও একটা বোঝা।

২০১৯ সালের ১৬ মে একটি ইংরেজি দৈনিকে ছাপা হওয়া এক প্রতিবেদনেই দেখছিলাম শুধু ছাপা টাকার ব্যবস্থাপনায় প্রতিবছর বাংলাদেশ ব্যাংকের খরচ হয় নয় হাজার কোটি টাকা! স্টাডিটা এখন করলে অংকটা কি দাঁড়াবে আমি জানি না। তবে আমার কথা হল– আমরা চাইলেই কিন্তু এই খরচটা নামিয়ে আনতে পারি স্রেফ ক্যাশলেস সমাজ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে। আর সেটাই করার জন্য নিরলস কাজ করছি আমরা।

লক্ষ্য বাস্তবায়নের অংশ হিসেবে আমরা নগদ থেকে কেবল টাকা লেনদেনের ভেতরেই আটকে থাকিনি। প্রধানত মানুষের অর্থনৈতিক অন্তর্ভুক্তিকে যতটা সম্ভব সহজ করার জন্য শুরু থেকেই কাজ করছি আমরা। আর এখন আমাদের লক্ষ্য মোবাইল লেনদেনের কলেবর বৃদ্ধি করা– যাতে দৈনন্দিন জীবনের প্রতিটি কাজই মোবাইল আর্থিক সেবা বা নগদের মাধ্যমে করা যায়। আর সে জন্যে অনলাইন কমার্সসহ সংশ্লিষ্ট সকলের সেবা প্রসারের সুযোগ দিতে হবে।

শুধু মোবাইল আর্থিক সেবাই নয়; যে কোনো খাত কতটা শক্তির ওপর দাঁড়িয়েছে তার প্রমাণ হয়– কঠিন সময়ে সেটি কতোটা কাজে দিয়েছে তার পরীক্ষার মাধ্যমে। এই যেমন কোভিডের সময় সুবিধাবঞ্চিত মানুষের জন্য প্রধানমন্ত্রীর ঈদ উপহার বিতরণের মাধ্যমে একটা প্রমাণ হয়েছে। সে সময় ৫০ লাখ পরিবারকে দুইবার করে আড়াই হাজার টাকা করে প্রধানমন্ত্রীর ঈদ উপহার পাঠানো হয়েছে। বলার অপেক্ষা রাখে না– নগদ-ই এক্ষেত্রে নেতৃত্ব দিয়েছে। এরপর সামাজিক নিরাপত্তা ভাতা এবং শিক্ষা উপবৃত্তি বিতরণের সাফল্য আমাদেরকে বড় কিছু করার স্বপ্ন দেখাচ্ছে।

আমাদের এই সাফল্য রচনা হয়েছে আসলে অসাধারণ কিছু প্রযুক্তির ওপর ভর করে। একটা সময় ব্যাংক বা যে কোনো আর্থিক প্রতিষ্ঠানের অ্যাকাউন্ট খোলা মানেই ছিল বিশাল একটা ধকল পোহানো। এক গাদা কাগজ পূরণ, ছবি, আইডি কার্ড নিয়ে ছোটাছুটি ছিল নিত্যকার ঘটনা। এই ব্যাপারটাই বাংলাদেশে বদলে দিতে পেরেছি আমরা।

এসব প্রেক্ষাপটে এটা নিশ্চয়ই বলা যায় যে, বাংলাদেশ একটি ক্যাশলেস সোসাইটির দিকে এগোচ্ছে। কিন্তু এগুনোর যে গতি সেটি দিয়ে উন্নত বাংলাদেশ পাওয়া হবে সময়সাপেক্ষ। স্মার্ট বাংলাদেশ গড়তে আমাদেরকে যেতে হবে পরের ধাপে। যেখানে ডিজিটাল ব্যাংকিং এবং মাইক্রো ফাইন্যান্সিংয়ের ওপর বাড়তি জোর দিতে হবে। এসব কাজের সাফল্য পেতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহার করতে হবে। ফলে সহজেই গ্রাহকের ক্রেডিট রেটিং হবে। আর ক্ষুদ্র ঋণ দেওয়া বলি, আর ‘বাই নাউ পে লেটার’ বলি না কেনো– সবই বদলে যাবে মুহুর্তে। এর পুরোটাই অর্থনৈতিক কার্যক্রমকে বেগবান করবে।

তাছাড়া ক্ষুদ্র লেনদেন এবং কেনাকাটাও অনেক শক্তিশালী হবে সামনের দিনে। ফলে রিকশা ভাড়া দেওয়া থেকে শুরু করে ফেরিওয়ালার পণ্যের দাম পরিশোধ– সবই করতে হবে ছাপা টাকার ব্যবহার ছাড়াই। ব্যবসায়িক লেনদেন বা গ্রাহক থেকে ব্যবসায়ীর লেনদেন গতিশীল করতে পারলে তা আমাদের অর্থনীতিকে দেবে আরো গতিশীলতা।

আমাদের এখন কেবল সামনে চলার পালা। উন্নত বিশ্বের কাতারে যেতে আমাদের যে প্রবৃদ্ধি প্রয়োজন সেটি অর্জন করতে স্মার্ট লেনদেনের কোনো বিকল্প নেই। স্মার্ট লেনদেনের সংস্কৃতি চালু করতেও আমরা দেশীয় উদ্যোক্তা এবং দেশের তরুণ মেধাবীরা নেতৃত্ব দেবে বলে আমার বিশ্বাস।