যুদ্ধদিনের গদ্য-০৫: রক্তমাখা কোরআন শরিফটাই মায়ের শেষ স্মৃতি

সালেক খোকনসালেক খোকন
Published : 8 Sept 2022, 04:40 PM
Updated : 8 Sept 2022, 04:40 PM

“বিহারি সমাজেই বড় হয়েছি আমরা। বাবা ছিলেন অ্যাকাউন্টস অফিসার, রেলওয়েতে। ওই সুবাদে থাকতাম সৈয়দপুর শহরে, আতিয়ার কলোনির এল-৭৬-বি নম্বর কোয়ার্টারে। ফুটবল খেলা নিয়ে বাঙালি-বিহারি গ্রুপিং হতো। বিহারিরা খেলত ভালো, তবে মারদাঙ্গাও করত। সামান্য অজুহাতেই মারামারি লাগিয়ে দিত। কিছু হলেই গালাগালি করত। ওদের মুখের গালি এতটাই খারাপ ছিল যে আমরা মুখেও আনতে পারতাম না।"

"সৈয়দপুরে বিহারিরাই নেতৃত্ব দিত। ছয় দফার আন্দোলন চলছে। বাঙালিদের প্রতি পাকিস্তানের বৈষম্যগুলোও স্পষ্ট হতে থাকে। বিহারিরা ছিল পাকিস্তানের পক্ষে। ফলে ওদের সঙ্গে আমাদের ভেদ তৈরি হয়। বঙ্গবন্ধুর অনুরাগী বাঙালিদের ওরা ভালো চোখে দেখত না।"

"ওরা উর্দুভাষায় নিজেদের মধ্যে নানা আলোচনা করত। প্রকাশ্যে শেখ মুজিবকে 'গাদ্দার' বলত, গালিও দিত। শুনে ঠিক থাকতে পারতাম না। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে সারা দেশে আন্দোলন তখন তুঙ্গে। সৈয়দপুর শহরের সকল বাঙালি একাট্টা হয়ে থাকতাম। স্টেডিয়ামের নাম উর্দুতে লেখা ছিল। তা আলকাতরা দিয়ে মুছে দিয়েছিলাম। ১৯৭০ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি। ভাষাশহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করব আমরা। আগেই টাকা তুলে ইট, বালি ও সিমেন্ট দিয়ে স্কুলমাঠে একটা শহীদ মিনার তৈরি করি। কিন্তু রাতের আঁধারে বিহারিরা মেথরদের দিয়ে বাইরে থেকে মল (পায়খানা) এনে ওই শহীদ মিনারের বেদিতে ফেলে রাখে। সকালে এ দৃশ্য দেখে বুকের ভেতর আগুন জ্বলে উঠে। লাঠিসোটা নিয়ে সবাই তৈরি। ওদের সঙ্গে মুখোমুখি সংঘর্ষ হবে। কিন্তু তার আগেই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নেন তৎকালীন এসডিও। নিজ উদ্যোগে শহীদ মিনার পরিষ্কার করে দেন তিনি। পরে সেখানে আমরা শহীদদের স্মরণে শ্রদ্ধা নিবেদন করি।"

সত্তরের নির্বাচনের সময় ঘটে আরেক ঘটনা। কলোনির পাশে চিকা (দেওয়াল লেখা) মারছিলাম। পরিচিত এক বিহারি ছেলে এসে বলে, শেখ মুজিব গুণ্ডা হ্যাঁয়। শুনেই মাথায় রক্ত চড়ে যায়। নিজেকে ঠিক রাখতে পারি না। ঘুষি দিয়ে ওর নাক ফাটিয়ে দিই। মুহূর্তের মধ্যে অনেক বিহারি একত্র হয়। ওরা আক্রমণ করে আমার নাকও ফাটিয়ে দেয়, নাকের নিচের ডগাটা আজও ভাঙা।

"সৈয়দপুরে আমাদের প্রতি বিহারিদের নির্মমতার চূড়ান্ত বহিঃপ্রকাশ ঘটে মুক্তিযুদ্ধে। তাদের বর্বরতা আর হিংস্রতার কথা মনে হলে এখনও বুকের ভেতরটা খামচে ধরে। অথচ একাত্তরে গণহত্যায় যুক্ত বিহারিদের বিচার এখনও আমরা করতে পারেনি।”

একাত্তরকে ঘিরে সৈয়দপুরে বাঙালিদের ওপর বিহারিদের অত্যাচারের নানা ঘটনার কথা এভাবেই তুলে ধরেন বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. মুরাদ হোসেন। এক সকালে তার বাড়িতে বসেই আলাপ চলে যুদ্ধদিনের নানা প্রসঙ্গে।

আমজাদ হোসেন সিকদার ও সুফিয়া খাতুনের সন্তান মুরাদ হোসেন। দুই ভাই-বোনের সংসারে মুরাদ বড়। তার পৈতৃক বাড়ি বিক্রমপুরের ভাগ্যকুল উপজেলার কামারগাঁওয়ে। আর নানা বাড়ি রাজবাড়ীর সূর্যনগর উপজেলার জিউপাড়া গ্রামে।

বাবার বদলির চাকরির কারণে মুরাদের জন্ম ও বেড়ে ওঠা তৎকালীন রংপুর ও বর্তমান নীলফামারী জেলার সৈয়দপুর শহরে। বর্তমানে তিনি রাজধানী ঢাকার উত্তর সিটি করপোরেশনের ১২ নম্বর ওয়ার্ডের নির্বাচিত কাউন্সিলর। পাশাপাশি ওয়ার্ডে আওয়ামী লীগের সভাপতিও।

মুরাদের লেখাপড়ায় হাতেখড়ি সৈয়দপুর এগ্নো মিডিয়াম ইংলিশ স্কুলে। ফাইভ পর্যন্ত পড়ার পর ক্লাস সিক্সে ভর্তি হন সৈয়দপুর হাই স্কুলে। মুক্তিযুদ্ধের সময় ছিলেন ওই স্কুলেরই ম্যাট্রিক পরীক্ষার্থী।

ছোটবেলায় চঞ্চল ও ডানপিটে ছিলেন মুরাদ। বাবার আদর ও প্রশ্রয় পেতেন বেশি। মা খুব শাসন করতেন। তিনি শিক্ষানুরাগী ছিলেন। মাগরিবের নামাজের পর মুরাদদের নিয়ে পড়তে বসাতেন। পাশে বসে তিনিও লাইব্রেরি থেকে আনা বই পড়তেন। ছেলেমেয়েদের পড়াশোনার ব্যাপারে কোনো ছাড় দিতেন না। বলতেন– পড়াশোনা আগে, তারপর অন্যকিছু। মায়ের আদর্শে এভাবেই বেড়ে ওঠেন তারা।

১৯৬৯ থেকে ১৯৭১ পর্যন্ত প্রতিদিনই মিছিল হতো সৈয়দপুরে। কলেজ থেকে বড়রা আসত। তখন ক্লাসে গিয়ে মুরাদ স্যারদের বলতেন– আজকে আর ক্লাস না স্যার, সবাইকে ছেড়ে দেন, মিছিল হবে। অনেক সময় নিজেরাই ঘণ্টা বাজিয়ে ছুটি দিয়ে দিতেন। ফলে হেডমাস্টার তার ওপর খুব নাখোশ হতেন। এভাবেই আন্দোলনের পথে এগিয়ে যান মুরাদরা।

সত্তরের নির্বাচনের সময় বঙ্গবন্ধু আসেন সৈয়দপুরে। মিটিং করেন স্কুল মাঠে। নেতাকে ওটাই তার প্রথম দেখা। ওই স্মৃতি আজও জীবন্ত হয়ে আছে মানসপটে। তার ভাষায়, “সৈয়দপুরে এমপিএ- তে দাঁড়ান ডা. জিকরুল হক। তিনি ছিলেন অত্যন্ত সাহসী ও ভালো মানুষ। ২৫শে মার্চ রাতেই তাকে বাড়ি থেকে আর্মিরা তুলে নিয়ে যায় সৈয়দপুর ক্যান্টনমেন্টে। পরে তার দেহ সাত টুকরা করে সাত রাস্তার মোড়ে টাঙিয়ে রাখে ওরা।"

"জিকরুল হকের জন্য ভোট চাইতেই সৈয়দপুর আসেন বঙ্গবন্ধু। এরপর যাবেন নীলফামারী। আমার মামা ছিলেন ইলেকশন অফিসার। তিনি খবর দেন, তোদের বাড়ির সামনে দিয়েই যাবেন বঙ্গবন্ধু।"

"শুনে আমাদের ভেতর সে কি উত্তেজনা। কীভাবে অভ্যর্থনা জানাব নেতাকে! তার প্রস্তুতি চলে। ছোটবোন ইভা জহুরা বান্ধবীদের নিয়ে ফুল সংগ্রহ করে মালা তৈরি করে। ওই মালা দিয়েই বঙ্গবন্ধুকে শুভেচ্ছা জানাই। ওইদিন টিপ টিপ বৃষ্টি হচ্ছিল। তার মধ্যেই মালা হাতে সবাই দাঁড়িয়ে। দেখে বঙ্গবন্ধু প্রথম খুব ধমকালেন। বললেন– ‘লেখাপড়া বাদ দিয়ে বৃষ্টির মধ্যে ভিজছো কেন তোমরা? যাও পড়াশোনা করো। পরীক্ষায় ভালো করতে হবে।’ বঙ্গবন্ধুকে মালা দিতে দেখে বিহারিরা আমাদের দিকে আক্রোশের চোখে দেখে। ক্রমেই তাদের সঙ্গে দূরত্ব বাড়তে থাকে।”

সত্তরের নির্বাচনে সৈয়দপুরসহ সারা দেশে আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করলেও ক্ষমতা দিতে টালবাহানা করতে থাকে পাকিস্তানি সামরিক জান্তা। বিহারিরাও তখন বাঙালিদের ওপর চড়াও হয়। বাঙালিদের সাথে তারা কথা বলা ও মেলামেশা বন্ধ করে দেয়। বাঙালিরাও আন্দোলনের জন্য ভেতরে ভেতরে রেডি হতে থাকে। বাকী ইতিহাস শুনি মুরাদের মুখেই।

তার ভাষায়, “দেখিয়ে দেখিয়ে ওরা কুড়াল, তলোয়ার, ছুরি প্রভৃতি অস্ত্র ধার দিতে থাকে। বুঝে যাই কিছু একটা ঘটাবে। ওরা ক্যান্টনমেন্টের সাথে আর আমরা আশাপাশের গ্রামের বাঙালিদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে থাকি। বেঙ্গল রেজিমেন্টে বাঙালি সেনারা যখন বাইরে আসত তখন তাদের সঙ্গেও যোগাযোগ হতো। গোপনে তারাও নষ্ট ও ডামি রাইফেল দিয়ে আমাদের অস্ত্র চালানো শেখায়। মার্চের প্রথম দিকে কলেজের পেছনের মাঠে চলে ট্রেনিং। বেঙ্গল রেজিমেন্টের একজন সুবেদার ট্রেনিং করান। আমরা ছাড়াও গ্রাম থেকে আসা যুবকরাও ট্রেনিং নেয়। বন্ধু উলফাত ক্যাডেট কলেজে পড়ত। সে-ও ট্রেনিংয়ে সহযোগিতা করে।”

এরপর কী ঘটল?

“বিহারিদের সঙ্গে দ্বন্দ্ব বাড়তে থাকে। ওদের নেতা ছিল মতিন হাশমি, সৈয়দপুর কলেজের প্রিন্সিপাল ছিলেন। পুরো বিহারি এলাকার নেতৃত্ব দিতেন। প্রকাশ্যে তিনি ঘোষণা দেন, ২৩শে মার্চ যুদ্ধ হবে। বোঝাপড়া হবে এদেশে আমরা থাকব নাকি তোমরা (বাঙালিরা)।"

"কিন্তু ওদের হুমকিতে আমরা আতঙ্কগ্রস্ত ছিলাম না। মরে যাব কিন্তু পাকিস্তানি বা বিহারিদের কাছে মাথা নত নয়। এ দেশ মুক্ত করে বাঙালিদের কাছেই দিয়ে যাব– এমন শপথ নিই সবাই।"

"২২শে মার্চ রাতেই গোলারহাটে যুদ্ধ শুরু হয়। বিহারিদের মধ্যে যারা ছুরি এনেছে তারা একদিকে, তলোয়ার, বল্লম, বন্দুক আর লাঠিওয়ালারাও একেক দিকে ভাগ হয়ে অবস্থান নেয়। এদিকে আশেপাশের গ্রামগুলো থেকে বাঙালিরাও লাঠিসোটা নিয়ে চলে আসে। রাত থেকেই মারামারি শুরু হয়। গোলারহাটে প্রথম আগুন জ্বলে। ওরা এগিয়ে আসলে গ্রামের দিক থেকে আসা বাঙালিদের সঙ্গে ফাইট হয়। রক্তাক্ত প্রান্তরে মারাঠাদের সাথে মুসলমানদের যুদ্ধ হয়েছিল। ওখানে কারা থাকবে– মুসলমানরা নাকি মারাঠারা। সৈয়দপুরে আমাদের যুদ্ধটাও ওরকমই ছিল।"

"২৩শে মার্চ সারাদিন যুদ্ধ চলে। কথা ছিল ক্যান্টনমেন্ট থেকে সেনারা কেউ বের হবে না। কিন্তু ২৪শে মার্চ পাঞ্জাব রেজিমেন্টের সেনারা ক্যান্টনমেন্ট থেকে সিভিল ড্রেসে বেরিয়ে আসে। মাথায় গামছা বেঁধে তারা মেশিনগান দিয়ে ফায়ার শুরু করে। ফলে পাখির মতো বাঙালি মরে। হাজার হাজার লাশ দেখে তৎকালীন এসডিও মুয়ীদ চৌধুরী থানায় অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলেন। আমরা তখন গ্রামের দিকে লুকিয়ে থাকি।”

পরিস্থিতি খারাপ দেখে মুরাদের ছোটবোন ইভা জোহরাকে পাঠিয়ে দেওয়া হয় নীলফামারী, মামার বাড়িতে। কলোনির কোয়ার্টারে তখন তার মা সুফিয়া খাতুনের সঙ্গে থাকত দূরসম্পর্কের এক বোন, নাম জোবাইদা। কিন্তু মুরাদ কলোনিতে ফিরতে পারে না। তার মাথার দামও ঘোষিত হয় প্রকাশ্যে। জীবিত বা মৃত তাকে ধরিয়ে দিতে পারলে ৫০০ টাকা দেবে বিহারিরা। এতেই তারা ক্ষান্ত হয় না। বাড়িতে আক্রমণ করে মুরাদের মমতাময়ী মাকে দ্বিখণ্ডিত করে হত্যা করে।

ওই ইতিহাসের কথা বলতে গিয়ে বারবারই থেমে যান মুরাদ হোসেন। বুকে জমে থাকা কষ্টের পাহাড়ে তখন বৃষ্টি ঝরে। চোখের জলে বুক ভাসিয়ে তিনি বলেন শহীদ মাতার আত্মত্যাগের করুন ইতিহাসটি– “সৈয়দপুর শহরের সব বাঙালিকে ওরা আটকে রেখেছিল। আন্দোলনে যারা যুক্ত ছিল তাদের ফ্যামিলিকেও বাঁচতে দেয়নি। ১৪ই এপ্রিল রাতে আম্মাকে ওরা নির্মমভাবে হত্যা করে। কলোনিতে ওটাই ওদের প্রথম অ্যাটাক। মেইন রোডের পাশেই ছিল আমাদের কোয়ার্টার, ছাদ দেওয়া একতলা বাড়ি। মার্চের শুরুতেই ছাদের ওপর বিশাল সাইজের একটা বাংলাদেশের পতাকা ও একটা কালো পতাকা লম্বা বাঁশ দিয়ে টাঙিয়ে দিয়েছিলাম। সেটা দেখা যেত অনেক দূর থেকে। রাস্তা দিয়েই যাতায়াত করত পাকিস্তানি আর্মি। বাংলাদেশের পতাকা দেখে তারা ক্ষিপ্ত হয়।"

"বিহারিরা প্রথম এসে আম্মাকে বলে, 'উসকো উতার দো'। তিনি বলেন, 'আমার ছেলে টাঙিয়েছে। এটা আমি নামাতে পারব না।' ওরা দূরে দাঁড়িয়ে থাকা পাকিস্তানি আর্মিদের ভয় দেখিয়ে আবারও পতাকা নামাতে বলে। এবারও আম্মা অস্বীকৃতি জানায়। তাকে ধাক্কা দিয়ে ছাদে ওঠার চেষ্টা করে ওরা। কিন্তু আম্মার বাধার কারণে পারে না। ফলে হুমকি ও গালাগালি করে চলে যায়।"

"এর কিছুক্ষণ পরই আর্মিসহ বিহারিদের একটি সশস্ত্র দল এসে দরজায় ধাক্কা দিতে থাকে। মা তখন রেহালে রেখে কোরআন শরিফ পড়ছিলেন। পেছনের দরজা দিয়ে তিনি ওই বোনটাকে পাঠান পাশের বাড়িতে, আব্বার বন্ধুকে ডেকে আনতে। কিন্তু পথের মধ্যেই বিহারিরা বোনটাকে কুপিয়ে হত্যা করে। সামনের দরজা ভেঙে তারা ঘরের ভেতরে যখন ঢোকে, আম্মা তখন কোরআন শরিফ বুকে জড়িয়ে ধরে বসে থাকেন। ওদের কাছে প্রাণভিক্ষাও চান। কিন্তু পিশাচদের মন গলে না। কোরআন শরিফ ধরা অবস্থাতেই আম্মাকে ওরা কোপ দিয়ে দেহ থেকে মাথা আলাদা করে ফেলে। রক্তে ভেসে যায় পুরো ঘর। আল্লাহর কালাম কোরআন শরিফও মাটিকে পড়ে রক্তে ভিজে যায়। মুসলমান হয়েও বিহারিরা এমন বর্বরতা চালিয়েছিল। পরে আম্মার লাশ পাকিস্তানি আর্মিরা ট্রাকে তুলে নিয়ে যায়। তার লাশটাও ফেরত দেয়নি ওরা। বোন জোবাইদার লাশটা রাস্তায় পড়েছিল কয়েকদিন। দুর্গন্ধ ছড়াতে থাকলে স্থানীয়রা পরে তা মাটি চাপা দেয়।"

আশাপাশের পরিচিতজনেরা আম্মার করুণ ও নির্মম মৃত্যু প্রত্যক্ষ করে। তাদের মুখেই শুনেছি সবকিছু। বিহারিরা চলে গেলে পাশের বাসার একজন ঘর থেকে আম্মার রক্তমাখা কোরআন শরিফটি তুলে নেন। পরে সেটি আমরা সংগ্রহ করি। রক্তমাখা ওই কোরআন শরিফটাই আমাদের মায়ের শেষ স্মৃতি। যার পাতায় পাতায় এখনো রয়েছে ছোপ ছোপ রক্তের দাগ।

"কোরআন শরিফটা হাতে নিলে বুকের ভেতর ঝড় ওঠে। পতাকা দুটি যদি না টাঙাতাম তাহলে হয়তো ওরা আম্মাকে এভাবে হত্যা করত না। মাঝেমধ্যে নিজেকেও অপরাধী মনে হয়। স্বপ্নে আম্মার চিৎকার শুনে জেগে উঠি প্রায়ই। তখন খুব কষ্ট লাগে। এই দুঃখের কথা ঠিক বোঝাতে পারব না ভাই। দেশ তো স্বাধীন হয়েছে কিন্তু আমরা তো মাকে ফিরে পাইনি, তার লাশও পাইনি। ফলে তার কবরও নেই। পুরো দেশের মাটিতেই মিশে আছে আমার মায়ের রক্ত। কিন্তু এ দেশ কি মনে রাখবে আমার শহীদ মাকে?”

আক্ষেপ নিয়ে মুরাদ বলেন, “একাত্তরে শত শত মায়েরা এভাবেই স্বাধীনতার জন্য জীবন দিয়েছিলেন। কিন্তু স্বাধীন দেশে আমরা কি মনে রেখেছি সেই মায়েদের? তাদের আত্মত্যাগের কয়টি ইতিহাস জানে এ প্রজন্ম। আজ আপনি এসেছেন বলে বলতে পারছি। কিন্তু সকল শহীদের আত্মত্যাগের ইতিহাস তুলে ধরতে না পারার দায় কিন্তু আমরাও এড়াতে পারব না। তাই শহীদেরদের ইতিহাসও তুলে আনতে হবে।"

গ্রামের দিকে কিছুদিন থাকার পর মুরাদরা ডোমার হয়ে চলে যান চিলাহাটির উত্তরে, ভারত অংশে। ওটা ছিল ছয় নম্বর সেক্টরের চিলাহাটি সাবসেক্টর এলাকা। সাবসেক্টর কমান্ডার ছিলেন ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট ইকবাল রশিদ। সেখানেই ট্রেনিং হয় তাদের। একুশ দিনের ট্রেনিং। কিন্তু মুরাদ পনের দিন করেই শারীরিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েন, হার্নিয়ার সমস্যায়।

তিনি বলেন, "মেডিকেল বোর্ডের পরামর্শে ট্রেনিং আর করা হয় না। সাবসেক্টর কমান্ডার আমাকে সঙ্গে সঙ্গে রাখতেন। তার বডিগার্ড হিসেবেই ক্যাম্পে ছিলাম। শারীরিক কারণে এরপর আমি চলে যাই বাবার নতুন কর্মস্থল, পাকশীতে। দেশে ঢুকেই আম্মাকে হত্যার খবরটি পাই। পরে পাকশী থেকে আসি কুষ্টিয়ায়, খালার বাড়িতে। ওখানে স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গেও ছোটখাটো অপারেশনে যুক্ত থাকি।”

রাজবাড়িতেও ছিল বিহারিদের শক্তিশালি ঘাঁটি। মুক্তিযুদ্ধ তখন শেষের দিকে। চারদিক থেকে রাজবাড়িতে মুক্তিযোদ্ধারা ঢুকছে। কুষ্টিয়া থেকে মুরাদও তখন চলে যান নানা বাড়িতে, রাজবাড়ির সূর্যনগর উপজেলার জিউপাড়া গ্রামে। পরিচিত মুক্তিযোদ্ধারা খোঁজ পেয়ে তাকে দলে নিয়ে নেন। তিনি যুক্ত হন জিল্লুল হাকিমের (বর্তমান সাংসদ) গ্রুপে।

বাকি ইতিহাস বলেন মুরাদ হোসেন– “নানা একাত্তরে অসহায় নারী-পুরুষদের পাশে ছিলেন। মুক্তিযোদ্ধাদেরও খাদ্য ও আশ্রয় দিয়ে সহযোগিতা করেছিলেন। জিল্লুল হাকিমের সাথে অস্ত্র হাতে রাজবাড়ি ঘেরওয়ে থাকি। ওটা ছিল আট নম্বর সেক্টরে। গোটা শহরে বিহারি বোঝাই, পাঞ্জাবিও অনেক। রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ হয় সেখানে। আমরা সংখ্যায়ও ছিলাম অনেক, চারপাশ থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের সকল গ্রুপও চলে আসে। পরে ওরা সারেন্ডার করে। অনেক বিহারি নারীও বাঙালি হত্যাযজ্ঞে যুক্ত ছিল। তখন বিহারি দেখলেই মনে হতো আম্মার হত্যাকারী। ১৮ ডিসেম্বর রাজবাড়ি হানাদারমুক্ত হয়। আমার অস্ত্রটা তখন জিল্লুল ভাইয়ের কাছেই জমা দিই।"

যে দেশের স্বপ্ন নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে গেলেন, যে স্বাধীনতার জন্য আপনার মা শহীদ হলেন– ওই স্বপ্নের দেশ কি পেয়েছেন?

“অবশ্যই পেয়েছি। আমরা তো যুদ্ধ করেছি একটি জাতির জন্য। বেঁচে গেছি সৌভাগ্যক্রমে। তবে আশানুরূপ দেশ এখনও হয়নি, হওয়ার পথে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় ও দুর্নীতি মুক্ত কাজের ধারা প্রতিষ্ঠা করা গেলে দেশ আরও এগোবে।”

অকপটে এই বীর আরও বলেন– “স্বাধীন দেশের পাতাকা এনেছি রক্তের বিনিময়ে। ওই পতাকা আবার জিয়ার আমলে স্বাধীনতাবিরোধীদের গাড়িতে উড়েছে। এর চেয়ে কষ্টের আর কি আছে বলেন।”

এমনটা কেন হলো?

“গণতন্ত্রের মধ্যে মৌলিক কাঠামো থাকতে হবে। সেটা আমাদের নেই। যেমন সবকিছুর ঊর্ধ্বে রাখতে হবে স্বাধীনতাকে, জাতির পিতাকে ও জাতীয় সংগীতকে। এসব বিষয়ে সব দলকেই ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে। এখন এক দল প্রো পাকিস্তানি, আরেকদল বাংলাদেশের পক্ষে, আরেক দল প্রো ইন্ডিয়ান– এমন তো হতে পারে না। আমরা দেশের জন্য ফাইট করেছি। বাংলাদেশের ভালো ও মন্দের পক্ষে থাকব। কিন্তু সেটা হয়নি। জিয়াউর রহমান স্বাধীনতাবিরোধীদের পুনর্বাসনের মাধ্যমে গোটা বাঙালি জাতিকে দ্বিখণ্ডিত করে গেছেন। ইতিহাস ও মুক্তিযুদ্ধকে করেছেন কলঙ্কিত। অথচ তিনি ছিলেন একটি সেক্টরের কমান্ডার। তাই তার মুক্তিযুদ্ধে যাওয়ার উদ্দেশ্য নিয়েও আরও গবেষণার প্রয়োজন রয়েছে। ইতিহাসের প্রকৃত সত্যটা প্রজন্মকে জানাতে হবে।”

কী করলে দেশ আরও এগোবে?

মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে বলবো– “সরকার যদি কঠোর হস্তে দুষ্টের দমন ও শিষ্টের পালন করতে পারে তাহলে খুব সহজে সোনার বাংলা গড়ে উঠবে। অপরাধী সে যেই হোক তার কোনো ছাড় নেই। এমনটা হতে হবে। বঙ্গবন্ধুই শিখিয়েছেন অন্যায়ের পথে যেন না হাঁটি। বঙ্গবন্ধু তো টাকার পেছনে ঘোরেন নাই, জাতির দিকে, তার দেশবাসীর দিকে তাকিয়েছিলেন। বাইশ পরিবারকে এ দেশ থেকে তাড়িয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধুর ওই আদর্শ আজ নেতাদের ভেতর ধারণ করতে হবে।”

এই বীর মুক্তিযোদ্ধা মনে করেন প্রজন্মের কাছে মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত ইতিহাস তুলে ধরা জরুরি। এদেশের উন্নতি করতে হলে দুটি স্তম্ভের ওপর দাঁড়াতে হবে– একটি মুক্তিযুদ্ধ, আরেকটি বঙ্গবন্ধু। মুক্তিযুদ্ধের আত্মত্যাগ বুকে ধারণ করতে না পারলে দেশের টাকা বাইরে পাচার করতেও কেউ দ্বিধাবোধ করবে না বলে মত দেন তিনি।

প্রজন্মের উদ্দেশে বীর মুক্তিযোদ্ধা মুরাদ হোসেন তুলে ধরেন শেষ কথাগুলো– “তোমরা মোহের পথ থেকে বিরত থেকো। বিচার বিশ্লেষণ ছাড়া কাউকে নেতা নির্ধারণ করো না। মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধুর আদর্শের পথে চলো। দেশকে ভালোবেসো। তোমাদের হাত ধরেই এ দেশ একদিন আরও সম্মানিত হবে, গড়ে উঠবে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা।”

ছবি ও ভিডিও: সালেক খোকন