রাজনীতি করতে যে যোগ্যতা লাগে, সেটা হিরো আলমের মতো লোকজনের আগমনের অনেক আগেই অসার করে দিতে শুরু করেছে রাজনৈতিক দলগুলো। এরই মধ্যে বগুড়ার পর ঢাকায় ফাঁকতালে নির্বাচন করতে এসে হিরো আলম সেটা ষোলকলায় পূর্ণ করে দিয়েছেন।
Published : 08 Jul 2023, 08:11 PM
বাংলাদেশে নির্বাচন সঠিকভাবে হয় না বা হলেও ফলাফল সঠিকভাবে ঘোষণা করা হয় না—এই অভিযোগ পুরনো। একটা কথা বলি, সরকারবিরোধী প্রচারণা জোরসে চললেও এখন আর আগের মতো হালে পানি পায় না। সত্য ও অর্ধ সত্যের সঙ্গে মিথ্যার মিশেল দিয়ে গুজবকারীরা এমন এক পরিবেশ তৈরি করেছে যে কেউ আর কাউকে বিশ্বাস করতে পারছে না। সেই ফাঁকে ঢুকে পড়েছে বৈরী কালের বাতাস । হিরো আলমরাও নির্বাচনী রাজনীতিতে আলোচনার বিষয় হয়ে যাচ্ছেন।এই বিষাক্ত বাতাসে গণতন্ত্র ধুঁকছে। আজ একটু স্পষ্ট করেই বলতে চাই, আসলে কি গণতন্ত্র আমাদের খুব প্রয়োজন? না আমরা চাইছি শেখ হাসিনা বিরোধিতা?
ব্যক্তিগতভাবে আমি কোনো দলের অন্ধ সমর্থক নই। ছেলেবেলায় বাম আদর্শের প্রতি ঝুঁকলেও বঙ্গবন্ধু এবং জাতীয় চার নেতার মৃত্যু মানতে পারিনি। বিশেষ করে ইতিহাস বিকৃতি আর বিএনপি জামায়াতের তাণ্ডবকালে বড় হয়ে উঠেছি আমরা। নিষিদ্ধ বঙ্গবন্ধু ও ইতিহাস ফিরিয়ে আনার জন্য যেমন, তেমনি এরশাদের ভয়াবহ স্বৈরশাসনের অবসান ঘটানোর জন্যও নৌকায় ভোটও দিয়েছি। আন্দোলনে যুক্ত হয়েছি। নৌকা ছিল তখন আশা ও ভরসার প্রতীক।
এখন নৌকা দেশ শাসনে। একের পর এক দেশ শাসনের ফলে দেশের চেহারা পাল্টে গেছে।গোল বেধেছে নির্বাচন আর গণতন্ত্র নিয়ে। এ লেখা যখন লিখছি খবরে দেখলাম হোয়াইট হাউসে নাকি কোকেন পাওয়া গেছে। খবরটা এখনো এটা পুরোপুরি বিশ্বাস করতে পারছি না। তবে এমনটা ঘটলে কি অবাক হবো খুব? গণতন্ত্রের ধ্বজাধারী দেশ আমেরিকা। এটা সত্য তাদের অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্র ভিত্তি পেয়েছে অনেক আগে। এবং তারা গণতান্ত্রিক জাতি। কিন্তু বাইরের দেশগুলোতে কি আমেরিকা সত্যি গণতন্ত্রের পক্ষে ন্যায়নিষ্ঠ? আজ যারা আওয়ামী লীগ ও শেখ হাসিনার সরকার হটানোর জন্য আমেরিকার পায়ে ধরতে রাজি, তারা কি ইরাক ও আরব দেশে আমেরিকার যুদ্ধ আর সরকার হটানো সমর্থন করেন? আমি জানি তারা তা করেন না। কিন্তু ওই যে দুশমনের দুশমন আমার বন্ধু সে ভাবে আমেরিকাকে দোস্ত ভাবার যুগ শুরু হয়েছে এখন। এর মূল্য কতটা ভয়াবহ হতে পারে তার প্রমাণ দেবে সময় ।
আমি একবারও বলছি না আমেরিকা বা পশ্চিমা দেশের সঙ্গে বৈরিতা করতে হবে। বরং ইউরোপের গণতন্ত্র বা সভ্যতার সঙ্গে চলি না বলেই আজ আমাদের এই করুণ হাল। এখানেও একটা কথা বলা জরুরি, যারা এখন গণতন্ত্রের নামে আমেরিকা ও পাশ্চাত্য দেশগুলোর সমর্থন কামনা করেন তারা ব্যক্তি ও রাজনৈতিক জীবনে ঘোর পশ্চিমাবিরোধী। তাদের রাজনৈতিক আদর্শ কি সেটা বিএনপি বা জামায়াতের আদর্শ বিবেচনা করলেই টের পাওয়া যায়। যখনই তারা দেশ শাসনে বা গদিতে এসেছে তখনই আসল চেহারা দেখেছে মানুষ। তারপরও গণতন্ত্রের নামে তাদের মায়াকান্না দেখি আর ভাবি আসলে কি চায় তারা?
বলতে চেয়েছিলাম যোগ্যতার কথা। গণতন্ত্রের নামে কি আমরা চোর ডাকাত বাটপার বা রুচিহীনদের সমর্থন করবো? আমরা কি চাইবো যে আমাদের ভঙ্গুর সমাজকে আরো কলুষিত করুক এরা? এরা কারা? কিভাবে এরা উঠে আসলো? আজ কি কারণে লাইম লাইটে তারা? এর জবাব আমাদের অজানা নয়। রাজনীতি যখন থেকে নিস্ক্রিয়, যখন থেকে রাজনীতি লোভ আর লালসার শিকার, তখন থেকেই শুরু হয়েছে অধঃপতন। একসময় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, তাজউদ্দীন আহমদ ও সৈয়দ নজরুল ইসলামদের মতো রাজনীতিবিদরা দেশ চালিয়েছেন। ছিলেন মাওলানা ভাসানী, মনি সিং, কমরেড ফরহাদ ও যাদু মিয়াদের মতো রাজনীতিবিদ। আদর্শ উদ্দেশ্য কিংবা পথের ভিন্নতা যতটুকু ততটুকুই ছিল সীমারেখা। এর বাইরে তাদের ভেতর যে সুসম্পর্ক ছিল তা কখনো নষ্ট হয়নি। তারা নষ্ট হতে দেননি। আজ পরিবেশ পুরা উল্টো। কেউ কাউকে বিশ্বাস করা দূরে থাক, একে অপরের বিরুদ্ধে ঠাট্টা-মশকরা করার নামে চলছে অসুস্থ প্রতিযোগিতা । বিরোধী দল যে বলে তাদের রাজনীতি করতে দেওয়া হয় না, তা কি আসলেই মিথ্যা? খেলার মাঠ সমান না—একথা বলতে বলতে কণ্ঠে ফেনা তোলা বিরোধীদের কথা তো সত্য। মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের রাজনৈতিক আদর্শ আমি সমর্থন করি না। তার দলের প্রতি সমর্থন জানাবার কোনো কারণ আমার কাছে নেই। কিন্তু এটা মানি তিনি একজন খাঁটি ভদ্রলোক। তার মার্জিত কথাবার্তা আমার পছন্দ। কিন্তু তিনি তো নীতি নির্ধারক নন দলটি। তার দলের সবাই যদি তার কথায় চলতো তাও কথা ছিল। সে দল চলে কার কথায় তা সবার জানা। তেমনি সরকারি দলটিও কার কথায় চলে আমাদের কারোর অজানা নেই। দলে যদি গণতন্ত্র না থাকে, দেশে থাকবে কিভাবে ?
বলছিলাম যোগ্য মানুষের কথা। এই যে ঢাকা-১৭ আসনের উপনির্বাচন, তার দিকে চোখ রাখলে বুঝবেন সমস্যা আসলে কোথায়? চিত্রনায়ক ফারুক (আকবর হোসেন পাঠান) মারা যাওয়ার পর খালি হওয়া এই আসনে উপনির্বাচন হবে । বাংলাদেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি এলাকা। এই এলাকার নির্বাচন সুষ্ঠু না হলে জনমনে কি প্রভাব পড়বে বা পড়তে পারে তা আমাদের অজানা নয়। কিন্তু মুশকিল হচ্ছে এই আসনে আওয়ামী লীগ প্রার্থী মোহাম্মদ এ আরাফাতের প্রতিদ্বন্দ্বী হলেন স্বতন্ত্র প্রার্থী আশরাফ আলম ওরফে হিরো আলম। প্রবাসে বসে যতটুকু টের পাচ্ছি, এখন পর্যন্ত আরাফাতের প্রচার-প্রচারণা পোস্টারেই আটকে আছে এবং হিরো আলম জনসংযোগ করতে নেমে নাটকের অবতারণা করছেন।
এখন পরিবেশ এমন আপনি হিরো আলম বা এমন কারো বিরুদ্ধে বললেই সমাজমাধ্যম আপনার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়বে। দেখবেন পঙ্গপালের দল কোনো কারণ ছাড়াই কতটা গণতান্ত্রিক আর খোলা তলোয়ার । দেশ ও সমাজের কোন অন্যায় অপমানে তারা না থাকলেও কাউকে অপমান করার বেলায় এক পা এগিয়ে। সম্প্রতি টক শোতে সত্য কথা বলতে গিয়ে হঠাৎ আওয়ামী লীগারদের কোপানলে পড়ে টের পেয়েছি তারাও কতটা আগ্রাসী আর মরিয়া । যা বলছিলাম, হিরো আলম বাংলাদেশের নাগরিক। তার অধিকার আছে নির্বাচন করার। ভোটে দাঁড়ানোর। তিনি তা করতেই পারেন।
রাজনীতি করতে যে যোগ্যতা লাগে, সেটা হিরো আলমের মতো লোকজনের আগমনের অনেক আগেই অসার করে দিতে শুরু করেছে রাজনৈতিক দলগুলো। এরই মধ্যে বগুড়ার পর ঢাকায় ফাঁকতালে নির্বাচন করতে এসে হিরো আলম সেটা ষোলকলায় পূর্ণ করে দিয়েছেন। কেন হিরো আলমের মতো লোকজন এটা করে দিতে পারছেন, তার কারণ হচ্ছে দেশে ভোটের পরিবেশ নেই। প্রতিযোগিতা নেই। প্রতিদ্বন্দ্বীও নেই। সে কারণে হিরো আলমের মতো কেউ নির্বাচনে দাঁড়াতে সাহস পেয়ে যান। বলাবাহুল্য তার পেছনে কারা সেটাও আমরা বুঝি। নির্বাচন নিয়ে কথা না থাকলে বা ঝামেলা না থাকলে এরা হিরো আলমের সঙ্গে থাকত না। আজ এটাই বাস্তবতা যে আরাফাতের মতো প্রার্থীকে লড়তে হচ্ছে হিরো আলমের সঙ্গে ।
এখন মানুষেরই ঠিক করতে হবে তারা কি যোগ্যতার জয় চায়, না রাজনীতিতে হিরো আলমের মতো অপ্রস্তুত কারোর অহেতুক আগমন ঘটাতে আগ্রহী? একাদশ জাতীয় নির্বাচনে শপথ নেওয়া সংসদ সদস্যদের ১৮২ জনই (৬১ দশমিক ৭ শতাংশ) পেশায় ব্যবসায়ী। নব্বুইয়ের গণঅভ্যুত্থানের পর সংসদ নির্বাচনে বিএনপির সব আসনে প্রার্থী দেওয়ার মতো অবস্থা ছিল না। তারা ধরেবেঁধে ব্যবসায়ীদের এনে দাঁড় করিয়ে দিল। সেই বার বিএনপি ক্ষমতায় এল এবং রাজনীতি হয়ে যেতে শুরু করল ‘বাণিজ্যে বসতে লক্ষ্মী’, লাভজনক ব্যবসা। হিরো আলম সংসদ সদস্য হতে চান। তার শিক্ষাদীক্ষা না থাকা নিয়ে আমরা বিস্তর কথা বলছি। তবে এই সংসদেই তো এসএসসি পাশ করেননি এমন সংসদ সদস্য আছেন ১১ জন।
হিরো আলমের যোগ্যতার যত ঘাটতিই থাকুক না কেন, একটা যোগ্যতা ভালোভাবে রপ্ত করেছেন তিনি, সেটা হলো ভিক্টিমের প্রতি সহানুভূতি আদায়ের অভিনয়। নিজেকে নিপীড়িতের অংশ করে নেওয়ার বুদ্ধি। নির্বাচন করতে এসে প্রার্থিতা হারানো, পরে আবার আপিল করে প্রার্থিতা ফিরে মাঠে নামার মধ্য দিয়ে আলোচনায় আছেন আলোচিত এই অনলাইন কনটেন্ট ক্রিয়েটর। এই সেদিন গত ৫ জুলাই ‘ওরা মহিলা বাহিনী দিয়ে আমাদের অ্যাটাক করছে’ অভিযোগ এনে আলোচনায় নতুন মাত্রা দিয়েছেন হিরো আলম। সেদিন তিনি মহাখালী সাততলা বস্তিতে প্রচার করতে বের হয়েছিলেন।
গণতন্ত্রের নামে এমন সর্বনাশা খেলা বন্ধ হোক। দেশ ও জনগণের স্বার্থে সরকারি দলের উচিত গণতন্ত্রের দুয়ার খুলে দেয়া, সবার জন্য। দোহাই লাগে, হিরো আলমদের ‘হিরো’ বানাবেন না।