অভ্যন্তরীণ বিষয়ে বিদেশিদের হস্তক্ষেপ দেশের মানুষ তো বটেই রাজনীতিবিদদের জন্যও যে সম্মানজনক নয়। কিন্তু বিদেশিরা কেন বাংলাদেশের নির্বাচন, গণতন্ত্র, মানবাধিকার, বাকস্বাধীনতা ইত্যাদি নিয়ে সবক দেয়ার সুযোগ পাচ্ছে—সেটিই মূল প্রশ্ন।
Published : 27 Jul 2023, 12:42 AM
ঢাকা-১৭ আসনে উপনির্বাচনের ভোট সুষ্ঠু না হলে নাকে খত দিয়ে পদত্যাগ করার ঘোষণা দিয়েছিলেন ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) কমিশনার খন্দকার গোলাম ফারুক। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ভোট সুষ্ঠু হয়নি। বরং খোদ পুলিশের সামনেই প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর ব্যাজপরা কিছু লোকের হামলার শিকার হয়েছেন স্বতন্ত্র প্রার্থী আশরাফুল আলম ওরফে হিরো আলম।
এই ঘটনার পরে ডিএমপি কমিশনার নাকে খত দিয়ে পদত্যাগ না করলেও তিনি এর ব্যাখ্যায় বলেছেন, পুলিশকে না জানিয়ে বনানী কেন্দ্রে যাওয়ায় হিরো আলম হামলার শিকার হয়েছেন। একজন প্রার্থী কেন্দ্রে যাবেন—সেটি পুলিশকে জানাতে হবে কেন এবং পুলিশকে না জানিয়ে যাওয়ার ফলে তিনি আক্রমণের শিকার হবেন—এটি কোনো গ্রহণযোগ্য কথা নয়। তাছাড়া হামলার সময় পুলিশ যে ঘটনাস্থলেই ছিলে, সেটি টেলিভিশন চ্যানেল ও পত্রিকার খবরেই দেখা গেছে।
এরকম পরিস্থিতিতে, অর্থাৎ ঢাকা-১৭ আসনের উপনির্বাচনে পুলিশের ভূমিকা নিয়ে যখন অনেকেই প্রশ্ন তুলছেন, তখন জানা গেলো যে, আওয়ামী লীগের ভ্রাতৃপ্রতিম তিন সংগঠন যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ ও ছাত্রলীগ ২৭ জুলাই বৃহস্পতিবার বায়তুল মোকাররমের দক্ষিণ গেটে শান্তি সমাবেশের অনুমতি চাইলেও পুলিশ তাদের অনুমতি দেয়নি। এরপর তারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জিমনেসিয়াম মাঠে সমাবেশের জন্য আবেদন করেও ব্যর্থ হয়েছে। অবশেষে আগারগাঁওয়ের আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মেলার পুরনো মাঠে সমাবেশের সিদ্ধান্ত নেয় এবং দিনতারিখও বদলে নেয়।
ক্ষমতাসীন দলকে তাদের পছন্দসই স্থানে, পছন্দ করা দিনে পুলিশ সমাবেশের অনুমতি না দিয়ে কি নিজেদের নিরপেক্ষ প্রমাণ করতে চাইলো এবং সরকারও কি এই বার্তা দিতে চাইলো যে, দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন হলেও পুলিশ সেখানে নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করবে?
যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন নানা সময়ে দলীয়করণ ইস্যুতে বিতর্কিত হয়েছে, সেই বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনও কি ক্ষমতাসীন দলকে সমাবেশের অনুমতি না দিয়ে নিজেদেরকে দলীয় কালিমামুক্ত করার চেষ্টা করছে? নাকি সত্যি সত্যিই বৃহস্পতিবার সপ্তাহের শেষ কর্মদিবসে জনভোগান্তির কথা চিন্তা করে পুলিশ ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন তাদেরকে সমাবেশের অনুমতি দেয়নি? ঘটনা যাই হোক, সমাবেশের ভেন্যু চেয়ে পরপর দুটি স্থান থেকে ক্ষমতাসীন দলের ‘প্রত্যাখ্যাত’ হওয়ার পেছনে কোনো একটি রাজনীতি থাকা অসম্ভব নয়।
উল্লেখ্য, একইদিনে রাজধানীতে সমাবেশ করতে চেয়েছিল ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপিও। সম্প্রতি এটি একটি অতি সাধারণ প্রবণতায় পরিণত হয়েছে যে, যেদিনই বিএনপি কোথাও কর্মসূচি দেয়, একই দিনে ক্ষমতাসীন দলও একই ধরনের কর্মসূচি নেয়। যেমন বিএপির পদযাত্রার বিপরীতে আওয়ামী লীগের শান্তি শোভাযাত্রা; বিএনপির সমাবেশের বিপরীতে আওয়ামী লীগের শান্তি সমাবেশ; বিএনপির এক দফার বিপরীতে আওয়ামী লীগেরও এক দফা। এ নিয়ে জনপরিসরে নানাবিধ রসিকতা চালু হয়েছে। যদিও ভোটের রাজনীতি শেষ পর্যন্ত আর রসিকতায় সীমাবদ্ধ থাকে না। সেটা অনেক সময় সংঘাতে রূপ নেয়। বিশেষ করে প্রতিদ্বন্দ্বী দুটি দল যখন নিজেদের দাবিতে অনড় থাকে এবং কোনো ধরনের ছাড় দেয়া, আলোচনা বা সমঝোতার পথ রুদ্ধ করে দেয়। তখন রাজপথেই ফয়সালা হয়। যারা আন্দোলনে জেতে, ভোটের ফলও তাদের পক্ষে যায়। এক্ষেত্রে ক্ষমতাসীন দল কিছুটা বাড়তি সুবিধা ভোগ করে। কেননা রাষ্ট্রের আইনশৃঙ্খলা ও অন্যান্য বাহিনী তাদের পক্ষে থাকে।
বৃহস্পতিবার বিএনপিও রাজধানীর নয়াপল্টনে সমাবেশ করতে চেয়েছিল। কিন্তু পুলিশ তাদের অনুমতি দেয়নি। বরং পুলিশ তাদের বিকল্প হিসেবে সায়েদাবাদ বাস টার্মিনালের পাশে গোলাপবাগ মাঠে সমাবেশ করার পরামর্শ দেয়। কিন্তু বিএনপি তাতে রাজি হয়নি। বরং তারা নয়াপল্টনে তাদের কার্যালয়ের সামনে অথবা সোহরাওয়ার্দী উদ্যানেই সমাবেশ করতে চায়। অবশেষে বুধবার রাতে দলের পক্ষ থেকে জানানো হয়, তারা একদিন পিছিয়ে শুক্রবার নয়াপল্টনেই সমাবেশ করতে চায়। যেদিন যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ ও ছাত্রলীগও সমাবেশ করবে আগারগাঁও এলাকায়।
সরকারি ছুটির দিন বলে এই দুটি সমাবেশকে কেন্দ্র করে রাজধানীতে খুব বেশি জনভোগান্তি হবে না বলে আশা করা যায়। এ জন্য দুটি দলই ধন্যবাদ পেতে পারে। এটিকে রাজনীতিতে কিছুটা ইতিবাচক পরিবর্তনের ইঙ্গিত বলা যাবে কি না—সে বিষয়ে এখনই উপসংহারে পৌঁছানো কঠিন। তবে এটা ঠিক, গত বছরের ১০ ডিসেম্বর রাজধানীতে বিএনপির সমাবেশ ঘিরে সারা দেশে যে উত্তেজনা তৈরি হয়েছিল; ওইদিন সরকার পতনে বিএনপি চূড়ান্ত আন্দোলনের ঘোষণা দেবে কিংবা ঢাকা অচল করে দেবে বলেও যে গুঞ্জন শোনা যাচ্ছিলো, সেরকমই অনেকটা বাতাস তৈরি হচ্ছিলো ২৭ জুলাইয়ের সমাবেশকে কেন্দ্র করে। এখন যেহেতু ২৭ তারিখের কর্মসূচি পিছিয়ে ২৮ তারিখে চলে গেছে, ফলে এটি একটি ইঙ্গিত যে রাজধানীতে আর যাই হোক বড় কিছু হবে না। বরং বিএনপি হয়তো এখন পর্যন্ত যে মোটামুটি শান্তিপূর্ণ কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে, সেই ধারাবাহিকতায় নতুন আরও কিছু কর্মসূচি ঘোষণা করবে।
বিএনপি সম্ভবত ধীরে ধীরে আন্দোলনের মাঠ গরম করতে চায় এবং সাবধানে পা ফেলতে চায়। এক্ষেত্রে তাদের সামনে চ্যালেঞ্জ তিনটি।
১. দলের শীর্ষ দুই নেতা আইনত সাজাপ্রাপ্ত আসামি। ফলে তারা নির্ধারিত সময়ে আগামী জাতীয় নির্বাচন হলে সেই নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন না। আইনত দলের প্রধান খালেদা জিয়া কোনো দলীয় কর্মসূচিতে অংশ নিতে পারছেন না। দলের দ্বিতীয় প্রধান নেতা তারেক রহমানও দেশের বাইরে। এ কারণে দলের নেতৃত্বে কিছুটা সংকট রয়েছে।
২. বিভিন্ন সময়ে দলের সিনিয়র নেতাদের মধ্যে অনৈক্যের যেসব খবর প্রকাশিত হয়েছে, তারও বাস্তবতা আছে। বিশেষ করে মহাসচিবপন্থি এবং মহাসচিববিরোধী দুটি গ্রুপ বিএনপিতে সক্রিয় বলে শোনা যায়। এর পুরোটা সত্য না হলেও পুরোপুরি উড়িয়ে দেয়ারও সুযোগ নেই। অতএব আওয়ামী লীগের মতো বিরাট শক্তিশালী দলের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নেমে খুব সাবধানে পা না ফেললে যে সেই আন্দোলনের ফসল ঘরে উঠবে না, সেটি বিএনপিও জানে।
৩. আন্তর্জাতিক চাপ। অস্বীকার করার সুযোগ নেই, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যে বাংলাদেশের আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচন অবাধ-সুষ্ঠু-নিরপেক্ষ-অংশগ্রহণমূলক ও গ্রহণযোগ্য করার ব্যাপারে চাপ দিচ্ছে—তার পেছনে বিএনপির লবি কাজ করছে। এখানে যুক্তরাষ্ট্রের নিজস্ব চিন্তা, ব্যবসা, আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক ভূরাজনীতি কাজ করলেও তাতে বিএনপি এবং তাদের বিদেশি বন্ধুদেরও প্রভাব রয়েছে। অতএব সেই বিদেশি বন্ধুরা যাতে গোস্বা না হয়, সেজন্য বিএনপি চেষ্টা করছে তাদের আন্দোলন অহিংস রেখে নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন দিতে সরকারকে বাধ্য করতে।
কিন্তু প্রশ্ন হলো, সরকার তথা আওয়ামী লীগ কেন এমন কোনো তরিকায় নির্বাচন দেবে যে নির্বাচনে তারা হেরে যাবে? সেক্ষেত্রে বিএনপি ও আন্তর্জাতিক চাপের কাছে সরকার কি নতি স্বীকার করবে? শেখ হাসিনার যে রাজনৈতিক দৃঢ়তা, সাহস এবং নিজের ওপর অবিচল আস্থা—তাতে তিনি শেষমেষ মার্কিন চাপ ও বিএনপির আন্দোলনের মুখে তাদের দাবি মেনে নিয়ে নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন দেবেন—আপাতত তার কোনো লক্ষণ নেই। বরং ঢাকা-১৭ আসনের উপনির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিরো আলমের ওপর হামলার ঘটনার নিন্দা জানিয়ে বিবৃতি দেয়ায় ১৩ জন বিদেশি রাষ্ট্রদূতকে একসঙ্গে তলব করে সরকার বলেছে, তাদের এই কাজে কূটনৈতিক শিষ্টাচার লঙ্ঘন হয়েছে। বুধবার দুপুরে রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন পদ্মায় ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও ১২ দেশের রাষ্ট্রদূত ও হাই কমিশনারদের ডেকে সরকারের অসন্তোষের কথা জানান পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম। অতএব সরকার যে বিদেশি শক্তিকে খুব একটা পাত্তা দিচ্ছে না সেটি মোটামুটি স্পষ্ট। আর সরকার যদি বিদেশি শক্তির তৎপরতা এমনকি মার্কিন নিষেধাজ্ঞাকেও পাত্তা না দেয়, তাহলে বিএনপি তাদের নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবি আদায়ে সফল হবে কি না—সেটি বিরাট প্রশ্ন। কারণ বিএনপি হয়তো এখন পর্যন্ত এই আশায় আছে যে, বিদেশিদের চাপের কারণেই তাদের আন্দোলন সফল হবে।
পক্ষান্তরে এও ঠিক যে, বিগত দুটি জাতীয় নির্বাচনের মতো হয়তো এবারের নির্বাচনটি হবে না বা আগের দুটি নির্বাচনের মতো একতরফা নির্বাচন করা সম্ভব হবে না। সেক্ষেত্রে দলীয় ও নির্দলীয় সরকারের মাঝামাঝি কোনো উপায় নিয়ে ভেতরে ভেতরে আলোচনা হচ্ছে কি না—সেটিও স্পষ্ট নয়। বাইরে থেকে মনে হচ্ছে বড় দুটি দলই নিজেদের এক দফায় অনড়। অর্থাৎ বিএনপি চাচ্ছে সরকারের পদত্যাগ। আর আওয়ামী লীগের ঘোষণা শেখ হাসিনা সরকারের অধীনেই নির্বাচন। এ দুটির মাঝামাঝি কিছু নিয়ে আলোচনা হচ্ছে কি না বা বিএনপিও শেষ পর্যন্ত তাদের দফায় অনড় থেকে দাবি আদায় করতে পারবে কি না—সেটি এখনই বলা মুশকিল। পুরোটাই নির্ভর করছে অনেকগুলো ‘যদি’ এবং ‘কিন্তু’র ওপর। কেননা এখন আর খেলাটা আওয়ামী লীগ ও বিএনপির ভেতরে সীমাবদ্ধ নেই। এখন খেলায় যুক্ত হয়েছে বিদেশি শক্তিসমূহ।
বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে বিদেশিদের হস্তক্ষেপ এই দেশের মানুষ তো বটেই রাজনীতিবিদদের জন্যও যে সম্মানজনক নয়, সেটি রাজনীতিবিদরাও বোঝেন। কিন্তু বিদেশিরা কেন বাংলাদেশের নির্বাচন, গণতন্ত্র, মানবাধিকার, বাকস্বাধীনতা ইত্যাদি নিয়ে কথা বলার কিংবা সবক দেয়ার সুযোগ পাচ্ছে—সেটিই মূল প্রশ্ন। অর্থাৎ বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলো যে নিজেদের মধ্যে বিবদমান সমস্যাগুলো নিজেরা সমাধান করতে ব্যর্থ হচ্ছে বলে বিদেশিরা এখানে নাক গলানোর সুযোগ পাচ্ছে—সেই আত্মসমালোচনাটুকু অন্তত তাদের করা উচিত। কেননা কোনো দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে বিদেশিরা হস্তক্ষেপ করলে বা নিজেদের সমস্যা সমাধানে বিদেশিদের পদক্ষেপ নেয়ার সুযোগ দিলে তার পরিণতি যে ভালো হয় না—পৃথিবীতে তার উদাহরণ ভুরি ভুরি।
এরকম বাস্তবতায় দেশবাসীর জন্য এটি একটি বিরাট সারপ্রাইজ হবে যদি শুক্রবারের সমাবেশ থেকে প্রধান দুটি দলের তরফেই এই ঘোষণা আসে যে, তারা আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে উদ্ভুত সমস্যা নিজেরাই আলোচনার মধ্য দিয়ে সমাধান করবে; ক্ষমতায় টিকে থাকা কিংবা ক্ষমতায় যেতে তাদের কোনো বিদেশি বন্ধু বা প্রভুর হস্তক্ষেপ বা সমর্থন প্রয়োজন নেই। কিন্তু বাস্তবতা হলো এর সম্ভাবনা ক্ষীণ। বরং শুক্রবারের সমাবেশ থেকে বিএনপি সরকার পতনে কী কর্মসূচি ঘোষণা করে আর যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ ও ছাত্রলীগ মাঠ দখলে রাখার জন্য পাল্টা কী কর্মসূচি দেয়—তারওপর নির্ভর করছে আগামী দিনগুলোয় রাজনীতির মাঠ কতটা গরম হবে। তবে দিন শেষে প্রশ্ন একটাই, আন্দোলনের গতিপ্রকৃতি কে নির্ধারণ করবে, আওয়ামী লীগ, বিএনপি নাকি বিদেশিরা?