টাঙ্গাইল শাড়ি ও পাশের বাড়ির আবদার

আমাদের পণ্য ভারতের বলে জিআই ট্রেডমার্ক পেয়ে যাচ্ছে— এর দায় কার? রাজনৈতিক সংঘাত আর গদি বজায় রাখা কিংবা গদির লোভে আগুনের রাজনীতি কী এসব নিয়ে ভাবে? না তাদের ভাবার সময় আছে আদৌ?

অজয় দাশগুপ্তঅজয় দাশগুপ্ত
Published : 5 Feb 2024, 01:12 PM
Updated : 5 Feb 2024, 01:12 PM

আমাদের কৈশোর ও যৌবনের শুরুতে বাংলাদেশের ৯০ শতাংশ নারীর পোশাক ছিল শাড়ি। আমাদের মা-বোনেরা ঘরে-বাইরে শাড়ির বাইরে অন্য কোনো পোশাক খুব একটা পরিধান করতেন না। তখনো আমাদের সমাজে রাজনীতি এতটা উগ্র হয়ে ওঠেনি। বরং যে পাকিস্তান ভেঙ্গে আমাদের অগ্রজরা বাংলাদেশের জন্য সংগ্রাম করেছিল সেই পাকিস্তানে জাতীয়তার সংগ্রাম ছিল গৌরবময়। ওই গৌরবে যুক্ত হয়েছিল স্বাজাত্যবোধ। জাতিসত্তার তেমন উন্মেষ আর কখনো চোখে পড়েনি। শাড়িময় বাঙালি নারীর জগৎ দখল করে রেখেছিল ঢাকাইয়া জামদানি, শীর্ষে ছিল টাঙ্গাইলের তাঁতের শাড়ি। তখনকার দিনে বাড়িতে বাড়িতে মাথায় করে শাড়ির বস্তা বয়ে আনতেন শাড়ি বিক্রেতারা। সাদা থান কাপড়ে মোড়ানো সেই বস্তায় থাকত নানা ধরনের শাড়ি। যার বেশিরভাগ জুড়ে থাকত টাঙ্গাইলের শাড়ি। বেছে বেছে মিহি বুননের এই শাড়ি কিনতেন মা-বোনেরা। সেই আদ্যিকাল থেকেই আমরা জানতাম টাঙ্গাইলের শাড়ি আমাদের ঐতিহ্য আমাদের গৌরব।

দিনকাল বদলে যায়। দেশ স্বাধীন হবার পর আমাদের কায়মনে বাঙালি হবার যে সাধনা সেটি আস্তে আস্তে পিছু হটতে শুরু করল। এখন এমন এক সময় যখন আমাদের জাতীয়তাবোধ আমাদের অতীত-বর্তমান সবকিছু আক্রান্ত। পাকিস্তান নেই বটে, আছে তাদের প্রেতাত্মা। ওই ধারা এতটাই ভয়ানক যে, তাদের দাপটে অনেক কিছু বদলে গেছে। এখনকার বাংলাদেশ ও বাংলাদেশের বাইরের বাঙালি জগতে শাড়ি বিতর্কিত এক পোশাক। এখন এমনও শুনি নারী সমাজের একটা অংশ শাড়ি পরবেন না বলে শপথ করেছেন। শাড়ি নাকি হিন্দুদের পোশাক। আর এই হিন্দুয়ানি পরিত্যাজ্য। কিন্তু এই ষড়যন্ত্র বা চাপিয়ে দেওয়া মতবাদের আড়ালে আমাদের যে কী সর্বনাশ ঘটে যাচ্ছে তার বিষয়ে আমরা উদাসীন। এই যেমন চলতি বছরের ২ জানুয়ারি টাঙ্গাইল শাড়িকে পশ্চিমবঙ্গের জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি দেয় ভারতের শিল্প ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অধীন পেটেন্ট, ডিজাইন অ্যান্ড ট্রেড মার্কস বিভাগ। এর আগে ২০২০ সালের সেপ্টেম্বরে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের হস্তশিল্প বিভাগ জিআই স্বীকৃতির জন্য আবেদন করেছিল। সেখানে টাঙ্গাইল শাড়িকে নদীয়া ও পূর্ব বর্ধমানের পণ্য হিসেবে ধরা হয়।

১ ফেব্রুয়ারি দুপুরে ভারত সরকারের সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের ফেইসবুক পেইজে এক পোস্টে টাঙ্গাইল শাড়িকে পশ্চিমবঙ্গের ঐতিহ্য উল্লেখ করা হয়। সেখানে বলা হয়, টাঙ্গাইল শাড়ি পশ্চিমবঙ্গ থেকে উৎপন্ন, এটি একটি ঐতিহ্যগত হাতে বোনা মাস্টারপিস। এর সূক্ষ্ম গঠনবিন্যাস, প্রাণবন্ত রং এবং জামদানি কাজের জন্য বিখ্যাত, এটি এই অঞ্চলের সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের প্রতীক। প্রতিটি টাঙ্গাইল শাড়িই দক্ষ কারুকার্য, ঐতিহ্যকে একত্র করে। তাদের এই প্রচার বা অপপ্রচারের ভিত্তি নেই তা বলা যাবে না। দেশের ভেতর ক্রমাগত কোণঠাসা হিন্দু বসাকেরা, তাঁতশিল্পীরা দলে দলে দেশ ছেড়ে চলে গেছেন। এই দেশত্যাগে আমাদের লোকসানের পাশাপাশি লাভবান হয়েছে ওপার বাংলার তাঁতশিল্প। আজ তারা নদীয়াকে টাঙ্গাইল শাড়ির উৎকর্ষ আর বুননের পীঠস্থান বলছে।

আমরা অনেকেই নানা কারণে কলকাতা যাই। বেড়াতে, চিকিৎসার জন্য কিংবা ব্যবসা, যে কারণেই হোক না কেন কলকাতা বিমানবন্দর আমাদের সুপরিচিত। সে বিমানবন্দরে অনেক নামি-দামি দোকানের একটির নাম বিশ্ব বাংলা। এই বিশ্ব বাংলায় তাঁতের শাড়ির উৎপত্তি আর বুননে পশ্চিমবাংলার কথা উল্লেখ করা আছে। কিন্তু তা আমাদের চোখে পড়েনি। আমরা বলিনি যে, এটা ভুল। আমাদের উন্নয়ন আর অগ্রগতির জোয়ারের নামে ভুলে গেছি অতীত ঐতিহ্য। সে সুযোগে টাঙ্গাইলের শাড়িকে নিজেদের বলে দাবি করছে ভারত। ইতিহাস কি বলে? কোথায় এই টাঙ্গাইল ?

বাংলাদেশের অবিচ্ছেদ্য একটি অংশ টাঙ্গাইল। আমরা যদি ইতিহাসের দিকে তাকাই তাহলে দেখতে পাই, টাঙ্গাইল নামটি পরিচিতি লাভ করে ১৫ নভেম্বর ১৮৭০ খ্রিস্টাব্দে মহকুমা সদর দপ্তর আটিয়া থেকে টাঙ্গাইলে স্থানান্তরের সময় থেকে। টাঙ্গাইলের ইতিহাস প্রণেতা খন্দকার আব্দুর রহিমের মতে, ইংরেজ আমলে এদেশের লোকেরা উঁচু শব্দের পরিবর্তে ‘টান’ শব্দই ব্যবহার করতে অভ্যস্ত ছিল বেশি। এখনো টাঙ্গাইল অঞ্চলে টান শব্দের প্রচলন আছে। এই টানের সঙ্গে আইল শব্দটি যুক্ত হয়ে হয়েছিল টান আইল। আর সেই টান আইলটি রূপান্তরিত হয়েছে টাঙ্গাইলে।

টাঙ্গাইলের নামকরণ নিয়ে আরও বিভিন্নজনে বিভিন্ন সময়ে নানা মত প্রকাশ করেছেন। অপর একটি সূত্র মতে, ব্রিটিশ শাসনামলে মোগল প্রশাসন কেন্দ্র যখন আটিয়াতে স্থাপন করা হয় তখন এই অঞ্চলটি জমজমাট হয়ে ওঠে। ওই সময়ে ঘোড়ার গাড়ি ছিল যাতায়াতের একমাত্র বাহন, যাকে বর্তমান টাঙ্গাইলের স্থানীয় লোকেরা বলত টাঙ্গা। বর্তমান শতকের মাঝামাঝি পর্যন্তও এ অঞ্চলের টাঙ্গা গাড়ির চলাচল ছিল স্থলপথে সর্বত্র। আল শব্দটির কথা এ প্রসঙ্গে চলে আসে। বর্তমান টাঙ্গাইল অঞ্চলের বিভিন্ন স্থানের নামের সঙ্গে এই আল শব্দটির যোগ লক্ষ্য করা যায়। আল শব্দটির অর্থ সম্ভবত সীমা নির্দেশক যার স্থানীয় উচ্চারণ আইল। একটি স্থানকে যে সীমানা দিয়ে বাঁধা হয় তাকেই আইল বলা হয়। টাঙ্গাওয়ালাদের বাসস্থানের সীমানাকে টাঙ্গা+আইল এভাবে যোগ করে হয়েছে টাঙ্গাইল।

মূলত কোনো একটি দেশের মাটি, পানি, আবহাওয়া এবং জনগোষ্ঠীর সংস্কৃতি যদি কোনো একটি পণ্য উৎপাদনের ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে, তাহলে সেটিকে ওই দেশের জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। কোনো পণ্য জিআই স্বীকৃতি পেলে বিশ্বব্যাপী এর ব্র্যান্ডিং করা সহজ হয়।

জানা যায়, ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষদিকে তৎকালীন বঙ্গের টাঙ্গাইলের তাঁতশিল্পের প্রসার ঘটে। টাঙ্গাইল শাড়ির তাঁতিরা ঐতিহ্যবাহী মসলিন তাঁতশিল্পীদের বংশধর। তাদের আদি নিবাস ছিল ঢাকা জেলার ধামরাই ও চৌহাট্টায়। তারা দেলদুয়ার, সন্তোষ ও ঘ্রিন্দা এলাকার জমিদারদের আমন্ত্রণে টাঙ্গাইলে যান এবং পরবর্তী সময়ে সেখানে বসবাস শুরু করেন। (সূত্র: আজকের পত্রিকা)

আমাদের পণ্য ভারতের বলে জিআই ট্রেডমার্ক পেয়ে যাচ্ছে— এর দায় কার? রাজনৈতিক সংঘাত আর গদি বজায় রাখা কিংবা গদির লোভে আগুনের রাজনীতি কী এসব নিয়ে ভাবে? না তাদের ভাবার সময় আছে আদৌ? একটা মজার বিষয়, এই বাইরে এবং অন্তরে প্রচণ্ড ভারত বিদ্বেষ লালন করলেও কাজের বেলায় আমরা লুজার। আমাদের জয়ের ইতিহাস নেই। কেন নেই? কারণ বিরোধিতার আড়ালে ঢাকা পড়ে যায় ন্যায্য অধিকার।

ভারত খুব ভালো জানে, উনবিংশ শতাব্দীর শেষভাগের ব্রিটিশ ভারতে টাঙ্গাইল ছিল ময়মনসিংহ জেলার এক মহকুমা।  ১৮৫০ সাল বা তার কাছাকাছি সময়ে তৎকালীন ধামরাই এবং চৌহট্ট নামে দুটি গ্রামে মসলিনের উত্তরসূরি কিছু তাঁতি বসবাস করতেন। সন্তোষ, করটিয়া, দেলদুয়ারে জমিদারি পত্তনের সময় অন্যান্য পেশাজীবীদের পাশাপাশি ওই তাঁতিদেরও সেসব জায়গায় নিয়ে বসতি স্থাপন করা হয়। এসব গ্রামের মানুষেরা যে শাড়ি বয়ন করতেন তাই ‘টাঙ্গাইল শাড়ি’ নামে পরিচিতি লাভ করে।

কালক্রমে দেশান্তরী তাঁতিদের উৎপাদন নিয়ে আজ ভারত এই বিশ্বখ্যাত শাড়িটি নিজেদের বলে মনে করছে। এবং তার স্বীকৃতি দিতেও কসুর করেনি। হিন্দু-মুসলমান, ভারত-বাংলাদেশ এসব উটকো বিষয়ে নিরন্তর ঝামেলা আর কলহে আমরা কী হারাচ্ছি এটা তার জ্বলন্ত প্রমাণ। এ লেখা যখন লিখছি তখন খবরে দেখলাম আমাদের কুম্ভকর্ণদের ঘুম ভাঙ্গতে শুরু করেছে। কিন্তু রামায়ণ বলে অকাল ঘুম ভাঙ্গায় কোনো লাভ হয় না। বরং তাতে ক্ষতিই হয়।

তবু আমরা আশাবাদী। ভারত সরকার ও যথাযথ জায়গায় আমাদের প্রতিবাদ আর সঠিক ইতিহাস গিয়ে পৌঁছাবে। বিশ্ব দরবারে আবার নিজের আসন লাভ করবে টাঙ্গাইলের শাড়ি। যা একান্তই আমাদের গর্বের ধন। আমাদের মা-বোনেরা শাড়ির দিকে মুখ না ফেরালে এসব কথার কী কোনো মানে থাকবে?