অন্যান্য মাছের সঙ্গে ইলিশের দাম এমন জায়গায় রাখতে হবে, যাতে এর একটা প্রভাব থাকে মাছের বাজারে। দেশের বিরাট জনগোষ্ঠীর কাছে ইলিশ যেন স্মৃতিচারণের বিষয় হয়ে না দাঁড়ায়।
Published : 27 Aug 2023, 12:09 AM
পাঙাসের দামও যখন বাড়তে বাড়তে অনেক বেড়ে গেল, তখন ইলিশ নিয়ে কেন লিখছি—তার ব্যাখ্যা চাওয়া যেতেই পারে। পাঙাস বলতে এখানে চাষের পাঙাসের কথাই বলা হচ্ছে, যেটা নাকি আমাদের মোট মাছ উৎপাদনের ১০ শতাংশেরও বেশি। যে পাঙাসকে 'গরিবের আমিষের সহজতম উৎস' বলে বর্ণনা করা হতো, তার দাম প্রায় দ্বিগুণ হয়ে যাওয়াটা এ বাজারে নিশ্চয়ই বড় দুঃসংবাদ। 'সাধারণ মানুষ তাহলে খাবেটা কী', এ প্রশ্ন অনেকেই তুলছেন। এর উত্তর দেওয়া যখন কঠিন—তখন ইলিশ নিয়ে কেন লিখতে বসলাম, সেটা তাহলে বলি। এটা বলতে বলতেই লেখাটি এগিয়ে নেওয়ার আশা।
পাঙাসের মতোই মাছ উৎপাদন/আহরণে ইলিশের অবদান ১০ শতাংশের কিছু বেশি। বোধহয় ১২ শতাংশের মতো। এই পরিমাণ ইলিশ কিন্তু আমরা একনাগাড়ে পাই না। সারাবছর তো ইলিশ ধরা যায় না। যেত এক সময়, যখন এর উৎপাদন বাড়াতে জাটকা (ছোট ইলিশ) ও মা ইলিশ ধরায় নিষেধাজ্ঞা ছিল না। অন্তত দুই দফায় মোটামুটি দীর্ঘ সময় নিষেধাজ্ঞা থাকছে এখন, যাতে ইলিশ ডিম ছাড়তে পারে মিঠাপানিতে এসে আর জাটকারা বড় হতে পারে। এটা বাদে অন্য সময়েও যে ইলিশ সমান তালে পাওয়া যায়, তা নয়। এর 'সিজন' রয়েছে। মূলত এটা বর্ষাকালের মাছ। বর্ষা আবার বিচিত্র আচরণ করছে আমাদের সঙ্গে। সঙ্গে ইলিশের আচরণও বদলাচ্ছে। সিজন শুরু হচ্ছে দেরিতে; সেটা স্থায়ীও হচ্ছে কম। তুলনায় পাঙাস আমরা উৎপাদন করে চলেছি বদ্ধ জলাশয়ে এবং সারাবছরই এটা খেতে পারছি। অন্যান্য চাষের মাছের বেলায়ও কথাটা প্রযোজ্য।
কথা হলো, বছরজুড়ে পাওয়া না গেলেও আমাদের মাছ উৎপাদনে ইলিশের হিস্যা দেখা যাচ্ছে সবচেয়ে বেশি। আর ইলিশ তো চাষ করতে হয় না; কেবল আহরণ করতে হয়। এটা প্রাকৃতিকভাবেই পেয়ে আসছি। আরও সৌভাগ্যের কথা, আমাদের যে সমুদ্রসীমা, মোহনা আর নদ-নদী, তাতে বিশ্বের সিংহভাগ ইলিশ মিলছে। তথ্য নিয়ে বিতর্ক থাকলেও এটা যে সারা দুনিয়ার ইলিশ উৎপাদনের তিন-চতুর্থাংশ, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। এর উৎপাদন বৃদ্ধিতে নানা পদক্ষেপ গ্রহণের ফলে এদেশে আহরিত ইলিশের হিস্যা বেড়ে উঠেছে বৈ কমেনি। এটা আরও বাড়ানো সম্ভব। তার মানে, চাষ না করেও আরও ইলিশ আমরা পেতে পারি। মাঝে অবশ্য চেষ্টা হয়েছিল, পাঙাসের মতো ইলিশও চাষ করা যায় কিনা। সে চেষ্টা যতদূর জানা যায়, সফল হয়নি। তাই ইলিশ সংরক্ষণ করে এর আহরণ বাড়ানোর কথাই এখন বেশি শোনা যাচ্ছে।
ইলিশের পূর্ণাঙ্গ জীবন-রহস্য উন্মোচনেও সফল হয়েছেন আমাদের বিজ্ঞানীরা। যে দেশে সবচেয়ে বেশি ইলিশ মিলছে, তার বিজ্ঞানীরা এর গবেষণায় ভালো করবেন, সেটাই তো স্বাভাবিক। এতে করে ইলিশের জীবনাচরণ এবং তাতে কিছু পরিবর্তন এলে সেটা বুঝতে বিশেষ সুবিধা হবে। ইলিশকে আমরা 'জাতীয় মাছ' বলেও বর্ণনা করছি এবং এটা বাংলাদেশের জিআই (ভৌগোলিক নির্দেশক) পণ্য হিসেবে নিবন্ধিত হয়েছে। এ অবস্থায় ইলিশ রপ্তানি করতে পারলে বিশ্ববাজারে আমরা বিশেষ সুবিধা পাব। তবে অনেকদিন হয় ইলিশ রপ্তানি করা হচ্ছে না। মাঝে মাঝে হয়তো পরিস্থিতি ভালো মনে করলে সরকার কিছু রপ্তানির অনুমতি দিচ্ছে। এখন আমরা যদি রপ্তানি না করে দেশের মানুষের চাহিদা মেটাতে পারি জাতীয় মাছ দিয়ে, সেটা কম কথা নয়। একটা সময় কিন্তু এমন হতো, ইলিশ মৌসুমে এর চাপে অন্যান্য মাছের দামও যেত কমে। তাতে গোটা বাজারেই আসতো স্বস্তি। ইলিশ তখন দামেও সাধারণের সাধ্যের মধ্যে ছিল। রিকশাচালকদেরও দেখা যেত দিনের শেষে একটা ইলিশ কিনে দড়িতে বেঁধে নিয়ে যেতে। সেইসব দিন গত হয়েছে বলেও ইলিশ নিয়ে এ আলাপটা করতে বসা।
লক্ষ করব, ইলিশ আহরণ বাড়তে থাকার সঙ্গে এর দামও বেড়েছে এবং বাড়তে বাড়তে এটা হয়ে উঠেছে শখ করে খাওয়ার বস্তু। একটা সময়ে দাওয়াত করে অতিথিকে খাওয়ানো হতো রুই-কাতলা, নদীর পাঙাস, আইড়, পাকা কই, মাগুর, গলদা চিংড়ি। ইলিশ ছিল নিজেরা খাওয়ার মাছ। কালক্রমে সেটি হয়ে উঠেছে দামি। এর 'আভিজাত্য' ছাড়িয়ে গেছে সম্ভবত সব মাছকে। সম্প্রতি একটি বেসরকারি টিভি এমন শিরোনামে আলোচনার আয়োজন করে যে, 'ইলিশ মাছ কবে কিনেছেন?' সাধারণ মানুষ ভরা মৌসুমেও ইলিশ কিনে খেতে না পারলে এটাকে আর জাতীয় মাছ বলা উচিত হবে কিনা, এমন তীব্র অভিমানভরা মতও প্রকাশ করছেন অনেকে। তাতেও যদি কিছুটা নাগালের মধ্যে আসতো মাছটি!
এবার ইলিশ আহরণ কেমন, সে বিষয়ে একেক সময় একেক রকম খবর পাওয়া যাচ্ছে। বেশি ইলিশ মিললেও কোথায় মিলছে, সেটাও খবর বৈকি। 'পদ্মার ইলিশের' খ্যাতি এখনও আছে। তবে পদ্মার মতো নদীগুলো বা এর উজানে ইলিশ কম মিলছে বলে কোনো কোনো বছর বেশি খবর পাওয়া যায়। ইলিশ নাকি বেশি মিলছে সাগর ও মোহনায়। কোত্থেকে আহরিত—তার ওপর ইলিশের স্বাদ ও দাম নির্ভর করে। মিঠাপানিতে এসে বিচরণ করতে থাকলেই ইলিশের স্বাদ বাড়ে। নদীতে প্রাপ্ত খাবার এর স্বাদ বাড়িয়ে দেয়। এতে যোগ করে উপকারি পুষ্টিও। তবে ইলিশ প্রাপ্তির সঙ্গে এর দামের সম্পর্ক রয়েছে। প্রাপ্তি বাড়লেই সমানুপাতিকভাবে দাম কমবে, সেটা অবশ্য নয়। প্রাপ্তি বাড়লে একগাদা ইলিশ কিনে ডিপ ফ্রিজে নিয়ে মজুদের প্রবণতা রয়েছে বহু ক্রেতার। তারা সারাবছর ইলিশ খেতে চায় অন্যদের বঞ্চিত করে। দেশে এদের সংখ্যাও বেড়েছে। তাছাড়া সব শ্রেণির মানুষই সম্ভবত ইলিশ খেতে চায়। কোনো মাছের বিষয়ে এমন সম্মিলিত আগ্রহ বোধহয় দেখতে পাওয়া যাবে না আমাদের সমাজে। ইলিশ নিয়ে কবিতা আর গল্পও কম হয়নি। বাঙালির বর্ষবরণেও এটা যুক্ত হয়ে পড়েছে—যদিও ওই সময়টা ইলিশের মৌসুম নয়।
জাটকা ও মা ইলিশ রক্ষায় সরকার একটা পর্যায়ে এসে খাদ্য সহায়তা কর্মসূচি চালু করেছে। ইলিশ ধরা বন্ধ থাকা অবস্থায় জেলেদের টিকে থাকাটা সহজ করতে আর কী করা যায়, তা নিয়েও চলছে আলোচনা। বিচরণক্ষেত্র রক্ষা করে ইলিশের উৎপাদন যাতে আরও বাড়ানো যায়, সে প্রয়াসও লক্ষণীয়। নিষিদ্ধ জাল ও ডুবোচরে বাধা পেয়ে ইলিশ যাতে গতিপথ বদলে না ফেলে, তা নিয়ে আলোচনাও কম নয়। অব্যাহত দূষণ এবং বিভিন্ন স্থাপনা নির্মাণের ফলে নদীপ্রকৃতি ক্ষতিগ্রস্ত হলে ইলিশের উৎপাদন ব্যাহত হবে কিনা—এসব আলাপও কম নেই। সবচেয়ে বড় কথা, এ বিষয়ে জ্ঞান বেড়েছে। কিন্তু যেটা একেবারেই হচ্ছে না, তা হলো ইলিশের দাম সহনীয় মাত্রায় নিয়ে আসা। ইলিশ ইতোমধ্যে হয়ে উঠেছে মধ্যবিত্তেরও আয়োজন করে খাওয়ার বস্তু। আর নিম্নমধ্যবিত্তে সম্ভবত বেড়ে গেছে 'গরিবের আমিষ' বেশি করে খাওয়ার প্রবণতা। সে কারণেও বোধহয় বেড়েছে পাঙাসের মতো মাছের চাহিদা। এর উৎপাদন ব্যয় বেড়েছে বটে; তবে চাহিদা বাড়ার কারণেও যে পাঙাসের দাম বাড়েনি, তা বলা যাবে না।
ইলিশের দাম ক্রমে মাত্রাছাড়া হয়ে যাওয়ার একটা কারণ অবশ্যই আহরণের সঙ্গে সঙ্গে এর চাহিদা বাড়তে থাকা। রপ্তানি বন্ধ রেখেও তাই ইলিশের দাম বৃদ্ধি ঠেকানো যাচ্ছে না। ইলিশ আহরণ ব্যয় অনেক বেড়ে যাওয়ার কথাও আজকাল এর সঙ্গে জড়িত, বিশেষত ট্রলার মালিকরা বলছেন। ব্যয়ের একটা অস্বাভাবিক চিত্র তুলে ধরছেন তারা। ডিজেলের দামের পাশাপাশি জেলেদের মজুরিও নাকি অনেক বেড়েছে। তাছাড়া সব ট্রিপে ইলিশ তো সমানভাবে পাওয়া যায় না। খরচ অভিন্ন হলেও কোনো কোনো ট্রিপ ব্যর্থ হয় ইলিশ আহরণে। যাতায়াত ব্যবস্থার বড় উন্নতি হওয়ায় যেটুকু ইলিশ মেলে, তা আবার ছড়িয়ে পড়ে সারাদেশের উৎসুক ক্রেতাগোষ্ঠীর কাছে। তাতে স্থানীয় পর্যায়ে ইলিশ দুষ্প্রাপ্য হয়ে দাম বৃদ্ধির ঘটনাও কম ঘটছে না।
ইলিশ আহরণ ও এর ব্যবসায় জড়িত, বিশেষত জেলেদের আয় বাড়লে তাতে কিন্তু আপত্তি করা চলে না। তবে চেষ্টা থাকতে হবে এর আহরণ ব্যয় নিয়ন্ত্রণে রাখার। মজুরি তো কমানো যাবে না; তাই জ্বালানির দাম কমাতে হবে। জাতীয়ভাবে সম্ভব না হলেও ইলিশ আহরণে যাওয়া ট্রলারে ডিজেল জোগাতে হবে ভর্তুকি দামে। তাদের জন্য সহজ শর্তে জোগাতে হবে ঋণ। আর ঠিক কী কী কারণে ইলিশের দাম এভাবে বাড়ছে, তা খতিয়ে দেখার উদ্যোগ নিতে হবে। ইলিশ উৎপাদন-আহরণ বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে এর বাজার ব্যবস্থাপনায় দিতে হবে দৃষ্টি। দেশের একজন নিম্নআয়ের মানুষ সিজনেও একটি ইলিশ কিনে খাওয়ার কথা ভাবতে পারবেন না, এটা তো কোনো কাজের কথা নয়।
পাঙাসের মতো মাছের উৎপাদন আর দাম স্বাভাবিক রাখারও ব্যবস্থা করতে হবে। এর উৎপাদন ব্যয় বেড়ে গিয়ে থাকলে সেসব উপাদান ধরে ধরে করতে হবে অ্যাড্রেস। কারণ এর সঙ্গে সরাসরি সম্পর্ক রয়েছে জাতীয় পুষ্টি নিরাপত্তার। কোনো রকম উৎপাদন ব্যয় ছাড়া যে ইলিশ আমরা পাই, তার ব্যবস্থাপনা নিশ্চিতের সঙ্গে সঙ্গে এর আহরণ ব্যয়টাও কমাতে হবে—যাতে বাজার স্বাভাবিক হয়ে আসে। ইলিশের দাম আগের মতো আর হবে না, কেননা অন্যান্য পণ্যের দামও বেড়েছে। এ অবস্থায় অন্যান্য মাছের সঙ্গে ইলিশের দাম এমন জায়গায় রাখতে হবে, যাতে এর একটা প্রভাব থাকে মাছের বাজারে। দেশের বিরাট জনগোষ্ঠীর কাছে ইলিশ যেন স্মৃতিচারণের বিষয় হয়ে না দাঁড়ায়।