ওয়ানডে জিতলেও টেস্ট জিতি না কেন, ধৈর্য না শান্তির অভাব?

সময় আর প্রস্তুতি নিয়ে পরিণত হয়ে সবকিছু করাই হচ্ছে বিজয়ের প্রথম ধাপ। নয়তো মাঝে মাঝে ঝলসে উঠলেও আখেরে আমাদের কোনো লাভ হবে না।

অজয় দাশগুপ্তঅজয় দাশগুপ্ত
Published : 23 Dec 2022, 06:34 PM
Updated : 23 Dec 2022, 06:34 PM

বাংলাদেশ ক্রিকেট দল ভারতকে ওয়ানডে সিরিজ হারিয়ে দিয়েছে। দুনিয়ার সব বড় দলগুলোকেই হারাতে পেরেছে এবং পারবে। অথচ ওই একই দল টেস্ট ক্রিকেটে নাকানি চুবানি খায়। পাঁচ দিনের খেলা দিন শেষ হবার আগেই ছেড়ে আসে। আসতে বাধ্য হয়। এর কারণটি কি না ভেবেই খেলোয়াড়দের দোষারোপ করেই আজীবন শান্তি পাবো আমরা? ভালো করে খেয়াল করলে দেখবেন আমাদের জাতীয় জীবন ও চরিত্রের সাথে এই ফলাফলের এক অদ্ভুত মিল আছে। ধৈর্য, সহ্য আর শক্তি এই তিন যেখানে একত্রিত হবার কথা সেখানেই আমরা কুপোকাৎ। আমি এগারোজন খেলোয়াড়ের দোষ ধরার পরিবর্তে বলতে চাই এর মূল কারণ আমাদের সমাজ আর চলমান বাস্তবতা।

আপনি মানুষের জীবন বা জীবনধারা দেখলেই বুঝবেন কোথাও তাদের স্বস্তি নাই। জনসংখ্যায় ভারত আমাদের চাইতে অনেক এগিয়ে। জনবহুল ভারতের শহরগুলোয় বিশেষ করে কলকাতার মানুষদের ভেতর আমি এমন অস্থিরতা বা তাড়াহুড়ো দেখিনি। যে লোকটা ভাঁড়ের চা বানায় তার মধ্যেও ছটফটানি নেই। ছটফটানি দেখিনি রিকশাওয়ালার আচরণে। একবার আমিই তাড়াতাড়ি করে সল্টলেকের শপিং মলের সামনে রাখা খালি এক রিকশায় চেপে আনন্দের সাথে হুকুম দিলাম, চলেন দাদা। আমার দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে কপালের ঘাম মুছতে মুছতে রিকশাচালক ভদ্রলোক ঠান্ডা মাথায় জবাব দিয়েছিলেন, নেমে পড়ুন বাবু, আমি যাব না। আমার আগের সিরিয়ালে আরেকজন আছে তার সাথে চলুন। কী আর করা? অবনত মস্তকে আরেক রিকশায় চাপতে চাপতে স্বগতোক্তি করেছিলাম, শিখলুম দাদা।

নিউ ইয়র্ক, টোকিও, সিডনিসহ বিশ্বে অসংখ্য জনবহুল নগরী রয়েছে। সর্বত্র মানুষ ছুটছে বটে কিন্তু তাড়াহুড়োয় ভুল করা বা দুর্ঘটনা ঘটানোর মতো কিছু করে না। দু-এক পার্সেন্ট মানুষকে বাদ দিলে এটাই প্রবণতা। এবার দেশের দিকে তাকান। রাজনীতি নেই, গণতন্ত্র মরে যাচ্ছে এসব কথায় আমরা অভ্যস্ত। এটাও সত্য যে রাজনীতি অচলায়তনে তালাবন্দী। কিন্তু রাজনীতি সচল হতে না হতে কি অবস্থা দেখলাম? এই মারে, তো সে মারে। মাঠে আন্দোলন জমে ওঠার আগেই লাশ ফিরে গেছে ঘরে। আমি দূরদেশে ইউটিউব ও টিভি নিউজে এসব দেখি আর ভাবি, কে আসলে আগ্রাসী? পুলিশ না বিপ্লবের নামে রাগী মানুষজন না সরকারি দল? আমার উত্তর, কেউ কারে নাহি ছাড়ে, সমানে সমান। সরকারি দল এমন এক জায়গায়, তাদের হাতের মুঠোয় সবকিছু। ব্যক্তি ও সামাজিক জীবনে যাদের হাতের মুঠোয় সবকিছু থাকে, মানুষ তাদেরকে ভয় পায় আবার সম্মানও করে। একসময় এমন জমিদার শ্রেণির মানুষেরা দান-খয়রাত করতেন, গরীববান্ধব নামে পরিচিতি ছিল তাদের। এখন যারা দাপুটে তাদের দিলে রহম বলতে কিছু নাই। খালি মারে আর মারে।

মানুষের দোষ দিয়ে কী লাভ? সে দৌড়ে ঠেলাঠেলি করে না উঠলে বাস তাকে নেবে না। সে বাড়াবাড়ি না করলে বাজারের দোকানদার তাকে অপমান করবে। মুদিওয়ালা ধমকাবে। ধরুণ, সে তার পাসপোর্ট নবায়ন করাতে চায়। তারপর? এদিকে বলা হচ্ছে ডিজিটাল অন্যদিকে ছদ্মবেশী দালালের সাহায্য ব্যতীত কাজ হবে না। বিশ্বাস না হলে প্রমাণ দেয়া কি আসলেই কঠিন? ডিজিটালের এই চাপও ভয়ংকর। বুঝলাম সবকিছু আধুনিকায়ন করা হচ্ছে– খাতা-কলমে, দলিলপত্রে এটা ওটা প্রমাণ করা চাই। বাস্তবে?

বাংলাদেশে কোটিখানেক মানুষের জন্মদিন ১ জানুয়ারি, ১ মার্চ বা জুন। এই এক তারিখের রহস্য কী?। এর কারণ তাদের জন্মদিনটা হয় নিজেরা ঠিক করেছে বা করতে বাধ্য হয়েছে। বর্তমান সময়ের নতুন প্রজন্ম ব্যতীত আমাদের সময় বার্থ রেজিস্ট্রেশন বলতে কি কিছু ছিল? চার দিদির পর এক ছেলে বলে আমার পিতা চট্রগ্রাম সিটি করপোরেশনে নামটা লিপিবদ্ধ করিয়ে রেখেছিলেন। কিন্তু বাকিদের বেলায় কী হবে? কথাগুলো বললাম এই কারণে যে, অস্থিরতা মানুষ তৈরি করে পরিবেশের চাপে। সমাজ ও জীবনের এই অস্থিরতার মূল কারণ রাজনীতি ও সমাজ বাস্তবতা।

আপনি আমাদের দেশের কজন নেতা দেখাতে পারবেন যিনি ধৈর্য ও শান্তির কথা বলেন? মিডিয়া তো মুখিয়ে আছে। তাদের রেটিং আর মানুষ টানার দায়ে অখবর-বেখবর দেখাতে দেখাতে চাপা পড়ে যায় যাবতীয় সম্ভাবনা। পরীক্ষার ফলাফলের মতো ভালো একটা সংবাদও সোশ্যাল মিডিয়ার কল্যাণে বিধ্বংসী আর একতরফা হয়ে পড়ে। ভাবখানা এই যারা নাম্বারের হিসেবে পিছিয়ে তাদের বেঁচে থাকার কোনো মানেই নাই। তখন এই দেয়ালে পিঠ ঠেকা ছাত্র-ছাত্রী বা অভিভাবকদের আত্মসম্মানের জন্য মরিয়া হবার বিকল্প কোথায়? এ চিত্র সর্বত্র।

বিশ্বকাপ ফুটবলে বাংলাদেশের উন্মাদনা দুনিয়াকে তাক লাগিয়ে দিয়েছে। খোদ আর্জেন্টিনায় খবর হয়েছে। ভালো কথা। কিন্তু এই আবেগ নিজেদের বেলায় নেই কেন? কী হাল আমাদের ফুটবলের? আমরা তো ধরে নিয়েছিলাম এক সময়ের তারকা খেলোয়াড় সালাউদ্দিন যখন দায়িত্বে এবার অন্যকিছু হবে। ক্রিকেট-ফুটবল দুটোই এক অস্থিরতা আর একনায়কত্বের আচরণে ধুঁকছে। ওই যে সবকিছু যেখানে উন্মাদ আর পাগল সেখানে হঠাৎ শান্তি আসবে কোথা থেকে? কৃচ্ছ সাধনের সময়কাল চললেও বাংলাদেশের বাঙালি ভীন দেশের জয়ে পার্টি দিয়ে চলেছে। বুয়েনস আইরেসে বা প্যারিসে যার যার কফি সে কিনে পান করলেও প্রতিবেশীকে অভুক্ত রেখে পার্টিতে খাবারের উদযাপন করা কি স্বাভাবিক কিছু?

আমি অভিবাসন সূত্রে অস্ট্রেলিয়ার নাগরিক। এই দেশ এবার চূড়ান্ত পর্যায়ে খেলেছে। চ্যাম্পিয়ন মেসিদেরও অস্ট্রেলিয়ার সাথে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই করে জিততে হয়েছিল। কিন্তু এমন উন্মাদনা দেখিনি। কেউ বলেনি চলো ব্রাদার জয় বা খেলার আনন্দে কফি হয়ে যাক। তার মানে কি এই যে, এদের আবেগ নেই? না এরা নির্বোধ। মূলত এরা বিচক্ষণ আর পরিমিত বলেই ভালো করে বা ভালো করতে জানে। আমি দেশের তারুণ্যকে শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা জানাই। নোংরা রাজনীতি আর দলাদলির কঠিন সময়ে তারা তাদের মন ও প্রাণের আনন্দ ঢেলে রাতভর খেলা দেখেছে। যার যার পছন্দমতো দল নির্বাচন করে উৎসাহ-উদ্দীপনা-বিষাদে নির্ঘুম রাত কাটিয়েছে। দুনিয়াকে জানান দিয়েছে এমন একটা দেশ আছে এশিয়ায় যার কাছে পৃথিবীর এমন দেশও প্রিয়, যার নাম আর খেলা ব্যতীত আর কিছুই তারা জানে না। এ জায়গাটা স্যালুটের।

কিন্তু ৫১ বছর পর আমাদের দেশের যে হাল তাতে ধৈর্য আর শান্তির বিকল্প দেখি না। ওই যে ওয়ানডে আর টেস্ট ম্যাচের পার্থক্য সেটাই আবার বলতে হচ্ছে। সময় আর প্রস্তুতি নিয়ে পরিণত হয়ে সবকিছু করাই হচ্ছে বিজয়ের প্রথম ধাপ। নয়তো মাঝে মাঝে ঝলসে উঠলেও আখেরে আমাদের কোনো লাভ হবে না। বড় বেশি দরকার সহ্য আর শান্তি। তবেই বাংলাদেশের আরাধ্য লক্ষ্য অর্জন সম্ভব হতে পারে। উন্মাদনার বাইরের জগতটুকু কবে উন্মোচিত হবে হে স্বদেশ?