যুদ্ধদিনের গদ্য-০৪: “বেসামরিক কোনো মুক্তিযোদ্ধাকে ‘বীরশ্রেষ্ঠ’ খেতাব না দেওয়াটা ঠিক ছিল না”

"ওই অপরেশনে সফল হইনি আমরা। সহযোদ্ধা ইন্দ্র কুমার চক্রবর্তীও ফেরে নি। মৃত্যুই তাকে ওই অপারেশনে টেনে আনে। জীবিত ধরা পড়ে পাকিস্তানি সেনাদের হাতে। হিন্দু হওয়ায় তাকে নির্মমভাবে টর্চার করে হত্যা করে পাকিস্তানিরা।"

সালেক খোকনসালেক খোকন
Published : 13 August 2022, 02:43 PM
Updated : 13 August 2022, 02:43 PM

“ক্লাস নাইনে পড়ি তখন। গ্রামের বড় ভাই অনেকেই পড়তেন ঢাকায়, বিশ্ববিদ্যালয়ে। তারা কেউ আসলেই ছুটে যেতাম, ঢাকার খবরাখবরও জানতে। ছয় দফা ছিল বঙালির মুক্তির সনদ। ক্রমেই তা আমাদের চোখ খুলে দেয়। ছয় দফার আন্দোলনই পাকিস্তানের ভিত কাঁপিয়ে দেয়। এমন নানা খবরে আলোড়িত হতাম। এর পর আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা হয়। ওই সময় হবিগঞ্জের বৃন্দাবন কলেজ থেকে আসেন মতিন, শরীফুল্লাহ, হাশেম ভাই প্রমুখ ছাত্রনেতারা। দেশ নিয়ে নানা বৈষম্যের কথা বোঝাতেন তারা। মিছিল মিটিংও চলত। এভাবে সারাদেশে ছাত্রদের কারণেই উত্তাল হয় ঊনসত্তরের গণআন্দোলন।”

“কিন্তু এই আন্দোলন কেন জরুরী ছিল? এটি বোঝাতে ওইসময় একটি পোস্টার ছাপানো হয়। পোস্টারে ছিল একটি গাভীর ছবি। গাভীর মুখের দিকটা পূর্বপাকিস্তানে আর পেছন দিকটা ছিল পশ্চিম পাকিস্তানে। অর্থাৎ গাভীটা পূর্ব পাকিস্তানের ঘাস ও খাদ্য খায়। কিন্তু তার দুধ আমরা পাই না। দুধ নিয়ে নেয় পশ্চিম পাকিস্তান।”

“প্রবল আন্দোলনের মুখে পাকিস্তানি সরকার শেখ মুজিবকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়। পরে নির্বাচন দেওয়া হয় ১৯৭০ সালে। কিন্তু সারাদেশে আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্টতা লাভ করলেও ক্ষমতা দেয় না পাকিস্তানি সামরিক সরকার। ফলে শুরু হয় অসহযোগ আন্দোলন। ওই আন্দোলনে সক্রিয় ছিলেন আওয়ামী লীগের প্রবীণ নেতা ইম্বর আলী, মোস্তফা আলী, মানিক চৌধুরী প্রমুখ।”

“এখন কী হবে, করণীয় কি? এসব নিয়ে অনিশ্চয়তায় ছিলাম আমার। সবাই নেতার (বঙ্গবন্ধু) নির্দেশনার অপেক্ষায় থাকে। নেতা সেই নির্দেশই দেন ৭ মার্চের ভাষণে, ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে। ওই ভাষণ শুনি রেডিওতে। বঙ্গবন্ধু বললেন- ‘... তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে প্রস্তুত থাকো....এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ এই কথাগুলোই সবকথা বলে দেয়। ঢাকার তিতুমির কলেজে পড়ত এক বড় ভাই, নাম আব্দুর রব শেখ। ভাষণ শুনে নবীগঞ্জে তিনিই প্রথম পাকিস্তানের পতাকা পোড়ান। তখনই বুঝে যাই যুদ্ধ ছাড়া মুক্তি নেই।”

একাত্তরপূর্ববর্তী নানা ঘটনার কথা এভাবেই তুলে ধরেন বীর মুক্তিযোদ্ধা নূর উদ্দিন আহমেদ (বীরপ্রতীক)। এক বিকেলে তার বাড়িতে বসেই আলাপ চলে যুদ্ধদিনের নানা ঘটনাপ্রবাহ নিয়ে।

তমিজ উদ্দিন আহমেদ ও তাহমিনা আহমেদের বড় সন্তান নূর উদ্দিন আহমেদ। বাড়ি হবিগঞ্জের নবীগঞ্জ উপজেলায়, সাতাইহাল গ্রামে। লেখাপড়ায় হাতেখড়ি সাতাইহাল প্রাইমারি স্কুলে। তিনি ক্লাস সিক্সে ভর্তি হন দিনারপুর উচ্চ বিদ্যালয়ে। মুক্তিযুদ্ধের সময় ছিলেন ম্যাট্রিক পরীক্ষার্থী।

২৫ মার্চের পর ঢাকা থেকে মানুষ হেঁটে চলে আসে গ্রামের দিকে। তাদের মুখেই নূর উদ্দিনরা শোনেন গণহত্যার খবর। শেরপুরে কুশিয়ারা নদীর কাছাকাছি পাকিস্তানি আর্মিরা একটা ক্যাম্প করে। প্রতিবাদে মাহবুবুর রব সাদীর নেতৃত্বে বিশাল এক মিছিল বের হয়। তিনিসহ সুবেদার জহুর আহমেদ ও স্থানীয় নেতারা আগেই সংগ্রহ করে দেশিয় কিছু অস্ত্র। মানিক চৌধুরীর নেতৃত্বে হবিগঞ্জের কোদ (অস্ত্রাগার) ভেঙ্গেও কয়েকটা রাইফেল আনা হয়। এছাড়া পালিয়ে আসা কয়েকজন ইপিআর সদস্যের কাছেও ছিল থ্রি নট থ্রি রাইফেল। এগুলো নিয়েই তারা প্রতিরোধ গড়ার পরিকল্পনা করেন।

৬ জুলাই ১৯৭১। নদী পাড়ে পজিশন নেন তারা। ওপারের পাকিস্তানিদের ক্যাম্প থেকে গুলি আসতে থাকে। মানুষকে ভয় দেখানোর জন্য তারা টু-ইঞ্চি গোলা ছোঁড়ে। ইপিআরের দুজন লোকও শহীদ হন ওই প্রতিরোধে। নূর উদ্দিনরা তখন বুঝে যান আর্মিদের সঙ্গে লড়াই করতে লাগবে উন্নত ট্রেনিং। ফলে তারা দেশের টানে একদিন ঘর ছাড়েন।

কীভাবে এবং কোথায় গেলেন?

তার ভাষায়, “এপ্রিলের মাঝামাঝি সময়ের ঘটনা। বন্ধুদের সঙ্গে আগেই মিটিং করেছি। কে কে মুক্তিযুদ্ধে যাবা? অনেকেই বলেছে যাবো। রাতে প্রাইমারি স্কুলের এক জায়গায় একত্রিত হওয়ার কথা। কিন্তু কেউ আর আসে নাই। চাচা সম্পর্কের গ্রাম্য ডাক্তার সিরাজুল ইসলাম শুধু আসেন। তখন চিন্তা করি, এখানে না থেকে যুদ্ধ করে মরাই ভাল। উনিও রাজি হলেন। ফলে দুজনেই রওনা হই।”

“সংগ্রাম পরিষদের জন্য আমরা বাড়ি বাড়ি গিয়ে টাকা ও চাল তুলেছিলাম। চাল বিক্রি করে যে ফান্ড হতো সেটা জেলার নেতাদের কাছে পাঠাতে হতো। তখন ফান্ডের ১৫০টাকা সঙ্গে ছিল। প্রথম আমরা যাই হবিগঞ্জে, সকালের দিকে আওয়ামী লীগ অফিসে পৌঁছি। সেখানে পাই প্রবীণ নেতা জোবেদ আলী সাহেবকে। তার কাছে সংগ্রাম পরিষদের টাকাটা জমা দিয়ে যুদ্ধে যাওয়ার ইচ্ছার কথা জানাই। মুচকি হেসে তিনি পঞ্চাশ টাকা হাতে তুলে দিয়ে বললেন, ‘যাইতে তো পয়সা লাগবে। তোমরা মৌলভীবাজার যাও, ডিসির বাংলোতে। ওখানে মুক্তিযোদ্ধা রিক্রুট করা হয়।’ একটা চিঠিও লিখে দেন। সেটি নিয়ে হবিগঞ্জ থেকে গেলাম মৌলভীবাজার। তিন দিন থাকার পর সেখানে একটি প্ল্যাটুন হয়। এর নেতৃত্বে ছিলেন মুসাব্বির নামের একজন। আরও ছিলেন আশরাফ বাবুল চৌধুরী, সিরাজ প্রমুখ।”

“ওখানে অধিকাংশ ছিল মৌলভীবাজারের লোক। হবিগঞ্জের কোন নেতা পাই না। ফলে আমরাও ট্রেনিংয়ে যাওয়ার সুযোগ পাচ্ছি না। একদিন আসেন তৎকালীন এমপিএ মানিক চৌধুরী। তিনিই আমাদের বাঁশবাড়ি ক্যাম্পে পাঠান। প্রাথমিক ট্রেনিং শুরু হয় সেখানেই। ওটা ছিল অস্থায়ী ক্যাম্প, শ্রীমঙ্গলের কাছাকাছি। এক রাতে হঠাৎ সাইরেন বাজে। পাক আর্মি বোম্বিং করবে। ৫ মিনিটের ভেতর উঠে সবাই গাড়িতে গিয়ে বসি। চলে যাই আশ্রমবাড়ি ইয়ুথ ক্যাম্পে।”

এরপর তাদের হায়ার ট্রেনিংয়ের জন্য পাঠানো হয় ভারতের ওমরা নগরে। সেখানে এসএলআর, স্টেনগান, লাইট মেশিনগান, মাইন, অ্যান্টিপারসনাল মাইন, অ্যান্টিট্যাংক মাইন, এক্সপ্লোসিভ প্রভৃতি শেখানো হয় দেড় মাসে।

ট্রেনিং শেষে নূর উদ্দিনদের পাঠিয়ে দেওয়া হয় চার নম্বর সেক্টরের কুকিতল অপারেশনাল ক্যাম্পে। অতঃপর শুরু হয় শত্রুর সঙ্গে লড়াই। প্রথম দিকে যুদ্ধ ছিল- হিট অ্যান্ড রান। পরে একেক ধাপে যুদ্ধটাও একেকভাবে এগোয়। সে যুদ্ধে সাধারণ মানুষ সবসময়ই ছিলেন মুক্তিযোদ্ধাদের পাশে।

কীভাবে?

অজানা একটি ঘটনার কথা তুলে ধরে বীর মুক্তিযোদ্ধা নূর উদ্দিন আহমেদ বলেন, “লাঠিটিলা বর্ডারে ছিল পাকিস্তানি আর্মিদের একটা ক্যাম্প, আমাদের ক্যাম্প থেকে দুই বা তিন কিলোমিটার দূরে। ওখানে আক্রমণ চালাতে হবে। রেকি করার দায়িত্ব দেওয়া হয় আমাকে। গোপনে ওই এলাকায় গিয়ে লোক মারফত নানা তথ্য নিয়ে রেকি করি। এভাবেই ঠিক করা হয় টার্গেট।”

“রাতে আমরা গন্তব্যে পজিশন নিয়ে ভোরে আক্রমণ করি। মিত্রবাহিনী পেছন থেকে আর্টিলারি সার্পোট দেয়, সামনে আমরা এগোই। দুই দিক থেকে আক্রমণ চলে। ফলে ওরা টিকতে পারে না। ওই ক্যাম্পে ৭জনের মতো পাকিস্তানি আর্মি মারা যায়। ওরা পাল্টা আক্রমণও চালায়। কিন্তু তার আগেই সফলভাবেই ফিরে আসি।”

“মজার ব্যাপার হলো, ওই অপারেশনে দুজন পাকিস্তানি আর্মি রাস্তা ভুলে চা বাগানের এক কুলিকে বলে, ‘আমাদের জুড়ি ক্যাম্পে নিয়ে যাও।’ ওই কুলি কৌশলে তাদের ইন্ডিয়ার ভেতরে নিয়ে আসে। খবর পেয়ে চতুর্থদিক থেকে ঘেরাও করে আমরা ওদের ‘হ্যান্ডস আপ’ করাই। পরে ইন্ডিয়ান আর্মিরা ওদের নিয়ে যায়।”

“এ সফলতায় বিশাল আবদান ছিল ওই বাঙালি কুলির। পাকিস্তানি আর্মির হাতে অস্ত্র। জীবন যাওয়ার ভয়ও ছিল। তবুও তাদের ভুল পথে নিয়ে আসছে। এভাবে সাধারণ মানুষ আমাদের সহযোগিতা করেছে। যখন যুদ্ধ করেছি তখন ভাবি নাই নয় মাসে দেশ স্বাধীন হবে। ভাবছি আমরা মারা যাবো। পরবর্তী প্রজন্ম আবার ট্রেনিং নিয়ে যুদ্ধটা এগিয়ে নিবে। কিন্তু সাধারণ মানুষের সহযোগিতার কারণেই গেরিলা যুদ্ধে সফল হই। স্বাধীনতা আনাও সহজ হয়।”

একাত্তরে একটি অপারেশনের কথা শুনি এই বীরের মুখে।

তার ভাষায়, “আমরা তখন কুকিতল ক্যাম্পে। আর দিলকুশা চা বাগানে ছিল পাকিস্তান আর্মিদের শক্তিশালি ঘাঁটি। ওই ক্যাম্পে মেয়েদের ধরে নিয়ে যেত ওরা। আশপাশের গ্রামে ঢুকে ঘরবাড়িও জ্বালিয়ে দিতো। আমাদের ক্যাম্প কমান্ডার রুহুল আহমেদ বাবুর সিদ্ধান্ত ওই ক্যাম্পে অপারেশন করতে হবে। কয়েকটা গ্রুপ করে আগেই ক্লাস করানো হয়।”

“সহযোদ্ধা শামসুল হক রেকি করে সব খবর এনে দেন। অপারেশনে ছিলাম অ্যাসল্ট পার্টিতে, ৩৩জনের একটি প্লাটুনের কমান্ডও করি। পরিকল্পনা হয়, সামনাসামনি যুদ্ধের ভেতরই আমরা ক্যাম্পে উঠে যাবে। গোলাগুলি শুরু করবে কাভারিং পার্টি। তাদের সামনে থাকবে আমাদের অ্যাসল পার্টি। শত্রু যেন ভেগে যেতে না পারে বা বাইরে থেকে ভেতরে ঢুকে সাহায্য করতে না পারে সেটি নিশ্চিত করবে কাট অফ পার্টি।”

“অপারেশনে অ্যাসল্ট পার্টিতে যারা থাকে তারা মৃত্যুকে মেনে নিয়েই এগোয়। বেঁচে থাকাটাই ছিল অ্যাকসিডেন্ট, মরা হলো স্বাভাবিক। ক্যাম্পে এক সহযোদ্ধা বন্ধু ছিল। নাম ইন্দ্র কুমার চক্রবর্তী। সে খুব ভয় পেত। বলত, বড় অপারেশনে আমাকে নিয়েন না। কিন্তু কেন জানি ওই অপারেশনে যাওয়ার জন্য সে খুব সিরিয়াস। বলে, আমাকে নিতেই হবে। তাকে সঙ্গে নিলাম।”

“পাকিস্তানিদের ক্যাম্পটা ছিল টিলার ওপরে। চা বাগানের রাস্তা মানেই নালা বা বাগানের ভেতর দিয়ে চলা। ভোরের আগেই সেখানে পৌঁছি। পূর্বদিকে লাল আভা যখন বেরোয় তখনই যুদ্ধ শুরু হয়। মিত্রবাহিনী আর্টিলারি সার্পোট দেয়। সেটা শেষ হলেই কাভারিং পার্টি ফায়ার ওপেন করবে।”

“পাকিস্তানি সেনারা তো ট্রেন্ড সোলজার। আর্টিলারি শুরু হলেই ওরা ক্যাম্প ছেড়ে দেয়। তখন কাভারিং পার্টি এসএলআর ও এলএমজির ফায়ার শুরু করে। ক্রলিং করে আমরা তখন এগোই। টিলার দিকে উঠব কিন্তু পেছন থেকে কাভারিং পার্টির ফায়ার বন্ধ হয় না। লোক পাঠানো হলো। কিন্তু তার আগেই ক্যাম্পে উঠতে গিয়ে আমাদের গুলিতেই তিনজন মারা যায়। ক্যাম্পে উঠে ওদের বান্কারে গ্রেনেড চার্জ করি। কিন্তু কয়েকজন বাঙালি রাজাকার ছাড়া কাউকে পাই না। মাত্র ২৫-৩০ মিনিট ক্যাম্পটি দখলে ছিল।”

আমাদের ‘কাট অফ’ পার্টি জায়গা মতো যেতেই পারে নাই। ফলে পাকিস্তানি আর্মিরা পেছনে গিয়ে শক্তি সঞ্চয় করে ‘ইয়া আলী’ বলে পাল্টা আক্রমণ করে। ফলে আমরা ক্যাম্প থেকে নিচে নেমে যেতে থাকি। তখন সকালবেলা। ওরা দেখে দেখে গুলি করতে থাকে। চা বাগানের নালা দিয়ে এগোই। কিছু দূর আসতেই দেখি ক্যাম্প কমান্ডার বাবু ভাই রক্তাক্ত হয়ে রাস্তায় পড়ে আছে। গুলিতে তার পা ঝাঝরা হয়ে গেছে। এক পা চামড়ার সঙ্গে ঝুলছিল কোনোরকমে। দুইজন সহযোদ্ধাকে নিয়ে খায়রুল মজিদ গামছা দিয়ে পিঠে বেঁধে বাবু ভাইকে তুলে নেয়।”

“ওই অপরেশনে সফল হইনি আমরা। সহযোদ্ধা ইন্দ্র কুমার চক্রবর্তীও ফেরে নি। মৃত্যুই তাকে ওই অপারেশনে টেনে আনে। জীবিত ধরা পড়ে পাকিস্তানি সেনাদের হাতে। হিন্দু হওয়ায় তাকে নির্মমভাবে টর্চার করে হত্যা করে পাকিস্তানিরা। তার কথা মনে হলে এখনও বুকের ভেতরটা খামচে ধরে।”

“তার মতো ৬জন সহযোদ্ধাই ক্যাম্প থেকে নামতে গিয়ে ধরা পড়ে। সবাইকেই হত্যা করা হয়। ক্যাম্প কমান্ডারসহ ওই অপারেশনে আহত হয় ২০জনের মতো। মূলত ‘কাট অফ পার্টি’র ব্যর্থতার কারণেই অপারেশনটিতে ব্যর্থ হই আমরা।”

“এরপর ছোটলেখা চা বাগানে যুদ্ধ হয়। ওই অপারেশনে নূর উদ্দিন আহমেদ ছিলেন ‘কাট অফ’ পার্টির প্রধান। টোয়োইসি ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা মাসুদ, আখাউড়া বাড়ি। এ অপারেশনে সবাই ভেবেছিলেন, তারা শহীদ হয়েছেন। তাদের মৃত ঘোষণাও করা হয়।”

ফ্লাইট ল্যাফটেনেন্ট নূরুল কাদের তখন কুকিতল সাব সেক্টরের কমান্ডার। মুক্তিযোদ্ধা নূর উদ্দিন আহমেদ চলে যান করিমগঞ্জ, এক আত্মীয়র বাড়িতে। খবর পেয়ে সাব-সেক্টর কমান্ডার মাহবুবুর রব সাদী তাকে নিয়ে আসেন জালালপুর সাবসেক্টরে। দায়িত্ব দেন মনিপুর ক্যাম্পের।

তার ভাষায়, “মনিপুর ক্যাম্পটি কানাইঘাট থানায়, টিলার মতো জায়গায়। লোকজন থাকতে পারত না। দুদিন পরপরই আক্রমণ হতো। লোকজন মারা যেত। ওখানে ৩৩জন ছেলে ছিল। সাদী ভাই আমাকে পাঠালেও কমান্ডার করেন আরেকজনকে। তবে উনি অসুস্থ থাকায় টোয়াইসি হিসেবে আমিই মূল দায়িত্ব পালন করেছি।”

“একদিন বিকাল বেলা কেন জানি মনে হলো আজ রাতে আক্রমণ হতে পারে। আমি পাশের গ্রাম থেকে বিশ-ত্রিশ জন লোক এনে ক্যাম্পের ভেতর বিরাট একটা বান্কার করে, ওপরে গাছ দিয়ে নিচে রাস্তার মতো করে অবস্থান নিই। ওই রাতেই অ্যাটাক করে ওরা।”

“রাত তখন আড়াইটা। নদীর পাড়েই আমাদের দুটি অ্যাম্বুস পার্টি ছিল। মেইন ক্যাম্পে ১১জনের মতো। বাকীরা অ্যাম্বুস ও বিভিন্ন জায়গায় পজিশনে। পেট্রল করে সব ঠিক আছে কিনা দেখতে বেরোই। নদীর পাড়ে লাস্ট অ্যাম্বুস চেক করি। তখন নদীতে বৈঠার আওয়াজ পাই। সবকিছু দেখে ফিরে যেতেই গুলির শব্দ। অ্যাম্বুসে থাকা একজন সিগারেট খাচ্ছিল। ফলে পাকিস্তানি আর্মিরা দূর থেকেই পজিশন বুঝে যায়। ওদের ওপর সমানে গুলি করতে থাকে। ফলে রবিন কমান্ডারসহ ওখানে থাকা ৬জনই মারা যায়।”

“ওরা মেইন ক্যাম্পের দিকে এগোনোর চেষ্টা করে। কিন্তু নদী পাড়ে থাকা আমাদের আরেকটা অ্যাম্বুস থেকে ব্রাশ করা হয়। ফলে নৌকার অধিকাংশ আর্মিই মারা যায়। কয়েকজন নদীতে ঝাপ দেয়।”

“এদিকে ভারতে খবর চলে যায় মনিপুর ক্যাম্পের কেউ বেঁচে নেই, পাকি আর্মিরা ক্যাম্প দখল করে আছে। ফলে ভারত থেকে আর্টিলারি এসে পড়ে ক্যাম্পে। কিন্তু তার আগেই আমরা সরে পড়ি। খরস্রোতা নালা দিয়ে হাওর পাড় হয়ে চলে যাই মেইন ক্যাম্পে। পাকিস্তানিদের ঝটিকা আক্রমণ ছিল সেটা। অ্যাট আ টাইম আটটা ক্যাম্পে আক্রমণ করেছিল ওরা।”

দিলকুশা গার্টেনে আরেকটি যুদ্ধে শহীদ হন বীর মুক্তিযোদ্ধা শামসুল হক।

কীভাবে?

বীরপ্রতীক নূর উদ্দিন আহমেদের ভাষায়, “ওই অপারেশনে আমিও ছিলাম। শামসুল ছিল গাছের ওপরে, ওপি পোস্টে। দেখে দেখে বলত কোনদিকে পাকিস্তানিরা। নিচে ছিলেন ক্যাপ্টেন। তার নির্দেশে সেই অ্যাঙ্গেলে বোম্বিং করা হতো। পাকিস্তানি আর্মিরা তাকে টার্গেট করে ফেলে। থ্রিইঞ্চি মর্টার মারলে সেটি এসে পড়ে তার ওপরে। মর্টারের আঘাতে তার শরীর দুটুকরো হয়ে যায়। চোখের সামনে সহযোদ্ধার ক্ষতবিক্ষত দেহ। কি যে মর্মান্তিক সেই দৃশ্য!”

“ওদিন আমিও মারা যেতাম। ভাগ্যের জোরে বেঁচে আছি। টুইঞ্চি মর্টার মাটিতে পরার পর বিকট শব্দে ওই জায়গার মাটি উপরে উঠে যায়। ওই মাটিতে চাপা পড়ে যাই আমি। আমার পেছনে বাধা ছিল ওয়ারল্যাস সেট। ওই সেটসহ মাটির নিচে চাপা পড়ি। সহযোদ্ধা খোকন ছিল পাশে। সে দ্রুত আমার চুল ধরে টেনে তোলে। রক্তাক্ত ওইদিনটির কথা এখনও মনে পড়ে। স্বপ্নে প্রায় শুনি শামসুলের আর্তনাদ। তখন কি যে কষ্ট হয়, ঠিক বোঝাতে পারব না ভাই। একাত্তরে মরতেই গিয়েছিলাম আমরা, বেঁচে আছি এটাই অস্বাভাবিক।”

এই বীর মুক্তিযোদ্ধা ‘বীরপ্রতীক’ খেতাব লাভ করলেও তালিকায় তিনি ছিলেন ‘শহীদ’ হিসেবে। এ নিয়ে তিক্ত অভিজ্ঞতার কথা অকপটে তুলে ধরেন ঠিক এভাবে- “স্বাধীনতা লাভের পর ‘শহীদ’ হিসেবে আমার পরিবারকে দুই হাজার টাকা ও বঙ্গবন্ধুর স্বাক্ষরিত একটা চিঠি পাঠানো হয়। কিন্তু আমি তো জীবিত। তাই ওটা ফেরত পাঠাই। খেতাব পেয়েছি সেটাও জানি না। এক সহযোদ্ধা চাকরি করতেন বিডিআরএ, লেন্স নায়েক ছিলেন। পেপারে খেতাবপ্রাপ্তদের তালিকা দেখে তিনিই খবর দেন। সেখানেও নামের পূর্বে ‘শহীদ’ শব্দটি যুক্ত ছিল। পরে চিঠিও পাই ‘শহীদ’ হিসেবে। এ নিয়ে বহু প্রতিবাদ করেছি- আমি তো শহীদ না। কিন্তু জীবিত- এটা প্রমাণ করবো কীভাবে। কল্যাণ ট্রাস্টে গেলাম। ওরা বলল- কমান্ডার যদি থাকেন তিনি সার্টিফাই করবেন। তখন সাদী ভাই (মাহবুবুর রব সাদী) লিখিত প্রত্যয়ন দেন যে, আমি জীবিত আছি। তারপরও অজ্ঞাত কারণে নাম ঠিক হয় না। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একবার আনুষ্ঠানিকভাবে বীরপ্রতীক সনদ প্রদান করেন। তখনও সনদে ‘শহীদ’ শব্দটি যুক্ত ছিল। কয়েক বছর আগে নাম সংশোধন হলেও মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর ও জাতীয় জাদুঘরসহ বিভিন্ন জায়গার তালিকায় ‘শহীদ’ শব্দটি এখনও আছে। খেতাবপ্রাপ্তদের নামের তালিকাও এত বছরে নির্ভুল হয়নি। এ দুঃখের কথা কাকে বলবো বলেন।”

খেতাব প্রদানেও বৈষম্য ছিল বলে মনে করেন এই বীরপ্রতীক। তার ভাষায়, “মাহবুবুর রব সাদী ভাই জালালপুর সাবসেক্টরের কমান্ডা ছিলেন। কিন্তু অফিসিয়ালি তাকে স্বীকৃতি দিতেও নানা টালবাহানা হয়। কারণ তিনি ছিলেন এফএফ (ফ্রিডম ফাইটার)। সাবসেক্টর কমান্ডার অধিকাংশরাই ছিলেন ডিফেন্সের লোক।”

“আবার অনেক এফএফ সম্মুখ সমরে লড়াই করে শহীদ হন। আমাদের সঙ্গে ছিলেন নিজাম উদ্দিন নামে একজন। এক অপারেশনে সহযোদ্ধাদের চলে যেতে বলে, তিনি একাই এলএমজি নিয়ে দাঁড়িয়ে গুলি করতে থাকেন। পরে পাকিস্তানি আর্মি তাকে ঘেরাও করে গুলিতে বুক ঝাঝরা করে দেয়। সহযোদ্ধাদের বাঁচাতে নিজামের মতো অনেকেই একাত্তরে শহীদ হন। কিন্তু সিভিলিয়ান হওয়ায় ‘বীরশ্রেষ্ঠ’ খেতাব দেওয়া হয়নি। যেটা করা ঠিক হয়নি। তাদের আত্মত্যাগের ঘটনাও উঠে আসেনি ইতিহাসে। এ নিয়ে সাদী ভাই প্রতিবাদ করেছিলেন। মুক্তিযুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ ভ‚মিকার জন্য তাকে বীরপ্রতীক খেতাব দেওয়া হলেও বেসামরিক কোনো মুক্তিযোদ্ধাকে বীরশ্রেষ্ঠ খেতাব না দেওয়ার প্রতিবাদে তিনি ওই খেতাবটি গ্রহণ করেননি।”

“মুক্তিযোদ্ধার তালিকা নয়, শুরুতেই করা উচিত ছিল রাজাকার ও যুদ্ধাপরাধীদের তালিকা”, এমনটাই মত দেন বীরপ্রতীক নূর উদ্দিন আহমেদ। তার ভাষায়, “যত সরকার আসবে বারবারই মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা হবে, তালিকাও বাড়বে। এটাও একটা রাজনীতি। কিন্তু করা উচিত ছিল রাজাকারের তালিকা। এখন সেটাও সম্ভব না। কারণ রাজাকারের অনেক উত্তসূরি ক্ষমতাসীন দলের বড় লিডার বনে গেছে। ফলে কোন তালিকাই এখন আর নির্ভুল হবে না।”

প্রজন্মকে নিয়ে দারুণ আশাবাদি এই বীরপ্রতীক। তিনি মনে করেন তারা হাল ধরলেই দেশ এগোবে। চোখেমুখে আলো ছড়িয়ে তাদের উদ্দেশে বীর মুক্তিযোদ্ধা নূর উদ্দিন আহমেদ (বীরপ্রতীক) বলেন, “যারা একাত্তরে ত্যাগ স্বীকার করে স্বাধীনতা এনেছে, সাহস দেখিয়েছে, তাদের বীরত্বের ইতিহাস তোমরা জেনে নিও। মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে বুকে ধারণ করো। অন্যায়ের প্রতিবাদ করো। মনে রেখো অন্যায়ের বিরুদ্ধেই লড়াই হয়েছিল একাত্তরে।”

ছবি ও ভিডিও: সালেক খোকন