১৯৭৫ সালে জাসদ একটি ‘অভ্যুত্থান’ সংঘটিত করতে পেরেছিল, যার সুফল জাসদের ঘরে না গিয়ে জিয়াউর রহমানের ভাগ্য বদল করে দিয়েছিল। এই অভ্যুত্থানের পরিকল্পনাকারী বা রূপকার কর্নেল তাহেরকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে জিয়া তার ঋণ পরিশোধ করেছেন।
Published : 07 Nov 2023, 12:47 PM
৭ নভেম্বর। বাংলাদেশের রাজনীতির জন্য এই তারিখটি বড় ধরনের ক্ষত ও ক্ষতির কারণ হলেও ৭ নভেম্বর নিয়ে আমাদের রাজনৈতিক নেতৃত্বের মধ্যে গভীর কোনো চিন্তার প্রতিফলন লক্ষ্য করা যায় না। অথচ ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর ছিল এমন একটি দিন, যা দেশের রাজনীতির ধারা বদলে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। দেশের রাজনীতি নিয়ে যেমন ঐকমত্য নেই, তেমনি ৭ নভেম্বর নিয়েও আছে মতভিন্নতা ও বিভিন্ন নামে দিনটি পালনের ছেলেমানুষি প্রবণতা। অবশ্য দেশের ব্যাপক জনগোষ্ঠীর কাছে এই দিন পালন করা, না-করা নিয়ে কোনো আগ্রহ কিংবা কৌতূহল ছিল বলে মনে হয় না। দেশের ক্ষমতাপ্রত্যাশী বড় দল বিএনপির কাছে ৭ নভেম্বর হলো ‘বিপ্লব ও সংহতি দিবস'। কারণ এই দিনের ঘটনাবলী জিয়াউল রহমানের রাজনৈতিক ভাগ্য গড়ে দিতে বড় ভূমিকা রেখেছিল। জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল বা জাসদের কাছে ৭ নভেম্বর হচ্ছে ‘সিপাহী-জনতার অভ্যুত্থান দিবস'। হ্যাঁ, ১৯৭৫ সালে জাসদ একটি ‘অভ্যুত্থান’ সংঘটিত করতে পেরেছিল, যার সুফল জাসদের ঘরে না গিয়ে জিয়াউর রহমানের ভাগ্য বদল করে দিয়েছিল। এই অভ্যুত্থানের পরিকল্পনাকারী বা রূপকার কর্নেল তাহেরকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে জিয়া তার ঋণ পরিশোধ করেছেন। আবার আওয়ামী লীগ ও অন্য প্রগতিশীলদের কাছে ৭ নভেম্বর হলো ‘মুক্তিযোদ্ধা সৈনিক হত্যা দিবস’।
বিএনপি ক্ষমতায় থাকলে ৭ নভেম্বর যতটা জৌলুশের সঙ্গে পালন করে ক্ষমতার বাইরে থাকলে তা না করে না। আবার আওয়ামী লীগের এই দিন নিয়ে তেমন আগ্রহ না থাকাই স্বাভাবিক। ৭ নভেম্বর এসেছিল ১৯৭৫ সালের অগাস্ট ট্রাজেডির পথ ধরেই। ১৯৭৫ সালের ১৫ অগাস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার মধ্য দিয়ে যে বিয়োগান্ত রাজনৈতিক ধারার সূচনা তার ধারাবাহিকতায় সে বছরের নভেম্বর মাসে ঘটেছিল আরও কিছু হত্যাকাণ্ড। ৩ নভেম্বর জেলখানায় বন্দী অবস্থায় হত্যা করা হয়েছিল চার জাতীয় নেতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, এএইচএম কামারুজ্জামান এবং ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলীকে। এই চার নেতা ছিলেন বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ। তাঁর অনুপস্থিতিতে এই চারজনই মূলত একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনায় নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। ১৫ অগাস্ট বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে খন্দকার মোশতাক আহমদ রাষ্ট্রপতির পদে বসেছিলেন। বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রিসভার বেশিরভাগ সদস্য মোশতাকের প্রতি আনুগত্য দেখিয়ে তার মন্ত্রিসভায় যোগ দিলেও ব্যতিক্রম ছিলেন চারজন। এই চারজনকে গ্রেপ্তার করে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে রাখা হয়েছিল। ওই কারাগারেই ৩ নভেম্বর তাদের হত্যা করা হয় খন্দকার মোশতাকের নির্দেশে। ১৫ অগাস্ট যে ঘাতক দল ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে গিয়ে বঙ্গবন্ধুকে হত্যায় অংশ নিয়েছিল তাদেরই কয়েকজন জেলহত্যায়ও একই নৃশংসতায় অংশ নিয়েছিল।
৭ নভেম্বরের ঘটনাপ্রবাহ জিয়াউর রহমানকে ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে এনেছিল, সংহত হয়েছিল বাংলাদেশবিরোধী শক্তির অবস্থান।
জিয়াউর রহমানকে বলা হয় ভাগ্যের বরপুত্র। সেনা কর্মকর্তা থেকে দেশের প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন। তিনি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর স্নেহ পেয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধু ছিলেন তাঁর প্রতি উদার। কিন্তু জিয়াউর রহমান বঙ্গবন্ধুর প্রতি সদয় হতে পারেননি; বরং বঙ্গবন্ধুর প্রতি তাঁর ছিল একধরনের প্রচ্ছন্ন প্রতিহিংসাপরায়ণ মনোভাব। বঙ্গবন্ধুর প্রতি জিয়া কেন অনুদার ছিলেন, তার কারণ অনুসন্ধান প্রয়োজন। কিন্তু এই প্রয়োজনীয় কাজটি না হওয়ায় জিয়াকে নিয়ে আমাদের দেশে মাতামাতি করার লোকেরও অভাব নেই।
বঙ্গবন্ধুর কারণে সেনাবাহিনীতে প্রতিষ্ঠিত হয়ে জিয়াউর রহমান পরবর্তী সময়ে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা এবং হত্যার পর তাঁর নাম ইতিহাস থেকে মুছে ফেলার সব অপচেষ্টারই মধ্যমণি ছিলেন। আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে জিয়াকে যখন পাকিস্তানি অনুচর বলে অভিহিত করা হয়, তখন অনেকেই সেটা মেনে নিতে পারেন না। কারণ, আওয়ামী লীগ জিয়ার বিরুদ্ধে বললে সেটা কারও কারও কাছে বিশ্বাসযোগ্য হয় না। কারণ, তাঁকে বীর উত্তম খেতাব দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু এবং সেনাবাহিনীর উপপ্রধানও বানিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধুই। কেন, কোন পরিস্থিতিতে এসব করা হয়েছিল, তা কেউ খতিয়ে দেখার চেষ্টা করেন না।
আমাদের দেশে একশ্রেণির মানুষের মধ্যে আওয়ামীবিরোধী বিদ্বেষ এতই প্রবল যে, আওয়ামী লীগ তথ্য-প্রমাণনির্ভর কথা বললেও তাঁরা তাকে বানোয়াট মনে করেন। জিয়াউর রহমান যেহেতু আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ হয়েছিলেন, সেহেতু তাঁর সুনাম ক্ষুণ্ণ করার জন্যই তাঁকে আওয়ামী লীগ পাকিস্তানি গুপ্তচর বলে থাকে– এমন ধারণা কারও হতেই পারে।
তাছাড়া ‘মেজর জিয়া’র নামের সঙ্গে বেশ কিছু মানুষের আবেগ জড়িয়ে আছে। কারণ, তাঁর কণ্ঠ থেকেই প্রথম কেউ কেউ স্বাধীনতার ঘোষণা শুনেছিলেন। তিনি ‘স্বাধীনতার ঘোষক’ এমন একটি ধারণা নানা প্রচার-অপপ্রচারের মাধ্যমে জনমনে ঠাঁই পেয়েছে। জিয়া মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছেন। সেক্টর কমান্ডারের দায়িত্ব পেয়েছেন। কাজেই তাঁর মুক্তিযোদ্ধার ভাবমূর্তিও মানুষের মনে উজ্জ্বল। কিন্তু তিনি স্বতঃস্ফূর্তভাবে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন কিনা, তা নিয়ে প্রশ্ন আছে।
স্বাধীনতার পর তিনজন (জেনারেল সফিউল্লাহ, জিয়া ও খালেদ মোশাররফ) সেনা কর্মকর্তার মধ্যে ব্যক্তিত্বের বিরোধের কথা কয়েকজন অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তার বইয়ে উল্লেখ আছে। জিয়ার আকাঙ্ক্ষা ছিল সেনাবাহিনীর প্রধান হওয়ার। সেটা হতে না পেরে তিনি ক্ষুব্ধ ছিলেন। বঙ্গবন্ধু তাঁর স্বভাবসুলভ সরলতায় ব্যক্তিগতভাবে জিয়ার প্রতি উদারতা দেখিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধু জিয়াকে সেনাবাহিনীর উপপ্রধান বানিয়েছিলেন। তাঁর জন্যই এই পদটি বঙ্গবন্ধু তৈরি করেছিলেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর প্রতি কি জিয়া শতভাগ অনুগত ছিলেন? পরবর্তী ঘটনাবলি থেকে বলা যায়, জিয়া আদতেই বঙ্গবন্ধুর হিতৈষী ছিলেন না।
বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডে প্রকাশ্যে নেতৃত্বদানকারী দুজন– কর্নেল ফারুক ও কর্নেল রশিদ দেশত্যাগ করার পর ব্রিটিশ টেলিভিশন চ্যানেলে এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন যে, তাঁরা মুজিব হত্যার পরিকল্পনার কথা জিয়াউর রহমানকে জানিয়েছিলেন। এই সাক্ষাৎকারটি আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে ব্যাপকভাবে প্রচারিত হয়েছিল। জিয়াউর রহমান তখন অত্যন্ত ‘ক্ষমতাধর’ হয়ে ওঠা সত্ত্বেও খুনি দুই কর্নেলের বক্তব্য অস্বীকার করেননি। বরং তিনি তাঁদের পৃষ্ঠপোষকতা দিয়েছেন। তিনি যদি দায়িত্ববান হতেন, বঙ্গবন্ধুর প্রতি যদি সামান্য আনুগত্য বা দরদ থাকত, তাহলে হত্যার পরিকল্পনার কথা শুনে ওই দুই কর্নেলকে পুলিশে সোপর্দ করতেন। সেটা না করে উল্টো তাঁদের এগিয়ে যাওয়ার উৎসাহ দিয়েছেন। এত বড় একটি রাষ্ট্রদ্রোহের ঘটনা ঘটতে যাচ্ছে জেনেও কোনো প্রতিকারের ব্যবস্থা না করে গুরুতর ফৌজদারি অপরাধ করেছেন জিয়া। সেদিন জিয়া যদি পরিকল্পনাকারীদের আইনের আওতায় আনার উদ্যোগ নিতেন, তাহলে বাংলাদেশের রাজনীতির ইতিহাসে এত বড় বিয়োগান্ত ঘটনা হয়তো ঘটত না।
আসলে জিয়ার অভিলাষ ছিল অন্য রকম। তিনি ইতিহাসের নায়ক হওয়ার লোভে মত্ত হয়ে উঠেছিলেন। বঙ্গবন্ধু হত্যার খবর শুনেও জিয়ার প্রতিক্রিয়া ছিল রহস্যজনক। তিনি বিচলিত হননি, ভারাক্রান্ত হননি। বিষয়টি তাঁর জানা ছিল বলেই স্বাভাবিক কণ্ঠে বলতে পেরেছেন: ‘সো হোয়াট? লেট ভাইস প্রেসিডেন্ট টেকওভার। উই হ্যাভ নাথিং টু ডু উইথ পলিটিক্স।’ অথচ কী কদর্যভাবেই না তিনি রাজনীতিতে জড়ালেন এবং রাজনীতিকে রাজনীতিবিদদের জন্য ডিফিকাল্ট করে দিলেন!
মুক্তিযুদ্ধে যোগদানের সুনাম কাজে লাগিয়ে তিনি স্বাধীনতাবিরোধীদের পুনর্বাসনের কাজটি ভালোভাবে করেছেন জিয়া। জামায়াত নেতা গোলাম আযমকে দেশে ফিরিয়ে এনেছেন, ধর্মভিত্তিক সাম্প্রদায়িক রাজনীতির জায়গা করে দিয়েছেন। শাহ আজিজের মতো রাজাকারকে প্রধানমন্ত্রী করে জাতিকে অপমানিত করেছেন। জাতীয় ঐক্যের নামে তিনি জাতিকে স্থায়ীভাবে চরম বিভক্তির পথে ঠেলে দিয়েছেন। জয় বাংলা স্লোগান নির্বাসনে পাঠানোর সঙ্গে সঙ্গে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের নাম মুছে ফেলার সব অপচেষ্টাই করেছেন। পাকিস্তানি পরাজিত সৈনিকরা সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের যে জায়গায় আত্মসমর্পণ করেছিল, সেখানে শিশুপার্ক বানিয়ে ইতিহাসের সঙ্গে তামাশা করেছিলেন জিয়া। বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের বিদেশি মিশনে চাকরি দিয়ে, তাঁদের বিচারের দায়মুক্তি দিয়ে জিয়া বুঝিয়েছেন তিনি আসলে কাদের লোক।
জিয়াউর রহমান তথাকথিত সৎ মানুষের কৃত্রিম ইমেজ নিয়ে দেশের রাজনীতি ও অর্থনীতিতে যে নীতিহীনতার বীজ রোপণ করে গেছেন, তার বিষফল এখন আমরা ভোগ করছি। তবে ইতিহাস কাউকে মার্জনা করে না।
জিয়াউর রহমান ইতিহাসের মহানায়ক শেখ মুজিবকে ইতিহাস থেকে বাদ দেওয়ার ঔদ্ধত্য দেখিয়েছেন; কিন্তু শেখ মুজিবকে তাঁর আসন থেকে সরাতে পারেননি। জিয়ার ভূমিকা নিয়ে আরও বেশি গবেষণা ও সত্যানুসন্ধান প্রয়োজন।