একদিকে খেলার মাঠের সংখ্যা অপ্রতুল, অন্যদিকে আছে সামাজিক ও ধর্মীয় বিধিনিষেধ। মধ্যবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের শিশুদের ক্ষেত্রে এই বিধিনিষেধ আরও কঠিন।
Published : 11 Oct 2022, 09:57 PM
নারীরাও পারে তা আবারও প্রমাণ করল সাফ ফুটবল জয়ী নারী ফুটবলার সাবিনা আক্তার, সানজিদা আক্তার, মারিয়া মান্দা, রূপনা চাকমা, সাবিনা খাতুন, কৃষ্ণা রানীসহ প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে উঠে আসা ফুটবলপ্রেমী ও উদ্যমী মেয়েরা। সাফ ফুটবল জয়ের পর নারী ফুটবলারদের নিয়ে আলাপ-আলোচনায় পুরুষ ফুটবলারদের সাথে বৈষম্যের চিত্রটাও স্পষ্ট হয়েছে আমাদের সামনে। বেতন কাঠামোতে পুরুষ ফুটবল তারকাদের ধারেকাছেও নেই নারী ফুটবলাররা। তিন ক্যাটাগরিতে জাতীয় দলের নারী ফুটবলারদের বেতন যথাক্রমে ১২, ১০ ও ৮ হাজার টাকা। এছাড়া খেলার মাঠ ও সরঞ্জামসহ অন্যান্য বিষয়ে বৈষম্য তো আছেই। খেয়ে না খেয়ে দিনাতিপাত করা এবং সমাজের নেতিবাচক আচরণের সাথে যুদ্ধ করে এগিয়ে আসা বর্তমান সময়ের নারী ফুটবলার ও ক্রিকেটারদের নিয়ে কিছুটা আলাপ আলোচনা হলেও সার্বিকভাবে মেয়েশিশুদের খেলার সুযোগ তৈরি করা নিয়ে তেমন কোনো আলোচনা নেই।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সালমা আক্তার কর্তৃক পরিচালিত ঢাকা শহরে শিশুদের খেলার পরিস্থিতির ওপর পরিচালিত ২০১৮ সালের সমীক্ষা প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, নিরাপত্তার অভাবে রাজধানীর মেয়েশিশুরা উন্মুক্ত স্থানের (ফুটবল, ক্রিকেট, ভলিবল, দাড়িয়াবান্দা ইত্যাদি) খেলাধুলার চাইতে ইনডোর খেলায় (ব্যাডমিন্টন, বাস্কেটবল, রশি টানা, সাঁতার ইত্যাদি) বেশি আগ্রহী। এছাড়া আছে উন্মুক্ত স্থানের সংকট, অপর্যাপ্ত খেলার মাঠ, পড়ার চাপ এবং তীব্র নেতিবাচক সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি। সার্বিক পরিস্থিতি ঢাকা মহানগরের শিশু বিশেষ করে মেয়েশিশুদের খেলার অধিকার যেন প্রতিনিয়ত ছিনিয়ে নিচ্ছে। পরিস্থিতির আরেকটি দিকও আছে– মেয়ে ও ছেলে শিশুদের মধ্যে সমান সংখ্যকেরই ভিডিওগেম পছন্দ যা তাদের পুরোপুরি ঘরবন্দী করে তুলছে। করোনাভাইরাস মহামারীর কারণে দীর্ঘদিন স্কুল বন্ধ থাকায় সমস্যা আরও প্রকট হয়েছে। উন্মুক্ত স্থানে খেলাধুলা থেকে দূরে মোবাইল আর কম্পিউটারে সময় কাটানোর অনিবার্য ফল শিশুর শারীরিক ও মানসিক ক্ষতি। স্থূলতাসহ নানান শারীরিক অসুস্থতার পাশাপাশি আচরণগত পরিবর্তন, মানসিক চাপ ও মানসিক ভারসাম্য হারানোর মতো গুরুতর সমস্যার শিকার হচ্ছে আমাদের শিশুরা। কিশোর-তরুণদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবনতা এবং আত্মহত্যা দুটোই বাড়ছে। অন্যদিকে নৈতিক স্খলন, আপরাধ প্রবণতা বৃদ্ধি, নেশায় অসক্ত হওয়ার মতো সমস্যাও বাড়ছে কিশোর-তরুণ জনগোষ্ঠীটির মধ্যে। ভয় হচ্ছে আমাদের শিশুরা অলস ও মেধাহীন হয়ে বেড়ে উঠবে এবং ভবিষ্যতে আমরা পরিণত হব এক অথর্ব জাতিতে।
বংলাদেশ তথা সারাবিশই দ্রুত নগরায়নের পথে এগিয়ে যাচ্ছে। অনুমান করা হচ্ছে ২০৫০ সাল নাগাদ মোট জনসংখ্যার অর্ধেকই নগরে বাস করবে। ইউএনডিপি’র অনুমিত হিসাব অনুযায়ী ২০৫০ সাল নাগাদ বংলাদেশের জনসংখ্যা হবে ২৩ কোটি থেকে ২৫ কোটি। বর্তমানে ঢাকা শহর তথা রাজধানীতে বসবাসকারীর সংখ্যা প্রায় দুই কোটি যা ২০৫০ সাল নাগাদ চার কাটিতে পৌঁছাবে। ঢাকা শহরে বসবাসকারী ১৮ বছরের নিচে শিশুর সংখ্যা মোট জনসংখ্যার ৪৮ শতাংশ যার প্রায় অর্ধেক মেয়েশিশু। এই বিপুল সংখ্যক শিশুর জন্য প্রয়োজন হলো ২,৪০০টি খেলার মাঠ কিন্তু ঢাকা মেট্রোপলিটন এলাকায় খেলার মাঠ আছে মোট ২৩৫টি। এর মধ্যে মাত্র ৪২টি মাঠ সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত, ১৬টি অবৈধ দখলে, ১৪১টি কোনো না কোনো প্রতিষ্ঠানের আওতায়, ২৪টি কলোনির অধীনে এবং ১২টি ঈদগাহ মাঠ (সমীক্ষা প্রতিবেদন- “শিশুবান্ধব শহর গড়তে উন্মুক্ত স্থানের গুরুত্ব” শরিফ তওসিফ ও জেরিন তাসনিম, ২০২০)। পর্যাপ্ত খেলার মাঠ বা উন্মুক্ত স্থান না থাকায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত শিশুরা বিশেষ করে মেয়েশিশু, নারী ও প্রবীণ জনগোষ্ঠী।
শুধু রাজধানী নয়, সারা দেশের চিত্রটি কমবেশি একইরকম। সর্বত্র মেয়েশিশুদের জন্য খেলা ও শরীরচর্চার সুযোগ অত্যন্ত সীমিত। একদিকে খেলার মাঠের সংখ্যা অপ্রতুল, অন্যদিকে আছে সামাজিক ও ধর্মীয় বিধিনিষেধ। মধ্যবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের শিশুদের ক্ষেত্রে এই বিধিনিষেধ আরও কঠিন। কি শহর কি গ্রাম সকল ক্ষেত্রে একই অবস্থা। ব্যতিক্রম হলো গুটিকয়েক উচ্চবিত্ত পরিবার, যাদের সামর্থ্য আছে রাজধানীর বিভিন্ন ক্লাব বা মাঠে নির্দিষ্ট অর্থের বিনিময়ে খেলাধুলায় (ইনডোর বা আউটডোর) যুক্ত হওয়ার। তবে সেই সুযোগও অত্যন্ত সীমিত। অন্যদিকে নিম্নবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়েশিশুরা নিজেদের একনিষ্ঠ আগ্রহ ও চেষ্টার কারণে সীমিত আকারে খেলাধুলায় যুক্ত হওয়ার সুযোগ তৈরি করে নেয়। তাদের বাবা-মায়েরা দু-মুঠো অন্ন যোগাতে সকাল থেকে সন্ধ্যা অক্লান্ত পরিশ্রম করে বেড়ায়। সন্তানের প্রতি যত্ন নেওয়া বা তার আগ্রহে উৎসাহ যোগানোর ফুরসত তাদের কম। সামাজিক নিরাপত্তাহীনতা ধনী-দরিদ্র নির্বিশেষে সকল পরিবারেই সন্তানকে উন্মুক্ত স্থানে খেলতে দেওয়ার ক্ষেত্রে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে, বিশেষ করে ঢাকাসহ মহানগর ও নগর এলাকাগুলোতে। মা-বাবারা শুধু মেয়েশিশু নয়, ছেলেশিশুকেও হাতছাড়া করতে সাহস পান না। ছিনতাই, অপহরণ, ধর্ষণ, প্রেমঘটিত বিষয়ে জড়িয়ে পড়ার মতো নানা ধরনের আশঙ্কা থেকে অভিভাবকরা সন্তানদের মাঠে খেলতে পাঠানোর জন্য একা ছাড়তে পারেন না। আবার জীবনধারণগত ব্যস্ততায় বাচ্চাদের সঙ্গে আসারও সময়ও পান না অধিকাংশ অভিভাবক। ফলে শিশুদের খেলার সুযোগ প্রতিনিয়ত সংকুচিত হয়ে আসছে।
ইউনিসেফের অনুমিত হিসাব অনুযায়ী ২০২৫ সাল নাগাদ নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলিতে প্রতি ১০ জন শিশুর মধ্যে ৬ জনই শহরে বাস করবে। জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার সাথে সামঞ্জস্য রেখে বাংলাদেশ সরকারও উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা ২০৩০ নির্ধারণ করেছে এবং তা অর্জন করতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। বিশেষ করে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা-১১-এর ধারা-৭ অর্জন করতে হলে ২০৩০ সালের মধ্যে খোলা স্থান ও খেলার মাঠগুলোয় নারী, শিশু, বয়স্ক ও প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করতে হবে। আমাদের দেশে আইন আছে কিন্তু প্রয়োগ নেই, তাই প্রয়োজন আইন প্রয়োগে সদিচ্ছা ও কঠোর মনোভাব। মেয়েশিশু তথা মেয়েদের খেলার সুযোগ সৃষ্টিতে কিছু পদক্ষেপও নেওয়া যেতে পারে:
রাজধানীসহ সকল শহর, উপশহর ও বিভাগে মহিলা ক্রীড়া কমপ্লেক্স গড়ে তোলা।
গ্রাম, উপজেলা, জেলা ও বিভাগীয় পর্যায়ের সকল স্কুলে এবং খোলা মাঠে পর্যায়ক্রমে মেয়েদের খেলার ব্যবস্থা নিশ্চিত করা
ইমারত তৈরি, খোলা জায়গা ও মাঠ ব্যবহার সংক্রান্ত আইনের যথাযথ প্রয়োগ নিশ্চিত করা
স্থানীয় সরকার পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়, যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়, মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও সংস্থাগুলোর মধ্যে সমন্বয়ের মাধ্যমে এ সংক্রান্ত স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা ও তার আশু বাস্তবায়ন।