আদিবাসী ‘খেলার সাথীরা কোথা আজ’

রবি সরেন পিতৃহত্যার বিচারপ্রার্থী হয়ে দিনাজপুর জেলা আদালতে এলে দেখা হয়, কখনও একবেলা খাওয়া হয় ওকেসহ। আইন তার নিজস্ব গতিতে চলে, রবি ফিরে যায় গ্রামে, বড় কচুয়ায়, বাবা, জেঠা, দাদুর মত নিজেরও খুন হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা নিয়ে।

মুস্তাফিজুর রহমান রূপমমুস্তাফিজুর রহমান রূপম
Published : 9 August 2023, 05:33 PM
Updated : 9 August 2023, 05:33 PM

টুডু কারোর নাম নয়—সাঁওতালদের একটি গোত্র পরিচিতি বা পদবি, ছোটবেলায় এটা জানা ছিল না। আমি যে বন্ধুটিকে টুডু বলে ডাকতাম, সে নিজেও কখনও বলেনি বোধ হয় কথাটা। টুডুর কথা মনে করতে গিয়ে মনে পড়ল, সেই ছোটবেলাতেই পড়া সুফিয়া কামালের একটা কবিতার কথা, ‘খেলার সাথীরা কোথা আজ তারা? ভুলিয়াও গেছি নাম’। ‘পল্লী স্মৃতি’ নামের ওই কবিতাটা পাঠ্যপুস্তকে ছিল আমাদের। কোন ক্লাসে ছিল, তা মনে নেই এখন। তবে টুডুর সঙ্গে আমার বন্ধুত্বটা যে তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ার সময় হয়েছে, সে নিয়ে সংশয় নেই। ওই বছরই দিনাজপুর শহর থেকে আমরা শহরতলীর গ্রামের বাড়িতে এসে থিতু হয়েছিলাম।

টুডুর মতো আরও অনেক আদিবাসী বন্ধু হারিয়ে গেছে আমার। দেশান্তরিত হয়েছে বহুসংখ্যক। দেশে রয়ে গেছে, তবে ধর্মান্তরিত হয়ে অন্যত্র গিয়ে আবাস গড়েছে এমন সংখ্যাও নেহায়েত কম নয়।

১৯৭৬ সালে তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ার সময় দিনাজপুর শহর থেকে আমরা গ্রামের বাড়িতে এসে থিতু হওয়ার পর গ্রাম চিনতে শুরু করি। গ্রাম, প্রকৃতই গ্রাম। কিন্তু শহর থেকে বেশি দূরে নয়। কোতোয়ালী থানা থেকে মাত্র তিন কিলোমিটার পূর্ব দিকে শেখপুরা গ্রাম, ইউনিয়নের নামও শেখপুরা। শেখপুরা বেশ বড় গ্রাম ছিল। এখন গ্রামটির অধিকাংশই দিনাজপুর পৌরসভার অন্তর্ভুক্ত হয়ে গেছে। দিনাজপুর পার্বতীপুর সড়কের উত্তরে মাতাসাগর নামের একটি বড় দীঘি আছে। দিনাজপুরের মহারাজাদের আমলে খনন করা দীঘিগুলোর মধ্যে আয়তনের দিক থেকে মাতাসাগরের স্থান রামসাগরের পরেই। এই মাতাসাগরের দক্ষিণদিকে ১০০ গজ দূরেই আমাদের বাড়ি। গ্রামটিকে আমরা মাতাসাগর নামে পরিচয় করিয়ে দিতে পছন্দ করি ছোটবেলা থেকে।

তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ার সময় মাতাসাগরের বাড়িতে থাকা শুরু হতেই আমি গ্রাম চিনতে শুরু করি। আবিষ্কার করতে শুরু করি প্রকৃতির বিশালত্বকে আর প্রকৃতির সন্তান আদিবাসীদের। আমার কৈশোর দারুণ বর্ণিল ছিল। তাতে পাঠ্যবইয়ের সঙ্গে সম্পর্কের কিছু ঘাটতি থাকলেও প্রকৃতির সঙ্গে এবং প্রকৃতির সন্তান আদিবাসীদের সঙ্গে সম্পর্ক ছিল খুবই নিবিড়। গরু দিয়ে হাল বাওয়া এবং মই দেওয়া শিখেছি তখন। ধান রোপা, ধানকাটা, মাড়াই করা, জমি থেকে আলু তোলা, খেজুরের গাছ থেকে রসের কলস নামানো, কলা গাছের ভেলা বানিয়ে বর্ষার পানিতে ভেসে বেড়ানো এই সবই ছিলো সেই জীবনে। যতটা না প্রয়োজন তার চেয়ে ঢের বেশি প্রকৃতিকে আবিষ্কারের নেশায়। আমাদের বাড়ির দক্ষিণে সাত-আটটি বাড়ি ছিল মাত্র, দক্ষিণ-পশ্চিমে বাঁশঝাড়ের পরে মাটির দেয়ালের মসজিদ আর পূর্বদিকে একটু দূরে দৃষ্টিসীমার মধ্যে যে বসতিটা ছিল, সেটা ছিল সাঁওতাল আদিবাসীদের বাড়ি, সাঁওতালপাড়া।

টুডু নামের সেই বন্ধুটি, যার প্রকৃত নামটি আর কোনোদিনই জানার সুযোগ পাব না হয়তো, তার সূত্রেই আমার আদিবাসীদের সঙ্গে নিবিড় বন্ধুত্ব হয়। টুডুরা কি দেশ ছেড়ে চলে গিয়েছিল? ধারণা করি, তাই হবে। টুডুর অবয়ব, মুখচ্ছবি এখনও আমার মনের চোখে ভাসে। কৃষ্ণ বর্ণের সুঠাম স্বাস্থ্যের মিষ্টি একটা কিশোর। তার সঙ্গে মার্বেল খেলেছি অনেক। কখনও ফুটবল খেলাতেও সে থাকতো আমাদের সঙ্গে। গ্রামের ছেলে-মেয়েদের খেলার তো অভাব ছিলো না সেকালে। দাড়িয়াবান্ধা, গাছুয়া আরও কত খেলা।

আমার কাছে অবশ্য এই সব খেলার চেয়ে বেশি আকর্ষণীয় ছিল টুডুর সঙ্গে, টুড়ুর আরও সাঁওতাল বন্ধুবান্ধব, যারা আমারও বন্ধু ছিল, যাদের নাম আমি ভুলে গিয়েছি, তাদের সঙ্গে ঘুরে বেড়ানো। শীতকালে ধানকাটা হলে জমিতে ইঁদুরের গর্ত খুঁড়ে ধান সংগ্রহ করত ওরা। ইঁদুর মেরে টুডু নিয়ে যেত রান্না করে খাবে বলে। এইসব কাজে আমিও অনেক সময় তার সাথি হয়ে থাকতাম। ওদের বাড়িতেও গিয়েছি। খড়ের ছাউনি দেয়া মাটির ঘরের দেয়ালে আলপনা আঁকা, নিকোনো উঠোন চোখে ভাসে এখনও। উঠোনের অদূরে বাঁধা থাকত পোষা শুকর। সাঁওতাল কিশোরের সঙ্গে গলাগলি ভাব থাকার কারণে গ্রামের অন্যান্য কিশোর তো ক্ষোভ জানাতই, প্রাপ্তবয়স্কদেরও কেউ কেউ কটাক্ষ করত আমাকে। অবশ্য আমার মা-বাবার কাছ থেকে বাধা আসেনি কোনো আমাদের এই বন্ধুত্বে। একবার বোধ হয় বকুনি খেয়েছিলাম বাড়িতে, টুডুসহ আমরা কজন শেয়ালের গর্ত খুঁড়ে খুঁড়ে শেয়াল ধরার চেষ্টা করেছিলাম বলে। বলাবাহুল্য আমাদের শেয়াল ধরার ওই অভিযান সফল হয়নি, শেয়াল অন্য গর্ত দিয়ে বের হয়ে পালিয়ে গিয়েছিল।

টুডুদের কাছে সাঁওতালি ভাষায় দুই একটি বাক্য বলতে শিখেছিলাম, যেমন ‘ওকাতেমা চেলাকানা’ অর্থ তুমি কোথায় যাচ্ছো। টুডুরাও চলে গিয়েছিল সেই সময়ই। হঠাৎ কাউকে কিছু না জানিয়ে ভিটে ছেড়ে, হয়তো দেশ ছেড়ে। পরে তাদের বসত ভিটার জায়গায় বেড়ে উঠেছে জোতদারের ‘বাগানখানা’। ছেলেবেলায় ওই বন্ধুটিকে হারিয়ে আঘাত লেগেছে মনে, কিছু না বলে হঠাৎ চলে যাওয়ার জন্য তাকেই দোষারোপ করেছি। বুঝিনি তাদের উপর কতখানি চাপ ছিলো ভিটে ছাড়ার জন্য। ভিটে ছেড়ে জন্মভূমি ছেড়ে তারা তো উন্নত জীবনের আশায় অভিবাসী হয়নি অন্য ভূমে। সত্যিকার অর্থে তারা নিগৃহীত হয়ে বিতাড়িত হয়েছে নিজ বাসভূম থেকে।

দিনাজপুরের ইতিহাসবিদ মেহেরাব আলীর লেখায় পাওয়া যায় যে অষ্টাদশ শতাব্দী শেষ ভাগে উত্তরের নিকটবর্তী জেলাগুলোর মধ্যে দিনাজপুরে আদিবাসীদের সংখ্যা সর্বাধিক ছিল। তাঁর ভাষায় “হিমালয় পর্বতমালার দক্ষিণ পাদভূমি অঞ্চলের অতি সন্নিকটবর্তী স্থানে অবস্থিত বলে বিভিন্নভাবে ভৌগোলিক সৌভাগ্যের কারণে দিনাজপুর জেলা যেমন উর্বর ও শস্যপ্রসূ তেমনই ইহার পৃষ্ঠদেশ বিভিন্ন জাতের তরুরাজী দ্বারা গভীরভাবে বনাকীর্ণ। আম, জাম, কাঁঠাল, শাল, মহুয়া, তাল, তমাল মেহেগণি, শিমূল, সেগুন, কড়ই, বুনোবট ইত্যাদি নানা জাতের ও আকারের বৃক্ষরাজী দ্বারা সমাকীর্ণ এই স্থান বরাবর স্বাপদ-সংকুল। ইহার দিগন্ত বিস্তৃত খণ্ড খণ্ড অরণ্যরাজী এককালে এমনই ভয়ভীতিপূর্ন ও হিংস্র জন্তু-জানোয়ারের আড্ডা ছিল যার লোমহর্ষক কাহিনী আজও এ অঞ্চলের বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের মুখে মুখে প্রচলিত কিংবদন্তি।”

সত্তরের দশকের শেষ ভাগে সাঁওতাল পুরুষদের দলবদ্ধভাবে শিকারে যাওয়ার সাক্ষী আমি নিজেই। গেছো ইঁদুর, বন বেড়াল, বিভিন্ন পাখি, গুঁইসাপ শিকার করতে দেখেছি তাদের। তখনও কিছ বনজঙ্গল অবশিষ্ট ছিল এই শেখপুরা (মাতাসাগর) নামের আমাদের গ্রামাঞ্চলে। আরও দেখেছি সাঁওতালদের ঐতিহ্যবাহী বিয়ের আচার-অনুষ্ঠান। বিয়ের আচারের একটি অংশ আমার বেশ মজার মনে হতো, বিষয়টি এমন, বর ঘরের চালার উপর অথবা আঙিনার কোনো গাছের ডালে উঠে বসে থাকবে আর কণে তাকে নেমে আসবার অনুরোধ করে সাঁওতালি ভাষায় যা বলবে তার অর্থ হলো সখা তুমি নেমে এসো আমাকে গ্রহন করো, আমি তোমাকে সারাজীবন উপার্জন করে খাওয়াবো। এখন খ্রিস্টধর্ম গ্রহনকারী সাঁওতালদের বিয়ে হয় বাইবেল অনুসারে ‘ফাদার’ বিয়ে পড়ান। সাঁওতালদের মধ্যেও কেউ কেউ ‘ফাদার’ উপাধি লাভ করেছেন। মিশন স্কুলগুলোর বাইরে দিনাজপুরের সবচেয়ে বড় গির্জাটিও মাতাসাগরের কাছেই, রাজারামপুর গ্রামে অবস্থিত।

মেহেরাব আলীর লেখা থেকে আরও জানা যায়, ১৮৮১ থেকে ১৯৪৭ পর্যন্ত দিনাজপুরে আদিবাসীদের সংখ্যা ক্রমবর্ধমান ছিলো। ১৮৮১ সালে তারা ছিল ছয় হাজার ৮১৩ জন। ১৯০১ সালে ৭৪ হাজার ১০১ এবং ১৯৪৭ সালে এক লাখ ৩৮ হাজার ৫০ জন আদিবাসী বসবাস করত দিনাজপুর জেলায়। এরপর থেকে জেলার আদিবাসীদের সংখ্যা ক্রমশ কমতে থাকে। ১৯৭৫ সালে মিশনারী পিটার মেকলিক জেলায় বসবাসকারী আদিবাসীদের যে সংখ্যা নির্ণয় করেন তা দাঁড়ায় ৯৯ হাজার জনে। শুধু সাঁওতালরাই সেই সময় ছিল ৮০ হাজার। ১৯৭৮ সালে বোর্ন বোরবির পরিসংখ্যান মতে তা কমে এসে দাঁড়ায় ৪৩ হাজার ১৯৬ জনে। আর ‘অদমশুমারি ও গৃহগণনা ২০১১ প্রকল্প ’ অনুযায়ী দিনাজপুর জেলার সর্বমোট ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর জনসংখ্যা ৬৬ হাজার ৮৬১ জন। কোন নৃ-গোষ্ঠীর কত জন তা উল্লেখ না করে দায়সারাভাবে বলা হয়েছে সাঁওতাল, ওঁরাও, বর্মন ও অন্যান্য। একথা স্পষ্ট যে এই জেলায় আদিবাসীদের মধ্যে সাঁওতালদের সংখ্যাধিক্য অতীতেও ছিলো, বর্তমানেও রয়েছে। তবে তাদের ধর্ম পালনে বিভক্তি ঘটেছে ব্যাপকভাবে। দিনাজপুরের পার্বতীপুর উপজেলায় বারোকোনা গ্রামে হাজার খানেক সাঁওতাল আদিবাসীর বসবাস। সেখানে সাঁওতালদের বাহা উৎসব অনেক বড় করে পালন করা হয়।

আদিবাসী নেতা রবীন্দ্রনাথ সরেনের গ্রাম এটি, তার ছেলে মানিক সরেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়াশোনা শেষ করে এসে উন্নয়ন সংস্থায় কাজ করছেন। তার মতে সাঁওতাল মোট জনসংখ্যার অর্ধেক মানুষও তাদের আদি ধর্মে স্থির নেই। মিশনারীদের মূল মিশনটাই তো এই মানুষগুলোকে ধর্মান্তরিত করে খ্রিস্টীয় ধর্মানুসারী সংখ্যা বৃদ্ধি করা।

সাঁওতাল আদিবাসীরা অত্যন্ত আত্মগরিমাপূর্ণ। একজন সাঁওতাল অন্য আরেকজন অপিরিচিত সাঁওতালকেও যদি প্রশ্ন করে ‘এন ডম চেলাকানা’ অর্থাৎ তুমি কে? তবে সে উত্তর পাবে ‘ইন ডম হরকানা’ অর্থ দাঁড়ায় তার আত্ম পরিচয় হলো ‘হর’। হর শব্দের অর্থ অন্য ভাষার বুলিতে অনুবাদ করা দূরূহ। হর সাধারণ অর্থে মানুষ, আবার হর বলতে সদগুন সম্পন্ন আত্মগরিমাপূর্ন মহানজাতিকেও বোঝায়। তারা অভুক্ত থাকলেও কারও কাছে হাত পাতেন না।

ছোটবেলায় অবশ্য আমি দিনাজপুরের সব আদিবাসীকেই সাঁওতাল বলে ভাবতাম। আমার শৈশব-কৈশোরের খেলার সাথিদের মধ্যে যে কড়ারাও ছিলো তা আমি জেনেছি এই হাল আমলে এসে। মাতাসাগরের আদিবাসীদের বসতিটা যেখানে ছিল সেটা তাদের মধ্য থেকে জেনেছি।

তুরিদের সঙ্গে আমার চেনা-জানা হয়েছে কিছুকাল আগে। জেলা আদালত চত্বরে এক আদিবাসী তুরি দম্পতির সঙ্গে দেখা হয় আমার, তারা সুভাষ ও বিজলী সিং। আদালতে এলে আমাকে জানায় তারা, দেখা হয়।

সুভাষ অত্যন্ত সরল এক তুরি যুবক। পেশায় নরসুন্দর। বাড়ি বিরল উপজেলার বিষ্ণুপুর গ্রামে । তাদের জমি নিয়ে বিরোধ চলছে। পাশের গ্রামের আদিবাসী নয়, এমন লোকদের সঙ্গে। এক একর ৭৯ শতাংশ জমি সি.এস (ব্রিটিশ) রেকর্ড অনুযায়ী সুভাষের পিতামহের। জাল-জালিয়াতির মাধ্যমে পরবর্তী রেকর্ডে সেই জমি হয়ে গেছে অন্যের নামে । সুভাষের বাবাকে বাধ্য করা হয়েছে তার বসত ঘরের ১১ শতক পৈতৃক জমি তাকেই পুনরায় কিনে নিতে। বাড়ির পাশে তাদেরই সৃজিত লিচু বাগান অন্যের দখলে চলে গিয়েছিল। গত দুই মৌসুম থেকে অবশ্য আবার সুভাষরাই ফল সংগ্রহ করছে। বিষ্ণুপুর গ্রামে মোট ৩১ টি তুরি পরিবারের বসবাস।

সুভাষের সঙ্গে আমার পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল কৃষ্ণ কড়া। বিরলের ঝিনাইকুড়ি গ্রামের কড়াদের সঙ্গে নিবিড় সম্পর্ক হওয়ার পর। বাংলাদেশ সরকারের ‘৫০টি ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠি’র তালিকায় নাম থাকা কড়াদের সংখ্যাই সব থেকে কম।ঝিনাইকুড়িতে ২৪ টি পরিবার আর দিনাজপুর সদরের ঘুঘুডাঙায় চাটি পরিবার বাস করে। সবমিলে ২৮ টি পরিবারের ১০৫ জন মানুষ তারা। বাংলাদেশের  আর কোথাও কড়া আদিবাসীদের কেউ আছে বলে জানা যায়নি। দুই জায়গাতেই তাদের ভূমি কেড়ে নেওয়া হয়েছে অন্যায়ভাবে, মূলত এই কারণেই অধিকাংশ কড়া দেশত্যাগী হতে হতে বিলুপ্তির দ্বারপ্রান্তে এসে দাঁড়িয়েছে।

আমাদের উন্নয়ন সংস্থা ‘ভাবনা’ কড়াদের টিকে থাকার লড়াইয়ে সামিল হয়েছে। কড়া শিশুদের জন্য তৈরি করা হয়েছে ‘কড়া পাঠশালা’। ওদের সঙ্গে একাত্ম হতে বুঝতে পেরেছি, আমরা দূর থেকে আদিবাসীদের উৎসব দেখি, বেদনা অনুভব করি খুব কম।

কড়া পাঠশালার কারণে পরিচয় হয় তিথি ওঁরাও ও বিচলি ওঁরাও নামে দুই তরুণীর সঙ্গে। তারা কড়া পাঠশালার শিক্ষার্থীদের নামমাত্র সম্মানিতে পাঠদান করেন। নিজেরাও বিরল ডিগ্রি কলেজের স্নাতক শেষ বর্ষের শিক্ষার্থী। বাড়ি ঝিনাইকুড়ির কাছেই আছোটিয়া আর তীনপাড়া গ্রামে। গ্রাম দুটি রাস্তার এপার-ওপারে। তীনপাড়ায় ৩০টি ওঁরাও পরিবারের বাস আর আছোটিয়া গ্রামে আটটি ওঁরাও এবং ২৩ টি মুন্ডা পরিবার বসবাস করে।

ছোটবেলায় ভূগোল বইয়ে পড়া ‘ বাংলাদেশ একটি ব-দ্বীপ’ তাহলে এই ভূখণ্ড একসময় জলমগ্ন ছিলো। পানির নিচ থেকে জেগে ওঠা ভূখণ্ডের এই উত্তর অংশ হিমালয় পাদদেশে অবস্থিত দেশের উচ্চতম সমতল অঞ্চল যা সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ১১২ ফুট থেকে ১২০ ফুট উচ্চতাসম্পন্ন। ধরে নেওয়া যায় এই অংশই প্রথম ডাঙ্গায় রূপ পায়।সেই থেকে মনে করা হয় এই উত্তরের আদিবাসীরাই দেশের প্রাচীনতম আদিবাসী।

টুডু হারিয়ে ফেলার চার দশক পর আবার তাদের সঙ্গে সখ্য হয়েছে আমার। মুখ ফুটে তাদের বলতে হয় নি ‘আমি তোমাদেরই লোক’ তারা বুঝে নিয়েছে। ‘ঘুঘুডাঙার কড়াদের জমিতে ঘুঘু চড়নো হচ্ছে ’ এই শিরোনামে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমে একটি লেখা প্রকাশিত হয়েছে আমার। সেখানে সমতলের আদিবাসীদের জন্য ১৯৫০ সালে ভূমি আইনের কথা তুলে ধরা হয়েছে স্পষ্ট করে। এমন সুস্পষ্ট এবং পোক্ত আইন থাকা সত্ত্বেও  এই উত্তরের আদিবাসীদের জমিগুলোর শেষ রক্ষা হয় না । তাদের নিগৃহীত হতে হয়, বিতাড়িত হতে হয়, এমনকি তাদের কেউ কেউ খুনও হয়ে যান ভূমি রক্ষা করতে গিয়ে।

আদিবাসীদের ভূমির অধিকার হরণ করা তাদের সংষ্কার করা জমি, তাদের ব্রিটিশ রেকর্ডীয় জমির দখল করে নেওয়ার ঘটনা অজস্র পাওয়া যায় এই দিনাজপুরে। জাল-জালিয়াতির মাধ্যমে দলিল, রেকর্ড থেকে তাদের নাম মুছে ফেলা যেন এক মামুলি ব্যাপার।দিনাজপুর জেলার নবাবগঞ্জ উপজেলার কুচদহ ইউনিয়নের বড়কচুয়া গ্রামের যুবক রবি সরেন, যার পূর্ব পুরুষদের দুই প্রজন্মের তিন জন খুন হয়েছে জমি সংক্রান্ত বিরোধের কারণে। তাদের ১০৭ বিঘা জমি নিয়ে বিরোধ ভূমিদস্যুদের সঙ্গে।১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের শেষভাগে খুন হন রবির পিতামহ ফাগু সরেন। ২০১৪ সালে খুন হন রবির জেঠা গোসাই সরেন। আজ অগাস্টের ২ তারিখে যখন আমি এই লেখাটি লিখছি, ২০১৪ সালের এই দিনে খুন হন রবির বাবা ডুডু সরেন। তার নাম অনুসারে বড়কচুয়া গ্রামের সাংখ্যতলা পাড়ার মোড়টি লোকমুখে ডুডুর মোড় নামে পরিচিতি পেয়েছে। রবি সরেন পিতৃহত্যার বিচারপ্রার্থী হয়ে দিনাজপুর জেলা আদালতে এলে দেখা হয়, কখনও একবেলা খাওয়া হয় ওকেসহ। আইন তার নিজস্ব গতিতে চলে, রবি ফিরে যায় গ্রামে, বড় কচুয়ায়, বাবা, জেঠা,দাদুর মত নিজেরও খুন হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা নিয়ে।