দীর্ঘমেয়াদে চা শিল্পে টেকসই উন্নয়ন ধরে রাখতে হলে একটি শক্তিশালী কমিশন বা এনকোয়ারি কমিটি গঠনের বিকল্প নেই। যে কমিশন বা কমিটি নিয়মিত ভিত্তিতে চায়ের উৎপাদন খরচ ও চা শ্রমিকদের মজুরির বিষয়টি তদারক করবে।
Published : 03 Aug 2023, 08:00 PM
প্রাথমিকভাবে যে কোনো শিল্পকে মূল্যায়ন করতে হয় তার বৈশ্বিক কাঠামোর পরিপ্রেক্ষিতে। এই মূল্যায়নের পূর্বে শিল্প সংশ্লিষ্ট পণ্যটির উৎপাদন খরচ, শিল্পজাত দ্রব্যটির মূল্য নির্ধারণ পদ্ধতি ও কৌশল, শিল্প সংশ্লিষ্ট পেশাজীবীদের অবদান, শিল্পজাত দ্রব্যটির লভ্যাংশের সূচক এবং শিল্পখাতটিতে মজুরি বৃদ্ধির হার বিবেচনায় নেয়া উচিত। গ্লোবাল ওয়েজ রিপোর্ট ২০২০-২১ অনুসারে ২০১৯ সালে বাংলাদেশে মাসিক ন্যূনতম মজুরি ছিল ৪৮ ডলার, যা দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে সর্বনিম্ন (ভুটান ও মালদ্বীপ এই সমীক্ষার অন্তর্ভুক্ত ছিল না)। ক্রয় ক্ষমতা সমতা বা পারচেজিং পাওয়ার প্যারিটি ব্যবহার করে আইএলও 'এশীয় ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে মাসিক ন্যূনতম মজুরি স্তর' নির্ধারণ করেছে। যেখানে বিশ্বব্যাপী ১৩৬টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল সর্বনিম্ন স্থান থেকে ওপরের দিকে পঞ্চম। পাকিস্তানের ন্যূনতম মজুরি ছিল ৪৯১ ডলার, যা দক্ষিণ এশীয় দেশগুলোর মধ্যে শীর্ষে। এই অঞ্চলের দ্বিতীয় সর্বনিম্ন ন্যূনতম মজুরি স্তরে ছিল প্রতিবেশী দেশ ভারত, ২১৫ ডলার। বাংলাদেশে শিল্পভেদে ন্যূনতম মজুরির পার্থক্য রয়েছে। পোশাক খাতের মজুরির হার অন্যান্য খাতের তুলনায় বেশি।
মজুরি কাঠামোতে দক্ষিণ এশীয় অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশ যথেষ্ট পিছিয়ে রয়েছে। ২০২০ সালে ওয়েজইন্ডিকেটর ফাউন্ডেশনের 'অ্যা স্টাডি অফ টি এস্টেট, রেডিমেড গার্মেন্টস, লেদার অ্যান্ড কনস্ট্রাকশন' শীর্ষক গবেষণার ফলাফল অনুসারে আমাদের নির্মাণ শিল্পে সর্বনিম্ন ন্যূনতম মজুরি বা তার বেশি বেতন দেওয়া হয়, অন্যদিকে চা শিল্পের মজুরি সর্বনিম্ন স্তরেরও অনেক নিচে।
শ্রমিক বাঁচলে শিল্প বাঁচবে, শিল্প থাকলে শ্রমিক বাঁচবে
আমাদের প্রধানমন্ত্রীর উদ্যোগে সম্প্রতি চা শ্রমিকদের দৈনিক মজুরি ১৭০ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। কিন্তু দ্রব্যমূল্যসহ অন্যান্য আনুষঙ্গিক বিষয়ের উর্ধ্বগতির প্রেক্ষাপটে সে মজুরি কতটা যুক্তিসঙ্গত তা বিবেচনার দাবি রাখে। শ্রমিকরা এতে সন্তুষ্ট হতে পারেনি। আবারও আন্দোলনে নামার ঘোষণা দিচ্ছেন তারা।
দীর্ঘমেয়াদে চা শিল্পে টেকসই উন্নয়ন ধরে রাখতে হলে একটি শক্তিশালী কমিশন বা এনকোয়ারি কমিটি গঠনের বিকল্প নেই। যে কমিশন বা কমিটি নিয়মিত ভিত্তিতে চায়ের উৎপাদন খরচ ও চা শ্রমিকদের মজুরির বিষয়টি তদারক করবে। পাকিস্তান আমলে যার চর্চা ছিল পুরোপুরি। চা খাতের উপযুক্ত মজুরি কাঠামো নির্ধারণ করতে হলে প্রথমেই আমাদের উৎপাদন খরচ নিরীক্ষা করা প্রয়োজন।
চা শিল্প মূলত বিদেশী যন্ত্রপাতি, রাসায়নিক এবং সারের ওপর অনেক বেশি নির্ভরশীল। ফলে আমাদের উৎপাদন খরচ অধিকাংশ ক্ষেত্রেই প্রতিবেশী দেশগুলোর তুলনায় বেশি।
এছাড়া ডিজেলের মূল্য বৃদ্ধির কারণে উৎপাদন খরচ পনের থেকে বিশ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। কারণ চা বাগানে জেনারেটর, সেচ এবং যন্ত্রপাতির জন্য জ্বালানি ব্যবহার করা হয়। পাশাপাশি বেশ কয়েক দফা বিদ্যুৎ ও গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধি চা উৎপাদনকারীদের জন্য অনেক জটিলতা তৈরি করেছে। বাংলাদেশে চায়ের উৎপাদনশীলতার বিপরীতে এর উৎপাদন খরচ ২০১২ সালের পর বর্তমান সময়ে এসে নিঃসন্দেহে আরো প্রকট হয়েছে।
নিলামে চায়ের বিক্রয় মূল্য নির্ধারণের কৌশল কতটা সময়োপযোগী?
উপরোক্ত হিসাব বিবেচনায় নিলে এদেশে চা ব্যবসা বহুকাল পূর্বেই বন্ধ হয়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। আশ্চর্যজনক হলেও সত্য যে, গত প্রায় দশ বছর ধরে নিলামে চায়ের বিক্রয় মূল্য প্রায় স্থবির। ২০১২ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত, প্রতি কেজি চায়ের জাতীয় গড় নিলাম মূল্য বেড়েছে মাত্র ৩২ পয়সা (২০১২ সালে ১৯৭.০৩ টাকা এবং ২০২১ সালে ১৯৭.৩৫ টাকা)। অথচ অধিকাংশ চা বাগানের মালিক বিগত বেশ কিছু বছর যাবৎ অভিযোগ করছেন যে, নিলামে চায়ের উপযুক্ত মূল্য পাচ্ছেন না তারা। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তা উৎপাদন খরচের তুলনায় কম বা প্রায় সমান। চা খাতের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, যেসব চা বাগান মালিকের বিনিয়োগ শুধু বাগানেই সীমাবদ্ধ নয় বরং চা নিলাম এবং প্যাকেজিংয়ের ক্ষেত্রেও যাদের অংশীদারত্ব রয়েছে, চা ব্যবসায় বর্তমানে তারাই নেতৃত্ব দিচ্ছেন। সরেজমিনে দেখা যায়, চায়ের নিলাম মূল্য এবং খোলা বাজারের খুচরা মূল্যের মধ্যে যোজন যোজন পার্থক্য! তাহলে এই লভ্যাংশটা যাচ্ছে কোথায়? সরকারের উচ্চ নীতি নির্ধারণী মহল গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর মাধ্যমে বিষয়টি খতিয়ে দেখতে পারেন। উল্লেখ্য যে, চা বাগানগুলোকে তাদের উৎপাদিত চা বিভিন্ন ব্রোকার হাউসের মাধ্যমে সরকার স্বীকৃত নিলাম কেন্দ্রে বিক্রি করতে হয়।
চা খাতে বিদ্যমান নানামুখী সমস্যা ও সম্ভাবনা
প্রতি হেক্টর চায়ের উৎপাদনশীলতা প্রতিবেশী দেশগুলোর তুলনায় বাংলাদেশে তুলনামূলকভাবে কম। উদাহরণস্বরূপ, ২০২১ সালে ভারতে যেখানে হেক্টরপ্রতি কাঁচা চা পাতার উৎপাদন ছিল ৩০০০-৩২০০ কেজি, বাংলাদেশে তখন সেটা ছিল মাত্র ১৬০০-১৭০০ কেজি। দীর্ঘদিন যাবৎ রাসায়নিক সার ও কীটনাশকের অপরিকল্পিত ব্যবহারে চা বাগানের মাটির গুণগত মান যথেষ্ট হ্রাস পেয়েছে। এছাড়া চা গাছগুলোর অধিকাংশই বয়স্ক। জৈব সার ও বালাইনাশক ব্যবহারে অধিকাংশ চা বাগান মালিকের চরম অনীহার কারণে চা শ্রমিকদের অধিকাংশই বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত। পুরনো চায়ের ঝোপের স্থলে নতুন গাছ রোপনের জন্য প্রতি বছর প্রচুর পুঁজি বিনিয়োগের প্রয়োজন। পাকিস্তান আমলে অর্থোডক্সসহ চায়ের বেশ কিছু ধরন ছিল। বর্তমানে চা বাগানগুলো সিটিসি চায়ের মাঝেই সীমাবদ্ধ। মূলধারার বাজারে উত্তরবঙ্গ থেকে নিম্নমানের চায়ের অন্তর্ভুক্তি, চায়ের দাম কম পাওয়ার আরেকটি অন্যতম কারণ। সমতলে ধানের মতো করে চায়ের চাষ করা হয়। ফলে অনেক কম পরিশ্রমে শ্রমিকরা অনেক বেশি পাতা সংগ্রহ করতে সক্ষম হন। পাতার গুণগত মান ততোটা বজায় রাখার প্রয়োজন হয় না। এখানে অন্যান্য কাজের ফাঁকে শ্রমিকরা চা শিল্পে শ্রম দেন। ফলে সমতলের চা শিল্পের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে পাহাড় তথা সিলেট অঞ্চলের চা শিল্প কুলিয়ে উঠতে পারে না। চায়ের মান বজায় রাখা যায় না। পাশাপাশি বাজার দরও কমে।
চা শিল্পের সংকটকে আরো ঘনীভূত করছে এমন আরও কিছু অনুচ্চারিত বিষয় রয়েছে। প্রতিটি চা বাগানেই রয়েছে মদের পাট্টা। চা শ্রমিকদের দেশীয় মদ সেবনের অভ্যাস তাদের জীবন সংগ্রামকে আরো কঠিন করে তোলে এবং তাদের জীবিকা নির্বাহের ক্ষমতাকে মারাত্মকভাবে প্রভাবিত করে। চা শ্রমিকদের কল্যাণে তাদের বেতনের একটা অংশ যেখানে জমা হয়, সে টাকা ব্যবহারে বরাবরই অস্বচ্ছতার অভিযোগ রয়েছে। চা শিল্পের আরেকটি বড় সমস্যা হলো যোগ্য টি প্ল্যান্টারের অভাব। এক সময় সবচেয়ে অভিজ্ঞ ও যোগ্যরা চা বাগানের ব্যবস্থাপক হতে আগ্রহী হতেন। কিন্তু বেতনাদিসহ বিভিন্ন ধরনের সুযোগ-সুবিধা হ্রাস পাওয়ায় এই খাতে পেশা গড়তে অনাগ্রহীর সংখ্যা ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। ফলে ব্রতচারী টি প্ল্যান্টারের অভাবে চা বাগানগুলো থেকে তুলনামূলক উৎপাদন ক্রমশ হ্রাস পাচ্ছে। দেশে চা আমদানিতে শুল্কের পরিমাণ ৯২ শতাংশ। প্রতি বছর অবৈধভাবে ভারতীয় চা বাংলাদেশে আসায় এই শুল্ক থেকে বঞ্চিত হচ্ছে সরকার, হারাচ্ছে ব্যাপক রাজস্ব।
ভারত, শ্রীলঙ্কা এবং অন্যান্য দেশে চা-কেন্দ্রিক পর্যটনের উদ্ভব হলেও বাংলাদেশে চা বাগানের ইজারার শর্তাবলির কারণে, চা উৎপাদনকারীরা পর্যটনের উদ্দেশ্যে চা বাগান ব্যবহার করতে পারেন না। চা নীতিমালার মাধ্যমে সরকার পর্যটনের পথ তৈরি করতে সক্ষম হলে এ শিল্পে প্রচুর কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে। ইজারাকৃত সম্পত্তিতে শুধু চা চাষ করা যাবে এই শর্তে সরকার থেকে জমি লিজ নিয়ে চা বাগান গড়ে তোলা হয়। এর ফলে প্রতিটি চা বাগানে প্রচুর পরিমাণে পতিত জমি রয়ে যায়। যেখানে চা চাষ কার্যকর না হলেও অন্যান্য ফল, মসলা, ঔষধি গাছের চাষ করা সম্ভব। লিজ নেওয়া জমির বিদ্যমান বন্দোবস্ত সংস্কার করা সম্ভব হলে চা বাগান সংশ্লিষ্টরা কৃষিভিত্তিক অন্যান্য লাভজনক ব্যবসা প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হবেন। এতে করে চা শ্রমিকদের আয় বৃদ্ধির পথ উন্মোচিত হবে।
ওই বিষয়গুলো বিবেচনায় নিয়ে সরকারের নীতি নির্ধারণী মহল একটি স্বল্প, মধ্যম এবং দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা ও কৌশল গ্রহণ করতে পারে। পাশাপাশি একটি কমিশন বা কমিটি কার্যকর করা প্রয়োজন। এর পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন বেশ কঠিন হলেও চা শিল্পের জন্য এটি অপরিহার্য। সরকারকে অবশ্যই চা খাত সংশ্লিষ্ট সমস্ত উপকারভোগীদেরকে সম্পৃক্ত করে একটি দীর্ঘমেয়াদী সমাধান খুঁজে বের করতে হবে। তা না হলে চা শিল্প টিকে থাকাটা দুস্কর হবে।