প্রয়োজন বনাম ভালোবাসা: ফিকশনের পরাজয়

নন-ফিকশনের উত্থানের পেছনের প্রধান কারণটা হলো, পৃথিবী এখন অনেক বেশি কেজো জায়গা। রোমান্টিসিজমের স্থান একেবারেই নেই। প্রয়োজনটাই মুখ্য।

আলভী আহমেদআলভী আহমেদ
Published : 20 March 2023, 08:42 AM
Updated : 20 March 2023, 08:42 AM

গল্পরা হেরে যাচ্ছে, মার খাচ্ছে পদে পদে। নতুন এই পৃথিবী বানানো গল্পে আর আগ্রহী নয়। সে চায় ফ্যাক্ট, সত্য ঘটনা।

নন-ফিকশনের উত্থান হয়েছে ব্যাপক আকারে, জোয়ারের মতো। বড় বড় ঢেউ উঠছে, ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে জনপ্রিয় ফিকশন লেখকদের, নির্বাসন দিচ্ছে ছোট্ট নির্জন এক দ্বীপে। ডিস্টোপিয়ান এক উপন্যাস যেন, যেখানে চরিত্রগুলো হলেন পৃথিবীর তাবৎ ফিকশন রাইটার। আর সেই উপন্যাসটা লিখতে বসেছেন এক দক্ষ নন-ফিকশন লেখক।

বইয়ের জগৎটা বদলে গেছে। নন-ফিকশন বই যে গতিতে উঠে আসছে, তাকে অস্বীকার করার উপায় নেই। অ্যাসোসিয়েশন অব আমেরিকান পাবলিশার্সের তথ্যমতে, নন-ফিকশন বইয়ের বিক্রির গ্রাফ ২০১৩ থেকে উর্ধ্বমুখী। অন্যদিকে কল্পকাহিনির বিক্রি এক জায়গায় থেমে আছে। এ তো গেল আমেরিকার চিত্র।

আমাদের বাংলাদেশের প্রকাশকদের কাছে জিজ্ঞেস করুন, তারা কী ধরনের বই ছাপতে আগ্রহী? আগ্রহের একেবারে তলানিতে থাকবে কবিতার বই, এরপরের স্থানটাই গল্প-উপন্যাসের। তবে নন-ফিকশনে তাদের আগ্রহের কমতি নেই। রাজনীতির বই থেকে শুরু করে আত্ম-উন্নয়নমূলক বই কিংবা স্পোকেন ইংলিশ টোটকা ছাপতে পারলে মুনাফা নিশ্চিত। সেল বাড়ানোর জন্য এগুলোর প্রচারণাও চলে সমানে।

সৃষ্টিশীল বইয়ের ক্ষেত্রে প্রকাশনা সংস্থার তরফ থেকে এর অর্ধেক প্রচারণাও চালানো হয় কি না সন্দেহ আছে। যেটুকু প্রচারণা হয়, লেখকরা নিজ দায়িত্বে চালান। সবারই মাশাল্লাহ একটা করে ফেসবুক অ্যাকাউন্ট আছে। কবি-সাহিত্যিকরা সেখানে নিজের ঢোল পেটাতে পেটাতে ফাটিয়ে ফেলেন। এতে করে পাঠকের আগ্রহ তৈরি হওয়ার বদলে একেবারে উবে যায়।

পাঠক রুচির এই ব্যাপক পরিবর্তনের কারণটা কী? আসলে জীবন এখন অনেক কঠিন। টিকে থাকতে হলে আধুনিক মানুষের দরকার দিক-নির্দেশনা, উৎসাহ এবং প্রয়োজনীয় জ্ঞান যার মাধ্যমে সে জীবনটাকে একটু গুছিয়ে নিতে পারবে। আর এই জিনিসগুলো একসাথে করে একটা বুফের মতো করে পরিবেশন করছে নন-ফিকশন ইন্ডাস্ট্রি। বলছে, যার যেটা দরকার বেছে নাও।

অন্যদিকে ফিকশন ইন্ডাস্ট্রি হলো চুলায় ভুলে ফেলে রাখা চায়ের পাত্র। অল্প আঁচে পানি গরম হয়ে গেছে, কিন্তু ভুলে গেছেন, আপনি চা খেতে চেয়েছিলেন।

সৃষ্টিশীল সাহিত্যকে চা না বলে ডেজার্টও বলা যেতে পারে। অন্যদিকে নন-ফিকশন হলো পুষ্টিকর খাবার। সারা বিশ্ব এখন হেলদি ফুডের দিকে ঝুঁকছে।

ডেজার্ট খেতে সুস্বাদু। মাঝেমধ্যে টেস্টও করা যায়। তবে আপনি প্রতিটা খাবারেই মিষ্টি চাইবেন না, স্বাস্থ্যসম্মত নয়। ফিকশন কি তবে শুধুই ডেজার্ট? মানসিক পুষ্টির জন্য দরকার নেই এর? এক কালে তো ছিল। কী এমন হলো যে মানসিক পুষ্টির দরকারটা ফুরোল?

উত্থান কিংবা পতন এমনি এমনি হয় না। কারণ থাকে পেছনে। নন-ফিকশনের উত্থানের পেছনের প্রধান কারণটা হলো, পৃথিবী এখন অনেক বেশি কেজো জায়গা। রোমান্টিসিজমের স্থান একেবারেই নেই। প্রয়োজনটাই মুখ্য। যে যার মতো করে আখের গোছাতে ব্যস্ত। এই দুনিয়ায় টিকে থাকতে স্কিলের বিকল্প নেই। স্কিল ডেভলপমেন্টের বইগুলো সেই কৌশল বাতলে দেয়।

এছাড়াও আছে আত্ম-উন্নয়নমূলক এবং মোটিভেশনাল বই। এগুলোর চাহিদা সব যুগেই ছিল। কৈশোরে দেখেছি, দোকানে আর ফুটপাতে ডেল কার্নেগি আর লুৎফর রহমানের বই সাজানো থাকত। সে তালিকায় এখন যুক্ত হয়েছেন স্টিভেন কোভি, জর্ডন বি পিটারসনসহ আরও অনেকে। জীবন বদলে দেওয়ার সাতটা উপায় জানা এই যুগে ভীষণ জরুরি। কারণ আমাদের জীবন যেভাবে চলছে, তা আসলেই বদলানো দরকার।

ইংরেজি শেখার বইয়ের বিপুল পরিমাণে বিক্রির কথা না বললেই নয়। ইতিহাস, বিজ্ঞান, ব্যবসা এবং প্রযুক্তিসহ বিভিন্ন বিষয়ের পাঠক সবসময়েই ছিল। দুর্দান্ত সব বইও লেখা হয় এসব বিষয়ে। ব্যক্তিগত বিকাশ বা নিজ নিজ পেশায় ওপরে উঠতে এগুলো দারুণ কাজে দেয়।

বাস্তব জীবনের ইস্যুগুলোয় ফোকাস করে এমন অনেক বইও আছে। রাজনীতি, আইন-আদালত, সংবিধান, সামাজিক ন্যায়বিচার কিংবা পরিবেশবাদ সম্পর্কে জানতে আগ্রহী বিপুল সংখ্যক মানুষ। মেমোয়ার পড়তেও মানুষ ভালোবাসে, যদিও তারা জানে অধিকাংশ জীবনীগ্রন্থেই ছাঁকনি দিয়ে ছেঁকে ভালোটুকু লেখা হয়। অন্ধকার দিকগুলো চেপে যাওয়ার প্রবণতা থাকে।

বর্তমানে মহিউদ্দিন আহমদের রাজনীতির বই চাহিদার শীর্ষে। প্রকাশ হতে যা দেরি, মুদ্রণ শেষ হতে দেরি হয় না। এরকম লেখক আরও আছেন। ওনারা প্রকাশকের লক্ষ্মী। এই ঘরের লক্ষ্মীকে পায়ে ঠেলে প্রকাশকরা সৃষ্টিশীল সাহিত্যের প্রমোশন কেন করতে যাবেন? পাগল তো নন কেউ।

তারপরও মানুষ ফিকশন পড়ত। তাহলে হঠাৎ কেন মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে? অনেকগুলো কারণ আছে।

প্রথম কারণ হিসেবে বলা যায়, মানুষের কোনো একটা নির্দিষ্ট বিষয়ে মনোযোগ দেওয়ার প্রবণতা কমে গেছে। তাদের মন এখন বিক্ষিপ্ত। আজকের দ্রুতগতির বিশ্বে একটা উপন্যাসের জটিলতা, ক্যারেকটার বিল্ডআপ বা গল্পের সূক্ষ্মতা তাকে আর স্পর্শ করে না। কবিতার হেঁয়ালি বোঝার সময় কোথায়? মানুষের দরকার তথ্য। নন-ফিকশন বই বা সোশ্যাল মিডিয়ার মতো আরও সংক্ষিপ্ত, আরও হজমযোগ্য কোনো জায়গা থেকে সেই তথ্য পাওয়া যায়।

সৃষ্টিশীল বইয়ের বাজারটা স্যাচুরেটেড। অ্যামাজন বহু আগে থেকেই কিন্ডেল ডিরেক্ট পাবলিশিংয়ের মাধ্যমে লেখককে নিজের বই ছাপতে উৎসাহ দিচ্ছে। আমাদের দেশেও কবিতা-গল্প-উপন্যাসের একটা বড় অংশ কবি-সাহিত্যিকদের নিজেদের টাকায় ছাপা হয়।

মোবাইল ফোনে ক্যামেরা আসার পর সবাই যেমন ফটোগ্রাফার, সোশ্যাল মিডিয়ার বদৌলতে সবাই মোটামুটি লেখক। ফলে বাজারটা স্যাটুরেটেড। কবি-সাহিত্যিকরা নিজেদের ভিড়ে নিজেরাই হারিয়ে যাচ্ছেন। এ যুগে নতুন করে আলোচনায় আসা কঠিন। তবে কবি-সাহিত্যিকদের মধ্যে চেষ্টাটা আছে, মরে যায়নি। আর তাই আমি ‘সেরা কবি’ বা ‘সেরা লেখক’ বলে ফেসবুকে কিছু পোস্টও চোখে পড়ে। কিছু বিনোদন পাওয়া যায় সেসব পোস্টে, এর বেশি কিছু নয়।

সেদিন এক জনপ্রিয় কবি ফেসবুকে মজা করে লিখেছিলেন, ‘ফেসবুক অ্যাকাউন্ট আছে, অথচ বইমেলায় বই প্রকাশিত হয়নি এমন লোকের জন্য আমার দুঃখ হয়।’

ফানটুকু স্কিপ করলে কথাটা আইরনিক। এটাই বাস্তব অবস্থা।

বিনোদনের অনেকগুলো বিকল্প মাধ্যম এসেছে, যা সৃষ্টিশীল সাহিত্যের বাজারকে সংকুচিত করেছে। নিজেকে দিয়েই উদাহরণ দিই। এ বছর সাহিত্যে নোবেল পেয়েছেন আনি এরনো। ভাবলাম, তাঁর একটা বই পড়ে দেখি। শেষপর্যন্ত যেটা করলাম তা হলো, তাঁর উপন্যাস থেকে বানানো একটা ছবি দেখে ফেললাম। মুভির নাম ‘হ্যাপেনিং’।

ইউটিউব, নেটফ্লিক্সের মতো বিভিন্ন ভিডিও স্ট্রিমিং প্ল্যাটফর্মগুলো বিনোদনের সহজ উপায় বাতলে দিয়েছে। তরুণ প্রজন্ম ঝুঁকছে গেমিংয়ে। সৃষ্টিশীল সাহিত্য থেকে মানুষ যে বিনোদন পেত, সেই জায়গায় ভাগ বসাতে প্রযুক্তি কঠিন সব প্রতিদ্বন্দ্বী মাঠে নিয়ে এসেছে।

ডিভাইস নির্ভরতার কারণে কিছু পাঠক প্রথাগত ছাপানো বই থেকে বেরিয়ে এসে ই-বুক পড়ছে। অডিওবুকও এই বাজারে আস্তে-ধীরে শক্ত অবস্থান তৈরি ফেলছে। তবে এই প্রবণতা ক্ষতিকর নয়। ছাপানো বই না পড়লেও এতে করে মানুষ বইবিমুখ হয়ে যাচ্ছে না।

বিল গেটস কয়েক বছর আগে এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘বহু বছর হয়ে গেছে আমি কোনো ফিকশন পড়িনি। তবে আমি প্রচুর নন-ফিকশন পড়ি, বেশিরভাগই জীবনী এবং ইতিহাস।’

তাঁর কথা থেকেই সামগ্রিক অবস্থার একটা ধারণা পাওয়া যায়। বিল গেটস কাজের লোক, অকাজে নষ্ট করার মতো সময় তাঁর নেই। ফিকশন পড়েন না। জীবনের একটা সেকেন্ডও বাজে খরচ করতে রাজি নন।

ফিকশন যদি এতটাই অপ্রয়োজনীয় হয়, তাহলে এর দরকারটা কী? আইন করে বলে দিলেই হয়, এখন থেকে কেউ আর ফিকশন লিখবেন না। লিখলে দুই বছরের সশ্রম কারাদণ্ড।

কথাসাহিত্যিক আনিসুল হক তাঁর ‘লেখক-সঙ্গ স্মৃতি আনন্দ’ বইয়ে উত্তরটা দিয়েছেন : ‘যদি এমন হতো, বুশকে দিয়ে তাঁর ছাত্রাবস্থায় কিছু ভালো কবিতা পড়িয়ে নেওয়া যেত, ভালো সংগীত, উৎকৃষ্ট চিত্রকলা, উৎকৃষ্ট চলচ্চিত্রের একজন রসগ্রাহী ভোক্তায় পরিণত করা হতো তাঁকে, তাহলে কি লোকটা একটা প্রাচীন সভ্যতার ওপর এভাবে নির্বিচারে বোমাবর্ষণ করতে পারতেন?’

মানুষের ভেতর যে অপ্রয়োজনীয় চাহিদাটা লুকিয়ে আছে, চাইলেই যেটাকে ঝেড়ে ফেলে দেওয়া যায়—সেই অদরকারি জিনিসই কিন্তু প্রধানতম চাহিদা হয়ে উঠতে পারে, যখন আপনি ‘মানবিকতা’ শব্দটা খুঁজতে শুরু করবেন। সৃষ্টিশীল সাহিত্য আপনার মন ও মননের নার্সিং করে, আত্মার পুষ্টি জোগায়। আপনাকে আরও বেশি ‘মানুষ’ হয়ে ওঠার কথা বলে।

বহু আগেই ইংরেজ কথাসাহিত্যিক নেইল গেইম্যান বলেছিলেন, ‘ফিকশন হলো এমন এক মিথ্যা, যা সত্যকে প্রকাশ করে।’

ওনার কথা ধরেই বলি, আপনারা নন-ফিকশন পড়েন ফ্যাক্ট খুঁজতে। সত্যটা জানা, জ্ঞান অর্জন কিংবা নিজেকে গড়ে তোলার জন্য নন-ফিকশনই একমাত্র অবলম্বন নয়। যা কিছু চোখে পড়ে তা হলো সত্য, কিন্তু আরও গভীরতর সত্য আছে। কল্পকাহিনীই আপনাকে সেই গভীর সত্যের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেবে।

কোনো ঘটনা ঘটে যাওয়ার পর নন-ফিকশন আপনাকে বলে দেবে, কী হয়েছিল।

আর ফিকশন বলবে, কী কী হতে পারত, কী হওয়া উচিত ছিল . . .। বাস্তব জীবনের জটিলতার এক নতুন দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে আপনাকে পরিচয় করিয়ে দেবে।

অনেক নিরাশার মধ্যেও আশার কথা হচ্ছে, সৃষ্টিশীল সাহিত্যে যাঁরা একবার মজা পেয়ে গেছেন, তাঁরা কিন্তু তাঁদের পড়ার অভ্যাস বদলে ফেলছেন না। টেকসই জীবনের টোকেন সংগ্রহের জন্য একদিন ঘুম থেকে উঠে তাঁরা মোটিভেশনাল বই পড়তে শুরু করবেন, এমন নয়। বাজারের কোনো উপন্যাসই যদি তাঁদের পছন্দ না হয়, তাঁরা বই কিনবেন না। কিন্তু সেই টাকা দিয়ে তাঁরা ‘সেভেন হ্যাবিটস অব হাইলি ইফেক্টিভ পিপল’ কিনবেন—এ সম্ভাবনা শূন্যের কোটায়।

গল্প-উপন্যাস কখনোই কোনো প্রয়োজনীয় বস্তু ছিল না। মানুষ ভালোবাসা থেকে এগুলো কেনে এবং পড়ে।

কিন্তু দুনিয়াটাই এখন এমন যে প্রয়োজনের কাছে ভালোবাসা হেরে যায়।