জলবায়ু সম্মেলন কিংবা রাক্ষসদের উদোম নৃত্য

জলবায়ু সম্মেলন মানে বৈশ্বিস রাক্ষসদের অতিরিক্ত কিছু কার্বন পোড়ানোর বিশ্বনৈতিক বন্দোবস্ত।

বাধন অধিকারীবাধন অধিকারী
Published : 20 Nov 2022, 11:58 AM
Updated : 20 Nov 2022, 11:58 AM

সূচনাটিকা:

কল্পনার রাক্ষসকে কে না চেনে? ছেলেবেলা/মেয়েবেলায় আমাদের নানী-দাদী-মায়েদের বলা রূপকথার জগতে রাক্ষস ছিল সবথেকে ভীতিকর বাস্তবতা। এরা বহুরূপী, আস্ত আস্ত মানুষ খেয়ে ফেলে, সব খেয়ে শেষ করে ফেলতে পারে, ধ্বংস করে ফেলতে পারে গোটা একটা অঞ্চল! ভারতের প্রাচীন পুরাণ থেকে ওপার বাংলার প্রয়াত পণ্ডিত কলিম খান রাক্ষস শব্দের ক্রিয়াভিত্তিক বিস্তৃত সামাজিক অর্থ উন্মোচন করতে গিয়ে আমাদের জানান দেন, ক্ষ বর্ণের অর্থ ‘ক্ষ-করণ’ বা খুবলে নেওয়া। রক্ষ শব্দে র মানে রক্ষণ, আর ক্ষ মানে ক্ষ-করণ তথা খুবলে নেওয়া। তাই রক্ষ মানে হল যে ক্ষ-করণ থেকে রক্ষা করে বা বাঁচায়, অর্থাৎ রক্ষক। এবার রক্ষস শব্দটিকে বিবেচনায় নিন। কলিম খান বলছেন, স বর্ণে শেষাবস্থা বুঝায়। রক্ষস মানে রক্ষ-এর শেষাবস্থা এবং শেষাবস্থায় রক্ষকই ভক্ষক হয় (অতিরক্ষণ ভক্ষণে পরিণত হয়)। রক্ষস মানে তাই রাক্ষস, যে আমাদের আমাদের ভক্ষণ করে। রামায়ণে রাবণকে রাক্ষস বলা হয়েছে। কলিম খান মোতাবেক, এখানে রাবণ বলতে তৎকালীন দুষ্ট শাসকদেরই বোঝানো হয়েছে, যাদের রবে ভুবন কাঁপত (রাবণ মানে ‘রব কারয়িতা’)। রাবনের দশ হাত মানে আসলে সরকারের দশ ডিপার্টমেন্ট। কলিম খান রাক্ষস বলতে তাই প্রথমে সরকারি সংস্থাগুলিকে বুঝেছেন, যারা জনগণের অর্থ রক্ষণের নামে ভক্ষণ করে। তো এবারের জলবায়ু সম্মেলন নিয়ে কিছু কথা বলতে গিয়ে এর শিরোনামে রাক্ষসদের উদোম নৃত্যের কথা মাথায় আসলো। 

কলিম খান প্রাচীন পুরাণ সূত্রে আমাদের জানান দিয়েছেন, কথা ছিল শাসকরা সমাজের উদ্বৃত্ত ধনসম্পদ রক্ষা করবেন। তবে তারাই ধীরে ধীরে রক্ষস তথা রাক্ষসে রূপান্তরিত হয়। সমাজের সব সম্পদ করায়ত্ত করে রক্ষক থেকে ভক্ষকে রূপান্তর হন তারা। অতঃপর প্রবল রাক্ষসেরা খোদ রাষ্ট্রকেই আক্রান্ত করে, রাষ্ট্রই রাক্ষসে রূপ নেয়। আজকের নব্য উদারবাদী অর্থনীতির যুগ-বাস্তবতায় যদি আমরা রাক্ষস-রাষ্ট্রকে বুঝতে চাই, তো দেখা যাবে পরিস্থিতি হুবহু মিলে যাচ্ছে। জনগণের উদ্বৃত্ত শ্রম শোষণ করেই সম্পদের পাহাড় গড়ছে ব্যক্তিমালিকানার স্বেচ্ছাচারী ক্ষমতা, রাষ্ট্র সেই স্বেচ্ছাচারী বড়লোকদের পাহারা দিচ্ছে, নিশ্চিত করছে সুরক্ষা। আমার বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের সবথেকে প্রিয় শিক্ষক ও ব্যক্তিগত বন্ধুজন সেলিম রেজা নিউটন রাষ্ট্র-করপোরেশনের এই সম্মিলিত কর্মকাণ্ডকে নাম দিয়েছেন রাজনীতির রাক্ষসতন্ত্র। 

আজকের যুগে রাষ্ট্রের কাজ হলো স্বেচ্ছাচারী ব্যক্তিমালিকানার স্বার্থ রক্ষা করা। অর্থাৎ মুষ্টিমেয় বড়লোক-রাক্ষসের সমুদ্রসম গভীর পেট ভরানোর কাজটার পাহারাদারি করা রাষ্ট্র নামের রাক্ষসের কাজ। আবার এই করপোরেশনগুলোই তথা বড়লোক রাক্ষসেরাই রাষ্ট্রের চরিত্র নির্ধারণ করছে, নির্বাচন করছে তার ম্যানেজার-মন্ত্রি। সুতরাং রাক্ষস-রাজত্ব আজও বহাল, খানিকটা ভিন্ন আঙ্গিকে। এই যেমন জনগণের উদ্বৃত্ত শোষণের মধ্য দিয়ে সৃষ্ট অর্থ (আধুনিক জাতিরাষ্ট্র ব্যবস্থায় যাকে আমরা কর নামে ডাকি) বালিশ/পর্দা কেনার নামে খেয়ে ফেলে দুর্নীতিবাজ সরকারি আমলারা। সরকারি-রাজনৈতিক সিন্ডিকেট যেমন করে যখন তখন বাজার থেকে উধাও করে দেয় সয়াবিন কিংবা ডিম, পুরে ফেলে নিজের রাক্ষুসে পেটের মধ্যে। এই যেমন সেলাই শেখা, পড়ানো শেখা কিংবা গাছ লাগানো শেখার নামে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ খেয়ে ফেলে সরকারের আমলারা। এই যেমন কৃষি বিস্তারের নামে সারা আফ্রিকার জমি খেয়ে ফেলছেন বিশাল রাক্ষস বিল গেটস! কিংবা বাংলাদেশের দণ্ডপ্রাপ্ত একজন বন সংরক্ষক ওসমান গণির কথা নিশ্চয় মনে আছে আপনাদের পাঠক, যিনি বনখেকো খেতাব পেয়েছিলেন? অথচ ভেবে দেখুন, দুনিয়াব্যাপী বিভিন্ন সরকার আর করপোরেশনগুলোই তো এই নব্য উদারবাদী যুগে মানুষকে সুরক্ষা দেওয়ার কথা বলে দায়িত্ব নিয়েছে, যেটাকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ভাষায় আমরা সোশ্যাল কনট্রাক্ট নামে চিনে থাকি।

সার্বভৌম জাতিরাষ্ট্র মানুষের জান-জীবনের সুরক্ষা নিশ্চিতের অঙ্গীকারে সামাজিকভাবে চুক্তিবদ্ধ। বহুজাতিক করপোরেশনগুলোরও অ্যাডাম স্মিথের অদৃশ্য হাতের স্পর্শে সবাইকে কমবেশি সুরক্ষিত রাখার কথা। কিন্তু কই? তো সেই কথিত রক্ষকরাই তো দুনিয়াজোড়া, যারা প্রাণ-প্রকৃতি-প্রতিবেশকে পণ্য বানিয়ে এর ভবিষ্যত হুমকির মধ্যে ফেলেছে, ক্রমাগত পৃথিবীটাকে ধ্বংস করে যাচ্ছে সর্বানাশা কার্বন মচ্ছবে, সমুদ্র-অরণ্য-পাহাড়-গাছপালা-কৃষিজমি সব ভক্ষণ করছে রাক্ষসের মতো। সেই কথিত রক্ষক বিশ্বনেতারা আর রাক্ষুসে করপোরেশনগুলোর কর্ণধাররা যাদের ভূমিকা চূড়ান্ত অর্থে ভক্ষকের; গিয়ে মিলিত হয়েছে মিসরে, কপ-২৭ নামের ধরিত্রী রক্ষার সম্মেলনে। এইসব সম্মেলন করে কী হয়? ধনী রাষ্ট্র আর তাদের করপোরেশনগুলোর কার্বন মচ্ছব অবিরত রাখার পথ তৈরি হয়। মানুষসহ সামগ্রিক প্রকৃতির সুরক্ষার প্রশ্নটিকে বাণিজ্যিক করে তোলা হয়। প্রচুর মিথ্যে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়। জীবাশ্ম জ্বালানির পক্ষে জোরালো লবিং হয়। এসবের বাইরে কাজের কাজ কিচ্ছুটিও যে হয় না, তা খুঁজে পেতে বেশিদূর যাওয়ার দরকার নাই। আমরা ঘুরে আসতে পারি বিগত সম্মেলন পরবর্তী বাস্তবতা তথা বিদ্যমান জলবায়ু পরিস্থিতি নিয়ে।

বিরাজমান জলবায়ু চিত্র:

সেই ১৯৯৫ সাল থেকে জাতিসংঘ প্রতি বছর জলবায়ু সম্মেলনের আয়োজন করে যাচ্ছে। সেই সময় থেকে কার্বন নিঃসরণের লাগাম টানতে বিশ্বের জাতিরাষ্ট্রগুলো এবারের আগ পর্যন্ত ২৬টি সম্মেলনের আয়োজন করেছে। তাতে তাপমাত্রা বৃদ্ধিতে লাগাম তো টানা যায়ইনি, উল্টো বেড়েছে কার্বন নিঃসরণের হার। জলবায়ু সম্মেলনগুলোর মধ্যে সবথেকে তাৎপর্যপূর্ণটি সম্ভবত প্যারিস সম্মেলন। ২০১৬ সালে ফ্রান্সের জলবায়ু সম্মেলনে হওয়া চুক্তিতে তাপমাত্রা বৃদ্ধির হার শিল্পযুগ-পূর্ববর্তী সময়ের তুলনায় ২ ডিগ্রি কিংবা পারলে ১.৫ এর মধ্যে সীমিত রাখার ব্যাপারে সমঝোতা হয়। অথচ কী প্রহসন! ৫ বছরের মাথায় ২০২১ সালের অগাস্টে ২৬তম গ্লাসগো সম্মেলনের আগে মানবতার জন্য ‌‌‌‘লাল সংকেত’ প্রকাশ করে জাতিসংঘ। ওই সময় তারা হিসেব করে দেখায়, বিদ্যমান ধারা অব্যাহত থাকলে মাত্র দুই দশকেই তাপমাত্রা শিল্পযুগের তুলনায় ১.৫ শতাংশ বাড়বে। এর মানে হলো, ২০১৫ সালে প্যারিস জলবায়ু সম্মেলনে উষ্ণায়নকে যে মাত্রায় বেধে রাখার অঙ্গীকার বিশ্বনেতারা করেছিলেন, তা পূরণ করা হয়ত সম্ভব হবে না। তাপমাত্রাকে শিল্পযুগের তুলনায় ১.৫ ডিগ্রির বেশি বাড়তে না দেওয়ার বৈশ্বিক অঙ্গীকার কেবলই প্রতিশ্রুতি হয়েই থাকবে। প্রতিবেদন অনুয়ায়ী, এ শতকের শেষভাগে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বেড়ে যাবে ২ মিটার। উল্লেখ্য, স্কটল্যান্ডের গ্লাসগো শহরে একই বছরের শেষের দিকে কপ-২৬ কে সামনে রেখে ওই প্রতিবেদন তৈরি করা হয়।

আইপিসিসির এই প্রতিবেদনটি তৈরিতে ব্যবহৃত এক সমীক্ষার রচয়িতা যুক্তরাজ্যের ‘ইউনিভার্সিটি অব রিডিং’-এর অধ্যাপক এড হকিন্স ওই সময় বলেছিলেন, বিজ্ঞানীদের পক্ষে ‘এর চেয়ে স্পষ্ট’ করে আর কিছু বলার নেই। তিনি বলেন, “এটা হচ্ছে বাস্তব অবস্থার বর্ণনা, এর চেয়ে নিশ্চিত করে আমাদের পক্ষে আর কিছু বলা সম্ভব নয়; এটা সর্বজনসম্মত এবং বিতর্কেরও ঊর্ধ্বে যে মানুষই পৃথিবীকে উষ্ণ করে তুলছে।” জাতিসংঘের মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস এ প্রতিবেদনটিকে ‘মানবতার জন্য লাল সংকেত’ আখ্যা দেন। ওই সময় তিনি বলেন, দেরি করার মতো সময় আমাদের হাতে নেই। নেই কোনো অজুহাত দেখানোর সুযোগ। গ্লাসগো জলবায়ু সম্মেলন সফল করার জন্য সব দেশের সরকার ও অংশীদারদের ভরসায় রয়েছি। সেই ভরসা সবসময় থাকে জাতিসংঘের দিক থেকে, প্রতিটা সম্মেলনেই। বিপরীতে বিশ্বকে কী দিয়েছেন ক্ষমতাধর দেশের নেতারা তথা রাক্ষসেরা? চলুন পরিসংখ্যানে নজর ফেরাই। 

২০২০ সালে PBL Netherlands Environmental Assessment Agency প্রকাশিত এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ১৯৯০ সালের তুলনায় ২০১৮ সালে এসে গ্রিনহাউজ গ্যাস নির্গমনের মাত্রা বেড়েছে ৫৭ শতাংশ। ২০০০ সালের তুলনায় এই বৃদ্ধির পরিমাণ ৪৩ শতাংশ। আওয়ার ওয়ার্ল্ড ইন ডাটা থেকে প্রাপ্ত তথ্য বলছে, ২০১৮ সালে জীবাশ্ম জ্বালানি ও শিল্পখাত থেকে কার্বন নিঃসরণের পরিমাণ ছিল ৩৬. ৮৩ বিলিয়ন টন। পরবর্তী বছরে ২০১৯ সালে নিঃসরণের পরিমাণ আরও বেড়ে দাঁড়ায় ৩৭.০৮ বিলিয়ন টনে। আর ২০২০ সালে এসে করোনাভাইরাস মহামারীর কারণে বিশ্ব অচল থাকায় নিঃসরণের পরিমাণ দাঁড়ায় ৩৫.২৬ মিলিয়ন টন। আর ২০২১ সালে এসে এই পরিমাণ দাঁড়ায় ৩৭.১২ বিলিয়ন টনে, যা এ যাবৎকালের মধ্যে সর্বোচ্চ। গ্লাসগোতে ২৬তম জলবায়ু সম্মেলনে বিশ্বনেতাদের দেওয়া প্রতিশ্রুতি যে তাপমাত্রা বৃদ্ধি ১.৫ ডিগ্রিতে সীমিত রাখা সম্ভব নয়, জাতিসংঘ সেটা সম্মেলনের সময়ই বলেছিল। সবমিলিয়ে এ বছর অক্টোবরে প্রকাশিত জাতিসংঘের পরিবেশবিষয়ক প্রতিবেদন অনুযায়ী, যদি ২০৩০ সাল পর্যন্ত পূর্ণভাবেও সব দেশ তাদের দেওয়া প্রতিশ্রুতি পূরণ করে, তারপরও বিশ্বের তাপমাত্রা বৃদ্ধি ২.৫ ডিগ্রিতে পৌঁছাবে, যার অর্থ হবে চরম বৈরী আবহাওয়া। জাতিসংঘের ওই প্রতিবেদন অনুযায়ী, একবছর আগে ২৬তম জলবায়ু সম্মেলনে বিশ্বের দেশগুলো কার্বন নিঃসরণ আরও কমানোর প্রতিশ্রুতির ব্যাপারে সম্মত হয়েছিল। তবে ২৭তম সম্মেলনের আগমুহূর্তে মুষ্টিমেয় কিছু দেশ সেই প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেছে। তাপমাত্রা বৃদ্ধিকে ১.৫ ডিগ্রিতে সীমিত রাখার প্রতিশ্রুতি ধরে রাখতে যেখানে নিঃসরণ ৫০ শতাংশ কমানোর দরকার ছিল, সেখানে অধিকাংশ দেশ প্রতিশ্রুতি রক্ষা না করায় ভয়াবহ পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। জাতিসংঘের ওই পরিবেশ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, যেটুকু প্রতিশ্রুতি রক্ষিত হয়েছে তাতে ২০৩০ সালের মধ্যে নিঃসরণ কমানো সম্ভব হবে মাত্র ১ শতাংশ। কোথায় ৫০ শতাংশ আর কোথায় ১ শতাংশ, ভাবুন তো পাঠক!

জলবায়ু সম্মেলন মানেই কেন ব্যর্থতা:

এ পর্যন্ত আলাপ থেকে স্পষ্ট যে, জলবায়ু সম্মেলনগুলো শেষ পর্যন্ত কার্বন মচ্ছব থামাতে পারেনি– প্রতিশ্রুতি, চুক্তি, অঙ্গীকার কিচ্ছু কাজে আসেনি। উল্টো নিঃসরণ বৃদ্ধির হার বেড়েছে। কিন্তু জলবায়ু সম্মেলনগুলো কেন ব্যর্থ হয়। কেন কোনও কার্যকর ভূমিকা পৃথিবী নিতে পারে না? কারণটা আলাপ করতে গেলে ব্যবস্থা নিয়ে আলাপ করতে হবে। এই নিও লিবারেল বাজার ব্যবস্থা, তার হোতা উন্নত কয়েকটি দেশ আর তৃতীয় বিশ্ব নামে পরিচিত সেই বাজারের পাহারাদার রাষ্ট্রগুলো মিলে যে রাক্ষস-রাজত্ব বিদ্যমান; তা ধরিত্রী রক্ষার সমাধান খুঁজছে বাণিজ্যিক প্রক্রিয়ায়। প্রাণ-প্রকৃতি-প্রতিবেশকে এই রাক্ষস-রাজত্ব ব্যবসার উপাদান বানিয়ে এর সুরক্ষার প্রশ্নকেও ব্যবসায়িক প্রক্রিয়ায় মোকাবিলা করতে চাইছে।

১৯৯৭ সালে স্বাক্ষরিত কিয়োটো প্রোটোকলের প্রশংসা শোনা যায় সবসময়ই। তবে ২০১০ সালে প্রকাশিত বিশ্ব ব্যাংকের এক সমীক্ষাতে দেখা গিয়েছে, সেই সম্মেলনের প্রতিশ্রুত নিঃসরণ কমানোর সমঝোতার বাস্তব ফল এখনও পাওয়া যায়নি। ১৮০টি দেশের সমন্বয়ে ১৯৯৭ সালের কিয়োটো সম্মেলনে শিল্পোন্নত ৩৮টি দেশকে ২০০৮ থেকে ২০১২ সালের মধ্যে তাদের কার্বন নিঃসরণের মাত্রা পূর্ববর্তী সময়ের চেয়ে (১৯৯০) ৫.২% কমানোর জন্য সীমা বেঁধে দেওয়া হয় এবং বলা হয়, আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বায়ুমণ্ডলে গ্রিনহাউজ গ্যাস নিঃসরণ বিষয়ে বাণিজ্য বা যৌথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা যাবে। মূলত এখান থেকেই কার্বন বাণিজ্যের সূত্রপাত। ২০১৫ সালে স্বাক্ষরিত প্যারিস জলবায়ু চুক্তির ৬ নম্বর অনুচ্ছেদে এই কার্বন মার্কেট ব্যবহার করে সেচ্ছাভিত্তিক নিঃসরণ কমানোর পথ নিয়ে আলাপ করা হয়েছে। প্যারিস চুক্তির ছয় বছর পর ২০২১ সালের গ্লাসগো সম্মেলনে আর্টিকেল ৬ বাস্তবায়নের নীতিনির্ধারণ করা হয়, তাদের মতে এতে কার্যকর আন্তঃসীমান্ত সহযোগিতার পথ প্রশস্ত হয়। আদতেও তা হয়েছে কিনা, সেটা পরের আলাপ। আপাতত বুঝে নিই, এই কার্বন বাণিজ্য জিনিসটা কেমন? 

কার্বন বাণিজ্যের ঘোষিত উদ্দেশ্য হলো শিল্পের অগ্রগতি রোধ না করে কার্বন মচ্ছব কমানো। পৃথিবীতে গ্রিনহাউজ গ্যাস (জলীয় বাষ্প, কার্বন-ডাই অক্সাইড, মিথেন ও ওজোন) কমানোর জন্য কিয়োটো প্রটোকলের ১৭ নম্বর অনুচ্ছেদে কার্বন বাণিজ্যের নিয়মনীতি বিষয়ে উল্লেখ রয়েছে। যেসব দেশ কিয়োটো প্রটোকলে স্বাক্ষর করেছে তাদের বাৎসরিক কার্বন নিঃসরণের পরিমাণ নির্ধারণ করে দিয়েছে ইউনাইটেড নেশনস ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশন অন ক্লাইমেট চেঞ্জ- ইউএনএফসিসি। কোনো সদস্য তার নির্ধারিত অংশের বেশি কার্বন নিঃসরণ করলে তা চুক্তির লঙ্ঘন হওয়ার কথা। তবে কেউ তার বরাদ্দ অংশের চেয়ে কম খরচ করলে অতিরিক্ত অংশ কার্বন ট্রেডিংয়ের মাধ্যমে বিক্রি করতে পারবে। যেহেতু প্রতিটি দেশের জন্য কার্বন নিঃসরণ একটি সীমার মধ্যে বেঁধে দেওয়া হয়েছে, তাই যে দেশ সীমার চেয়ে কম কার্বন নিঃসরণ করবে, সেই অনুপাতে তার নামে কার্বন ক্রেডিট জমা হবে। এই ক্রেডিট সে বিশ্ববাজারে বিক্রি করতে পারবে। আর যারা সীমার চেয়ে বেশি নিঃসরণ করবে, তারা ওই ক্রেডিট কিনে নেবে। একেই বলা হয় কার্বন ট্রেডিং বা কার্বন বাণিজ্য। ধরুন জলবায়ু চুক্তি অনুযায়ী কোনও একটা দেশের ২০০ গিগাটন পর্যন্ত কার্বন নিঃসরণের অধিকার রয়েছে। এখন সেই দেশ নিঃসরণ করল ১০০ গিগাটন। তাহলে বাকি যে ১০০ গিগাটন তারা নিঃসরণ করল না, তা কার্বন ক্রেডিট হিসেবে জমা হবে। এই পরিমাণ কার্বন নিঃসরণের অধিকার সেই দেশ বিক্রি করতে পারবে অন্য কোনও দেশের কাছে। ধরুন, সবথেকে বেশি কার্বন নিঃসরণকারী দেশ হিসেবে চীন-ভারত কিংবা যুক্তরাষ্ট্র ওই কার্বন ক্রেডিট কিনে নিয়ে ব্যবহার করল। তাহলে এখন কাণ্ডজ্ঞান দিয়ে চিন্তা করুন তো পাঠক, এভাবে কি কার্বন নিঃসরণ কমানো সম্ভব? সহজ উত্তর না। এ আসলে নয়া উপনিবেশবাদ। পৃথিবী ধ্বংসের তোয়াক্কা না করে জীবাশ্ম জ্বালানিভিত্তিক শিল্পায়নকে নিজেদের মুনাফার হাতিয়ার বানানো অক্ষুণ্ন রাখার এক নতুন পশ্চিমা কৌশল। বিশ্বের অনেক উন্নয়নশীল দেশই রয়েছে, যাদের জন্য নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে কম নিঃসরণ ঘটায় তারা। কার্বন বাণিজ্য সেই দেশগুলোর নিঃসরণের অধিকার বিক্রি করার সুযোগ তৈরির মধ্য দিয়ে কার্বন মচ্ছবকে আরও নিরঙ্কুশ করার পথ তৈরি করেছে, আর তাকেই সমাধানকল্প আকারে আমাদের সামনে দৃশ্যমান করতে চাইছে। এটিকে আপনারা আসলে উপনিবেশবাদের একটি নতুন ধারণা হিসেবে দেখতে পারেন। উপনিবেশবাদী দেশগুলো এর মাধ্যমে অনুন্নত দেশগুলোকে জীবাশ্ম জ্বালানিভিত্তিক শিল্পায়নে নিরুৎসাহিত করে চলেছে। যেহেতু কার্বন-ট্রেডকারী প্রতিষ্ঠানগুলো উন্নতবিশ্বে গড়ে উঠেছে সেহেতু ট্রেডিংয়ের মাধ্যমে প্রাপ্ত অর্থ অনুন্নত বিশ্ব থেকে উন্নত বিশ্বের দিকে চলে যাচ্ছে। অন্যদিকে এ চুক্তির ফলে উন্নত দেশগুলো অর্থের বিনিময়ে তাদের কার্বন নিঃসরণের বৈধতা পাচ্ছে। ফলে কার্বন নিঃসরণ তো কোনভাবেই কমছে না বরং ধনী দেশগুলো কার্বন ক্রেডিট কিনে নিয়ে দায়মুক্তি পাচ্ছে এবং অবাধে নিঃসরণ করেই যাচ্ছে।

প্যারিস চুক্তি অনুযায়ী তাপমাত্রা বৃদ্ধি প্রাক-শিল্পযুগের তুলনায় ১.৫ ডিগ্রিতে সীমাবদ্ধ রাখতে জাতিসংঘের হিসাবে ২০৩০ সালের মধ্যে কার্বন নিঃসরণ কমাতে হবে ৪৫ শতাংশ। আর ২০৫০ সালের মধ্যে নিঃসরণের পরিমাণ শূন্যে নামিয়ে আনতে হবে। নিঃসরণ শূন্যে নামিয়ে আনার বিষয়টিকে বলা হচ্ছে নেট জিরো। রাক্ষস-রাজনীতি এই নেট জিরো অর্জনের বিষয়টিকে ব্যবসার উপাদান বানিয়েছে। তাদের মতে নিঃসরণ শূন্যে নামিয়ে আনার জন্য দুইটা পথ, এক) গ্রিনহাউজ গ্যাস কম নিঃসরণ করা। আর দুই) নিঃসরিত গ্রিনহাউজ গ্যাসের বিপরীতে সমুদ্র-বনের মতো অঞ্চলগুলোকে ব্যবহার করে বায়ুমণ্ডলে নির্গত কার্বনকে শোষণ করা। 

প্যারিস চুক্তির সময়ে চীন-যুক্তরাষ্ট্র-ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ বিশ্বের ৭০টি দেশ নেট জিরো লক্ষ্য অর্জনের ব্যাপারে সমঝোতায় পৌঁছায়। এই দেশগুলোই বিশ্বে সামগ্রিক গ্রিনহাউসের ৭৬ শতাংশ নিঃসরণ করে। ৩০০০ ব্যবসায়ী ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান জলবায়ু ‍বিজ্ঞানের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে নিঃসরণ কমানোর চেষ্টা করছে। এক হাজারের বেশি শহর, এক হাজারের বেশি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আর ৪০০ আর্থিক প্রতিষ্ঠানও যুক্ত হয়েছে নেট জিরো লক্ষ্য অর্জনে। তবে খোদ জাতিসংঘই বলছে, সরকারগুলোর ঘোষিত প্রতিশ্রুতি তেমন কিছুই অর্জনের পথ বাতলে দিতে পারেনি। ১৯৩টি রাষ্ট্র-প্রতিষ্ঠানের প্যারিস চুক্তিতে নেওয়া নেট জিরো লক্ষ্য সত্ত্বেও বায়ুমণ্ডলে গ্রিনহাউজ গ্যাস নিঃসরণ ২০১০ সালের তুলনায় ২০৩০ সালে গিয়ে ১১ শতাংশ বাড়বে বলে আভাস দিয়েছে তারা। জাতিসংঘ বলছে, পৃথিবীকে বাঁচাতে তাই প্যারিস চুক্তি স্বাক্ষরকারী দেশগুলোর কার্বন নিঃসরণে জাতীয়ভাবে নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রা (এনডিসি) আরও শক্তিশালী করতে হবে। দ্রুততর পদক্ষেপ নিতে হবে।

জাতীয়ভাবে নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রা (এনডিসি) দ্রুত বাস্তবায়নের লক্ষ্যে ২০১৬ সালে মরক্কোয় জাতিসংঘের ২২তম বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলনে গঠন করা হয়েছে জাতীয়ভাবে নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রা অংশীদারত্ব (এনডিসিপি)। এই এনডিসি কী? প্যারিস জলবায়ু সম্মেলনে সিদ্ধান্ত হয় প্রতিশ্রুতির বিপরীতে বিশ্বের রাষ্ট্রগুলো কার্বন নিঃসরণ কমাতে কতটুকু কী ভূমিকা রাখছে, প্রতি ৫ বছর পর পর তার হিসেব সরবরাহ করবে। চুক্তির ৪ নম্বর আর্টিকেলে বলা ছিল, নিঃসরণ কমানোর পরিকল্পনা কীভাবে বাস্তবায়ন করা হবে, প্রতি ৫ বছর পর পর দেওয়া এনডিসিতে তারও হিসাব থাকবে। পূর্ববর্তী পরিকল্পনার চেয়ে পরেরটি আরও বেশি নিঃসরণ কমানোর লক্ষ্যাভিমুখী হবে। গ্লাসগো সম্মেলনে এ সংক্রান্ত প্রথম রিপোর্ট উপস্থাপনের কথা ছিল। তবে এ বছর ২৩ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত প্যারিস চুক্তিতে স্বাক্ষরকারী ১৯৩টি রাষ্ট্র-প্রতিষ্ঠানের মধ্যে আপডেটেড এনডিসি সরবরাহ হয় মাত্র ২৪টি। ওইসব এনডিসি বিশ্লেষণ করে জাতিসংঘ দেখেছে, ২০৩০ সালের মধ্যে নিঃসরণ আরও ১৩.৭ শতাংশ বাড়বে।

করোনাভাইরাস মহামারীর কারণে ২০২০ সালের ২৬তম জলবায়ু সম্মেলন স্থগিত ছিল। পরের বছর ২০২১ সালে স্কটল্যান্ডের গ্লাসগোতে এই সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সিদ্ধান্ত হয়, মিসরের এ বছরের ২৭তম জলবায়ু সম্মেলনে প্রত্যেক দেশ তাদের আপডেটেড এনসিডি সরবরাহ করবে। তবে ১৮ নভেম্বর শুক্রবার দুপুর একটায় ক্লাইমেট অ্যাকশন ট্র্যাকারে গিয়ে দেখা যায়, এ বছর ২৭তম সম্মেলনে সব দেশের এটি সরবরাহ করার কথা থাকলেও এ পর্যন্ত এনডিসি সরবরাহ করেছে মাত্র ২৮টি দেশ। 

পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় উৎপাদনের কেন্দ্রীয় লক্ষ্য মুনাফা। এই নব্য উদারবাদী বাজার ব্যবস্থা সেই মুনাফা-বাসনার সবথেকে শক্তিশালী সংস্করণ। এই বাজার-ব্যবস্থা আর তার পাহারাদার রাষ্ট্রগুলো মুনাফার স্বার্থে জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার থেকে সরে আসতে চায় না। তাই তারা নেট জিরো, কার্বন ট্রেড, কার্বন অফসেটের মতো বাণিজ্যিক ধারণাগুলোকে প্রমোট করে থাকে। তাদের মুনাফা বাসনা কার্বন মচ্ছবকে নিরঙ্কুশ রাখে। 

এই শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়, অর্থাৎ ২০৫০ সালের মধ্যে নেট জিরোতে পৌঁছানোর লক্ষ্য রয়েছে ১২০টি দেশের। ২০২১ সালের অগাস্টে প্রকাশিত বেসরকারি দাতা সংস্থা অক্সফামের এক প্রতিবেদন স্পষ্ট করে বলেছে, কার্বন নিঃসরণ অটুট রেখে কার্বন শোষণের মধ্য দিয়ে নেট জিরোতে পৌঁছানোর পরিকল্পনা অবাস্তব। তারা হিসাব কষে দেখিয়েছে, চলমান নিঃসরণ অক্ষুণ্ন রেখে ২০৫০ সালের মধ্যে নেট জিরোতে পৌঁছাতে ১.৬ বিলিয়ন হেক্টর নতুন বনভূমি প্রয়োজন হবে। যে পরিমাণ গাছ লাগাতে হবে, তারজন্য ভারতের মতো ৫টা দেশের সমান জমি দরকার হবে। চিন্তা করে দেখুন পাঠক, যে বিশ্বব্যবস্থা ক্রমাগত বনভূমি-পাহাড়-জঙ্গল ধ্বংস করে সর্বগ্রাসী উন্নয়ন মচ্ছব চালায়, তারা কার্বন শোষণে কতটুকু ভূমিকা রাখতে পারবে? আর রাখতে চাইলেও তা কোনোভাবেই সম্ভব হবে কিনা!

২৭তম সম্মেলন কী দিলো:

স্কটল্যান্ডের গ্লাসগোতে গতবারের জাতিসংঘ জলবায়ু সম্মেলনে (কপ-২৬) অংশ নেওয়াদের মধ্যে ৫ শতাধিক ছিল জীবাশ্ম জ্বালানি শিল্পের দালাল (লবিস্ট)। গ্লোবাল উইটনেসের ওই সময়ের এক অনুসন্ধানে বলা হয়, তেল ও গ্যাস শিল্পের মতো জীবাশ্ম জ্বালানির স্বার্থ রক্ষার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে তারা। জলবায়ু-অধিকারকর্মীদের পক্ষ থেকে তাদেরকে সম্মেলনে নিষিদ্ধ করার দাবি তোলা হয়। গ্লাসগো সম্মেলনে মোট অংশ নেন ৪০ হাজার প্রতিনিধি। তাদের মধ্যে ব্রাজিলের পক্ষ থেকে সর্বোচ্চ ৪৭৯ জন ছিলেন। আর গ্লোবাল উইটনেসের অনুসন্ধান অনুযায়ী, সম্মেলনে যোগ দেওয়া জীবাশ্ম জ্বালানির দালালদের সংখ্যা ছিল ৫০৩। সেই হিসেবে সম্মেলনে অংশ নেওয়া যেকোনো দেশের প্রতিনিধির চেয়ে জীবাশ্ম জ্বালানি শিল্পের দালালের সংখ্যা ছিল বেশি। গ্লোবাল উইটনেসের অনুসন্ধানে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক উঠে আসে: ১) এই দালালদের বেশিরভাগই রাশিয়া ও কানাডার প্রতিনিধি হিসেবে সম্মেলনে যোগ দিয়েছেন। ২) জলবায়ুর অভিঘাতে সবথেকে ক্ষতিগ্রস্ত ৮ দেশ থেকে যে সংখ্যক প্রতিনিধি এসেছেন, তাদের চেয়ে এই দালালদের সংখ্যা বেশি। ৩) জীবাশ্ম জ্বালানিভিত্তিক শতাধিক কোম্পানির প্রতিনিধিত্ব রয়েছে এই সম্মেলনে। 

জীবাশ্ম জ্বালানির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ওই প্রতিনিধিরা বিশ্বব্যাপী তেল এবং প্রাকৃতিক গ্যাসভিত্তিক শিল্প কারখানা স্থাপন সংক্রান্ত দালালির কাজে নিয়োজিত রয়েছেন; এমন অভিযোগ করে পরবর্তী সম্মেলনগুলোতে তাদেরকে নিষিদ্ধ করার দাবি তোলেন জলবায়ু আন্দোলনের কর্মীরা। সে সময় দ্য ইন্ডিপেনডেন্ট পত্রিকার অনুসন্ধান বিষয়ক সম্পাদক ডেভিড কোহেন তার পত্রিকায় প্রকাশিত এক অনুসন্ধানে তুলে আনেন এই করপোরেশনগুলোর বাস্তবতা। তিনি হিসাব কষে দেখান, কপ-২৬ সম্মেলনের স্পন্সরশিপে থাকা ১১টি কোম্পানি মিলে গত ২০২০ সালে মুনাফা করেছে ২৬০ বিলিয়ন। আর এই মুনাফা অর্জন করতে গিয়ে তারা ৩৭৫ মিলিয়ন টন কার্বন নিঃসরণ করে। আর পরিবেশ আন্দোলনের সুইডিশ কর্মী গ্রেটা থানবার্গ ক্লাইমেট মার্চে অংশ নিয়ে বলেছিলেন, নীতিনির্ধারকদের সঙ্গে করপোরেশনের মধ্যস্থতার ক্ষেত্র হিসেবে কপ সম্মেলনকে ব্যবহার করা হচ্ছে। তাই, এসব সম্মেলনে গৃহীত সিদ্ধান্ত জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় কোনো কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারছে না। কপ-২৬ এ মিথেন নিয়ে চুক্তি, বন উজাড় বন্ধে চুক্তি, জীবাশ্ম জ্বালানী বিনিয়োগ বন্ধ করার বিষয়ে, ‘সবুজ প্রতিরক্ষা’সহ এবং আরও অনেক পদক্ষেপের কথা বলা হয়েছিল। এইসব চুক্তির মেয়াদ এখনো অবশিষ্ট আছে তবে খুবই সামান্য। তবে অগ্রগতি কিছুই যে হয়নি, তা তো আমাদের বিদ্যমান জলবায়ু চিত্র থেকেই স্পষ্ট। 

গ্রেটা থানবার্গ এবারের ২৭তম জলবায়ু সম্মেলন বর্জনই করেছেন। একে গ্রিন ওয়াশিং আখ্যা দিয়েছেন তিনি। বলেছেন, ক্ষমতাসীন রাজনীতিক ও অন্যরা বিভিন্ন ধরনের গ্রিন ওয়াশিংয়ের মধ্য দিয়ে বিশ্বের মনোযোগ আকর্ষণের সুযোগ পায় সম্মেলনগুলোর মধ্য দিয়ে। এগুলো কোনও কাজে আসে না। আসলেই যে কাজে আসে না, তা তো আমরা দেখতেই পাচ্ছি। জলবায়ু সংকট থেকে উত্তরণের লক্ষ্যে ৬ নভেম্বর থেকে ১৯৬টি দেশের অন্তত ৪৫ হাজার প্রতিনিধি জড়ো হয়েছেন মিসরের নয়নাভিরাম শারম আল-শেখে। বেছে নেওয়া স্থানটি এমন, যেখানে বিক্ষোভ করা শক্ত। পরিবেশ আন্দোলনকারীদের কেউ কেউ বলছেন, জায়গাটি বেছে নেওয়ার মূল কারণ সম্মেলনস্থলের বাইরের বিক্ষোভ প্রশমিত করা। এমন সময় সেখানে সম্মেলন হচ্ছে, যখন স্বৈরশাসক ফাত্তাহ আল সিসির দেশের কারাগারে রয়েছেন ৬০ হাজার রাজনৈতিক বন্দি। সম্মেলনের আগে বেশ কয়েকজন পরিবেশকর্মীকে গ্রেফতারেরও খবর মিলেছে। ১৮ নভেম্বর শুক্রবার সম্মেলনের শেষ দিনে জানা যাচ্ছে, সবমিলিয়ে একটি খসড়া চুক্তি হয়েছে। প্রত্যাশিত চূড়ান্ত চুক্তির জন্য ২০ পৃষ্ঠার খসড়াটিতে গত বছর গ্লাসগোতে অনুষ্ঠিত কপ-২৬ এর বৈশ্বিক তাপমাত্রা দেড় ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখার পুনরাবৃত্তি করা হয়। চুক্তিতে ‘নিরবচ্ছিন্ন কয়লা বিদ্যুতের ব্যবহার ধীরে ধীরে বা পর্যায়ক্রমে বন্ধ করার পদক্ষেপ ত্বরান্বিত করতে এবং অকার্যকর জীবাশ্ম জ্বালানি ভর্তুকি যুক্তিযুক্ত করতে বা পর্যায়ক্রমে বন্ধ করতে’ বলা হয়েছে। এই খসড়ায় জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোকে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার জন্য তহবিল গঠনের বিস্তারিতও অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। দ্বীপ রাষ্ট্রগুলোসহ জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে হুমকির মুখে থাকা অধিকাংশ দেশের প্রধান দাবি ছিল এটি। সম্মেলনের কার্যসূচিতে ‘ক্ষয়ক্ষতির ক্ষেত্রে সাড়া দিতে তহবিল ব্যবস্থাসংক্রান্ত বিষয়াদি’ অন্তর্ভুক্ত করতে প্রথমবারের মতো পক্ষগুলোর সম্মত হওয়ার বিষয়টিকে ‘স্বাগত’ জানানো হয়েছে। তবে এই নথিতে ‘প্যারিস চুক্তির তাপমাত্রা লক্ষ্য অর্জনের জন্য সব স্তরে সব প্রচেষ্টা চালানোর গুরুত্বের ওপর জোর দেওয়া’ হয়েছে। সবমিলিয়ে বিগত সম্মেলনগুলোতেও যেমনটা হয়েছিল, এবারও গ্রিন ওয়াশিং হয়েছে অতীতের মতোই। সম্মেলনে বাংলাদেশের প্রতিনিধি জিয়াউল হক ইউএনবিকে বলেছেন, উন্নত দেশগুলো ‘লস অ্যান্ড ড্যামেজ’ কর্মসূচির কাঠামো চূড়ান্ত করার জন্য ২০২৪ সালকে নির্ধারণ করেছে। তিনি বলেন, ‘ক্ষয়ক্ষতিসহ জলবায়ু পরিবর্তনে ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোকে অর্থ দেয়ার প্রাথমিক ইস্যুতে আমরা একমত হতে পারিনি। কার্বন নিঃসরণ কমাতে প্রশমন কর্মসূচির পরিধি নিয়েও কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। আমি মনে করি না যে আমরা এই বছরের সম্মেলনে খুব বেশি অর্জন করব, কারণ ধনী দেশগুলো পুরনো ইস্যুতেই ঐকমত্যে পৌঁছাতে ব্যস্ত।’

এবারের কপ সম্মেলনের স্পন্সর কারা জানেন? ভোডাফোন, মাইক্রোসফট, বোস্টন কনসাল্টিং গ্রুপ, ইনফিনিটি পাওয়ার, ইজিপটিয়ার, ব্লুমবার্গ ফিলানথ্রপিস, আফ্রিকান এক্সপোর্ট-ইমপোর্ট ব্যাংক, ওরাসকম কনস্ট্রাকশন পিএলসি, সিমেন্স এজি, আইবিএম, কোকাকোলা, সিসকো, সোডিক, সিমেন্স এনার্জি এজি, গুগল, মাশরেক ব্যাংক পিএসসি, অ্যাডসেরো, হাসান আল্লাম হোল্ডিং। এদের বেশিরভাগের পরিবেশগত ভূমিকা ভয়ঙ্কর। নেট জিরো অর্জনের প্রতিশ্রুতি দিয়েও এরা সমানে কার্বন মচ্ছব চালাচ্ছে। জলবায়ু সম্মেলনকে তারা ব্যবহার করছে তাদের উদগ্র ব্যবসা বাসনার স্বার্থে। প্লাস্টিক দূষণ এবং বিশুদ্ধ পানির ব্যবহার ক্রমান্বয়ে বৈশ্বিক পরিবেশগত স্থায়িত্বের প্রান্তিক সীমা অতিক্রম করেছে। এরমধ্যে কোকাকোলার স্পন্সরশিপের কারণে এবারের কপ সম্মেলনের অন্তসারঃশূন্যতার বিষয়টি আরও বেশি প্রকাশ্যে এসেছে। কোকাকোলা অবশ্য ২০৩০ সালের মধ্যে কার্বন নির্গমন ২৫ শতাংশ হ্রাস ও ২০৫০ সালের মধ্যে নেট জিরো অর্জনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। এই প্রতিশ্রুতির বিপরীতে ২০১৯ সাল থেকে ২০২১ সালের মধ্যে তারা প্লাস্টিকের ব্যবহার ৮.১ শতাংশ বাড়িয়ে ৩.২ মিলিয়ন টনে নিয়ে এসেছে। তো নেট জিরো কিংবা নিঃসরণ কমানোর প্রতিশ্রুতি কী, নিশ্চয় বোঝা গেছে!

জলবায়ু সম্মেলন তারমানে বৈশ্বিস রাক্ষসদের অতিরিক্ত কিছু কার্বন পোড়ানোর বিশ্বনৈতিক বন্দোবস্ত। যাবতীয় প্রাণের সঙ্গে সঙ্গে প্রকৃতি-প্রতিবেশ নিয়ে এক ব্যবসায়িক আয়োজন। এই বন্দোবস্ত/আয়োজনের হোতাদেরও মা-বাবা আছেন, সন্তান আছে, আছে বন্ধু-স্বজন। সন্তানদের জন্য কোন পৃথিবী রেখে যাচ্ছেন তারা? অন্ধ বাজার তাদের তা দেখতে দেয় না। তাই দুনিয়াটাই ধ্বংস হয়ে গেলে ব্যবসাটা কোথায় হবে, সেই চিন্তাও তাদের মাথায় আসে না। তাহলে কি এরা নিজেদের কথাও ভাবে না, নাকি অন্য পৃথিবীতে আবাস গড়ার চিন্তা করে রেখেছেন তারা? কিন্তু ভিন্ন পৃথিবীও কি রাক্ষসতন্ত্রের হাত থেকে সুরক্ষা পাবে?