পহেলা বৈশাখের সঙ্গে মঙ্গল শোভাযাত্রার সংযুক্তি খুব বেশি দিনের নয়। তবে এই মঙ্গল শোভাযাত্রার বিরোধিতার নামে আবারও একদল মানুষ বাঙালি সংস্কৃতির বৃহত্তম অসাম্প্রদায়িক সামাজিক-সাংস্কৃতিক উৎসবটিকে বিঘ্নিত করতে মাঠে নেমেছে। কেন তা বন্ধ করে দেওয়া হবে না জানতে চেয়ে আইনি বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়েছে। বিজ্ঞপ্তি প্রদানকারী আইনজীবীটি জ্ঞাতনামা হলেও হুমকি দিয়েছে অজ্ঞাতনামা কেউ বা কেউ কেউ। মঙ্গল শোভাযাত্রার এই বিরোধিতা আসলে একটা বড় ষড়যন্ত্রের অংশ, প্রকাশটা আপাতত ছোট মনে হলেও।
আধুনিক শৈল্পিক রূপ না থাকলেও শত শত বছর ধরে বাঙালি পহেলা বৈশাখে গ্রামেগঞ্জে বৈশাখী মেলা করে আসছে। ব্যবসায়ীরা হালখাতা করছেন। হিন্দু ব্যবসায়ী পূজাঅর্চনা করে মিষ্টি বিতরণের মাধ্যমে হালখাতার সূচনা করেন আর মুসলমান ব্যবসায়ী মিলাদ পড়িয়ে করেন মিষ্টি বিতরণ। আদিবাসীরা নিজস্ব প্রথামাফিক নানা অনুষ্ঠান পালন করে আসছেন। এর মধ্যে ধর্মের প্রভাব খুব অল্পই। পুরোটাই লোকজ উৎসব। এ কারণে শত বছর ধরে ধর্মীয় চিন্তাবিদরা নববর্ষ উদযাপনে ধর্মকে টেনে এনে নিজেদের সংকীর্ণ মনোভাব বা মতলবি বয়ান দেননি। কিন্তু সম্প্রতি রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সামনে রেখে নিজেদের আলোর সামনে উপস্থাপন করার জন্য পুরনো অন্ধকার পথ ধরে কোনো কোনো মহল হামলে পড়েছে নববর্ষ ও মঙ্গল শোভাযাত্রা নিয়ে।
যুগ যুগ ধরে মতলববাজরা ধর্মের ধুয়ো তুলে মানুষের স্বাভাবিক ও নান্দনিক জীবনযাত্রাকে জটিল করে তুলেছে। ধর্মের মঞ্চে নায়ক হতে চেয়েছে। পাকিস্তান আমলে বাঙালির বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিল তদানীন্তন ক্ষমতাসীন মহল। পাকিস্তানি সামরিকজান্তা আইয়ুব খান ১৯৬৭ সালে পহেলা বৈশাখ পালনকে হিন্দু সংস্কৃতির প্রভাব বলে আখ্যা দেন। কারণ ক্ষমতাসীনরা দেখতে পায়, এই উৎসব ক্রমে বাঙালির প্রাণের উৎসবে পরিণত হচ্ছে, এর প্রভাবে বাঙালিরা ঐক্যবদ্ধ হচ্ছে। ভাষা ও সংস্কৃতিভিত্তিক এই ঐক্যকে তারা ভয় পায়। তাই তো তারা ধর্মের হাতিয়ার নিয়ে মাঠে নামে। যেহেতু তখন পুরো পাকিস্তানে ইসলাম ধর্মের মানুষ সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিল, তাই কৌশলে পহেলা বৈশাখ পালনকে হিন্দু সংস্কৃতির সঙ্গে মিলিয়ে মুসলমানদের তা থেকে দূরে রাখার চেষ্টা করেছেন। তারা ভেবেছিল এর ফলে হিন্দু-মুসলিম বিরোধ সৃষ্টি হবে আর তারা ওই ফায়দা লুটবে। মূলত আইয়ুব খানের এমন ঘোষণা ছিল বাঙালি জাতির শত বছরের সংস্কৃতির মূলে কুঠারঘাত।
ভাষা আন্দোলনকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করতে ধর্মের বিকৃত ব্যবহার শুরু করে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী। বলা হলো ‘বাংলা’ হিন্দুর ভাষা আর ‘উর্দু’ মুসলমানের। একইভাবে একাত্তরে গণহত্যার সময় পাকিস্তানি সৈন্যদের মগজধোলাই করে জানানো হয়েছে পূর্ব পাকিস্তানের মানুষরা কাফের। এদের খতম করা ইমানি দায়িত্ব।
এরও আগে ১৯৪৯ সালে বাংলা বর্ণমালা সংস্কারের প্রস্তাব দেওয়া হয়। এর কারণ হিসেবে দেখানো হয় যে, বাংলা বর্ণমালায় কিছু সংস্কৃত বর্ণ আছে যেগুলো হিন্দুরা ব্যবহার করে। তাই বাংলাকে সংস্কৃতমুক্ত তথা পবিত্র করার লক্ষ্যে এ ভাষার বর্ণমালার সংস্কারের প্রয়োজন। সচেতন বাঙালিরা আইয়ুব সরকারের ফাঁদে পা দেয়নি। তারা এর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছে। এই পদক্ষেপ ব্যর্থ হলে আইয়ুব খান ১৯৫৯ সালে রোমান হরফে বাংলা ও উর্দু লেখার পদক্ষেপ গ্রহণ করেন এবং একটি কমিটি গঠন করেন। তা ব্যর্থ হলে, ১৯৬৮ সালে আবার রোমান হরফে বাংলা লেখার উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। আইয়ুব সরকারের বিরুদ্ধে সক্রিয় ভূমিকা পালনের অপরাধে সরকার ১৯৬৬ সালে প্রগতিশীল ‘দৈনিক ইত্তেফাক’সহ বেশ কিছু প্রকাশনা নিষিদ্ধ ষোষণা করে।
উল্লখ্য, বাংলায় অসাম্প্রদায়িক সমাজ গড়ে তোলার পেছনে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের উৎসাহ অনুপ্রেরণা হিসবে কাজ করে বিধায় পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকগণ প্রথমে ১৯৬২ সালে পরে ১৯৬৭ সালে রবীন্দ্র সংগীত নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। তারপরও বাঙালিকে দমিয়ে রাখা যায়নি। বীর বাঙালি ভাষা ও সংস্কৃতির চেতনায় বলীয়ান হয়ে নিজস্ব গতিতে এগিয়ে গেছে। কি হিন্দু কি মুসলমান, সবাই কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে একসঙ্গে সামনে এগিয়েছে।
স্বাধীনতার পর পাকিস্তানের প্রেতাত্মারা কিছু দিন ঘাপটি মেরে থাকে। সুযোগ খুঁজতে থাকে আবার ফণা তুলবার জন্য। পঁচাত্তরের ১৫ অগাস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করার মধ্য দিয়ে একাত্তরের পারাজিত শক্তি আবার ঘুরে দাঁড়ায়। একটু একটু করে তারা ভাষাভিত্তিক সংস্কৃতিকে ধর্মের আলখেল্লায় ঢেকে দেওয়ার চেষ্টা করে। তাদের ওই প্রচেষ্টা কখনও থেমে থাকেনি। এদিকে রাজনীতির পালাবদলে কখনও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়। কখনও পাকিস্তানি ভাবাদর্শের সমর্থকরা। কিন্তু ক্ষমতায় গিয়ে কেউই বাঙালি সংস্কৃতিকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরতে পারেনি। বরং ধর্মমুখী যাত্রায় কে কার চেয়ে বেশি এগিয়ে থাকতে পারে, তারই একটা অলিখিত প্রতিযোগিতা লক্ষ করা যায়। এতে করে পুরো সমাজ ব্যবস্থাই ধর্মবাদের দ্বারা আচ্ছন্ন হয়ে ওঠে। বলা বাহুল্য যে, এই ধর্মবাদ পুরোটাই পোশাকি, লোক দেখানো, লোক ঠকানোর জন্য নিবেদিত।
যে পহেলা বৈশাখে রাষ্ট্রীয় ছুটি ঘোষণা করা হয়েছে, যেদিনটি ঘিরে সারাদেশে সীমাহীন প্রাণচাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়, উৎসবের সমারোহে দেশের আবাল-বৃদ্ধ-বণিতা মাতোয়ারা হয়, ওই উৎসবকে ঘিরে ষড়যন্ত্র এখনও দৃশ্যমান। সেই পাকিস্তানের পরাজিত শক্তির দোসররা এখনও পহেলা বৈশাখকে ধর্মের বিরুদ্ধে দাঁড় করিয়ে বক্তব্য দিয়ে চলেছে। এটা হিন্দুয়ানি সংস্কৃতি, বিজাতীয় সংস্কৃতি, ইসলামে এটা না-জায়েজ ইত্যাদি বলে বাংলার মানুষকে আবার বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করছে। ধর্মের দোহাই দিয়ে সাম্প্রদায়িক মনোভাব গড়ে তোলার পাঁয়তারা চালানো হচ্ছে। রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষমতাপ্রত্যাশী এই ধর্মব্যবসায়ীদের প্রধান লক্ষ্য মানুষের মধ্যে বিভেদ ছড়ানো আর ফিতনা-ফ্যাসাদ তৈরি করা। রাজনৈতিক শক্তির প্ররোচনা ও পৃষ্ঠপোষকতায় এই সুবিধাবাদী গোষ্ঠী ক্রমেই সবল ও সতেজ হচ্ছে। তাই পহেলা বৈশাখের মঙ্গল শোভাযাত্রাকে ফ্যাসাদ সৃষ্টির উপলক্ষে পরিণত করা হয়। মঙ্গল শোভাযাত্রায় থাকা প্যাঁচাসহ অন্য সব পাখি আর পশুর মডেলে তারা ‘দৈত্যের আদল’ খুঁজতে শুরু করেছে। মূর্তিপূজার সঙ্গে তুলনা করছে। ভাবখানা এমন যে, আবহমান বাংলায় লক্ষ্মীদেবীর বাহন ছাড়া প্যাঁচার অস্তিত্ব নেই। ইঁদুরের আক্রমণ থেকে মাঠের ফসল বাঁচাতে হলে প্যাঁচাকে দরকার। বিশ্বের অন্যতম ইঁদুর উপদ্রুত এবং বংশবিস্তারকারী এলাকা হচ্ছে গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র অববাহিকা, যার মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। এখানকার উপকূলীয় লোনা ও মিঠাপানির মিশ্রণের এলাকাগুলো ইঁদুরের বংশবিস্তারের জন্য বেশ অনুকূল। ফসলের মাঠ ছাড়াও এ অববাহিকায় অবস্থিত হাট-বাজার ও শিল্পাঞ্চলগুলোতেও ইঁদুরের দাপট বেশি দেখা যায়। ইঁদুর বা ইঁদুরজাতীয় প্রাণীগুলো রাতে চলাফেরা করে। কিন্তু রাতের অন্ধকারে চলাচলের এ কৌশল পেঁচার হাত থেকে এদের রক্ষা করতে পারে না। ইঁদুরেরও প্রয়োজন রয়েছে প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষায়। ইঁদুর আবার গণেশের বাহন। প্যাঁচা ও ইঁদুরের প্রতিকৃতি যদি দোষের হয়, তবে তো বাঙালির সংস্কৃতি থেকে, প্রতিদিনের জীবন থেকে রাজহাঁস, হাতি, গরু এসব আরও অনেক পশুপখিকে নির্বাসন দিতে হবে। কারণ হিন্দু ধর্ম মতে, এসব পশুপাখি কোনো না কোনো দেবদেবীর বাহন।
কিছু ধর্মান্ধ, মূঢ়, ধান্দাবাজের কাছে মঙ্গল শোভাযাত্রা শরীরে জ্বালা ধরায়। হুমকির চিরকুটে লেখা হয়েছে ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা কাজটা শিরকের, এখানে এসে ক্ষতি করো না তোমাদের, হামলা হতে পারে এনিটাইম ঐ দিনের, দাজ্জালী বাহিনী পাবে না টের মোদের।’ ধর্মান্ধদের গাত্রদাহের কারণ হলেও আমাদের মঙ্গল শোভাযাত্রা গোটা বিশ্বের কাছেই আজ সমাদৃত। লাভ করেছে ইউনেসকোর স্বীকৃতিও। এমন একটি সাংস্কৃতিক মিছিল বা শোভাযাত্রার নয়নাভিরাম পোশাকের সমাহার, চিত্রাঙ্কনের উৎকর্ষ, চারুকলার অসামান্য রচনাশৈলী সমগ্র বিশ্বে বিরল ঘটনা।
এটি শুধু একটি শোভাযাত্রা নয়, বাংলার ঐতিহ্য ও শিল্পকলার পারদর্শিতা, শিক্ষা ও সংস্কৃতির প্রতি মানুষের প্রচণ্ড অনুরাগ– সবই প্রকাশ পায় এই শোভাযাত্রার মাঝে। এমন শ্রেষ্ঠত্ব ও আধিক্যে ভরপুর শোভাযাত্রা বিশ্লেষণ করেই ইউনেসকোর বিশারদগণ আন্তর্জাতিকভাবে অভিনন্দিত করেছেন এই শোভাযাত্রাকে এবং তাদের তালিকায় স্থান দিয়েছেন। ভাবতে অবাক লাগে এমন একটি শোভাযাত্রার বিরুদ্ধে এই স্বাধীন দেশে কেউ একজন আইনি নোটিশ পাঠানোর দুঃসাহস দেখায়!
সাতচল্লিশ থেকে একাত্তর পর্যন্ত যারা বাঙালির সংস্কৃতির অধিকার, অর্থনৈতিক অধিকার অস্বীকার করেছে, তাদের প্রেতাত্মারা এখনও বাঙালির সকল অর্জনকে নস্যাৎ করার মোহে মাতোয়ারা। তাই তো এখনও বিভিন্ন ধর্মীয় বক্তা পহেলা বৈশাখ পালনের বিরুদ্ধে ফতোয়া জারি করেন। মঙ্গল শোভাযাত্রার বিরুদ্ধে আইনি নোটিশ পাঠানো এই আইনজীবীকে কে বোঝাবে যে, এ দেশ ধর্মের ভিত্তিতে নয়, গড়ে উঠেছে সংস্কৃতির ভিত্তিতে। যার প্রথম সোপান ভাষা আন্দোলন। প্রথমে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী আমাদের ভাষার ওপর আঘাত করল। তারপর আঘাত করল মর্যাদা, অর্থনীতি এবং স্বাধিকারের ওপর। ধর্মের ভিত্তিতে ভাগ হলে আজও সেই পাকিস্তানেই থাকতাম। আমরা যে স্বাধীন জাতি হিসেবে গর্ববোধ করি, তার ভিত্তিমূল আমাদের সংস্কৃতি। কিছু কিছু স্বার্থান্ধ ধর্মব্যবসায়ী অহেতুক বিতর্কিত করার চেষ্টা করছে ধর্মকে। নানা কৌশলে বিজ্ঞান-রাজনীতি, অর্থনীতি-সংস্কৃতি সবক্ষেত্রেই ধর্মকে মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে একটা অরাজক পরিস্থিতি তৈরির চেষ্টা চলছে। অথচ ধর্ম প্রতিটি মানুষের অন্তরের সাধনার পবিত্র বিষয়। ধর্ম কখনোই আমাদের দেশে সংস্কৃতি চর্চার ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি।
পহেলা বৈশাখে নববর্ষ পালনের বিরুদ্ধে যারা প্রচারণা চালায়, তারা আসলে বাঙালির বিরুদ্ধে, বাঙালি সংস্কৃতির বিরুদ্ধে। পাকিস্তানি ভাবাদর্শ থেকে তারা বের হয়ে আসতে পারেনি। তাদের চিন্তাভাবনার সঙ্গে আইয়ুব সরকারের চিন্তার কোনো ফারাক নেই। আসলে তারা এখনো বাংলাকে মেনে নিতে পারে না, অন্তরে এখনো পাকিস্তান ধারণ করেন। এদেশকে বাংলাস্তান বানাতে চান।
বাংলা ভাষা-সংস্কৃতি ও বাঙালির বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে পাকিস্তানি শাসকরা সুবিধা করতে পারেনি। বাঙালি সংস্কৃতির বিরুদ্ধে যারাই দাঁড়িয়েছে, তারা খড়কুটোর মতো ভেসে গেছে। নানা ষড়যন্ত্র, বিভেদ-বিভ্রান্তির পরও বাঙালি এখনও বীরের জাতি। অনেক বেশি সচেতন। তারা কখনোই শত বছরের সংস্কৃতি ধ্বংস হতে দেবে না। ১৯৬৭ সালে আইয়ুব সরকার যা করতে পারেনি, আজ ২০২৩ সালে এসে আইয়ুবের প্রেতাত্মারা কীভাবে তা পারবে?