কেউ মারা গেলে তার বন্দনা আর কীর্তির কথা বলাটা আমাদের জাতীয় স্বভাব। জীবিতাবস্থায় কেউ এসব মনে রাখে না।
Published : 20 Apr 2024, 03:49 PM
শিব নারায়ণ দাশ মারা গেছেন। আমি জানি আজকের প্রজন্মের অনেকেই তাকে চেনে না। নামও শোনেনি। কীভাবে জানবে তারা? যারা জানানোর কথা, বলার কথা, লেখার কথা— তারা কি সেটা করেছেন? করেননি বলেই একা হারিয়ে গেলেন বাংলাদেশের প্রথম পতাকার অন্যতম নকশাকার।
বর্ণাঢ্য জীবন কাকে বলে? যে মানুষটি শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের হাত ধরে রাজনীতিতে এসেছিলেন তিনি আদর্শিক মানুষ হবেন এটাই স্বাভাবিক। ভাষাসংগ্রামী ও মুক্তিযুদ্ধের শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের হাত ধরে রাজনীতিতে আসেন শিব নারায়ণ দাশ। ১৯৬২ সালের শিক্ষা আন্দোলন অংশগ্রহণ করে কারাবরণ করেন তিনি।
১৯৭০ সালের ৭ জুন তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের রাজধানী ঢাকার পল্টন ময়দানে অনুষ্ঠিত ছাত্রদের এক সামরিক কুচকাওয়াজে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অংশগ্রহণের কথা। এই লক্ষ্যে ছাত্রদের নিয়ে একটি জয়বাংলা বাহিনী, মতান্তরে ‘ফেব্রুয়ারি ১৫ বাহিনী’ গঠন করা হয়। ছাত্রনেতারা এই বাহিনীর একটি পতাকা তৈরির সিদ্ধান্ত নেন। ৬ জুন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্জেন্ট জহুরুল হক হলের (তৎকালীন ইকবাল হল) ১০৮ নং কক্ষে ছাত্রলীগ নেতা আ স ম আবদুর রব, শাহজাহান সিরাজ, কাজী আরেফ আহমেদ, মার্শাল মনিরুল ইসলাম পতাকার পরিকল্পনা নিয়ে বৈঠকে বসেন। এ বৈঠকে আরও উপস্থিত ছিলেন ছাত্রলীগ নেতা স্বপন কুমার চৌধুরী, জগন্নাথ কলেজের ছাত্রলীগ নেতা নজরুল ইসলাম, কুমিল্লা জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ও কেন্দ্রীয় ছাত্রনেতা শিব নারায়ন দাশ, প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সাধারণ সাধারণ সম্পাদক হাসানুল হক ইনু ও ছাত্রনেতা ইউসুফ সালাউদ্দিন।
সভায় কাজী আরেফের প্রাথমিক প্রস্তাবনার ওপর ভিত্তি করে সবার আলোচনা শেষে সবুজ জমিনের ওপর লাল সূর্যের মাঝে হলুদ রঙের বাংলার মানচিত্রখচিত পতাকা তৈরির সিদ্ধান্ত হয়। কামরুল আলম খান (খসরু) তখন ঢাকা নিউমার্কেটের এক বিহারী দর্জির দোকান থেকে বড় এক টুকরো সবুজ কাপড়ের মাঝে লাল একটি বৃত্ত সেলাই করে আনলেন; এরপর বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের কায়েদে আজম হল (বর্তমানে তিতুমীর হল)-এর ৩১২ নং কক্ষের এনামুল হকের কাছ থেকে অ্যাটলাস নিয়ে ট্রেসিং পেপারে আঁকা হলো পূর্ব পাকিস্তানের মানচিত্র। শিব নারায়ণ দাশ পরিশেষে তার নিপুণ হাতে মানচিত্রটি আঁকলেন লাল বৃত্তের মাঝে, এমনি করে রচিত হলো ‘ফেব্রুয়ারি ১৫ বাহিনী’র পতাকা। যা কিছুদিন পর বাংলাদেশের প্রথম পতাকা হিসেবে স্বীকৃত হয়।
শিব নারায়ণ দাশ দেশ স্বাধীনের পর জাসদের নেতা হয়েছিলেন। সাম্যবাদ আর সমাজতন্ত্রের জন্য তখনকার তরুণ-তরুণীদের ভেতর প্রবল জনপ্রিয় এই দলটি নিয়ে আপনি যত তর্ক-বিতর্ক করেন না কেন, সত্য এই জাসদের জোয়ার ছিল ওই সময়। যে জোয়ারে আওয়ামী লীগের ছাত্রসংগঠন ছাত্রলীগ ভেসে যেত প্রায়ই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তথা ডাকসুর নির্বাচনের ফলাফলও বলবে ওই কথা। ওই প্রবল জোয়ারের কালে শিব নারায়ণ দাশও ভেবেছিলেন সমাজ পরিবর্তন হতে বাধ্য। পরের ঘটনা আমরা সবাই জানি। প্রতিবিপ্লব আর পথ হারানোর যুদ্ধে ক্লান্ত জাসদ হারিয়ে গিয়েছে। তাদের তেমন কোনো অস্তিত্ব এখন আর নেই। তাদের নেতাদের অনেকেই ভোল পাল্টে কেউ আওয়ামী লীগে, কেউ আবার বিএনপিতে। আর শিব নারায়ণ দাশ? যে তিমির বিনাশের জন্য সংগ্রাম করেছিলেন সে তিমিরেই ডুবে ছিলেন। অবশেষে হারিয়ে গেলেন।
কেউ মারা গেলে তার বন্দনা আর কীর্তির কথা বলাটা আমাদের জাতীয় স্বভাব। জীবিতাবস্থায় কেউ এসব মনে রাখে না। মনে আছে, চট্টগ্রামে মাইন উদ্ধার কাজে নিয়োজিত দুজন রাশিয়ান বীরের কথা। একাত্তরে পাকিস্তানিদের পুঁতে যাওয়া মাইন না সরালে বহু মানুষের প্রাণহানি হতে পারত। ওই মানুষ দুজনের জন্য নামকাওয়াস্তে কিছু একটা করা হলেও আজ আর কেউ তাদেরকে মনে রাখেনি। ভারতীয়সহ যেসব বিদেশী সৈন্য জীবন দিয়ে এদেশ স্বাধীন করেছিলেন তাদের কথাও মনে রাখে না কেউ। রাখে না বলতে রাখানোর কোনো চেষ্টাও নেই আসলে।
আমি যে দেশে বসবাস করি ওই দেশের একজন ডাচ-অস্ট্রেলিয়ান মুক্তিযোদ্ধা বীরপ্রতীক ওডারল্যান্ড। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের একমাত্র বিদেশী বীরপ্রতীক। তার কথা কি সেভাবে প্রচার করা হয়? এই ভদ্রলোকের সঙ্গে কথা বলতে পেরেছিলাম আমি। নিদারুণ কষ্ট আর যন্ত্রণা ছিল তার বুকে। অস্ত্র হাতে যুদ্ধ শুধু না জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তথ্য প্রদানসহ গেরিলাদের ট্রেনিং দিতেন তিনি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে আক্রান্ত নাৎসিদের হাতে বন্দী ওই তরুণ তার সর্বশক্তি আর অভিজ্ঞতা দিয়ে আমাদের সাহায্য করলেও আমরা মনে রাখি না। আজ তিনিও জীবনের ওপারে।
এই দেশটির জন্য সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করা মানুষজনই অবহেলিত, যোদ্ধা, বীর তাদেরই খবর নেই আর শিব নারায়ণ দাশ! ভদ্রলোক একসময় চট্টগ্রামের নন্দন কাননে এসে থেকেছিলেন কিছুকাল। দেখতে যতটা তার চেয়ে অনেক বেশি আকর্ষণীয় ছিলেন কথায়। তিনি যে বাংলাদেশের প্রথম পতাকার অন্যতম নকশাকার, এটা সবাই জানত। পতাকা সেলাই করার ছবিও আছে। তাতে কী?
বঙ্গবন্ধু যে স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছিলেন, তাজউদ্দীন আহমদ যে প্রথম প্রধানমন্ত্রী আপনি জানেন না? একইভাবে শিব নারায়ণ দাশকেও মনে রাখা হয়নি।
মাঝে মাঝে হতাশ হয়ে পড়ি। আজকাল মনে হয় এতটা আত্মবিস্মৃত জাতি কি আসলেই তার মূল জায়গায় পৌঁছতে পারবে কোনোদিন? এটা কি বিস্মৃতি না অকৃতজ্ঞতা? আজ এই প্রশ্নের উত্তর জানা জরুরি হয়ে পড়েছে। এভাবে চলে? জীবদ্দশায় কেবল চতুর আর ধূর্ত মানুষজনের আস্ফালন, একের পর এক তাদের পদক-পুরস্কার-স্বীকৃতি দেখতে দেখতে ক্লান্ত জাতি বুঝতেই পারছে না তার রত্নভাণ্ডার খালি হয়ে আসছে। একসময় আর এমন কেউই থাকবে না যাকে বা যাদের দেখে আশা পথ খুঁজে পাবে। আমাদের জীবন ও ভবিষ্যতের পথ দেখানো মানুষগুলোর এমন পরিণতি কামনা করিনি কেউ। এই দেশ কেবল ধনী চতুর আর স্তাবকের দেশ হবে এমনটা ভাবনায় আসেনি কারও।
শিব নারায়ণ দাশ তবু আপনাকে শ্রদ্ধা। তবু প্রণাম।
‘এর যত মূল্য সে কি ধরার ধুলায় হবে হারা...’