শিল্পী আসমা সুলতানা ইতিহাসের সংক্ষিপ্ত অথচ ভয়াবহ রক্তক্ষয়ী স্বাধীনতা যুদ্ধের সেই নয় মাসকে তুলনা করেছেন কোনো ছোটগল্পের মতো, সংক্ষিপ্ত কিন্তু গভীর। সেই যুদ্ধে আমরা বাংলাদেশীরা সবাই কিছু না কিছু হারিয়েছি।
Published : 26 Jul 2023, 06:53 AM
টরোন্টোর পূর্ব দিকে ইন্ডিয়া বাজারের মধ্য দিয়ে অতিক্রম করা জেরার্ড স্ট্রিটে খানিকটা ঢুকতেই আপনার হাতের বাম পাশে পড়বে জেরার্ড আর্ট স্পেস (Gerrard Art Space)। এখানেই হচ্ছে শিল্পী আসমা সুলতানা ত্রয়োদশ একক শিল্পকলা প্রদর্শনী ‘লং লস্ট লালাবাই’ (বিস্মৃত ঘুমপাড়ানি গান)। কৌতূহলী যারা রাস্তা থেকে শিল্পের এই পরিসরে প্রবেশ করবেন, গ্যালারির ছাদ থেকে মেঘের মতো ঝুলে থাকা শিশুদের সাদা জামার গোলক ধাঁধার মধ্যে তাদের প্রবেশ করতে হবে, আর এখান থেকে কেউই প্রশ্ন কিংবা উত্তর না নিয়ে ফিরে যেতে পারবেন না। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে শিল্পী, বন্ধু আর শুভনুধ্যায়ীদের ভিড়ে জীবন্ত হয়ে ওঠা বিস্মৃতির সঙ্গে স্মৃতির সংযোগ ঘটিয়েছে। বিস্মৃতি থেকে স্মৃতি উদ্ধারের সংগ্রামের এই শৈল্পিক রূপটি বহু দর্শককে আবেগতাড়িত করেছে—যাদের মধ্যে ছিল শিশুরাও। প্রদর্শনীর নামও একইভাবে আকর্ষণ করেছে আগ্রহীদের।
বাণিজ্যিক কিংবা স্লোগাননির্ভর শিল্পকলা সৃষ্টি করা থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়া আসমার এবারের প্রদর্শনীও একটি একক ধারণাগত পরিপ্রেক্ষিতের প্রতিনিধিত্ব করছে। পুরো প্রদর্শনীর শিল্পকর্মগুলোর সমন্বয় শিল্পীর অভিব্যক্তির সার্বিক একটি রূপ সৃষ্টি করেছে। আর এবারের সেই অভিব্যক্তি ঘিরে আছে আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের ক্রমশ বিস্মৃত হতে থাকা একটি ইতিহাস—নিহত, নির্যাতিত, নির্বাসিত, অবহেলিত শিশুরা। ধারণা করা হয় আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধে শহীদ হয়েছিল প্রায় চার লাখ শিশু, আর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর ধর্ষণের শিকার হওয়া নারীদের অর্ধেকই ছিল কিশোরী, যারা মূলত শিশুই। খুব রক্ষণশীল একটি হিসেবেও এটি স্পষ্ট যে প্রায় চার লাখ নারী ধর্ষিত হয়েছিল।
আর এদের মধ্যে গর্ভবতী হয়েছিল কত জন ওই প্রকৃত সংখ্যাটি দুর্জ্ঞেয় থেকে অজ্ঞেয় একটি বাস্তবতায় রূপান্তরিত হবার প্রক্রিয়ায় আছে। ধারণা করা হয় এই সংখ্যা প্রায় তিন লক্ষ স্পর্শ করেছিল। ভারতে কিংবা গোপনে অনেকে সন্তানের জন্ম দিয়েছেন, এর বাইরে অসংখ্য গর্ভপাত হয়েছে। গর্ভপাত সম্ভব হয়নি এমন শিশুরা ‘যুদ্ধ শিশু’ হিসেবে জন্মগ্রহণ করেছিল। কানাডিয়ান ইউনিসেফের একটি রিপোর্টে ১০ হাজার যুদ্ধশিশুর কথা উল্লেখ করা হয়েছে। সুসান ব্রাউনমিলারের মতে সন্তান জন্ম দিয়েছিলেন এমন বীরাঙ্গনার সংখ্যা কমপক্ষে ২৫ হাজার। এই ভয়ঙ্কর ইতিহাসের প্রকৃতি এখনো উন্মোচনের অপেক্ষায় আছে। ক্ষমা চায়নি এই অননুতপ্ত নৃশংস ধর্ষক গণহত্যাকারীরা। আজও স্বীকৃতি পায়নি বিশ শতকের ভয়াবহ একটি গণহত্যা।
গ্যালারির ছাদ থেকে ঝুলে থাকা জামাগুলো সব বাংলাদেশ থেকে সংগৃহীত সাদা কাপড় দিয়ে তৈরি, গ্যালারি আলোকসম্পাত সেগুলোকে শুভ্র শুদ্ধতা আর নিষ্কলুষতার একটি জ্যোতির্বলয় দিয়ে ঘিরে রেখেছে। এগুলো সেলাই করতে শিল্পী তার নিজের মাথার চুলকেই সুতা হিসাবে ব্যবহার করেছেন। নির্ভার, নিষ্কলঙ্ক শিশুদের অনুপস্থিত শরীরের প্রতীক হয়ে সেগুলো ভাসছে দর্শকের দৃষ্টিসীমার নানা স্তরে। শিল্পকর্মে চুলের ব্যবহার করে আসছেন আসমা দীর্ঘদিন থেকে। তার কাজে চুল ব্যবহৃত হয়েছে প্রায়শই সূচিকর্ম, বর্ণমালা, প্রতিকৃতি সৃষ্টিতে—তার আত্মপরিচয়ের অবিচ্ছেদ্য একটি অংশ হিসেবে। শিল্পী আসমা সুলতানা বলেন, ‘আমার চুল আমার ডিএনএ বহন করে, আর আমার শিল্পকর্মগুলো হচ্ছে আমার সেই আত্মপরিচয়ের সিলমোহর। আমার মাথার চুল হচ্ছে আমার শিল্পকলার উপকরণ, আর সাদা কাপড় হচ্ছে পরিসর কিংবা কখনো নিজের ব্যবহৃত চিরুনি, ছবি আঁকার তুলি বা অন্য কোনো আটপৌরে সরঞ্জাম। আমার অভিব্যক্তির প্রকাশ এতটাই সরল। আমরা শিল্পকর্মগুলো আত্মজৈবনিক—বৈচিত্র্যময় সাংস্কৃতিক-ভৌগোলিক পরিবেশে নিজের আত্মপরিচয় খুঁজে নেবার সংগ্রাম। মানুষ হিসেবে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর নিরন্তর যুদ্ধ, অপমান, বঞ্চনা আর আত্মত্যাগের নানা আখ্যানের প্রতীকী রূপ খুঁজে বেড়ায় আমার শিল্পকর্ম।’
আপনি নিচ থেকে ভাসমান জামাগুলোর ঘিরে থাকা শূন্যস্থানগুলো দেখতে পারবেন, বাইরে থেকে সেই দৃশ্যের ফ্রেমের ভেতরে আপনি প্রবেশ করতে পারবেন অস্বস্তিকর একটি প্রশ্ন নিয়ে—এদের কথা কি আমরা আসলেই ভুলে গেছি?
ঢুকতেই বাম দেয়ালে আমরা একটি শূন্য জামা দেখি সেখানে কোনো অবয়ব নেই, এর ওপর শিল্পী হাতে বাংলা বর্ণমালায় লিখেছেন, যুদ্ধাপরাধী আদালতে সাক্ষীর জবানবন্দি থেকে নিয়ে কিছু বাক্য। এর পাশেই আছে আরেকটি জামা, যেখানে শিল্পী চুলের সূচিকর্মে ইংরেজি বাক্যে অ্যানা ফ্রাঙ্কের একটি উপলব্ধি প্রতিধ্বনিত করেছেন, ‘জামার চেয়ে স্মৃতি আমার কাছে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ’। বিপরীত দেয়ালে ঝুলে আছে ঘুমপাড়ানি গান লেখা দুটি তালপাতার হাতপাখা, শিল্পী যা শিল্পকর্ম রূপান্তরিত করেছেন সতর্কভাবে পুড়িয়ে আঁচড় কেটে, দহনের ক্ষত যেন সেই স্মৃতিবহ যন্ত্রণাকে দর্শকের চোখের সামনে তুলে ধরছে। এর পাশেই আছে দীর্ঘ একটি শাড়ি, যেখানে পুড়িয়ে লেখা হয়েছে ভয়াবহ একটি জবানবন্দির একটি চুম্বক অংশ, আপনি চাইলে সেই শাড়ি উল্টে দেখতে পারেন, পোড়ানো অংশ গলে আলো সেই ভয়ঙ্কর স্মৃতিবহ শব্দগুলোকে দেয়ালে মূর্ত করে রেখেছে।
আরেকটু অগ্রসর হলে বিশাল কাগজের ওপর সার্চলাইট থেকে বেরিয়ে আসা আলোকরশ্মির একটি ট্রাপিজয়েড আকৃতির রেখাচিত্র, যার পুরো ক্ষেত্রটি আন্দোলিত হচ্ছে অসংখ্য বৃদ্ধাঙ্গুলির ছাপে। বাংলাদেশের ইতিহাসের সঙ্গে পরিচিতদের কাছে সার্চলাইট শব্দটির ভয়াবহতা অবিস্মরণীয়। কালি আর আঙ্গুলের ব্যবহারে সাদা কাগজের ওপর একের পর এক স্তরে কালো রঙের নানা ঘনত্বের অসংখ্য বৃদ্ধাঙ্গুলির ছাপ। আঙ্গুলের ছাপ খুবই ঘনিষ্ঠ একটি অনুকরণীয় আত্মপরিচয়, শিল্পী যেন সেই বহু লক্ষ শিশুকে জীবন্ত করতে চেয়েছেন তাদের একটি চিহ্নে রূপান্তরিত করে। দুই পাশের দুই দেয়ালে আঙ্গুলের ছাপের বিশাল দুটি ড্রইং আসলেই সেই ভাসমান জামাগুলোর প্রেক্ষাপট তৈরি করেছে। আমরা এগুলোর ওপর ঝুলন্ত জামাগুলোর ছায়ার নানা ধরনের রূপ সৃষ্টি করতে দেখি। শিল্পী সেই সব শিশুদের হয়ে চিহ্ন এঁকে রেখেছেন, তাদের অস্তিত্বের সাক্ষ্য হিসেবে। তালপাতার হাতপাখায় আবার আমরা ফিরে আসি, পুড়িয়ে লেখা নানা ছড়া, ঘুমপাড়ানি গান…জাতীয় সংগীত। যে তালপাতার পাখা মায়ের হাতে দুলত, এই শিশুরা যা আর কোনোদিনও পাবে না। আমরা সেখানে দেশ থেকে নির্বাসিত এক যুদ্ধশিশুর জবানবন্দির কিছু অংশ দেখি। মায়ের জরায়ুই ছিল যাদের সর্বশেষ স্বদেশের ঠিকানা।
আসমার এবারের প্রদর্শনীটি দর্শকদের আবেগীয় স্তরে খুবই আলোড়ন তোলে। কানাডার দর্শকরাও নতুন কিছু ইতিহাসের মুখোমুখি হয়েছেন। পরিত্যক্ত যুদ্ধ শিশুদের দত্তক নিতে কানাডা উদ্যোগী হয়েছিল প্রথম।
১৯৭২ সালে কানাডার সমাজকর্মী বনিকাপুচিনোর সংগঠন ‘ফ্যামিলিজ ফর চিলড্রেন’ ১৫ জন যুদ্ধশিশুকে কানাডায় নিয়ে এসেছিল। পরে এই পথ ধরেই যুদ্ধশিশুদের পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে দত্তক হিসেবে গ্রহণ করার কার্যক্রম শুরু হয়েছিল। ‘৭১-এর যুদ্ধশিশু: অবিদিতইতিহাস’ গ্রন্থে গবেষক মুস্তফা চৌধুরী আমাদের স্মরণ করিয়ে দেন, ‘যে যুদ্ধ শিশুরা মানবিক বিবেচনার দুগ্ধধারা থেকে বঞ্চিত হয়েছিল, তারা যে মর্মবিদারী দুঃখ পেয়েছিল, তার খবর কেউ জানে না। কেউ সে বিষয়ে জানার ইচ্ছা পোষণ করে কিনা, সে প্রশ্নের উত্তরও আমাদের জানা নেই।’
আসমা সুলতানা ইতিহাসের সংক্ষিপ্ত অথচ ভয়াবহ রক্তক্ষয়ী স্বাধীনতা যুদ্ধের সেই নয় মাসকে তুলনা করেছেন কোনো ছোটগল্পের মতো, সংক্ষিপ্ত কিন্তু গভীর। সেই যুদ্ধে আমরা বাংলাদেশীরা সবাই কিছু না কিছু হারিয়েছি। আমরা শুধু আমাদের প্রিয়জনকেই হারাইনি বরং হারিয়েছি সেই যুদ্ধশিশুদের যারা মায়ের মুখ দেখবার আগেই মৃত্যুবরণ করেছে। যুদ্ধশিশুদের মায়েরা হারিয়েছে তাদের সম্ভ্রম এবং সন্তান, তাদের নিজেরই জঠরে। যেখানে মায়ের কোল নিরাপদ আশ্রয় হবার কথা ছিল অথচ তাদের মায়েদের জঠর হয়েছে তাদের সমাধিস্থান। আর যারা এই ভয়াবহ গণহত্যার মাঝেও বেঁচে ছিল তাদের পাড়ি দিতে হয়েছিল ভিনদেশে কোনো বিদেশী মা-বাবার ঘরে পালিত সন্তান হয়ে। আমাদের মানচিত্র, পতাকা, মাটি এবং আত্মপরিচয়ের জন্য আমরা এইসব শিশুদের কাছে ঋণী।
শিল্পী তার বার্তায় স্মরণ করিয়ে দেন, ‘আমরা ভুলে গেছি তাদের বিসর্জনের কথা, আমরা আত্মপরিচয়ের গ্লানি নিয়ে বেঁচে আছি বিস্মৃতির পথে হারিয়ে গিয়ে। আমাদের স্মৃতি, দৃষ্টি সবকিছু ঘোলাটে হয়ে গেছে রাজনীতি এবং জীবনদর্শন দ্বারা। আমরা আগের মতো শিশুদের ঘুমপাড়ানি গান গেয়ে আর ঘুম পাড়াই না। আমরা ঘুমন্ত এক জাতি হিসেবে নিজেদের আত্মপরিচয়কে ভুলে যেতে বসেছি, ভুলে যেতে বসেছি যুদ্ধশিশুদের আত্মবলিদান। সে কারণে আমাদের ঘুমপাড়ানি গান গেয়ে ঘুম পাড়াতে নয়, ঘুম ভাঙাতে হবে। আজ সময় এসেছে আমাদের পেছনে ফিরে দেখার, ইতিহাসকে আরও একবার বিশ্লেষণ করে দেখার, যেন আমরা আমাদের ইতিহাসকে বিশ্বের সামনে উপস্থাপন করতে পারি।’
বাংলাদেশীদের আমন্ত্রণ জানানো হলেও দ্বিতীয় বাংলাদেশী হিসেবে এই প্রদর্শনীতে আমি উপস্থিত ছিলাম। কিন্তু আমি বিস্ময়ের সঙ্গে দর্শকদের জানার আগ্রহ লক্ষ্য করেছি। আর আসমার উদ্দেশ্য ছিল এটাই, সেই সত্যিকারের কাহিনিটি জানানো, যারা সেটি জানতে চায়। আর যারা ভুলে যেতে চায়, তাদের স্মরণ করিয়ে দেয়া যে ঘুমপাড়ানি এই গান যেন আমাদের সত্য প্রতিষ্ঠা করতে জাগিয়ে তোলে, নতুন আত্মবিশ্বাসী আত্মপরিচয়ের অনুসন্ধানে প্ররোচিত করে।
আসমা সুলতানা জন্মসূত্রে একজন বাংলাদেশী-ব্রিটিশ শিল্পী, বর্তমানে কানাডায় বসবাস ও স্বাধীনভাবে দৃশ্য শিল্পের চর্চা করছেন। বাংলাদেশে অঙ্কন ও চিত্রায়ণ বিভাগে স্নাতক ডিগ্রি অর্জনের পর তিনি লন্ডন ও টরোন্টো শহরে চারুকলা ও শিল্পকলার ইতিহাস বিষয়ে পড়াশোনা করেন। এছাড়াও বর্তমানে তিনি টরোন্টোর ইয়র্ক ইউনিভার্সিটি এবং ইংল্যান্ডের অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটিতে শিল্পকলার ইতিহাস বিষয়ে পড়াশোনা করছেন। স্বাধীন শিল্পী হিসেবে এর আগে তিনি কানাডা, যুক্তরাজ্য, ভারত ও বাংলাদেশে কিছু একক ও বেশকিছু যৌথ শিল্প প্রদর্শনীতে অংশ নিয়েছেন। যুদ্ধশিশু নিয়ে তার শিল্পকলা প্রদর্শনীটি চলবে ৬ অগাস্ট পর্যন্ত প্রতিদিন দুপুর দুইটা থেকে সন্ধ্যা সাতটা পর্যন্ত।