সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য ও একজন চন্দ্রকান্ত মুড়াসিং

যেখানে আপনার ভাষাই থাকল না, সেখানে আপনার সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য আর সাহিত্য কী, আপনার আত্মপরিচয় কী? ভাষা হারিয়ে আপনিই তো আর আপনি নাই। সেখানে আপনার আবার সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য কী?

আনিসুর রহমানআনিসুর রহমান
Published : 21 May 2023, 11:42 AM
Updated : 21 May 2023, 11:42 AM

প্রতিবছর সাংস্কৃতিক উন্নয়ন আর আন্তঃসাংস্কৃতিক সংলাপের ধারণাকে এগিয়ে নেবার জন্যে ২১ মে ‘বিশ্ব সাংস্কৃতিক দিবস’ উদযাপন করা হয়। আজ থেকে দুই দশক আগে ২০০২ সালে জাতিসংঘ দিনটিকে দুনিয়াব্যাপী উদযাপনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। এবছরও দেশে দেশে দিনটি উদযাপিত হচ্ছে। কিন্তু তাতে কি সংস্কৃতির বৈচিত্র্য রক্ষার আকুতি হালে পানি পাচ্ছে? নাকি সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য দিন দিন হুমকির মুখে পড়ছে? সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যের বিরুদ্ধে আদতে হুমকি কী কী?

দেশে দেশে সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যের আদিশত্রু সাম্রাজ্যবাদ বা উপনিবেশবাদ বা দখলদারিত্ব। এই উপনিবেশবাদ বা দখলদারিত্ব এখন আর বাইরে থেকে আসার দরকার পড়ে না। আপনার পাশের বাড়ির ভাইয়েরা যদি আপনার থেকে ক্ষমতাধর হয় এবং তাদের যদি খায়েশ থাকে যে কোনো প্রকারে ছলে বলে কলে কৌশলে আপনাকে ভিটেছাড়া করার এবং কার্যত যদি তা করে, তাহলে আপনার জীবনমান আর সংস্কৃতি কোথায় গিয়ে ঠেকবে?

কালে কালে দুনিয়ার নানা প্রান্তে এমনটাই হয়ে আসছে। মোদ্দাকথা ঠগবাজি। এই ঠগবাজি ইউরোপ এবং দুনিয়ার অপরাপর অংশের বেনিয়ারা করেছেন। এখনো করে চলেছেন, কখনো কোনো দেশ বা অঞ্চল দখল করে, কখনোবা দখল না করেই, অন্য কায়দায়। আর এই কায়দার শানে-নজুল হচ্ছে সামরিক বেসামরিক ক্ষমতা পুঁজি এবং প্রযুক্তি। এর সিলসিলার খপ্পরে পড়ে পৃথিবীর দেশে দেশে সংখ্যায়লঘু নৃগোষ্ঠীর মানুষেরা তাদের ভিটে-মাটি, প্রাণ-প্রকৃতি আর সংস্কৃতি রক্ষার সংগ্রামে নাস্তানাবুদ। এই চিত্র মধুপুরের গজারি জঙ্গল ঘেরা লালমাটির গারো জনপদ থেকে শুরু করে স্ক্যান্ডিনেভিয়া অঞ্চলের সামি, চীনের উইঘুর, বার্মার রোহিঙ্গাসহ শতশত নৃগোষ্ঠীর মানুষ যেমন রয়েছে, রয়েছে আরও নানা দেশের মানুষের আত্মপরিচয় টিকিয়ে রাখার হৃদয়ে রক্তক্ষরণের ইতিহাস। তেমনই গোটা আফগানিস্তান দেশটাই তালেবানি খপ্পরের কাছে আজ নাস্তানাবুদ।

যেখানে জীবন ও দেশটাই এক অলীক স্বপ্ন, দুমুঠো অন্ন আর এক পেয়ালা জল অধরা সেখানে সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য বা সৃজনশীল কর্ম হিসেবে সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যের প্রকাশ বা প্রকাশের স্বাধীনতা বড়ই বেমানান শোনা যেতে পারে। এই মাসের শুরুর দিকে স্টকহোমে অনুষ্ঠিত শিল্পকলা ও সংস্কৃতি বিষয়ে নবম বিশ্ব সম্মেলনে আফ্রিকি ইউনিয়নের ঊর্ধ্বতন সংস্কৃতি কর্মকর্তা দারুস সালাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাবিদ তানজানিয়ার নাগরিক ভিসেনসিয়া সুলে এই সত্যকে ইঙ্গিত করে পর্যবেক্ষণ তুলে ধরেছিলেন।

এই পর্যায়ে একটি তথ্য জানিয়ে রাখতে চাই। প্রতি ১৪ দিনে একটি ভাষা মারা যায়। পরবর্তী শতাব্দীর মধ্যে পৃথিবীতে কথিত প্রায় সাত হাজার ভাষার অর্ধেকই সম্ভবত বিলীন হয়ে যাবে। এইসব ভাষায় কথা বলার মানুষগুলো ইংরেজি, ম্যান্ডারিন বা স্প্যানিশ ভাষার আগ্রাসনে ঢুকে পড়বে। যেখানে আপনার ভাষাই থাকল না, সেখানে আপনার সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য আর সাহিত্য কী, আপনার আত্মপরিচয় কী? ভাষা হারিয়ে আপনিই তো আর আপনি নাই। সেখানে আপনার আবার সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য কী?

আমাদের দেশের কথাই বলি। আমরা বারোয়ারি শিক্ষাব্যবস্থার মধ্যে অভিজাতদের জন্যে চালু করেছি ইংরেজি মাধ্যমের শিক্ষা। দেশে বিরাজমান অপরাপর চল্লিশ থেকে পঞ্চাশের মতো আদিবাসী ভাষার কথা তো দূরের কথা, আমরা তো বাংলার মর্যাদাই রক্ষা করিনি। অবস্থাটা কি এমন হয়ে যাচ্ছে না ‘তাহলে সাহেবদের জয়ধ্বনি করে, চলুন বঙ্গভূমে আমরা সবাই 'ইংরেজ' হয়ে যাই! সারা বছর ইংরেজির পায়ে পড়ি আর একুশে ফেব্রুয়ারি এবং পহেলা বৈশাখে দলবেঁধে ন্যাকামো করি।'

আপনার পরিচয় হারিয়ে নাই হয়ে যাওয়ার বাস্তবতায় সুযোগ না হয়ে আরেক আপদ বা বিপদ হচ্ছে পুঁজি এবং প্রযুক্তি। পুঁজি এবং প্রযুক্তি যখন মানুষকে রক্ষার পরিবর্তে প্রাণে মনে মানুষকে দুমড়েমুচড়ে মুনাফা আর দখলের উপাদান মনে করে, সেখানে তার ভাষাটি আর রক্ষা পায় কেমনে? ছোট্ট একটি উদাহরণ দেই। প্রযুক্তি 'দানব' গুগলের কি সাধ্য আছে পৃথিবীর বিরাজমান সাত হাজার ভাষায় গুগল অনুবাদ সেবা দেয়ার? কিংবা নবাগত 'দানব' কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার কি এমন ক্ষমতা আছে মান্দি বা চাকমা কিংবা মারমা ভাষায় আপনাকে খবরদারি দেখাবে? দুনিয়ার বিপন্ন মানুষ এবং ভাষার পক্ষে পুঁজি এবং প্রযুক্তি কোনোটাই কাজে আসছে না। আদতে পুঁজি এবং প্রযুক্তি সাম্রাজ্যবাদী ভাষাগুলোর খবরদারি আরও বাড়াবে এবং শত শত নৃগোষ্ঠীর ভাষাকে হুমকির মুখে ঠেলে দেবে।

এরকম অভিজাত আগ্রাসন আর ন্যাকামোর বিপরীতে ঊনবিংশ শতাব্দীতে অবস্থান নিয়েছিলেন নরওয়ের নাট্যকার হেনরিক ইবসেন। দেশটি ছিল দিনেমার প্রদেশ। এমনকি রাজধানী অসলোর নাম পাল্টে ডেনমার্কের দখলদার রাজা ক্রিস্টিয়ানিয়ার নামানুসারে অসলোর আরোপিত নাম রাখা হয় ‘ক্রিস্টিয়ানিয়া’। দেশটিতে চালু হয়েছিল দখলদার ড্যানিশ রীতিনীতি। এমনকি লেখালেখির চলটাও শুরু হয়েছিল ড্যানিশ ভাষার আদলে।

ইবসেন ধরলেন আত্মমর্যাদা আর আত্মপরিচয় রক্ষার পথ। তিনি লেখালেখি শুরু করলেন নরওয়ের মানুষের মুখের ভাষায়। ওই সময় দেশটির জনসংখ্যা ছিল দেড় লাখের মতো। আজকে দেশটির জনসংখ্যা অর্ধ কোটিরও কম। কিন্তু দেশের সংস্কৃতি ও ভাষার নীতিনির্ধাকরা কিন্তু ইবসেন থেকে শিখেছেন। আধুনিক নরওয়েতে নিজের ভাষার মর্যাদা যেমন রয়েছে তেমনি নাই অহেতুক ইংরেজির ফুটানি।

একজন কবিকে মনে করা হয় সত্যের মশাল প্রজ্জ্বালনকারী। ওই মশাল যেমন তার সময়ে ইবসেন জ্বালিয়েছিলেন, তার সময়ের আগেও দেশে দেশে আরও অনেক দৃষ্টান্ত ছিল। আমাদের এই প্রান্তেও ছিলেন লালন, রবীন্দ্রনাথ, নজরুলের মতো মনীষীরা। এবার আমাদের ঘরের কাছের এক্কেবারে আমাদের সময়ের উদাহরণ দিতে চাই।

সম্প্রতি প্রয়াত হয়েছেন ত্রিপুরার ককবরক ভাষার কবি চন্দ্রকান্ত মুড়াসিং। যার সঙ্গে বাংলাদেশের নিবিড় যোগাযোগ ছিল। ১৯৯০ দশকের শেষের দিকে আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষার্থী এবং জহুরুল হক হলের আবাসিক ছাত্র। কবি সমুদ্র গুপ্ত এবং হলের আবাসিক শিক্ষক, কবিতা পরিষদের কর্তাদের একজন ডক্টর মুহাম্মদ সামাদ আমাকে কবি চন্দ্রকান্ত মুড়াসিংয়ের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন। ওই সময়ে ককবরক এই কবির একটি দীর্ঘ সাক্ষাৎকার নিয়েছিলাম আরও দুইজন বিদেশী কবির সঙ্গে। ওই আলাপচারিতায় তিনি কবিতায় মাটি ও মানুষের কথা, সংস্কৃতি ও জীবনের বহু বৈচিত্র্যের তাৎপর্য নিয়ে বিশদ বলেছিলেন। সাক্ষাৎকারটি দৈনিক সংবাদের সাহিত্যপাতায় প্রয়াত কবি আবুল হাসনাত দুই পৃষ্ঠাজুড়ে গুরুত্বের সঙ্গে ছেপেছিলেন।

ককবরক এই কবির সঙ্কলন ও সম্পাদনায় ঢাকার বাতিঘর থেকে 'ককবরক লোকসংগীত ও কবিতা' শিরোনামের একটি বই প্রকাশিত হয়েছে। তিনি গোটা ভারতবর্ষ ছাড়িয়ে বাইরের দুনিয়াতেও মনযোগ আকর্ষণ করতে পেরেছিলেন। ত্রিপুরার মাটি এবং নিজের ভাষা ককবরককে আঁকড়ে ধরে থেকেও। মাটি ও মানুষের এই কবি ৬৬ বছর বয়সে অকালে চলে গেলেন। যেখানে তাঁর বাবা শ্যামপদ মুড়াসিংয়ের বয়স এখন ১১০ চলছে।

তিনি ত্রিপুরার আদিবাসী জনগোষ্ঠীর ভাষা ককবরক সাহিত্যের ঠিকানা। তিনি এমন একটি ভাষার প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন যা প্রান্তিকতার দীর্ঘ ইতিহাসের মুখোমুখি হয়েছে। ১৯৭৯ সালে ককবরক ত্রিপুরার রাজ্যভাষার মর্যাদা লাভ করে। তিনি যেমন অনুবাদ করেছেন, তেমনি অন্যান্য আদিবাসী ভাষা সাহিত্য রক্ষা, পৃষ্ঠপোষকতা, অনুবাদ কর্মশালার মাধ্যমে অন্যান্য ভাষাভাষী দুনিয়ার সঙ্গে আন্তঃসাংস্কৃতিক সম্পর্ক স্থাপনে দুর্গম জনপদে  ছোটাছুটিও করেছেন।

তারুণ্যে যুক্ত ছিলেন প্রগতিশীল বামধারার রাজনীতির সঙ্গে। কর্মজীবনে কাজ করেছেন ব্যাংকে। তার রাজনীতি এবং ব্যাংকারের জীবিকা কোনোটাই কবি পরিচিতিকে ছাপিয়ে যেতে পারেনি। খুব বেশি কবিতা তিনি প্রকাশ করে যাননি। ৬৬ বছরের জীবনে প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ পাঁচটি। এত কম বই প্রকাশ করেও, আদিবাসী একটি ভাষায় লিখেও তিনি কী করে সমীহ আর ঈর্ষার এই জায়গা অর্জন করতে পেরেছিলেন?

তিনি ছিলেন নির্জলা কবি, নির্ভেজাল মানুষ। আমি তাঁকে বলতাম ত্রিপুরার রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তিনি জন্মেছিলেন ত্রিপুরার সোনামুড়া মহকুমার প্রত্যন্ত গ্রাম তৈবান্দালের এক কৃষক পরিবারে। তাঁর কবিতা দূরের আদিবাসী গ্রামগুলোর কান্না, ত্রিপুরার সবুজ বনানী, ঢেউ খেলানো পাহাড়, সুনিবিড় পরিবেশের এক বিশাল ভূগোলকে আলিঙ্গন করতে পেরেছিল। জাতি-জনজাতির মৈত্রী, আন্তঃসাংস্কৃতিক ভাব বিনিময় এবং জনজীবনের নিরন্তর সংগ্রামকে তিনি তাঁর লেখালেখির উপজীব্য করেছিলেন।

তিনি ঢাকার জাতীয় কবিতা উৎসব এবং বইমেলায় অংশ নিতে বেশ কয়েকবার বাংলাদেশে এসেছেন। একবার এসেছিলেন সস্ত্রীক। তাঁকে আমার কাছ থেকে দেখার সুযোগ হয়েছিল। ছিল মেইল এবং টেলিফোনে যোগাযোগ। ২০১৫ সালের দিকে একবার তাঁর নিমন্ত্রণে আগরতলা গিয়েছিলাম। একইদিন তিনি দিল্লী থেকে আগরতলা ফিরেছিলেন বিমানযোগে। আমি গিয়েছি সড়কপথে আখাউড়া হয়ে। তিনি দিল্লী থেকে যাত্রা করার আগে আমাকে জানালেন, আমি আগে পৌঁছে গেলে যেন আগরতলা আন্তর্জাতিক বাস টার্মিনালের অভ্যর্থনা কক্ষে তাঁর জন্যে অপেক্ষা করি।

যথারীতি আমি অপেক্ষা করছিলাম। তিনি এসে আমাকে সরাসরি তাঁর বাসায় নিয়ে গেলেন। গেট দিয়ে ঢুকতে ঢুকতে খুব জোরেশোরে বৌদিকে ডাকছিলেন আর বলছিলেন, ‘কই গো তুমি দেখ কাকে নিয়ে এলাম, আমাদের ঘরের মানুষ নিয়ে এলাম। ঘরে ঢোকার পর আমাকে মাঝখানে বসিয়ে দুইজন দুইপাশে বসে রাজ্যের খবর জানতে চাইলেন। সঙ্গে সঙ্গে ফোন এগিয়ে দিয়ে বললেন তোমার বউ আমাদের আসমাকে ধরিয়ে দাও জিজ্ঞেস করি, ও আর তোমাদের মেয়ে অতসী কেন এলো না?’ তারপর ঠিক ঠিক বৌদি এবং চন্দ্রকান্তদা ফোনে আসমার খোঁজখবর নিলেন।

তাঁর বাসায় বড় ছেলের বিয়ের আয়োজন চলছিল। বাসা আত্মীয়-স্বজনে ঠাসা। এরপর আগরতলার সাহিত্য অঙ্গনের এক-একজনকে ফোন করতে থাকলেন আর জানাতে থাকলেন, ‘ঢাকা থেকে আমাদের আনিস এসেছে, এখন ও আবার বাইরে-টাইরেও থাকে, ও আবার কালকেই চলে যাবে। তোমরা সবাই চলে এস, আড্ডা দেব।’

বাসার বিয়ের সব প্রস্তুতিযজ্ঞ বৌদিকে সামলাতে বলে তিনি বের হলেন আমাকে নিয়ে। প্রথম একটা রিকশা, এরপরে একটা স্কুটার ভাড়া করলেন সারা বিকেলের জন্যে। চালককে বলে নিলেন সারা আগরতলা চক্কর দিতে। আমরা যাচ্ছি আর পথে পথে নেমে কখনও রাজবাড়ি, নজরুল ভবন, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শতবর্ষ ভবন, বইয়ের দোকান, মুখ্যমন্ত্রীর বাসভবন এরকম দর্শনীয় স্থানগুলো ঘুরিয়ে দেখাচ্ছেন। নিয়ে গেলেন বইয়ের দোকানগুলোতে, প্রকাশনা এলাকাতেও। সন্ধ্যায় নিয়ে গেলেন স্থানীয় পত্রিকা দফতরগুলোতে। ঘোরাঘুরিতে আমাদের সঙ্গে পেলাম তাঁর পরের প্রজন্মের ত্রিপুরার কবি আকবর আহমেদকে।

আমাদের আড্ডা চলল মধ্যরাত পর্যন্ত। একপর্যায়ে কথাপ্রসঙ্গে কবি আকবর আহমেদ বললেন তাঁর তখনও দেশটির রাজধানী দিল্লীতে যাওয়া হয়নি। চন্দ্রকান্তদা উৎসাহ দিয়ে বললেন, যাবে নিশ্চিত যাবে। তার দুই-এক বছরের মাথায় ত্রিপুরার দুই প্রজন্মের দুই কবি রাজধানী দিল্লী, কলকাতাসহ ভারতবর্ষের অন্য প্রান্তেও তাদের লেখালেখি এবং কাজসূত্রে কতবার যে যাওয়া আসার মধ্যে ছিলেন, তার হিসাব নাই। ভারতের সাহিত্য একাডেমির পরিচালনা বোর্ডের সদস্য হতে তরুণ কবি আকবর আহমেদকে প্রতিষ্ঠিত বয়োজ্যেষ্ঠ কবি চন্দ্রকান্ত মুড়াসিং এগিয়ে দিয়েছিলেন। জীবনের শেষ পাঁচ বছর তিনি সাহিত্য একাডেমির উত্তর পূর্বাঞ্চলীয় মৌখিক সাহিত্য কেন্দ্র- নিকোলের (NECOL) অধিকর্তা হিসেবে বৈচিত্র্যময় সংস্কৃতির বিকাশ ও চর্চায় অবদান রেখে গেছেন।

তিনি আদিবাসী ভাষা-সাহিত্য নিয়ে কাজ করার জন্যে কেবল ককবরক এবং বাংলার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকেননি। তিনি ত্রিপুরার অন্যান্য ভাষা যেমন বংচ আদিবাসীর ভাষা-সাহিত্য নিয়ে অনুবাদ কর্মশালা আয়োজন করার জন্যে তাদের গ্রামে ছুটে গিয়েছেন, রাত্রিযাপন করেছেন, তাদেরকে একত্র করে অনুবাদ উদ্যোগ সফল করেছেন। তিনি আমন্ত্রিত হয়েছেন, সম্মানিত হয়েছেন অস্ট্রেলিয়া, বাংলাদেশ এবং ভারতবর্ষের নানা প্রতিষ্ঠান ও বিশ্ববিদ্যালয়ের বিবিধ সাহিত্য উদ্যোগে। তাঁর লেখাজোখা অনূদিত হয়েছে বাংলা, হিন্দি, সুইডিশ এবং ইংরেজিসহ নানাবিধ ভাষায়। তিনি ছিলেন প্রতিভাবান সুরকার, রবীন্দ্রনাথের গীতাঞ্জলির ককবরক ভাষায় স্বরলিপি তৈরি করেছিলেন।

তাঁর সঙ্গে ছিল আমার নিবিড় যোগাযোগ। তিনি আমাকে স্নেহ করতেন সন্তানের মতো, বন্ধুর মতো। তিনি পথের নিশানা দেখাতেন। জগতের অনেক ভাষার বড় বড় কবির সান্নিধ্য লাভ করার সুযোগ পেয়েছি, তাদের পরিবারের অন্দরেও আমন্ত্রণ পেয়েছি। কিন্তু কোথাও ঘরের মানুষ বোধ করার আহবান ও অনুভব কোনোটাই মনের ভেতরে কাজ করেনি, যেটা করেছে চন্দ্রকান্তদার সঙ্গে। আন্তঃসাংস্কৃতিক যোগাযোগ, সাংস্কৃতিক বিকাশ, প্রসার ও রক্ষায় যদি চন্দ্রকান্ত মুড়াসিংয়ের মতো সংশ্লিষ্টদের আত্মার যোগ না থাকে, তা কেবল ‘দিবস বন্দনা’তেই থেকে যাবে। আর ক্ষমতা, পুঁজি, প্রযুক্তি আমাদের সবকিছু গ্রাস করতে থাকবে। মানুষ হিসেবে আমরা ‘নাই’ হতে থাকব।

তিনি ধীর স্থির আশাবাদী স্বপ্ন দেখার ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির মানুষ ছিলেন। ২০২০ সালে করোনার সময়ে তিনি মেইলের একজায়গায় আমাকে লিখলেন, ‘মানুষেরা একদিন মানুষ হবে বৈকি? অমানুষেরা করোনার মতো বিস্তারের আগেই, মানুষ ধুয়ে ধুয়ে নির্মল হবে সর্বাঙ্গে, এই স্বপ্ন আমিতো দেখি' –চন্দ্রকান্ত দা।

তিনি তীক্ষ্ণ পর্যবেক্ষণ ক্ষমতার, দৃঢ় সত্য প্রকাশ করার মানুষ ছিলেন। তিনি সত্য যেমন দেখতে পেতেন তেমনি প্রকাশও করতেন লেখায় এবং বলায়। একবার আমাদের দেশের মোড়ল এক কবির একটি প্রশাসনিক কর্তার পদ পাবার পর অভিনন্দন জানিয়ে একটি পত্র পাঠিয়েছিলেন। পত্রের একজায়গায় ছোট একটি বাক্যে মোক্ষম সত্যটি উচ্চারণ করে সেই মোড়ল কবিকে সতর্ক করেছিলেন, কবির কাছে কবিতার বিকল্প নেই।

রামকুমার মুখোপাধ্যায় সম্পাদিত ভারতবর্ষের কবিতার সঙ্কলন ‘ভারতজোড়া কাব্যগাঁথা’ বইয়ে অন্তর্ভুক্ত চন্দ্রকান্ত মুড়াসিংয়ের গুচ্ছ কবিতা থেকে একটি কবিতা দিয়ে এই লেখা শেষ করছি। কবিতাটি তিনি নিজেই ককবরক থেকে বাংলায় অনুবাদ করেছিলেন।

অরণ্য-আলাপ

না, এক হব কেন?

এই তো মুঠোফোন সঙ্গে আছে

একে নিয়ে খেলা করি বোতাম টিপে —

দূর থেকে ভেসে আসে বনের মৃদু কণ্ঠ।

তুমি যেমন ভাবছ তেমন নোই আমি এখন,

পিচ রাস্তা বিছানো হয়েছে আমার বুক চিরে।

ঝোপঝাড় আর সরল গাছগুলো কেঁটে

বাজার বসেছে, নতুন মুখ, কত লোক আসে।

রাজার যজ্ঞের ঘোড়া আসে এলাকা জয়ের জন্য

কেউ ধরে না, পঞ্চায়েত তিতুন নিয়ে চলে যায়।

ঘোড়ার পায়ের দাগ পরে থাকে মাঘের হাওয়া,

পাহাড় চুইয়ে পড়া চোখের জল জমাট বাঁধে।

তুমি যেরকম দেখেছিলে সেরকম নোই আমি এখন

আমার হৃদয় এফোঁড় ওফোঁড় ক'রে

কালো চকচকে রাস্তা চলে গেছে।

তোমার আলোয় আমার অন্ধকার দূর হয়েছে

আমি ডুবে আছি এক অদ্ভুত খেলায়।

(তিতুন শব্দের অর্থ বিনা পারিশ্রমিকে শ্রম নেয়া)