হে প্রতিবন্ধী নারী, আমরাও পারি

নারী দুর্বল! নারী অবলা! তাই নারী পারবে না। এই শুনতে শুনতে বেড়ে ওঠা, আমরা প্রতিবন্ধী নারীরা সাধারণ নারীর চেয়েও দুর্বল এবং অসহায় হয়ে পড়ি।

সাবরিনা সুলতানাসাবরিনা সুলতানা
Published : 8 March 2023, 06:29 AM
Updated : 8 March 2023, 06:29 AM

আমাদের কন্ঠস্বর কেবলই রুদ্ধ করে রাখা হয়। আমাদের চিৎকারে কানে তুলো গুজে রাখে পরিবার তথা সমাজ। আমাদের সবকিছুতেই কেবলি ‘না’ ‘না’ ‘না’ আর না।

শিক্ষা, চাকরি, ব্যবসা, বন্ধুত্ব-সামাজিক মেলামেশা সকল ক্ষেত্রেই না। জীবিকার তাগিদে শহরের বাইরে অথবা দূরে কোথাও যেতে চাইলে– ভাই/চাচা/মামা সাথে যাবে, নচেৎ যেও না। নিরাপত্তার অজুহাতে পুরুষতান্ত্রিক পরিবার বারে বারে ‘না’ সূচক সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেয় নারীর ওপর। সবক্ষেত্রেই বাধা। ফলে নারীর স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নিয়ে স্বাবলম্বী হয়ে ওঠার পথ অতটা সহজ নয়। নারীর বেলায় যেমন শত হাজারও ‘না’, প্রতিবন্ধী নারীর বেলায় সেই ‘না’ আরও শতেক হাজারগুণ মাত্রায় চাপানো হয়।

নারী দুর্বল! নারী অবলা! তাই নারী পারবে না। এই শুনতে শুনতে বেড়ে ওঠা, আমরা প্রতিবন্ধী নারীরা সাধারণ নারীর চেয়েও দুর্বল এবং অসহায় হয়ে পড়ি। এই দুর্বল অসহায়ত্ব ক্রমশই যেন আমাদের মেরুদণ্ডহীন করে তুলছে! কিন্তু এখানে প্রশ্ন হলো আমাদের প্রতি পরিবেশগত এবং সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গিগত বাধা কেন মানসিক শক্তি অর্জনের পথে বাধা হয়ে দাঁড়াবে?

অসীম মনোবলের অধিকারী গুটিকয় প্রতিবন্ধী নারী এই ‘না’-কে উপেক্ষা করে বের হয়ে আসতে চান। কিন্তু সংখ্যায় তা অত্যন্ত নগণ্য এবং উদ্বেগজনক।

বহুযুগের পুরনো ক্রীতদাসদের অবস্থা মনে পড়ছে– দীর্ঘদিন প্রভুর অধীনে থাকতে থাকতে বদ্ধমূল ধারণার ছাপ পড়ে যেত মননে-মগজে; যেন নিজস্ব চিন্তা-চেতনা-স্বপ্ন বলে কিছু থাকতে নেই। ইচ্ছে নেই। অধিকার নেই। নিজ থেকে কিছুই করার নেই জীবনে। একটা সময় তারা ভাবতে শুরু করতেন, প্রভুর অধীন থেকে বেরিয়ে নিজ পায়ে ভর করে চলতে পারাই সম্ভব নয় কখনো। তারচেয়ে এই বেশ ভালো আছি! ‘পরনির্ভরশীলতাই আমার ধর্ম’ এই হয়ে যেত তাদের নীতি। ধীরে ধীরে এই পরনির্ভরশীলতার এক চরম পর্যায়ে গিয়ে তাদের মনেই থাকত না স্বাধীনভাবেও বেঁচে থাকা যায়। নিজের সিদ্ধান্ত নিজে নেওয়া যায়। প্রভুর চোখে চোখ রেখেই পৃথিবীর মাটিতে বীরদর্পে ঘুরে বেড়ানো যায়– কিন্তু কিছু ক্রীতদাস মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে চেয়েছিলেন বলেই দাসপ্রথা ঘুচেছে এককালে। এরপর সমাজকে পাত্তা না দিয়ে নারীরাও দীর্ঘ সময়ের আন্দোলন-সংগ্রামে খানিকটা এগিয়েছেন। ভুলে গেলে চলবে না, সৃষ্টির আদি পেশা কৃষিকাজের সূচনা হয় নারীর হাত ধরেই। প্রথম কৃষিসমাজ গড়ে ওঠে নারীর সুগঠিত নেতৃত্বে। কিন্তু আমরা কী ভাবছি, কোথায় আছি আমরা প্রতিবন্ধী নারীরা? আদতেই কি আমরা দুর্বল?

আমাদের শারীরিক সীমাবদ্ধতা শিক্ষিত হয়ে ওঠার এবং স্বাধীন জীবনযাপন চর্চার জন্য নিশ্চয়ই বাধা হতে পারে না। আমাদের মনের গহীনে নিজেদের জন্যেও কিছু চাহিদা রয়েছে। পরিবারের বোঝা হয়ে থাকতে নিশ্চয়ই আমাদের কারোরই ইচ্ছে নেই! নানা রঙের ইচ্ছেগুলো ডাল-পালা মেলে দেয়। তবুও আমরা দমিয়ে রাখি। মনে মনে অনেক কিছুই ভাবি এবং বলি। কিন্তু বাবা-মা পরিবার তথা সমাজে প্রকাশ্যে বলতে কীসের এত দ্বিধা-সংকোচ আমাদের!

সিদ্ধান্ত গ্রহণের চর্চা

ক্ষমতায়ন। ছোট্ট এক শব্দের হলেও এর শক্তি সীমাহীন। এটি আসলে একটি সামগ্রিক প্রক্রিয়া। যে প্রক্রিয়ায় নারী তার নিজের জীবনের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পেশা নির্বাচন, পরিবার গঠনসহ সবক্ষেত্রে পরিকল্পনা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে থাকে। আপাতদৃষ্টিতে সমাজে এবং পরিবারের শিক্ষা, কর্মসংস্থানের মাধ্যমে ক্ষমতায়ন, নেতৃত্ব, প্রতিনিধিত্ব এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণের চর্চা, পরিবার গঠন, সামাজিক-সাংস্কৃতিক মেলামেশায় কোথাও আমাদের অবস্থান নেই। এ কথা সত্য নারীকে পুরুষের তুলনায় দুর্বল ও হীন করে দেখার মানসিকতা আজও বদলায়নি। ফলে এখনো আমরা দেখতে পাই, অবলীলায় নারীর প্রতি চরম অবমাননাকর ও অশালীন বক্তব্য দিতে দ্বিধা করছেন না অনেকেই। এই নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টাতে আমাদেরই নিজেদের অবস্থান পরিবর্তন করতে হবে। শিক্ষা এবং অর্থনৈতিক ক্ষমতা অর্জিত হলে পরিবার ও সমাজ এই নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে বাধ্য। পরিবার যদি তার ছেলে সন্তানকে শিশুকাল থেকেই নারীর প্রতি সম্মান করার গুরুত্ব বিষয়ে শিক্ষা দেয়, তাহলে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম নারীকে সম্মান করতে শিখবে। বিদ্যায়তনে, কর্মক্ষেত্রে এবং রাস্তাঘাটে নারীর নিরাপত্তা নিশ্চিতের পথে আমরা অগ্রসর হবো।

নারীর ক্ষমতায়ন আজ মুখে মুখে। নারীর আজকের এই অবস্থান তাদের দীর্ঘ আন্দোলনের ফসল। নারীর নেতৃত্ব ও সিদ্ধান্ত নেওয়ার চর্চায় মিলেছে তাদের মুক্তি। কিন্তু এই মুক্তি এত সহজে মেলেনি। একদা নারীর দুর্বল হওয়ার দুর্নাম তাদেরকেই কাটাতে হয়েছে। পুরুষতন্ত্র কর্তৃক সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেওয়ার প্রবল প্রবণতাকে অস্বীকার করে নারীরা সংঘবদ্ধ হয়েছে। সংগঠিতভাবে প্রতিবাদে সোচ্চার হয়েছে। নারী প্রমাণ করেছে একতাবদ্ধ নারী পুরুষের চেয়ে বহুগুণ শক্তিশালী। নিজের সিদ্ধান্ত নিজে গ্রহণের স্বাধীনতা পেয়েছে আন্দোলন বাদ-প্রতিবাদের মাধ্যমে। 

সমঅধিকার ও মর্যাদাপূর্ণ জীবনযাপনের দাবিতে এক সময়ে নারী আন্দোলন যে কারণে শুরু হয়েছিল; ঠিক একই কারণে আমাদের প্রতিবন্ধী নারীদের সংঘবদ্ধ হওয়া জরুরি। করুণা নয়, আত্মমর্যাদার খোঁজে অহংবোধ নিয়ে সামাজিক মর্যাদাপূর্ণ জীবনের খোঁজে নামতে হবে আমাদের। এর জন্য কিছু বিষয় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এক. শিক্ষার্জন। দুই. অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন। তিন. স্বাস্থ্যকর জীবন যাপন। চার. রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন। কিন্তু সবার আগে যেটি জরুরি তা হলো সিদ্ধান্ত গ্রহণের চর্চা।

শিক্ষার বিকল্প নেই। শিক্ষার মাধ্যমেই আমাদের অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন সম্ভব এবং সর্বোপরি জরুরি নিজের সিদ্ধান্ত নিজে গ্রহণের চর্চা। এই সিদ্ধান্ত গ্রহণের চর্চা আমাকে আমার পরিবার থেকেই শুরু করতে হবে। কেউ এসে সাহস অথবা শক্তি সঞ্চয় করিয়ে দিয়ে যাবে না। নিজের শক্তিতে নিজেকেই উঠে দাঁড়াতে হবে। সমাজের প্রচলিত প্রথাকে ভেঙে অধিকার আদায়ের চেতনায় উদ্দিপ্ত হয়ে আমাদের সংগঠিত হতে হবে। আর এর জন্য প্রয়োজন অনেক অনেক বেশি সাহসী ও লড়াকু মনোভাব।

পরিবার গঠন ও স্বাস্থ্য 

ছোটবেলা থেকে আমাদের চিন্তায় মননে গেঁথে দেয় পরিবার তথা সমাজ– তুমি স্বাভাবিক নও। সুতরাং সমাজের অন্য দশটা কিশোরী মেয়ের মতোন প্রেম/ভালোবাসা/বিবাহ ইত্যাদি বিষয়ে ভাবনা বহুদূরের কথা বিপরীত লিঙ্গের কারও দিকে ভুলেও নজর দিও না। কারণ তুমি স্বাভাবিক নও। ওসব তোমার জন্য নয়। বিয়ে তথা পরিবার গঠনের স্বপ্ন মহাপাপ আমাদের জন্য।

উঠতে বসতে এসব উপদেশ শুনে বেড়ে উঠতে গিয়ে নারী ধরেই নেয় প্রতিবন্ধিতা যার বর্তমান অবস্থা তার আবার পরিবার গঠন কীসের। তার যেন মন নেই। ভালোবাসা পাওয়ার অধিকার নেই। জীবনসঙ্গীর হাত ধরে নিজের জগতটিকে সাজিয়ে নেওয়ার আকাঙ্ক্ষা নেই। তার যেনবা যৌন চাহিদাও থাকতে নেই। এহেন মানসিকতা নিয়েই বেড়ে উঠি আমরা বেশিরভাগই।

আমি এখনো অনেকের মানসিকতায় অনুভব করি প্রতিবন্ধী নারীর বিয়ের কথা ভাবাও যেন মহাপাপ। নারী-পুরুষের স্বাভাবিক জৈবিক চাহিদাগুলো বা খোলামেলাই বলি প্রতিবন্ধী মানুষের sex, sexuality, sexual desires ইত্যাদি নিয়ে কথা বলতে গিয়ে আমরাই অনেকে আড়ষ্ট হয়ে পড়ি। যেন বড় কোনো অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড করতে গিয়ে হাতেনাতে ধরা পড়ে গেছি। চুরি-ডাকাতি করে ফেলেছি। আমার প্রশ্ন, কেন আমরা অস্বস্তিবোধ করি এ বিষয়ে কথা বলতে?

মুরুব্বী গোছের বড় মানুষেরা চোখ পাকিয়ে তাকাবেন হয়তো, মেয়ে বেশি পাকনা হয়ে গিয়েছে এই ভেবে। কিন্তু এই ভাবনা যেকোনো অপ্রতিবন্ধী মানুষের জন্য যেমন স্বাভাবিক তেমনি, প্রতিবন্ধী নারী ও পুরুষের বেলাতেও পরিবার গঠন বা একজন জীবনসঙ্গীর স্বপ্ন দেখা একেবারেই স্বাভাবিক একটি প্রক্রিয়া।  

অনেকেই মনে করেন, প্রতিবন্ধী নারী সন্তান জন্ম দিতে অক্ষম। অনেকে ভয়ে থাকেন প্রতিবন্ধী নারীর গর্ভের সন্তান প্রতিবন্ধী শিশু হয়েই জন্ম নেবে। কোনো পরিবারে প্রতিবন্ধী সন্তান জন্ম নিলে অনাগত সন্তান ধারণ নিয়েও অনেকে আশঙ্কায় ভোগেন। প্রতিবন্ধী ভাই বা বোনের প্রতিবন্ধিতা নিয়ে তারই অপ্রতিবন্ধী ভাই বোনের বিয়েকে কেন্দ্র করে নানা জটিলতা তৈরি হয় স্বজনদের মধ্যে। কিন্তু এই সমস্ত ধারণাই সমাজের প্রচলিত কুসংস্কার ব্যতীত আর কিছুই নয়। অন্যদিকে, অপ্রতিবন্ধী পুরুষের বহনকৃত জেনেটিক্যাল কারণেও অপ্রতিবন্ধী নারীর গর্ভে প্রতিবন্ধী সন্তান জন্মগ্রহণ করতে পারে। কিন্তু বরাবরই সমাজ নারীকেই অপরাধীর কাঠগড়ায় দাঁড় করায়। গর্ভধারণের সাথে প্রতিবন্ধিতার কোনো সম্পর্ক নেই। দুর্ঘটনা বা প্রাকৃতিক যেকোনো কারণেই প্রতিবন্ধিতা বরণ করতে পারেন যেকোনো শিশু বা মানুষ। অর্থাৎ প্রতিবন্ধী নারীও অপ্রতিবন্ধী সন্তান জন্ম দিতে পারে। চারদিকে ঋতুকালীন পরিচর্যা এবং স্বাস্থ্যসম্মত ব্যবস্থা নিয়ে আলোচনা হয়। অথচ আমাদের দেশে প্রতিবন্ধী কিশোরী ও নারীর ঋতু ব্যবস্থাপনা ও প্রজনন-স্বাস্থ্য সুরক্ষায় সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে কোনো আলোচনা, প্রশিক্ষণ-উদ্যোগ নেই। সন্তানসম্ভবা প্রতিবন্ধী নারীর প্রজননস্বাস্থ্য সেবায় হাসপাতালগুলোর অব্যবস্থাপনার দিকে নজর দেওয়ার কেউ নেই। স্বাস্থ্য পরীক্ষা-নীরিক্ষা সংক্রান্ত জটিলতা বা প্রবেশগম্য টয়লেটের অপ্রতুলতা ইত্যাদি শতেক আহাজারিতেও কুম্ভকর্ণের ঘুম ভাঙায় কার সাধ্যি!

অসচেতনতা এবং সঠিক শিক্ষা ও ধারণার অভাবে প্রান্তিক পর্যায়ের কিশোরী ও নারীদের ঋতুকালীন ব্যবস্থাপনা অত্যন্ত নাজুক অবস্থায় রয়েছে। আমাদের মধ্যে যারা স্বাধীনভাবে চলাফেরা, পোশাক পরিধান এবং টয়লেট ব্যবহার করতে পারেন না বা সমস্যার মুখোমুখি যারা, বিশেষত এদের মধ্যে আরও বৈষম্যপীড়িত বুদ্ধি প্রতিবন্ধী নারী, মস্তিষ্ক পক্ষাঘাত প্রতিবন্ধী নারী, মাস্কুলার ডিস্ট্রফি প্রতিবন্ধী নারী, অটিস্টিক নারী, মনো-সামাজিক প্রতিবন্ধী নারী, ডাউনসিন্ড্রোম নারীদের ঋতুকালীন পরিচর্যা এবং যৌন ও প্রজননস্বাস্থ্য অধিকার, স্বাস্থ্যসম্মত খাদ্য, পরিচ্ছন্ন থাকার পদ্ধতি বিষয়ে আমাদের রাষ্ট্রযন্ত্র এখনো বিবেচনাহীন অবস্থানে রয়েছে।

একজন নারী তার ব্যক্তিসত্ত্বা ব্যতীতও কখনো মেয়ে, স্ত্রী, কখনো মা হিসেবে জীবনের ধাপগুলো পার করেন। কিন্তু অসচেতন এই সমাজ একজন প্রতিবন্ধী নারীর নারীত্বকে স্বীকার করতে চায় না। ভুল করেও তাকে বিবাহযোগ্য ভাবতে পারে না। এখানে প্রতিবন্ধিতাই তার সবচেয়ে বড় অক্ষমতা হিসেবে গণ্য হয়। সেদিক থেকে প্রতিবন্ধী পুরুষদের এহেন প্রতিকূল পরিবেশের সম্মুখীন তেমন একটা হতে হয় না। বিয়ের ব্যাপারে প্রতিবন্ধী নারীদের ক্ষেত্রেই এই নেতিবাচক মনস্তাত্ত্বিক প্রভাব কাজ করে এবং বেশিরভাগের মধ্যেই পারিবারিক ও সামাজিক নেতিবাচক মনোভাব পরিলক্ষিত হয়। অনেকের ধারণা, প্রতিবন্ধিতা তাদের ভাগ্যের ফল, যা থেকে পরিত্রাণ লাভের কোনো উপায় নাই। অন্যদিকে যদি কোনো বিবাহিত প্রতিবন্ধী নারী তার প্রতিবন্ধিতার কারণে গৃহস্থালীর কাজ বা তার ওপর অর্পিত পারিবারিক দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হন অথবা অনেক স্বামী আবেগীয় কারণে প্রতিবন্ধিতার বিষয়টি মেনে নিলেও সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির কারণে চারিপাশের প্রতিকূলতার সাথে যুদ্ধ করে কোনোরূপ সাহায্য করতে পারেন না। অথবা বাস্তব পরিস্থিতির (সামাজিক ও দৃষ্টিভঙ্গীগত বাধা) কাছে হার মেনে নেয়। কোনো ক্ষেত্রে কয়েক বছরের ব্যবধানেই দাম্পত্য জীবনে বিচ্ছেদ ঘটে। কিছু ক্ষেত্রে আবার প্রতিবন্ধী মেয়েকে শুধু যৌতুকের লোভে বিয়ে করার উদাহরণও রয়েছে। পরবর্তীতে অযৌক্তিক কারণ দেখিয়ে যৌতুকের সমস্ত সম্পদ হাতিয়ে নিয়ে স্ত্রীকে পরিত্যাগ করে চলে গেছে।

এত শত প্রতিকূলতার মধ্যেও কিছু ব্যতিক্রমী উদাহরণ তো রয়েছেই! যারা একে অপরের বিশ্বাসে-ভালোবাসায় হাতে হাত রেখে পার করে দিচ্ছেন আজীবন। ভুলে গেলে চলবে না পরিবার গঠন আমাদের অধিকার। আমরা কেবল মনে মনে স্বপ্ন দেখব না। জীবনসঙ্গীর হাত ধরে ঘর বাধার স্বপ্ন বাস্তবায়নে দৃপ্ত পদক্ষেপে এগিয়ে যাব। সমাজের সমস্ত নেতিবাচক ধারণা ভাঙতে আমাদের প্রতিবন্ধী মানুষদেরই শক্ত হাতে হাল ধরতে হবে। পরিবর্তন আসবেই।

প্রসঙ্গ নির্যাতন 

জন্মলগ্ন থেকেই সমাজে প্রতিবন্ধী নারীদের আলাদা দৃষ্টিতে দেখা হয়। ফলে শহর বা গ্রামে হোক, প্রতিবন্ধী নারীরা মূলত তিনটি ক্ষেত্রে নির্যাতনের শিকার হন। এক. নারী হিসেবে, দুই. প্রতিবন্ধী নারী হিসেবে এবং তিন. দারিদ্র্যের কষাঘাতে। যার সাথে যুক্ত হয় কুসংস্কার ও বৈষম্যমূলক নীতির নির্যাতন। এ সমাজে প্রতিবন্ধী নারীরা প্রতিনিয়ত চরম উপেক্ষা, বৈষম্য ও বিভিন্ন ধরনের শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। বিশেষত শ্রবণ প্রতিবন্ধী নারী, শ্রবণ-দৃষ্টি প্রতিবন্ধী নারী এবং বুদ্ধি প্রতিবন্ধী ও মনোসামাজিক প্রতিবন্ধী নারীদের ওপর যৌন নির্যাতনের অধিকাংশ ঘটনাই জনসমক্ষে আনতে চান না খোদ তাদের পরিবারই। নগণ্য কিছু ঘটনার মামলা হলেও নির্যাতন প্রতিরোধ সংক্রান্ত আইনগুলো প্রতিবন্ধী ব্যক্তিবান্ধব না হওয়ায় এবং আইনের দীর্ঘসূত্রিতার কারণে অধিকাংশ ক্ষেত্রে মামলাগুলোর নিষ্পত্তি হয় না। থানা আদালতগুলোতে সরকারিভাবে নিয়োগ নেই বাংলা ইশারা ভাষা দোভাষীদের। বাংলা ইশারা ভাষা দোভাষী প্রশিক্ষণের উদ্যোগে নীরব ভূমিকায় রাষ্ট্র। ফলে যে সমস্ত শ্রবণ প্রতিবন্ধী নারীর পরিবার বিচার-ব্যবস্থায় আসতে চান দোভাষীর অভাবে তাদের ভাগ্যে সুবিচার মেলে না। অন্যদিকে নির্যাতনের শিকার দৃষ্টি প্রতিবন্ধী নারীদের সাক্ষ্য আদালত কর্তৃক গৃহীত হয় না। বাংলাদেশে বছরে কতজন প্রতিবন্ধী নারী বিভিন্নভাবে নির্যাতিত হয় তার সঠিক পরিসংখ্যানও নেই সরকারি-বেসরকারি কোনো সংস্থার কাছে।

নারীর ক্ষমতায়নে শীর্ষে, অথচ প্রতিবন্ধী নারী অনুপস্থিত

নারীর ক্ষমতায়ন নিশ্চিতের লক্ষ্যে সরকার কর্তৃক গৃহীত পদক্ষেপগুলোতে প্রতিবন্ধী নারীর অনুপস্থিতি নিন্দনীয়। নারীর প্রতি সকল প্রকার বৈষম্য বিলোপ সনদ (সিডও) এবং টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট (এসডিজি) অর্জনে সরকার সাধারণ নারীদের ক্ষমতায়ন নিশ্চিতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হলেও প্রতিবন্ধী নারীদের ইতিবাচক উন্নতি দেখা যাচ্ছে না।

বাংলাদেশে বর্তমানে নারীর ক্ষমতায়নে রাজনৈতিক অংশগ্রহণ, কর্মসংস্থান বৃদ্ধি, উদ্যোক্তা তৈরি, ঋণ প্রদান, প্রশিক্ষণ, নারী নির্যাতন বা যৌন সহিংসতা প্রতিরোধ এসব ক্ষেত্রে সরকারের পদক্ষেপ লক্ষণীয়। তবে একই প্রাসঙ্গিকতায় প্রতিবন্ধী নারীদের বিষয়টি গৌণ। বরং প্রতিবন্ধী নারীরা সাধারণ মৌলিক অধিকার থেকেও হচ্ছে বঞ্চিত। এ ছাড়া সরকারি বা বেসরকারি নিয়োগ, প্রশিক্ষণের ক্ষেত্রে নারীর সংখ্যাভিত্তিক তথ্য বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের জরিপ প্রতিবেদনে নিয়মিত পাওয়া যায়। কিন্তু সেখানে প্রতিবন্ধী নারীদের বিষয়ে তেমন কোনো তথ্য নেই। উপরন্তু তথ্যের খোঁজ চাইলে সরকারি দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা হিমশিম খেয়ে যান। স্থানীয় সরকারে সাধারণ নারীরা নির্বাচিত হলেও প্রতিবন্ধী নারীর অংশগ্রহণ-সংক্রান্ত তথ্য নির্বাচন কমিশন বা স্থানীয় সরকার কারও কাছেই নেই। অর্থাৎ সরকারের তথ্যভাণ্ডারে প্রতিবন্ধী নারীরা প্রায় অদৃশ্য। এই সংখ্যাতাত্ত্বিক অবহেলা সমাজের প্রচলিত সেবা বা কল্যাণমূলক দৃষ্টিভঙ্গির বহিঃপ্রকাশ। আবার গোদের ওপর বিষফোঁড়া হয়ে দাঁড়িয়েছে সর্বক্ষেত্রে প্রবেশগম্যতার অভাব। সমাজের নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি এবং অবকাঠামোগত বাধা এ দুয়ে মিলে প্রতিবন্ধী নারীর বৈষম্যপীড়িত অবস্থানকে আরও বেশি ঝুঁকির মধ্যে ফেলছে। অনুৎসাহিত করছে সামাজিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক জীবনে সম-অংশগ্রহণে।

এসডিজি লক্ষ্য ৫ নারীর সমঅধিকার তথা ক্ষমতায়ন চর্চাসহ নানা বিষয় উঠে এসেছে। বাংলাদেশ সরকার এসডিজি অর্জনে কাজ শুরু করার পর আমরা আশা করেছিলাম, সরকার প্রতিবন্ধী নারীদের বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে নিয়ে তথ্য সংরক্ষণ, উপাত্ত বিনিময় এবং তা বিশ্লেষণ করেই প্রতিবন্ধী ব্যক্তি বিষয়ক জাতীয় কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করবে। কিন্তু অবস্থার পরিবর্তন না হওয়ায় ক্রমান্বয়ে সামাজিক নিরাপত্তা খাতই হয়ে উঠছে প্রতিবন্ধী নারীর শেষ গন্তব্য।

আমরা দেখতে পাচ্ছি, সরকার বছর বছর সামাজিক নিরাপত্তা খাতে প্রতিবন্ধী মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধি করছে এবং আওতা বাড়াচ্ছে। প্রশ্ন এসেই যায়, তাহলে কী শুধু সামাজিক নিরাপত্তা খাতই প্রতিবন্ধী মানুষের মুক্তির সমাধান? এ কারণেই কী শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কর্মসংস্থান এবং প্রবেশগম্যতাসহ নানাক্ষেত্রে অংশগ্রহণ, প্রতিনিধিত্ব, ক্ষমতায়নের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়সমূহে প্রতিবন্ধী নারীর বৈষম্যের প্রকটতা লক্ষণীয়! প্রতিবন্ধী নারীর বিষয়ে নির্দিষ্ট তথ্য সংগ্রহের এ প্রসঙ্গে জাতিসংঘসহ জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ের সরকারি-বেসরকারি সংস্থাসমূহের নিরবতায় আমরা বিস্মিত!

বাংলাদেশের প্রতিবন্ধী নারীদের ক্ষমতায়ন বা অগ্রগতির অবস্থা পরিমাপের জন্য প্রচলিত সূচকসমূহে নারীর পাশাপাশি প্রতিবন্ধী নারীর সুনির্দিষ্ট তথ্য-উপাত্ত উপস্থাপন প্রয়োজন। এজন্য সরকারকে আরও বেশি চাপ প্রয়োগে উদ্যোগী হওয়া দরকার। নতুবা আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশে ক্ষমতা ও সমতার ভিত্তিতে প্রতিবন্ধী নারীর বাধাহীন পূর্ণ অংশগ্রহণ ছাড়া চূড়ান্ত বিশ্লেষণে ইতিবাচক পরিবর্তন দৃশ্যমান হবে না।

দীর্ঘ ৫০ বছরের আন্দোলন-সংগ্রামের ফলে আজ জাতীয় ও স্থানীয় পর্যায়ের নির্বাচনসহ প্রশাসন, আইন-শৃঙ্খলা ও বিচার বিভাগে নারীর পদচারণা বৃদ্ধি পেয়েছে। কিন্তু এই জায়গাগুলোতে প্রতিবন্ধী নারীর অংশগ্রহণ বৃদ্ধির পরিবেশ তৈরি হয়নি। সরকার গৃহীত লিঙ্গ সংবেদনশীল বাজেটে প্রতিবন্ধী নারীর জন্য বরাদ্দ প্রসঙ্গে অবহেলা কীসের? আমাদের কতদিন সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অধীনে সীমাবদ্ধ রাখা হবে?

প্রতিবন্ধী মানুষের অধিকার বিষয়ক সর্বোপরি নারী বিষয়ক সরকারি এবং বেসরকারি নীতি-নির্ধারণী পর্যায়ের যেকোনো সিদ্ধান্ত ও পরিকল্পনা গ্রহণেও আমাদের যথাযথ অংশগ্রহণ বৃদ্ধি এখন সময়ের দাবি। প্রতিবন্ধী নারীর বিষয়টি মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়, মহিলা অধিদফতর এবং জাতীয় মহিলা সংস্থার গৃহীত সকল কর্মসূচি ও সুযোগ সুবিধায় অন্তর্ভুক্ত করা না হলে অবস্থার পরিবর্তন সম্ভব নয়।