পাকিস্তানে পরিস্থিতি এতটাই খারাপ হয়েছে যে শপিংমল এবং অন্যান্য পাবলিক প্লেস বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে। পাকিস্তানের অর্থনীতি বড় ধরনের সংকটে আটকে আছে, যেখান থেকে উত্তরণের পথ দেখা যাচ্ছে না।
Published : 26 Feb 2023, 11:20 PM
পাকিস্তান ধুঁকছে। যারা মনে করেন এটি আনন্দের সংবাদ, আমি তাদের সাথে দ্বিমত পোষণ করি। যে কোনো দেশ মানেই ওই দেশের জনগণ। জনগণ যদি কষ্ট পায় আর ভালো না থাকে তবে শুধু ওই দেশ নয় তার প্রতিবেশী দেশ এমনকি বর্তমানের গ্লোবাল ভিলেজও ভালো থাকে না। কারণ আজকের দুনিয়া পারস্পরিক বিনিময়ের দুনিয়া। একটি দেশ আরেকটি দেশ ব্যতীত বাঁচতে পারে না। পাকিস্তানের অর্থনীতির যে হালচাল তাতে পাশের দেশগুলোও শঙ্কিত। একজন খাঁটি মুক্তিযুদ্ধপ্রেমী ও প্রবাসী বাংলাদেশী হিসেবে আমি মনে করি পাকিস্তানের বোধোদয় এখন সময়ের ব্যাপার। আগেই বলে রাখি এটা কোনো কাটখোট্টা লেখা নয়। এ লেখায় আমি পাকিস্তানের পাশাপাশি নিজেদের কথাও বলতে চাই।
চরম অর্থনৈতিক সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে পাকিস্তান। দেশটির বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে ৪.৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে নেমে এসেছে। পাকিস্তানভিত্তিক ফ্রন্টিয়ার পোস্ট পত্রিকার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ফেডারেশন অব পাকিস্তান চেম্বারস অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (এফপিসিসিআই) ব্যবসায়ী প্যানেল (বিএমপি) সতর্ক করেছে যে, পাকিস্তানের অর্থনীতি বর্তমানে সবচেয়ে খারাপ সংকটের মুখোমুখি হচ্ছে।
পাকিস্তানে পরিস্থিতি এতটাই খারাপ হয়েছে যে শপিংমল এবং অন্যান্য পাবলিক প্লেস বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে। পাকিস্তানের অর্থনীতি বড় ধরনের সংকটে আটকে আছে, যেখান থেকে উত্তরণের পথ দেখা যাচ্ছে না। পাকিস্তানে আটা, চিনি ও ঘি-এর মতো দৈনন্দিন জিনিসের দাম বেড়েছে। প্রতিদিনই দাম লাফিয়ে বাড়ছে।
পাকিস্তানে অর্থনৈতিক সংকটের প্রভাবে খাদ্যসংকট তৈরি হয়েছে। সম্প্রতি দ্য ডনের প্রতিবেদনে বলা হয়, লাহোরে ১৫ কেজি আটার ব্যাগ বিক্রি হচ্ছে ২ হাজার ৫০ রুপিতে। গত দুই সপ্তাহে ১৫ কেজি আটার বস্তার দাম বেড়েছে ৩০০ রুপি। ইতিহাসে এই প্রথম পাকিস্তানে ২০ কেজি আটার বস্তার দাম হয়েছে ৩ হাজার রুপি। করাচি শহরে ১ কেজি আটার দাম ১৫০ রুপি। গত কয়েক সপ্তাহে সেখানে ২০ কেজির আটার বস্তার দাম বেড়েছে ৪০০ রুপি। হায়দরাবাদে ২০ কেজি আটার বস্তার দাম ২ হাজার ৮৮০ রুপি আর পেশোয়ারে ২ হাজার ৬৫০ রুপি।
গত বৃহস্পতিবার ইতিহাসের সর্বনিম্ন ছিল পাকিস্তানি টাকার দর। সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত রিপোর্ট অনুযায়ী, বৃহস্পতিবার বাজার খোলার পর দিনের শুরুতে পাকিস্তানি টাকার মূল্য ডলারের তুলনায় ছিল ১৯৮.৩৯ টাকা। কিন্তু সময় পেরোতে না পেরোতেই বাজারের পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়। ডলারের তুলনায় রুপির দাম আরও কমে দাঁড়ায় ২০০। অর্থাৎ ২০০ পাকিস্তানি রুপি এক ডলারের সমান। ৭৫ বছরের পাকিস্তানের অর্থনীতিতে এতটা খারাপ সময় আসেনি।
এই অর্থনীতি পাকিস্তানিদের ভুল রাজনীতির কুফল। একটি দেশ যদি বারবার অগণতান্ত্রিক পথে চলে তার ভবিষ্যত এমন হবেই। ২৩ জন প্রধানমন্ত্রী সরকার সামলেছেন কিন্তু একজনও শেষ পর্যন্ত টিকতে পারেননি। মহাবিখ্যাত ক্রিকেটার বিশ্বকাপজয়ী পাকিস্তান দলের কাপ্তান ইমরান খানও পারেননি। যার অর্থ দাঁড়ায়, ওই দেশের রাজনীতি মূলত মানুষ বা জননির্ভর না। বারবার সামরিক বাহিনীর কারণে গণতন্ত্র কখনোই সেখানে জায়গা নিতে পারেনি। আজকে অর্থনৈতিক ধসের জন্য মূলত গণতন্ত্রহীনতাই দায়ী। যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের কাছ থেকে পাকিস্তান যে পরিমাণ সাহায্য সহযোগিতা পেয়েছে তার তুলনা চলে না। পাকিস্তানের দোস্ত চীন ও যুক্তরাষ্ট্র একাত্তরে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের বিরোধীতা করেছিল। অস্ত্র ও টাকার স্রোতে ভাসমান পাকিস্তান তখন এবং পরেও বোঝেনি যে এই বসন্ত কাল্পনিক। অন্যের টাকায় বেশিদিন ভালো থাকা যায় না।
ওই টাকাগুলো কী করেছে তারা? লুটপাট আর বিদেশে পাচারের পাশাপাশি যুদ্ধ আর যুদ্ধ। আমি যখন এ লেখা লিখছি তখন আফগানিস্তানের সাথে যুদ্ধংদেহী অবস্থা চলছে তাদের। খবরে দেখলাম আহত হয়েছে পাকিস্তানি সেনারা। আগফানদের শারিরীক শক্তি আর অদম্য জেদের কথা যারা জানেন তাদের অজানা নয় ওরা কেমন মারমুখী। তাদের সাথে যুদ্ধ করে যুক্তরাষ্ট্রই পারেনি। কথা আসলে অন্য কিছু। এইসব লড়াই কতদিন আর কতকাল? ৭৩ বছর ধরে কাশ্মীর যুদ্ধ কী দিয়েছে তাদের? এক খণ্ড জমি দূরে থাক কিছুই জোটেনি।
অন্যদিকে ভারত কিন্তু ঠিকই এগিয়ে গেছে। কাশ্মীরে তারাও যুদ্ধ করেছে, করে হয়তো করবেও। কিন্তু তাদের ফোকাস অন্য কোথাও। তাদের আর্থিক প্রগতি আর উন্নয়ন এখন চোখ ধাঁধানো। পাকিস্তান ওই দৌড়ের ধারে কাছেও নেই। দুটি দেশ একসাথে স্বাধীন হয়েছিল। ওই সময় পাকিস্তান এগিয়ে গিয়েছিল অনেকটা পথ। তাদের তখন রমরমা সময়। কিন্তু সে সময়কাল ধরে রাখতে পারেনি তারা। আজ সব হারিয়ে পথের ফকির হতে চলেছে পাকিস্তান।
আমাদের মনে রাখতে হবে কোনোভাবেই যেন একনায়ক আর সেনাশাসকের খপ্পরে না পড়ে দেশ। পাশাপাশি গণতন্ত্রের প্রয়োজন অনস্বীকার্য। গণতন্ত্র কী এবং কেন সবাই জানেন। আমাদের সমাজে দেশবিরোধী আর পাকিস্তানপ্রেমীদের কমতি নাই। তাদের কারণে সম্পূর্ণ গণতান্ত্রিক সমাজ হয়তো সম্ভবপর নয়, কিন্তু উপায় কী? গণতন্ত্র ও স্বচ্ছতা না থাকলেই যে দুর্নীতি হবে। পাচারের টাকায় মুখ থুবড়ে পড়বে আমাদের উন্নয়ন। এটুকু আমরা জানলেও মানি না। সরকারবিরোধী মনোভাব এখন তুঙ্গে। এ জন্য সরকারের কিছু মানুষ আর পদ্ধতি দায়ী। পদক, পুরস্কার থেকে সংস্কৃতি ও রাজনীতিতে এত তোষামোদি আর দালালি কেউ দেখেনি আগে।
পাকিস্তানের সমাজেও এগুলো ছিল। পরে কী দেখলাম আমরা? ওদের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ও প্রেসিডেন্টদের অনেকেই আজ দেশ ছাড়া। সেদিন ছোট্ট একটা নিউজে দেখি পারভেজ মোশাররফ মারা গেছেন। গদিতে থাকার সময় যুক্তরাষ্ট্রের চামাচামি করা তালেবানের জন্মদাতা মোশাররফকে কেউ মনে রাখেনি। এদিকে পাকিস্তানের সর্বনাশ যা হবার হয়ে গেছে। আজ তার নাভিশ্বাস উঠছে। যার দায় চুকাচ্ছে নিরীহ জনগণ।
পাকিস্তানের দিকে তাকালে আমার আর একটি কথা মনে হয়। কোনো দেশ যে শুধু জঙ্গিবাদ আর উগ্রতা দিয়ে এগুতে পারে না তার সেরা উদাহরণ পাকিস্তান। সাধারণ মানুষজনকে পাশ কাটিয়ে সরকারগুলো যেভাবে যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থ দেখেছিল তাতে কল্যাণ ছিল না। ছিল না মানুষের জন্য ভালোবাসা। সবার চেয়ে বড় কথা মানুষই নির্ণায়ক। তাদের কথা মনে রাখাই সুশাসন।
পাকিস্তানের শাসকেরা তা মানেননি। তারা গণতন্ত্রের চর্চা করেননি। তারা অর্থনীতিকে পাত্তা দেননি। আমাদের বাস্তবতা ভিন্ন। আমদের নেতা শেখ হাসিনা। তিনি চেষ্টা করেন। স্বপ্ন বাস্তবায়িত করে দেখান। সমস্যা হচ্ছে অন্য জায়গায়। ব্যাপক দুর্নীতি আর লুটপাটের জন্য আমাদের ভয়। পাকিস্তান যেন চোখ খুলে দেয়। কার্পাস, শ্রমশক্তি, গম, তৈরি পোশাক শিল্পসহ নানা বিষয়ে এগিয়ে থাকা দেশটি তার পর্যটন হারিয়েছে। এখন তার আম-ছালা দুটি যাবার পথে। বাংলাদেশের জন্ম হয়েছে তাদের অন্যায় আর অবিচারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে। আমরা ইতিহাসের রক্তধোয়া জাতি। কিন্তু কারও অমঙ্গল আমরা চাই না। আমরা প্রত্যাশা করি বাংলাদেশের নেতা, নেতৃত্ব আর জনগণ শক্তি হয়ে দেশ ও জাতিকে বাঁচিয়ে রাখবে। উন্নয়ন থাকবে অব্যহত।