আমরা কি জানি, দুই ঈদে জাকাত-ফিতরাসহ উপহার বাবদ কত অর্থের লেনদেন হয়ে থাকে? নিশ্চয় ভালো হয় এ অর্থটা দীর্ঘমেয়াদি কাজে লাগলে।
Published : 11 Apr 2024, 07:46 PM
রাজধানীর যে এলাকায় আমরা থাকি, সেখানটা এত সুনসান হয়ে আছে যে– একটু অবাকই লাগছে। সাপ্তাহিক ছুটিছাটায়, এমনকি কোনো কারণে সেটা কিঞ্চিৎ দীর্ঘ হয়ে পড়লেও এত সুনসান কখনও হয় না এলাকাটা। দুপুরবেলা শালিক আর চড়ুইয়ের ডাক শোনা যাচ্ছে। কাক নাকি কমে যাচ্ছে শহরে। কাক আসলেই কম দেখছি আজকাল। সে কারণে পরিবেশগত ভারসাম্য আরও বিনষ্ট হতে পারে। অনলাইনে খবর দেখছি, আজও ঢাকার বাতাসের মান খারাপ। বিশ্বের ১০০টি শহরের মধ্যে ঢাকা আছে নিচের দিক থেকে সাত নম্বরে। বৃষ্টি হলেও এখানে বাতাস স্বাস্থ্যকর হচ্ছে না। কলকারখানা আর নির্মাণকাজ বন্ধ এখন; যান চলাচলও অনেক কমে এসেছে। তারপরও ঢাকার বাতাস অস্বাস্থ্যকর! করোনা কেটে যাওয়ার পরও এ অবস্থায় তাই মাস্কের চাহিদা খুব একটা কমেনি। তারপরও ভালো লাগছে রাজধানীর এ সুনসান পরিবেশটা।
ঈদ আর নববর্ষ মিলিয়ে লম্বা ছুটি পড়েছে এবার। সংবাদপত্রে এত দীর্ঘ ছুটি পড়েছে যে, এর ভালো-মন্দ নিয়েও কথা হচ্ছে। কথাবার্তা হওয়া ভালো। ঈদের দীর্ঘ ছুটি নিয়েও কথা হতে পারে। কথা হতে পারে আমাদের কাজের সংস্কৃতি নিয়ে। কাজের বিনিময়ে কে কতটা পায়, তা নিয়েও। উৎসবে লম্বা ছুটির পক্ষে আমি; যে কোনো উৎসবে। বছরের অন্যান্য ছুটি কমিয়ে হলেও উৎসবে ছুটি বাড়ানো দরকার। তাহলে সেটা কাজে লাগাতে পারে মানুষ। যেমন, গ্রামে যাদের শেকড় রয়ে গেছে, তারা যেতে পারে সেখানে। রেখে আসা পরিবারের সঙ্গে গিয়ে মিলতে পারে কিংবা সেখানে নিয়ে যেতে পারে নিজের ছোট পরিবারটিকে। এর মূল্য তারা বুঝব না, যারা বরাবর সুনসান হয়ে আসা শহরগুলোতেই থেকে যাই এমনকি ঈদে।
আমাদের বাসায় যে দু’জন গৃহকর্মী পালাক্রমে কাজ করে যাচ্ছেন, তারা চলে গেছেন গ্রামে। ঈদের আগের দিন পর্যন্ত কাজ করেছেন। আমাদের তরফ থেকে এবার অপ্রত্যাশিত বেশি ‘বোনাস’ পেয়ে তারা বেজায় আনন্দিত। আনন্দ গোপন করতে জানে না এরা। তাদের মুখভর্তি আনন্দ দেখে আমাদেরও ভালো লেগেছে সেদিন বিকেলবেলা। কত সামান্যে খুশি হয় আজও এদেশের মানুষ! আর ঈদের মতো উৎসব এলে এইসব ঘটে থাকে।
তাদের সঙ্গে আমি একমত নই, যারা বলেন– মানুষের মধ্যে দেওয়ার প্রবণতা কমেছে। অর্থ উপার্জন ক্ষমতা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে দেওয়ার প্রবণতা বেড়েছে বরং। সেটা হয়তো আরও বাড়ানো দরকার। বাড়ানো যেতে পারে। আমরা কি জানি, দুই ঈদে জাকাত-ফিতরাসহ উপহার বাবদ কত অর্থের লেনদেন হয়ে থাকে? নিশ্চয় ভালো হয় এ অর্থটা দীর্ঘমেয়াদি কাজে লাগলে। বিত্তশালী লোকজন যদি টার্গেট করে প্রতি ঈদে একেকজন দরিদ্রকে দাঁড় করিয়ে দিতে উদ্যোগী হয়, তবে সেটা অবশ্যই কাজের কাজ হবে। এটা যে একদম হচ্ছে না, তাও নয়। পরিচিত একজন এই ঈদে আর কাউকে কিছু দিচ্ছেন না– এক ঋণগ্রস্ত স্বজনকে ঋণমুক্ত করবেন বলে। এর চেয়ে ভালো কাজ আর কী হতে পারে? তবে বিক্ষিপ্ত দেওয়াথোয়ার ভেতর দিয়েও অর্থনীতি হয়ে ওঠে চাঙ্গা। বিভিন্ন খাতে এবার নাকি এক লাখ ৫০ থেকে এক লাখ ৭০ হাজার কোটি টাকার লেনদেন হবে। আর এর একটা বড় অংশ চলে যাবে উপর থেকে নিচে এবং গ্রামের দিকে।
ঘরে বসে পাখির ডাক আর মাঝেমধ্যে গলিপথে একটা-দু’টা গাড়ির হর্ন শুনতে শুনতে ভাবছি, ঢাকার কত শতাংশ লোক অস্বাস্থ্যকর বাতাসের এ শহর ছেড়ে এরই মধ্যে গ্রামাঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েছে? তারা এখন নিশ্চয় নির্মল বায়ু সেবন করছে স্বজনদের সান্নিধ্যে। হয়তো গ্রামে রয়ে যাওয়া ছেলেবেলার অভিন্ন হৃদয় বন্ধুটির সঙ্গেও দেখা হয়ে যাচ্ছে তাদের। এর মূল্য পরিমাপ করা কঠিন। তবে ভেবে খারাপ লাগছে যে, এপ্রিলের এ সময়টায় দেশের অনেক অঞ্চলে গরম পড়েছে বেশ এবং কোথাও কোথাও মৃদু থেকে মাঝারি তাপপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে। বৃষ্টিও হচ্ছে কোথাও কোথাও। ঈদের ছুটিতে বৃষ্টির পূর্বাভাস রয়েছে।
দেশের কোনো কোনো এলাকায় অবশ্য একদিন আগেই ঈদ পালন করেছে কিছু মানুষ। আর ঈদের দিনক্ষণ নিয়ে বিতর্ক বাড়ছে। ফেসবুকেও ছড়িয়ে পড়ছে এমন বিতর্ক। তবে যারা যেদিনই ঈদ পালন করুক– এতে আনন্দের যোগ একই। এ নিয়ে রেষারেষি না হলেই হয়। সমাজে এমনিতেই অনেক কিছু নিয়ে রেষারেষি বাড়ছে। সম্পর্কের হচ্ছে অবনতি। ঈদের সময়টায় এটা কমে আসা বরং জরুরি। এক সময় তো বিভিন্ন ধর্মসম্প্রদায়ের মধ্যেও আনন্দের বিস্তার ঘটতো এমনকি ধর্মীয় উৎসবে। একের উৎসবে অন্যরা আমন্ত্রিত হতো আর তারা এসে অংশ নিতো সোৎসাহে। এখনও যেখানে যেটুকু রয়েছে এর অনুশীলন, তা অব্যাহত রাখা চাই। সবকিছুতে আমরা যেন নিজেদের মানবিক পরিচয়কে তুলে ধরতে পারি ঊর্ধ্বে। সেটাই আমাদের বাঁচাবে আর করবে ভবিষ্যৎ নির্মাণ।
ঈদের দীর্ঘ ছুটিতে যারা বেড়াতে গেছি দেশের পর্যটন স্পটগুলোয়, সেখানে আমরা যেন পরিবেশ বিনষ্ট না করি। দেশের বাইরেও বেড়াতে যাচ্ছে অনেকে। ওখানে গিয়ে তারা খরচ করবে দেশে উপার্জিত অর্থ। বেশ কিছু ডলার চলে যাবে দেশের বাইরে। এ সংকট অবশ্য কিছুটা স্তিমিত হয়ে আসার প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। এতে আবার আছে ঈদের অবদান। প্রতি ঈদেই প্রবাসী আয় আসা বেড়ে যায়। গ্রাম থেকে শহরে কিংবা বিদেশে যারা যায়, তাদের সিংহভাগ তো যায় অর্থ উপার্জন করতেই। বড় উৎসবে তারা বেশি অর্থ পাঠায় স্বজনদের কাছে। এখনও অটুট পারিবারিক বন্ধনের কারণেও এমনটা ঘটছে। বেশি টাকা পাওয়া যাচ্ছে বলে হুন্ডিতেও অনেক প্রবাসী আয় আসছে এখনও। তবে যেভাবেই আসুক, এর বড় অংশ ব্যয় হচ্ছে ভোগ্যপণ্য কেনাকাটায়।
এই যে ঈদে পণ্যবাজার চাঙ্গা হয়ে উঠছে, তাতে মূল অবদান রাখছে প্রবাসী আয়। দেশের কিছু অঞ্চলে আলাদা করে মূল্যস্ফীতি বেশি– সেখানকার মানুষজন অধিক হারে বিদেশে গেছে বলে। ঈদে তাদেরও অনেকে এসে যোগ দিয়েছে দেশে রেখে যাওয়া স্বজনদের সঙ্গে। বহু পরিবারে এটা ঘিরে তৈরি হয়েছে উৎসবমুখর পরিবেশ। ঈদের লম্বা ছুটিতে সামাজিক অন্যান্য কাজও হবে গ্রামে। শুধু বিয়েশাদি নয়; হবে বিরোধ নিষ্পত্তিও। মন কষাকষির অবসান হবে অনেকের মধ্যে।
ঈদের ছুটিতে মানুষ মুখোমুখি বসে আলাপ করবে কত কিছু নিয়ে! জাতীয় নির্বাচন হয়ে গেছে। সামনে উপজেলা নির্বাচন। এসব ঘিরে যা হচ্ছে, তা নিয়েও কি আলাপ করবে না মানুষ? ফেসবুকে মনের সব কথা মানুষ বলে না নানা কারণে। কিন্তু প্রিয়জনের সান্নিধ্যে গেলে বলে। ঈদের ছুটিতে এসব বলাবলি বাড়বে। দেশের অর্থনীতির গতিপ্রকৃতি নিয়েও কম কথা হবে না। শহরাঞ্চলে কাজকর্ম করা মানুষের কাছ থেকে লোকে বরাবরই শুনতে চায় দেশের ‘আসল খবর’। শহরাঞ্চলের মানুষেরও ভালো করে খোঁজ নেওয়া দরকার কৃষিকাজের। এ খাত বড় রূপান্তরের ভেতর দিয়ে যাচ্ছে। মাঠে এখন বোরো ফসল। এর ওপর আমাদের নির্ভর করে থাকতে হবে বছরের বেশিরভাগ সময়। শহর থেকে গ্রামে যাওয়া শিশু-কিশোরদের আমরা যেন এ কথাটা বলি।
এবার আলুর ভালো দাম নাকি পাচ্ছে কৃষক। পেঁয়াজেরও। আসছে মৌসুমে তারা যেন ধানেরও ভালো দাম পায়। তাহলে কিছু বাড়তি আয় আসবে কৃষিজীবী পরিবারগুলোয়। তাহলে তাদের আর সঞ্চয় ভেঙে, ধারকর্জ করে চলতে হবে না। বিদেশ আর শহর থেকে অর্থ প্রাপ্তির অপেক্ষায়ও থাকতে হবে না তাদের। তারা তখন নিজেদের আয় থেকেই স্বাস্থ্য সুরক্ষা আর শিক্ষার মতো খাতে খরচ করতে পারবে। কৃষিকাজেও আগ্রহ হারাবে না। ধান-চাল উৎপাদনের মতো কাজে কৃষক আগ্রহ হারালে কী হবে আমাদের? সরকার কিছু চাল আমদানির উদ্যোগ নিয়েছে এর মধ্যে। গরুও নাকি আমদানি হবে! এদিকে কমে এসেছে আমদানি সক্ষমতা। ঈদে যে গরুছাগল আমাদের প্রয়োজন, তা অবশ্য নিজেরাই জোগান দিচ্ছি দেশের ছোট-বড় খামার থেকে। আর রোজার ঈদে জামাকাপড়সহ যেসব ভোগ্যপণ্য লাগে, তার সিংহভাগ এখন উৎপাদিত হয় দেশেই। এক সময় এ ক্ষেত্রে আমরা ছিলাম আমদানিনির্ভর।
তৈরি পোশাক শিল্পে আমাদের কত সুনাম সারা বিশ্বে! একথাও ঠিক, প্রতি ঈদের আগে এ শিল্পের কর্মীদের বেতন-ভাতা সময়মতো পরিশোধ হয় না। এ নিয়ে কখনও কখনও ঘটে আইনশৃঙ্খলার অবনতি। এবার অবশ্য তেমন কিছুর খবর মেলেনি। বিজিএমইএভুক্ত সব প্রতিষ্ঠানে নাকি বোনাস দেওয়া হয়েছে, দেরিতে হলেও। মার্চের বেতন কি পরিশোধ হয়েছে? আর যেগুলো বিজিএমইএভুক্ত নয়, সেখানে? এ খাতে নতুন মজুরি কাঠামো কার্যকর হয়েছে অবশ্য। তাতে কর্মীদের বেতন-ভাতা বেড়েছে। এবারের ঈদে এটা তাদের জন্য একটু হলেও বাড়তি আনন্দ বয়ে আনবে। দেশে যে লাখ লাখ দোকানপাট রয়েছে পোশাকসহ বিভিন্ন ভোগ্যপণ্যের; তারাও রোজায় ভালো বেচাকেনা হওয়ায় আনন্দিত নিশ্চয়। তবে ব্যবসা প্রত্যাশিতভাবে বেড়েছে কিনা, এ প্রশ্ন অনেকেই তুলবেন।
ঈদে বোধগম্য নানা কারণে বাজারে অর্থ সরবরাহ বাড়ে। তবে অনেকের হাতেই অর্থকড়ি নেই তেমন। টানা উচ্চ মূল্যস্ফীতি তাদের অবস্থার অবনতি ঘটিয়েছে এরই মধ্যে। ঈদের আগ দিয়ে রাজধানীতে একজন বেকার হয়ে পড়া পিতা সন্তানকে হত্যা করে ঝুলে পড়েছেন রজ্জুতে। অর্থসংকটে আরও কিছু মর্মান্তিক ঘটনার খবর রয়েছে। তবে কঠিন সংকটে পড়েও সবাই নিশ্চয়ই আত্মহননের পথ বেছে নেবে না। মানুষ লড়াই করবে তার অবস্থা পরিবর্তনের জন্য। রাষ্ট্রকে এসে দাঁড়াতে হবে তার পাশে। আর এটাই তো ছিল মুক্তিযুদ্ধের অঙ্গীকার।
ঈদের পর যে নববর্ষ আমরা উদযাপন করব, তাতে মিলব সব ধর্মসম্প্রদায়ের মানুষ। পাহাড় আর সমতলের নৃগোষ্ঠীগুলোও এতে শামিল হবে। তখন আমরা নতুন করে ভাবব পরস্পরের মঙ্গল নিয়ে। রাষ্ট্র হিসেবে কীভাবে আমরা সংকটমুক্ত আর সফল হতে পারি, সে আলাপও নিশ্চয় করব।