রঙ্গরসিকতা, ব্যঙ্গবিদ্রুপ, তামাশা, সবই চলবে, চলুক। শতফুল ও সহস্র আগাছা বিকশিত হোক। কিন্তু আমরা এখন যে বিপদের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে, যথার্থ রাজনীতিই তার মোকাবিলার একমাত্র উপায়।
Published : 04 Jul 2023, 07:30 PM
বাংলাদেশে এখন সুস্থ ধারার রাজনীতির চর্চা নেই। কোনো সামাজিক-রাজনৈতিক অন্যায় ও অপকর্মের জোরালো প্রতিবাদ নেই। আছে কেবল ঠাট্টা-মশকরা। ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ। একটা ‘হাওয়া হাওয়া’ সংস্কৃতি।
তরুণ প্রজন্মের আর কিছু থাকুক আর না থাকুক, সবার হাতে একটা করে স্মার্টফোন আছে। আর আছে একটা ফেইসবুক আইডি। বাংলাদেশে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের পরিধি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মানুষের নিজস্ব মতামত সবার কাছে প্রকাশ করা এখন বেশ সহজ হয়েছে। আত্মপ্রদর্শন আর কাণ্ডজ্ঞানবর্জিত মত প্রকাশের অবারিত মাঠ হয়ে উঠেছে এই ফেইসবুক।
দৈনন্দিন জীবনের নানা খুঁটিনাটি বিষয় থেকে শুরু করে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি, অগণতান্ত্রিকতা, দুর্নীতির মতো জাতীয় ইস্যুসহ যেকোনো সামাজিক সমস্যায় অকাতরে ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ বা ট্রল করতে দেখা যায়। কেউ কেউ বলে থাকেন, বিভিন্ন ইস্যুতে হতাশা কাটাতেই সোশ্যাল মিডিয়ায় এমন হাসিঠাট্টা করাকে বেছে নিচ্ছে মানুষ! আবার কারও কারও মতে, এটা প্রতিবাদের বিকল্প পন্থা!
আমাদের রাজনীতিতে দীর্ঘদিন ধরেই নানা রকম অলীক কুনাট্য মঞ্চস্থ হচ্ছে। আর তার প্রতিক্রিয়ায় সমাজমাধ্যমে সৃষ্টি হচ্ছে ব্যঙ্গবিদ্রুপের প্লাবন। গদ্যে, পদ্যে, ছবিতে মুহুর্মুহু ক্ষেপণাস্ত্র ছুটছে ক্ষমতার বড়, মেজো, সেজো, ছোট কারবারি এবং তাদের চেলাচামুণ্ডাদের নিশানা করে। ব্যঙ্গের বিস্তর রসদ রাজনীতিবিদরা সরবরাহ করছেন, রসিক জনগণ পরম উৎসাহে ওইসব ব্যবহার করছে।
সদ্ব্যবহার কি না, সেটা অবশ্য তর্কের বিষয়। বঙ্গীয় রসিকতা গত এক দশকে উচ্চফলনশীল, কিন্তু ফলন ভালো হলেই ফসল স্বাদে-গন্ধে উৎকৃষ্ট হবে, পুষ্টিকর হবে, তা নয়— ভালোবেসে কিনে আনা কমলাটি দেখতে একেবারে মসৃণ, আকর্ষণীয়, খেতে গেলে বিস্বাদ, এ-রকম তো কতই হচ্ছে।
রাজনৈতিক ব্যঙ্গের ইতিহাস প্রাচীন, সমৃদ্ধ। দুনিয়ার কথা ছেড়ে দিলাম, বাংলা ভাষার ভাণ্ডারেই জমা আছে তার বিবিধ রতন। সেই মাপকাঠিতে দেখলে সমাজমাধ্যমে উৎপন্ন এ-কালের ফসল নিয়ে উচ্ছ্বসিত হওয়া কঠিন।
সেটা অস্বাভাবিক নয়। জমি যেমন, ফসল তেমনই হয়ে থাকে। আমাদের সমাজে, বিশেষত সমাজমাধ্যমে, রাজনীতির আলোচনা বলতে ইদানীং যে জিনিস প্রচলিত হয়েছে, তার বেশিরভাগটাই রবীন্দ্রনাথের ‘কালান্তর’ প্রবন্ধের সূচনায় বলা ‘চণ্ডীমণ্ডপের আখড়া’র কথা মনে পড়িয়ে দেয়। পারস্পরিক কুৎসা বা গালিগালাজের প্রসঙ্গে যাওয়ার দরকার নেই, ওই আবর্জনা সব যুগেই থাকে, কম বা বেশি। রবীন্দ্রনাথও সে-পাঁক ঘাঁটতে যাননি, তাঁর সমালোচনার লক্ষ্য ছিল সমাজের সীমাবদ্ধ মনের ক্ষুদ্রতা: ‘‘যে জগতের মধ্যে বাস সেটা সংকীর্ণ এবং অতি-পরিচিত। তার সমস্ত তথ্য এবং রসধারা বংশানুক্রমে বৎসরে বৎসরে বার বার হয়েছে আবর্তিত অপরিবর্তিত চক্রপথে, সেইগুলিকে অবলম্বন করে আমাদের জীবন-যাত্রার সংস্কার নিবিড় হয়ে জমে উঠেছে, সেই সকল কঠিন সংস্কারের ইঁটপাথর দিয়ে আমাদের বিশেষ সংসারের নির্মাণকার্য সমাধা হয়ে গিয়েছিল।’’
আমাদের রাজনীতি ক্রমেই যেন ক্ষুদ্রতা ও তুচ্ছতার আখড়ায় পরিণত, আর রাজনীতির আলোচনা তার গণ্ডিতেই চক্রপথে আবর্তিত হয়ে চলে, সেই চাক থেকেই উঠে আসে আমাদের রঙ্গরসিকতা। রাজনীতি এবং রাজনীতিক নিয়ে আমরা হরেক রকমের তামাশা করি, হুল ফোটাই, পয়ার-ত্রিপদীতে চমৎকার চালাকি ছুড়ে দিই, কিন্তু যে গভীর বোধ এবং তীক্ষ্ণ সমালোচনা কৌতুক বা ব্যঙ্গকে যথার্থ রাজনৈতিক হাতিয়ারে পরিণত করতে পারে, এই ফেনার সাগর সেচে তার সন্ধান সচরাচর মেলে না। ক্রমাগত ভেসে আসা নানান রসিকতা পড়ি, দেখি, শুনি, হাসি, শেয়ার করি, এবং পরবর্তী রসিকতার দিকে এগিয়ে যাই।
শুধু তুরস্ক নয়, গণতন্ত্রের অন্যতম সেরা বিজ্ঞাপনের দেশ ভারতসহ আরও কিছু দেশে যে প্রবণতাটি লক্ষ করা যাচ্ছে, তা হলো গণতন্ত্র থেকে একনায়কতন্ত্রের পথে যাত্রা। তিল তিল করে একেকটি দেশ পৌঁছে যাচ্ছে স্বৈরশাসনের নিবিড় ঘন আঁধারে। অনেক দিন পর্যন্ত এরদোয়ান ও তার সাগরেদদের নানা উৎকট আচরণ দেখে অনেকেই হেসেছে, রসিকতা করেছে, বলেছে— ওদের এত পাত্তা দেওয়ার মানে হয় না, দেশের মানুষ ওদের ঠিক ঠিক চিনে নেবে এবং কুলোর বাতাস দিয়ে বিদেয় করবে। ঘটেছে তার উল্টো। হাসিঠাট্টা, রঙ্গব্যঙ্গ, সব কিছু হজম করে নিয়েছেন তারা, উত্তরোত্তর চেপে বসেছেন ক্ষমতায়, ব্যঙ্গবিদ্রুপের স্রষ্টারা যখন সেটা টের পেয়েছেন ততদিনে আর কিছু করার নেই। ২০১৭-এর গোড়ার দিকে আমেরিকায় এক অনুষ্ঠানে তখনকার নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্পকে নিয়ে ঠাট্টাতামাশায় মশগুল মেয়েদের উদ্দেশে এক তরুণী তুর্কি বলেছিলেন, ‘‘হাসছেন বটে, কিন্তু সাবধান— কেন হাসছেন এবং কেমন হাসি হাসছেন, সেটার দিকে খেয়াল রাখবেন।’’
কেন হাসছি, কেমন হাসি হাসছি, নিজের কাছে, নিজেদের কাছে সেই হাসির কী মানে তৈরি করছি, এই প্রশ্নগুলো আসলেই ভাবনার বিষয়। ক্ষমতাবানদের ব্যঙ্গ করে, বিদ্রুপে বিদ্ধ করে আমরা অনেক সময়েই মনে মনে প্রতিবাদের স্বাদ মেটাই। সমাজমাধ্যমের কল্যাণে ইদানীং এই মানসিকতা আরও জোরদার হয়েছে— ক্ষমতাবানের প্রতি কেউ একটি ব্যঙ্গ বা বিদ্রুপের বাণ ছুড়ে দিলেই যদি মুহূর্তের মধ্যে সেটি লক্ষ জনের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে, তা হলে সেই জনমনে এক ধরনের প্রতিবাদী সংহতির বোধ তৈরি হওয়া অসঙ্গত নয়। সেই বোধ সহজেই আত্মতৃপ্তিতে পরিণত হতে পারে। সে-পরিণতি শুধু দুর্ভাগ্যজনক নয়, বিপজ্জনকও বটে, কারণ তা প্রতিস্পর্ধী রাজনীতির শক্তি হরণ করে। ব্যঙ্গ তখন রাজনীতির প্রকরণ না হয়ে রাজনীতির বিকল্প হয়ে ওঠে। এবং তার ফলে এক অমোঘ দ্বান্দ্বিক প্রক্রিয়ায় সেই ব্যঙ্গ ক্রমশ তার রাজনৈতিক চরিত্র হারিয়ে ফেলে, হয়ে ওঠে রাজনীতির মোড়কে গণ-বিনোদনের পণ্য।
ফেইসবুক-আদি সমাজমাধ্যমের বাণিজ্য-কৌশল এই জনপ্রিয়তাকে একটা অপূর্ব গুরুত্ব এবং প্রতিষ্ঠা দিয়েছে। সেই বাণিজ্যের ভুবনে পরিচিত ‘মেটকাফ সূত্র’ অনুসারে, একটি যোগাযোগমাধ্যম যত জন ব্যবহার করছেন সে-সংখ্যা দ্বিগুণ হলে ওই মাধ্যমের ব্যবসায়িক দর চারগুণ বেড়ে যায়, সংখ্যাটি পাঁচগুণ হলে দর বাড়ে পঁচিশগুণ। এই সূত্র ধরে আমেরিকার বামপন্থী রাষ্ট্রবিজ্ঞানী জোডি ডিন তাঁর ‘কমিউনিকেটিভ ক্যাপিটালিজ়ম’-এর ধারণাটি ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেছেন, এই ব্যবসার চালকদের কাছে আমার-আপনার কোনও মেসেজ-এর নিজস্ব কোনও মূল্য নেই, বার্তাটি কত লোক দেখলেন, কত জন তাতে লাইক দিলেন, কত জন শেয়ার করলেন, সেগুলোই মূল্যবান। পুরনো গণমাধ্যমেও এই হিসেব ক্রমশই আধিপত্য বিস্তার করেছে— টেলিভিশন চ্যানেলের টিআরপি রেটিংয়ের মাহাত্ম্য সর্বজনবিদিত। কিন্তু সমাজমাধ্যমের চরিত্র ও বিস্তার সেই আধিপত্যকে পৌঁছে দিয়েছে এক সম্পূর্ণ নতুন মাত্রায়। আর তার অনিবার্য প্রভাব পড়েছে আমাদের চেতনায়। আমরা সেই ভাবেই ভাবতে অভ্যস্ত হয়েছি, যা তৎক্ষণাৎ বহু জনের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারে। তার শ্রেষ্ঠ উপায় এমন কিছু বলা বা করা যাতে অনেককে চমক দেওয়া যায়। আমরা এখন মানুষকে ভাবিয়ে তুলতে চাই না, চমক দিতে চাই। আমাদের রাজনৈতিক ব্যঙ্গও সেই ধারায় গা ভাসিয়েছে।
ওই কারণেই আত্মোপলব্ধি এখন খুব জরুরি। রঙ্গরসিকতা, ব্যঙ্গবিদ্রুপ, তামাশা, সবই চলবে, চলুক। শতফুল ও সহস্র আগাছা বিকশিত হোক। কিন্তু আমরা এখন যে বিপদের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে, যথার্থ রাজনীতিই তার মোকাবিলার একমাত্র উপায়। সে রাজনীতি পরিশ্রমের, সংগঠনের, সমন্বয়ের। প্রতিবাদের, প্রতিরোধেরও। সেই পথে না হেঁটে যদি কেবল ব্যঙ্গ ও বিদ্রুপের মৌতাতে বিভোর হয়ে ‘কেমন দিলাম’ ভেবে আত্মপ্রসাদ অনুভব করি, তা হলে অচিরেই আমরাও ফেইসবুকের পর্দার সামনে বসে পরম আমোদে পরস্পরকে বলতে পারব— কী করে একটা দেশকে রসাতলে পাঠাতে হয়!