লুমনা-১০ বলে একটা ট্যাবলেটের দাম মাঝে ১২ থেকে ১৬ টাকা হয়ে গিয়েছিল। একটি সুপরিচিত ওষুধ কোম্পানির ট্যাবলেট এটা। ঘটনাটা উল্লেখ করছি এজন্য যে, নির্দিষ্ট ওই ওষুধের দাম কমে আবার ১২ টাকা হয়ে গেছে। আর কোনো ওষুধের বেলায় এমনটা ঘটেছে কিনা, তা সংশ্লিষ্টরাই বলতে পারবেন। পরিচিত দু'একটা দোকানে খোঁজ নিয়ে দেখেছি, আর কোনো ওষুধের দাম কমেছে বলে তাদের জানা নেই। লুমনার দাম কমেছে দেখে তারা একটু অবাক। সংশ্লিষ্ট ওষুধ কোম্পানির কোনো প্রতিনিধিকে পেলে হয়তো জিজ্ঞেস করতাম—ঘটনা কী? কিন্তু তারা কি সঠিক কারণ বলতে পারবেন?
এমন কিছু ঘটতে দেখলে তার ওপর অনুসন্ধানমূলক প্রতিবেদন হওয়া কি জরুরি নয়? নিশ্চয়ই ভুল করে দাম বাড়িয়ে পরে সেটা সংশোধন করা হয়নি। ওষুধের দাম নির্ধারণে সাধারণভাবে প্রধান ভূমিকা রাখে এর উপকরণ ব্যয়। একই গ্রুপের ওষুধের দামে অনেক ক্ষেত্রে কোম্পানিভেদে বড় তফাৎ হতে দেখা যায়। এর পেছনে মূলত থাকে উপকরণ ব্যয়। কে কোন উৎস থেকে উপকরণ সংগ্রহ করছে, সেটা বড় ব্যাপার। ওষুধের দাম নির্ধারণে ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরের সম্মতি নিতে উপকরণ ব্যয়সহ একটা বিবরণী জমা দিতে হয়। কোম্পানি যে সে অনুযায়ীই ওষুধ বানাবে, তা হয়তো নয়। এক্ষেত্রে কিছু অনিয়ম নাকি হয়েই থাকে। তবে ওষুধ প্রশাসন ওই বিবরণী দেখেই প্রস্তাবিত দাম অনুমোদন করে। দাম বৃদ্ধির বেলায়ও নিশ্চয়ই একই পদ্ধতি অনুসৃত হয়।
সাম্প্রতিককালে বেশ কিছু ওষুধের দাম বাড়ানো হয়েছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে দাম বেড়েছে উল্লেখযোগ্যভাবে। এ বিষয়ে প্রতিবেদন এসেছে মিডিয়ায়। ওষুধের দাম বাড়ানোর কারণ বলা হয়েছে তাতে। লুমনার দামও ওই সময়ে বেড়েছিল। এটি যে গ্রুপের ওষুধ, তা বিভিন্ন ব্র্যান্ড নেইমে বানিয়ে থাকে আরও কিছু কোম্পানি। ওদেরও কেউ কেউ তখন দাম বাড়ায়। তারও কারণ নিশ্চয়ই দেখানো হয়েছিল। বিষয় সেটা নয়। প্রশ্ন হলো, আলোচ্য ট্যাবলেটের দাম চার টাকা বাড়িয়ে কেন আবার আগের দামে ফেরত আনা হলো?
লুমনা-১০ উৎপাদনকারী কোম্পানি দাম কমাতে পারলে একই ট্যাবলেট উৎপাদনকারী অন্যান্য কোম্পানিও কেন কমাবে না? অন্তত দুটি কোম্পানির নাম এখানে বলতে পারব, যারা একই সময়ে দাম দেড় টাকা বাড়িয়ে এখনও কমায়নি। নাকি লুমনার বেলায় বিশেষ কিছু ঘটেছে? আগে যে উপকরণে ওষুধটি বানানো হতো—এখন কি তার চেয়ে কম দামি উপকরণে হচ্ছে? নাকি একই উপকরণের দাম বেড়ে আবার কমে গেছে? ব্যাপারটা খতিয়ে দেখা দরকার বুঝতে যে, এ ধারায় আরও কিছু ওষুধের বর্ধিত দাম কমিয়ে আনা যেতে পারে কিনা।
'অত্যাবশ্যকীয়' কিছু ওষুধের একটা তালিকা আছে, যেগুলোর দাম অধিদপ্তর স্থির করে। যেমন প্যারাসিটামল গ্রুপের ওষুধ। এমন কোনো কোম্পানি বোধহয় নেই, যারা বহুল ব্যবহৃত এ ওষুধ উৎপাদন করে না। অনেক আগে নির্ধারিত দামে এসব ওষুধ উৎপাদন করে নাকি পোষাচ্ছিল না কোম্পানিগুলোর। তাদের দাবিতে সরকার ওই তালিকার বেশ কিছু ওষুধের দাম বাড়ায় কিছুদিন আগে। 'কিছুদিন আগে' মানে ওই সময়ে, যখন অন্যান্য ওষুধের দামও বাড়ছিল। ওটা আবার ছিল করোনা ও তৎপরবর্তী সময়, যখন বহু পরিবারে আকস্মিকভাবে বেড়ে গিয়েছিল চিকিৎসা ব্যয়। মূল্যস্ফীতিও বাড়ছিল। এর মধ্যে আবার কর্মসংস্থান ও আয় যাচ্ছিল কমে।
ওষুধের দামই শুধু বেড়েছে, তা তো নয়। ডাক্তারের ফি, টেস্টের রেইট কি বাড়েনি? সব ডাক্তার হয়তো ফি বাড়াননি; তবে সব ডায়াগনস্টিক সেন্টারই সম্ভবত টেস্টের রেইট বাড়িয়েছে। ঘরে ঘরে এমন রোগী তো আছে, যাদের বছরে অন্তত দু'বার ডাক্তার দেখাতে হয়। তখন অনেক ক্ষেত্রে টেস্টও করাতে হয় তাদের। কত শতাংশ রোগী এ সময়ে বর্ধিত চিকিৎসা ব্যয় মেটাতে না পেরে 'ফলো-আপ' করেননি? এমনকি দাম একযোগে বেড়ে যাওয়ায় কিছু ওষুধ সেবন বাদ দিয়েছেন?
দেশে ডায়াবেটিস রোগী কত? অশনাক্ত রোগী বোধহয় আরও বেশি হবে। এদের অনেককে নিতে হয় ইনসুলিন। আমদানিকৃত ইনসুলিনও কম ব্যবহৃত হয় না। চেনাজানা এক চিকিৎসককে জিজ্ঞেস করেছিলাম, কেন তারা দেশে উৎপাদিত ইনসুলিন কম প্রেসক্রাইব করেন? তিনি বিরস মুখে বললেন, মানের ব্যাপার আছে। যাহোক, কিছু ইনসুলিনের দামও কাছাকাছি সময়ে বেড়েছিল। সেটাও কি যৌক্তিক ছিল? আমদানিকৃত ইনসুলিনের দামের যৌক্তিকতাই বা বিচার করে কে?
আর টেস্টের রেইট কীভাবে স্থির হয়ে থাকে? সেক্ষেত্রেও উপকরণের দাম নাকি বড় নির্ণায়ক। যে মেশিনে টেস্ট করা হয়, তার দামও। করোনাকালে দুনিয়াজুড়ে এসবের চাহিদা হঠাৎ বেড়ে যাওয়ায় দাম বেড়েছিল নিশ্চয়ই। ওষুধের চাহিদাও বেড়েছিল অনেক। আমাদের ওষুধ কোম্পানিগুলোর ব্যবসা বেড়েছে তখন। ওষুধের দোকানও অনেক বাড়ে। তবে শোনা যাচ্ছিল, চিকিৎসা উপকরণ ও যন্ত্রপাতি আমদানিতে সমস্যা দেখা দিয়েছে। ওই সময় থেকে রিজার্ভ সংকট বাড়তে থাকায় এলসি খুলতে এবং এর নিষ্পত্তিতে ঝামেলা হচ্ছিল। এমন খবরও ছিল, মেডিকেল ডিভাইস সময়মতো আসছিল না বলে জরুরি অপারেশন হচ্ছিল বিঘ্নিত। অপারেশন বাবদ রোগীর ব্যয়ও কি তাতে বেড়ে ওঠেনি?
একটি ট্যাবলেটের দামের বাড়া-কমা নিয়ে আলাপ করতে গিয়ে কত কথা এসে গেল! এসে যাওয়াই স্বাভাবিক। দেশে তো মূল্যস্ফীতি বাড়ছে। একই সময়ে আরও যেসব দেশে মূল্যস্ফীতি ঘটেছিল, তাদের অনেকে এটা কমিয়ে আনতে পারলেও আমরা পারিনি। মূল্যস্ফীতি বরং বেড়ে চলেছে। অন্যরা পারলেও আমরা কেন এক্ষেত্রে সফল হইনি, তা জটিল আলোচনার বিষয়। অর্থনীতিবিদরা সেটা করে চলেছেন। দেরিতে হলেও সরকার যে মূল্যস্ফীতি সহনীয় করে আনতে কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছে না, তাও নয়। এ অবস্থায় জনসাধারণের চিকিৎসা ব্যয়ের দিকে আলাদা করে দৃষ্টি দেওয়া জরুরি বলেই আলাপটা তোলা। নির্দিষ্ট একটি ওষুধের দাম বাড়ার পর সেটা আবার আগের জায়গায় আসার ঘটনায় মনে হলো—অন্যান্য ক্ষেত্রেও এমনটি ঘটানো সম্ভব কিনা, তা খতিয়ে দেখা দরকার।
ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরের বিষয়ে অভিযোগ আছে যে, তারা দাম নির্ধারণসহ কোম্পানিগুলোর কর্মকাণ্ড ঠিকমতো মনিটর করেন না। এ বিষয়ে বিধিবদ্ধ সংস্থাটিরও হয়তো বক্তব্য আছে। নিজেদের নানা 'সীমাবদ্ধতা'র কথা তারা হয়তো বলবেন। তবে এ মুহূর্তে তাদের চিন্তা করে দেখতে হবে, পরিবর্তিত অবস্থায় ওষুধের বেড়ে যাওয়া দামের বিষয়টি কীভাবে 'রিভিউ' করা যায়। যেসব উৎস থেকে কোম্পানিগুলো উপকরণ সংগ্রহ করে, সেখানে এর দাম কমে এসেছে কিনা? বিশ্ববাজারে অনেক পণ্যের দামই কিন্তু উল্লেখযোগ্যভাবে কমে এসেছে। স্থানীয়ভাবে ডলারের দাম বেড়ে যাওয়ায় আমরা হয়তো এর সুফলটা নিতে পারছি না। ওষুধের উপকরণের ক্ষেত্রেও হয়তো সেটা ঘটছে। এটাও ঠিক, বহু ওষুধের দাম কিন্তু আলোচ্য সময়ে বাড়েনি। সেটাই বা কীভাবে সম্ভব হলো? এক্ষেত্রে মানের জায়গায় আপস করা হয়নি তো?
আমাদের ওষুধের মান সাধারণভাবে ভালো এবং দামও নিয়ন্ত্রণে আছে বলে দাবি করা হয়। দেশের চাহিদা মিটিয়ে বেশ কিছু কোম্পানি উন্নত দেশেও ওষুধ রপ্তানি করছে। কিছু কোম্পানি শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত। দু-একটি কোম্পানি বিদেশেও প্লান্ট প্রতিষ্ঠা করছে। এগুলো উৎসাহব্যঞ্জক। এ অবস্থায় অবশ্যই খতিয়ে দেখা দরকার, মাঝে বেশ কিছু ওষুধের দাম বৃদ্ধি (এবং এর হার) স্বাভাবিক ছিল কিনা? লুমনার মতো করে এটা আবার কমিয়ে আনা যায় কিনা? মানের জায়গাটায় অবশ্য কোনো আপস করা যাবে না।
ইনসুলিনে যে বিদেশ নির্ভরতা রয়ে গেছে, তার অবসান ঘটানোতেও দৃষ্টি দিতে হবে। ডায়াবেটিসসহ কিছু রোগে ব্যবহৃত ওষুধ উৎপাদনে সম্ভবত কর-শুল্ক ছাড় দেওয়া হয়েছে চলতি বাজেটে। দামে এর প্রতিফলন আছে কিনা, সেটাও খতিয়ে দেখতে হবে। মাঝে একজন চিকিৎসকের কথা বলছিলাম। তিনি এটাও বলছিলেন, টেস্ট রিপোর্টে কিছু অসঙ্গতি দেখছেন আজকাল। সেজন্য তিনি বলছিলেন—পারলে সরকারি ল্যাবে টেস্ট করিয়ে আনার কথা। তবে কি টেস্টে নিম্নমানের উপকরণ ব্যবহারের প্রবণতাও বেড়েছে? সেটাই বা দেখবে কে?
রাজস্ব আহরণ পরিস্থিতি ভালো নয়। তাই বলে এ দাবি থেকে তো নড়া যাবে না যে, চিকিৎসার বর্ধিত ব্যয় কমিয়ে আনতে সম্ভব সব ক্ষেত্রে কর-শুল্ক ছাড় দিয়ে সরকারকে সদিচ্ছার পরিচয় দিতে হবে। জায়গামতো এর যথাযথ প্রতিফলনও নিশ্চিত করতে হবে তাকে। ওষুধে ফোকাস করে শেষে বলতে চাই, দেশে এর উপকরণের উৎপাদন বাড়ানোর উদ্যোগ জোরদারসহ যেসব সমস্যা 'অ্যাড্রেস' করলে দাম নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব—সেদিকে অবশ্যই দৃষ্টি দিতে হবে।