সক্ষমতার প্রমাণ দিয়েছেন শেখ হাসিনা, বিএনপি কি পেরেছে?

দুর্নীতি-অনিয়ম, লুটপাটের ঘটনা দেশে ঘটছে না, তা নয়। বিদেশে অর্থ পাচারের অভিযোগও বাড়ছে। তবে লুটপাটের কাহিনী কি এই এক যুগে, নাকি এর ধারাবাহিকতা আছে?

বিভুরঞ্জন সরকারবিভুরঞ্জন সরকার
Published : 21 April 2023, 10:27 AM
Updated : 21 April 2023, 10:27 AM

সরকার প্রধান হিসেবে শেখ হাসিনার টানা দায়িত্ব পালনের রেকর্ড করেছেন। পরপর টানা তিন মেয়াদে এবং মোট চারবার প্রধানমন্ত্রী থাকার রেকর্ড কেবল শেখ হাসিনারই আছে। তিনি প্রথম প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নেন ১৯৯৬ সালের ২৩ জুন। এরপর দ্বিতীয় দফায় ২০০৯ সালের ৬ জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন। তারপর ২০১৪ তৃতীয়বার এবং ২০১৯ সালে চতুর্থবার প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নেন। শেখ হাসিনার আগে বাংলাদেশে আর কেউ এত দীর্ঘ সময় সরকার প্রধানের দায়িত্ব পালনের সুযোগ পাননি।

শেখ হাসিনার ঝুলিতে আরও অনেক রেকর্ড রয়েছে। দেশের বৃহত্তম এবং ঐতিহ্যবাহী রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের সভাপতির দায়িত্ব তারচেয়ে বেশি সময় আর কেউ পালন করেননি। বাংলাদেশ রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আওয়ামী লীগের সভাপতির দায়িত্বে ছিলেন ১৯৬৬ সাল থেকে ১৯৭৪ সাল পর্যন্ত। তার আগে দশ বছর অবশ্য তিনি আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্বও পালন করেছেন। অন্যদিকে, শেখ হাসিনা ১৯৮১ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে এখন পর্যন্ত আওয়ামী লীগের সভাপতির দায়িত্ব পালন করে আসছেন। গত ২৪ ডিসেম্বর আওয়ামী লীগের জাতীয় সম্মেলনে ১০ম বারের মতো দলের সভাপতি নির্বাচিত হয়েছেন শেখ হাসিনা।

সংসদীয় রাজনীতিতে বিরোধী দলের নেত্রী হিসেবেও সময়ের হিসাবে এগিয়ে শেখ হাসিনা। ১৯৮৬, ১৯৯১ এবং ২০০১ সালে তিনি জাতীয় সংসদে বিরোধীদলীয় নেত্রী ছিলেন। সরকার পরিচালনায় এবং বিরোধী রাজনীতিতে তিনি তার যোগ্যতা, প্রজ্ঞা, সাহসিকতা এবং দূরদর্শিতার স্বাক্ষর রেখেছেন। তার পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যেমন প্রবীণ নেতাদের চেয়ে নেতৃত্বগুণে এগিয়ে গিয়ে বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা হয়ে উঠেছিলেন, শেখ হাসিনাও তার সময়ের সবাইকে ছাড়িয়ে নিজের নেতৃত্বকে অনন্য এক উচ্চতায় নিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছেন।

দেশের মানুষের অভাব-দুঃখ যে আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে কমেছে, সেটা অস্বীকার করা যাবে না। শেখ হাসিনার প্রধানমন্ত্রিত্বের আগের বাংলাদেশ আর তার শাসনের বাংলাদেশ এক নয়। এক সময় বাংলাদেশ ছিল বড় দেশগুলোর করুণানির্ভর। তলাবিহীন ঝুড়ি। খাদ্য ঘাটতি, ঝড়-বন্যা-জলোচ্ছ্বাস ইত্যাদি প্রাকৃতিক দুর্যোগের নিত্যসঙ্গী ত্রাণ পাওয়ার আশায় হাত পেতে থাকা একটি দেশ। কিন্তু এখন বাংলাদেশ বিশ্বের অনেক দেশের কাছেই উন্নয়নের রোল মডেল। বাংলাদেশকে অনুসরণ করতে বলার মতো মানুষ এখন অনেক আছেন। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় বাংলাদেশ মডেল। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ একদিকে দৃঢ, অন্যদিকে অবস্থা মতো ব্যবস্থা নিতে সক্ষম। 

শেখ হাসিনার হাতে বাংলাদেশ একদিকে যেমন নিরাপদ, অন্যদিকে তেমনি উন্নয়ন-অগ্রগতির উদাহরণ। ২০১৫ সালে নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশ এবং ২০১৮ সালে স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের স্বীকৃতি পেয়েছে বাংলাদেশ। এখন উন্নত দেশের লক্ষ্য অর্জনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেছিলেন, ‘কেউ আমাদের দাবায়ে রাখতে পারবে না'। তার কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আমরা এগিয়ে যাওয়ার গল্প তৈরি করছি একের পর এক। কেউ দাবিয়ে রাখতে পারছে না। 

শেখ হাসিনাকে অসফল প্রমাণ করার ষড়যন্ত্র কম হয়নি। ২০০৯ সালে সরকার গঠনের পর বিডিআর বিদ্রোহের মাধ্যমে সরকার এবং দেশকে অস্থিতিশীল করার এক বড় ষড়যন্ত্র অত্যন্ত সাফল্যের সঙ্গেই মোকাবিলা করতে সক্ষম হয়েছে শেখ হাসিনার সরকার। বিএনপি-জামায়াত শাসনের সময় দেশে জঙ্গিবাদ মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছিল। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পেয়ে জঙ্গিবাদী অপশক্তি দেশকে প্রকাশ্যে মানুষ হত্যার মহড়া দিয়ে মধ্যযুগীয় বর্বরতা দেখাতে পেরেছে। কিন্তু শেখ হাসিনার সরকার দেশকে জঙ্গিবাদ মুক্ত করার ক্ষেত্রে ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে সক্ষম হয়েছে। বেশ কয়েকটি সফল অভিযানের মাধ্যমে জঙ্গিদের গোপন আস্তানা গুড়িয়ে দিয়ে তাদের কার্যক্রম প্রায় বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। জঙ্গিদের সংগঠিত হওয়ার কোনো সুযোগ আইনশৃঙ্খলা বাহিনী দিচ্ছে না।

রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ সরকারবিরোধিতার নামে সহিংতার বিস্তার ঘটিয়ে মানুষকে ভীত-সন্ত্রস্ত করার চেষ্টা একাধিকবার করেছে। ২০১৩ সালের মে মাসে হেফাজতে ইসলামের তাণ্ডব দমনে সরকার বিচক্ষণতার পরিচয় দিয়ে বড় ক্ষয়ক্ষতি এড়াতে সক্ষম হয়েছে। এরপর  ২০১৪ সালে  বিএনপি-জামায়াত নির্বাচনে অংশ না নিয়ে এবং পরের বছর সরকার পতনের ডাক দিয়ে দেশজুড়ে ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছিল। আগুন সন্ত্রাস ছড়িয়ে ভীতিকর অবস্থা তৈরি করা হয়েছিল। মানুষের মনে তৈরি হয়েছিল আতঙ্ক। সরকার পরিস্থিতি সামাল দিতে পারবে কিনা, সে প্রশ্ন দেখা দিয়েছিল। কিন্তু সরকার দৃঢ়তার সঙ্গে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এনে মানুষকে স্বস্তি দিয়েছে। গণতন্ত্রের সুযোগের অপব্যবহার করে সন্ত্রাস-সহিংসতার পথে হেঁটে বিএনপি ও তার সহযেগীরা জনবিচ্ছিন্ন হয়ে এখন রাজনীতিতে খাবি খাচ্ছে। একের পর এক ভুল রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত বিএনপি নামের দলটিকে এখন অস্তিস্ত সংকটের মুখে এনে দাঁড় করিয়েছে। আর শেখ হাসিনা রাজনৈতিক কৌশল এবং ব্যক্তিগত সাহসিকতা  দিয়ে পরিস্থিতি নিজের অনুকূলে রাখতে পেরেছেন।

শুধু রাজনৈতিকভাবেই দেশকে শেখ হাসিনা সংহত অবস্থানে এনেছেন, তা নয়। অর্থনৈতিকভাবেও বাংলাদেশ এখন শক্ত অবস্থানে আছে। কোভিড মহামারির কারণে পৃথিবীব্যাপী বড় সংকট তৈরি হয়েছে। সবকিছু এলোমেলো হয়ে গেছে। উন্নত-সমৃদ্ধ দেশগুলো কোভিডের ক্ষতি পুষিয়ে নিতে ধুঁকছে। পরিস্থিতি মোকাবিলায় হিমশিম খাচ্ছে। কিন্তু শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশের অগ্রযাত্রা মহামারীর সময়ও ছিল, এখনও রয়েছে।

পদ্মা সেতু নির্মাণে দুর্নীতির আগাম অভিযোগ এনে অর্থ সহায়তা না করার সিদ্ধান্ত নিয়ে যারা বাংলাদেশকে বেকায়দায় ফেলতে চেয়েছিল, তারা এখন অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে দেখছে এক নতুন সক্ষম বাংলাদেশকে। পদ্মা সেতু ছাড়াও মেট্টোরেল আংশিকভাবে চালু হয়েছে। বাংলাদেশের যোগাযোগ ব্যবস্থায় এক অভাবনীয় পরিবর্তন এসেছে। ছোটবড় অসংখ্য সেতু মানুষের যাতায়াত সহজ করে তুলেছে। কর্ণফুলী নদীর তলদেশে টানেল নির্মাণ শেষ হতে চলেছে ঢাকা এলিভেটেট এক্সপ্রেসওয়ের মতো মেগা প্রকল্পের কাজও দ্রুত এগিয়ে চলেছে। ঈশ্বরদীতে ব্যয়বহুল পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের কাজও বন্ধ নেই। কক্সবাজারের মাতারবাড়ি এবং পটুয়াখালীর পায়রায় গভীর সমুদ্র বন্দর তৈরির কাজ শুরু হয়েছে। ঢাকা-চট্টগ্রামের মধ্যে বুলেট ট্রেন চালুর কথা ভাবা হচ্ছে। এসব প্রকল্প শেষ হলে বাংলাদেশ সমৃদ্ধির নতুন সোপানে উন্নীত হবে।

বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের মতো কাজগুলো হতে পেরেছে শেখ হাসিনার প্রজ্ঞা ও বলিষ্ঠতার কারণেই। শেখ হাসিনার শাসনকালেই প্রতিবেশী ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে সন্দেহ-অবিশ্বাস দূর হয়েছে। দীর্ঘদিন থেকে ঝুলে থাকা ছিটমহল সমস্যার সম্মানজনক নিষ্পত্তি হয়েছে। সমুদ্রসীমার বিরোধ মিটেছে আন্তর্জাতিক আদালতে। কয়েক লক্ষ রোহিঙ্গা শরণার্থীকে মানবিক কারণে বাংলাদেশে আশ্রয় দিয়ে শেখ হাসিনা বিশ্ব দরবারে প্রশংসিত হয়েছেন। যদিও রোহিঙ্গা শরণার্থীরা এখন বাংলাদেশের ভেতরেও সামাজিক অস্থিরতা তৈরির উপাদান হয়ে উঠছে। রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে ফিরিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক মহলের নিষ্ক্রিয়তা দুঃখজনক।

তবে গত বছর ফেব্রুয়ারি মাসে রাশিয়া আকস্মিকভাবে ইউক্রেইন আক্রমণ করার পর পৃথিবী জুড়েই নানা সংকট তৈরি হয়েছে। জ্বালানি সংকট তীব্র হয়েছে। খাদ্য সরবরাহ ব্যবস্থা বিপর্যস্ত হয়েছে। অর্থনৈতিক মন্দার কবলে পড়েছে অনেক দেশ। বাংলাদেশও এই সংকটের আঘাত থেকে মুক্ত থাকতে পারছে না। 

মহামারির পরপরই রাশিয়া-ইউক্রেইন যুদ্ধ অবশ্যই কিছুটা বাধা হয়ে এসেছে। তবে সব বাধা অতিক্রমের সাহস যুগিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার শাসনের মেয়াদকাল পূর্ণ করবেন – এটা বলতে দ্বিধা নেই। বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ কমে এলেও তা আতঙ্কিত হওয়ার মতো নয়। গত কয়েক বছরের মতো এবারও বছরের শুরুতেই নতুন বই পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে  শিক্ষার্থীদের হাতে।

দুর্নীতি-অনিয়ম, লুটপাটের ঘটনা দেশে ঘটছে না, তা নয়। বিদেশে অর্থ পাচারের অভিযোগও বাড়ছে। তবে লুটপাটের কাহিনী কি এই এক যুগে, নাকি এর ধারাবাহিকতা আছে? শেখ হাসিনা সব সময় সব কিছু তার মতো করে করতে পারেন, তা-ও হয়তো নয়। দুনিয়ার কোনো দেশেই রাজনীতি একটি সরল রেখা ধরে চলে না। সরকার এবং সরকারের বিরোধিতা হলো রাজনীতির চিরায়ত খেলা। দ্বন্দ্ব-বিরোধ রাজনীতির স্বাভাবিক প্রবণতা। যে রাজনীতি বেশি মানুষের উপকার নিশ্চিত করে, সে রাজনীতিই টেকসই হয়। বিভিন্ন সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী তৈরি করে শেখ হাসিনার সরকার সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের মুখে হাসি ফোটানোর চেষ্টা করছেন। গৃহহীন লাখ লাখ মানুষ ঘর পেয়েছে।

ডিজিটাল বাংলাদেশের পর শেখ হাসিনা স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয় ঘোষণা করেছেন। দেশে অনেক রাজনৈতিক দল আছে। আছেন অনেক নেতা । কিন্তু সব দল ও সব নেতা মানুষকে স্বপ্ন দেখাতে পারেন না। শেখ হাসিনা সেটা পারেন বলেই তিনি অসাধারণ। তার প্রতি মানুষের আস্থা-বিশ্বাসেরও ঘাটতি নেই। স্মার্ট বাংলাদেশ হোক সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়ে এগিয়ে চলার বাহন। ভুলত্রুটি মানুষের হতেই পারে। তবে ভুল বুঝতে পারা এবং ভুল থেকে সরে আসতে পারাই স্মার্টনেসের পরিচয় বহন করে। শেখ হাসিনা প্রমাণ করেছেন, তিনি পারেন।

আগামী নির্বাচন আগের নির্বাচনের মতো হবে না, সেটা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজেও বলছেন। যাদের জনপ্রিয়তা নেই, যারা সমালোচিত তারা আগামী নির্বাচনে মনোনয়ন পাবেন না। কিন্তু সবচেয়ে বড় প্রশ্ন, নির্বাচনে বিএনপি অংশগ্রহণ করবে নাকি করবে না? সরকার বা আওয়ামী লীগ বিএনপিকে যে ছাড় দেবে না সেটা পরিষ্কার। কিন্তু বিএনপি কি তার অবস্থান দেশের মানুষের কাছে স্পষ্ট করতে পেরেছে? সরকারের পতন ছাড়া অন্য কোনো বিকল্প নিয়ে কথা না বলে বিএনপি কি ঠিক করছে? শেখ হাসিনা একাধিক বার প্রমাণ করতে পেরেছেন, তিনি যা বলেন, তা করেনও। বিএনপি কিন্তু কথা ও কাজের মিল দেখাতে প্রতিবারই ব্যর্থ হয়েছে।