বঙ্গবন্ধুর ধর্মনিরপেক্ষতার দর্শন

অসাম্প্রদায়িকতার বিষয়টি বঙ্গবন্ধু খুব শক্তভাবে উপলব্ধি করেছিলেন বিধায় 'ভাষাগত জাতীয়তাবাদ', যার মূল ভিত্তি হচ্ছে ভাষা এবং সংস্কৃতি, জনগণের মধ্যে ছড়িয়ে দেয়ার চেষ্টা করেছিলেন।

প্রণব কুমার পান্ডেপ্রণব কুমার পান্ডে
Published : 18 August 2022, 04:16 PM
Updated : 18 August 2022, 04:16 PM

জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অন্যতম চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য ছিল ধর্মনিরপেক্ষতা। ১৯৪৭ পরবর্তী সময়ে যখন ধর্মের ভিত্তিতে দুটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, সেই বাস্তবতায় দাঁড়িয়ে একজন রাজনৈতিক নেতার পক্ষে ধর্মনিরপেক্ষতাকে আঁকড়ে ধরে একটি দেশের স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখাটা খুবই কঠিন একটি বিষয় ছিল। ১৯৪৭ সালের ৩ জুন লর্ড মাউন্টব্যাটেন যখন বাংলাকে খন্ডিত করাসহ ভারতবর্ষ ভাগের পরিকল্পনা প্রকাশ করেছিলেন, ঠিক সেই সময় কলকাতা ইসলামিয়া কলেজের সিরাজ- উদ-দৌলা ছাত্রাবাসে শেখ মুজিব ছাত্র এবং যুবনেতাদের নিয়ে এক রুদ্ধদ্বার বৈঠক করেছিলেন। সেই সভায় শেখ মুজিব বলেছিলেন, "পাকিস্তান হতে যাচ্ছে। এই স্বাধীনতা সত্যিকারের স্বাধীনতা নয়। হয়তো বাংলার মাটিতে নতুন করে আমাদের সংগ্রাম করতে হবে।" (বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব, মযহারুল ইসলাম, আগামী প্রকাশনী, পৃষ্ঠা ৯৪)। সেই সভাতেই শেখ মুজিব একটি অসাম্প্রদায়িক সংগঠন তৈরির তাগিদ দিয়েছিলেন।

অষ্টাদশ শতাব্দীর ইসলামিক আন্দোলন এবং উনিশ শতকের পাকিস্তানি আন্দোলন এর মূল ভিত্তি ছিল ধর্ম। এই প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে বঙ্গবন্ধু একটি অসাম্প্রদায়িক দেশ গড়ার স্বপ্ন দেখেছিলেন। ১৯৪৭ সালে যখন ধর্মের ভিত্তিতে ভারত ও পাকিস্তান দুইটি পৃথক রাষ্ট্রে বিভক্ত হয়ে গেল, সেই সময় তিনি খুব কাছ থেকে উপলব্ধি করেছিলেন দুই ধর্মের মানুষের কষ্টকে। শুধুমাত্র ধর্মের কারণে একটি অঞ্চলের মানুষকে পাকিস্তানের দিকে ঠেলে দেয়া হয়েছিল এবং অন্যদিকে আরেকটি অঞ্চলের মানুষকে ভারতের সাথে রাখা হয়েছিল যা শেখ মুজিবকে ব্যথিত করেছিল। এই বিষয়গুলো বঙ্গবন্ধুকে খুব অল্প বয়স থেকেই নাড়া দিয়েছিল। ফলে, বঙ্গবন্ধু শুধু নিজের হৃদয়ে অসাম্প্রদায়িক চেতনাকে লালন করেননি, বরং ব্রিটিশ এবং পাকিস্তান উপনিবেশিক শাসনামলে প্রায় ৩২ বছর সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে লড়াই করেছিলেন।

অসাম্প্রদায়িকতার বিষয়টি তিনি খুব শক্তভাবে উপলব্ধি করেছিলেন বিধায় 'ভাষাগত জাতীয়তাবাদ' (যার মূল ভিত্তি হচ্ছে ভাষা এবং সংস্কৃতি) জনগণের মধ্যে ছড়িয়ে দেয়ার চেষ্টা করেছিলেন। পরবর্তীতে তিনি বাঙালি জাতীয়তাবাদ বিষয়টিকে পূর্ববঙ্গের মানুষের বাঁচার একমাত্র অবলম্বন হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন। যার অর্থ ছিল একটি দেশ কোন ধর্মের ভিত্তিতে বিভক্ত হবে না, কিংবা একে অপরের সাথে দ্বন্দ্ব-সংঘাতে লিপ্ত হবে না, বরং বাঙালি জাতীয়তাবাদের অধীনে সকল ধর্মের ও বর্ণের মানুষ একে অপরের সাথে মিলেমিশে বসবাস করবে। এমনই একটি স্বপ্ন দেখেছিলেন বঙ্গবন্ধু তরুণ বয়সে।

তিনি খুব অল্প বয়সেই পাকিস্তানের রাজনীতির অংশ হয়ে গিয়েছিলেন। ১৯৪৭ সালের ভারত-পাকিস্তান স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে ভাগ হওয়া থেকে শুরু করে ১৯৭১ সালের বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলন পর্যন্ত সকল রাজনৈতিক সংগ্রামে বঙ্গবন্ধু অগ্রনায়ক এর ভূমিকা পালন করছিলেন। ১৯৪৯ সালে যখন আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠিত হয়েছিল, শেখ মুজিব তখনও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন। কিন্তু আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠিত হবার পরে বঙ্গবন্ধু উপলব্ধি করেছিলেন এখানেও ধর্ম একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। আর এই কারণেই পরবর্তীতে দলের নাম থেকে মুসলিম শব্দটি বাদ দিয়ে অসাম্প্রদায়িক ধারার আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন তিনি। এখানে বলে রাখা ভালো যে সেই সময় যারা আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে ছিলেন তাদের তুলনায় বঙ্গবন্ধু বয়সে অনেক তরুণ ছিলেন। তার পরেও তিনি দলের নাম পরিবর্তন করার মধ্য দিয়ে একদিকে যেমন অসাম্প্রদায়িক পূর্ব পাকিস্তানের ধারণাটি কি প্রচার করবার চেষ্টা করেছিলেন, ঠিক তেমনিভাবে বাঙালি জাতীয়তাবাদের আদর্শ সকলের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা করেছিলেন।

শেখ মুজিব তরুণ বয়সে যাদের সাথে রাজনীতি করতেন তাদের বেশীরভাগ নেতা সেই অর্থে ধর্মনিরপেক্ষ ছিলেন না। ফলে, সেই পরিস্থিতিতে একটি ধর্মনিরপেক্ষ দল গঠন এবং ধর্মনিরপেক্ষতাকে মূলমন্ত্র করে একটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করবার প্রত্যাশা সত্যিই দুঃসাহসিক ব্যাপার ছিল। কিন্তু বঙ্গবন্ধু খুব অল্প সময়ের মধ্যেই তা করতে পেরেছিলেন বিধায় অসাম্প্রদায়িকতা এবং বাঙালি জাতীয়তাবাদ বিষয়দুটিকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে গেছেন।

বঙ্গবন্ধুর লেখা 'অসমাপ্ত আত্মজীবনী' পড়লে আমরা দেখতে পাই কতবার তিনি অসাম্প্রদায়িক চেতনাকে রক্ষা করবার জন্য এগিয়ে গেছেন। সেই সময় প্রায়ই হিন্দু ও মুসলিম ধর্মের মানুষের মধ্যে দাঙ্গা হতো। বঙ্গবন্ধু অনেক সময় জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দুই দলের সামনে দাঁড়িয়েছেন। বঙ্গবন্ধুর সব সময় চিন্তা ছিল বাঙালির জাতীয়তাবাদকে সামনে রেখে সকল ধর্মের মানুষের সহবস্থান নিশ্চিত করার মাধ্যমে শোষণমুক্ত সমাজ গড়ার। এই কারণেই বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরে জাতীয়তাবাদকে সংবিধানের অন্যতম মূল স্তম্ভ হিসেবে বিবেচনা করে সংবিধানের অংশ করেছিলেন তিনি। পৃথিবীতে বাংলাদেশের সংবিধানই হয়তো একমাত্র সংবিধান যা প্রণয়ন করা হয়েছিল স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের সাথে সামঞ্জস্য রেখে। আর এই কারনেই জাতীয়তাবাদ এবং ধর্মনিরপেক্ষতাকে বঙ্গবন্ধু সংবিধানের মূল স্তম্ভ হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন।

মাইদুল ইসলাম (২০১৫:১১-১৫) তার একটি লেখায় উল্লেখ করেছিলেন যে বঙ্গবন্ধুর ধর্মনিরপেক্ষতার ধারণাটি ছিল 'ইউরোকেন্দ্রিক', যার অর্থ হল রাষ্ট্রকে ধর্মীয় বিবেচনায় বা আনুগত্যের পরিপ্রেক্ষিতে কোনো কাজ করতে হবে না। তবে এত সাধারণভাবে বঙ্গবন্ধুর ধর্মনিরপেক্ষতার ভাবনাকে বোঝা ঠিক নয়। এখানে কোনো সন্দেহ নেই যে তিনি রাজনীতি থেকে ধর্মকে আলাদা রাখতে চেয়েছিলেন, তবে, তিনি কখনই ধর্মবিরোধী ছিলেন না। তাঁর ধর্মনিরপেক্ষতার মধ্যে ছিল সকল ধর্মের ঐক্য নিশ্চিত করার জন্য সকল ধর্মের অনুশীলন অন্তর্ভুক্ত ছিল।

তবে বঙ্গবন্ধুকে ধর্মনিরপেক্ষতার বিষয়টিকে ব্যক্তিগত এবং রাষ্ট্রীয় জীবনে অনুশীলন করতে গিয়ে অনেক চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হতে হয়েছিল। একদিকে ছিল ধর্মীয় শক্তিগুলো যাদের মধ্যে রাজনৈতিক দলের নেতারাও ছিল যারা সবসময় মানুষকে ভুল বুঝিয়েছে এই বলে যে বঙ্গবন্ধু ধর্মনিরপেক্ষতার অর্থ হচ্ছে রাষ্ট্রে ধর্মের অনুপস্থিতি। আবার অন্যদিকে কিছু একাডেমিক ছিলেন যারা সবসময় বঙ্গবন্ধুর ধর্মনিরপেক্ষতার বিরুদ্ধাচারণ করেছেন এই বলে যে যে দেশের ৯০ শতাংশ মানুষ একটি নির্দিষ্ট ধর্মের বিধায় সেখানে ধর্মনিরপেক্ষতার কোন স্থান নেই। কিন্তু বঙ্গবন্ধু তার চলার পথে ছিলেন অত্যন্ত অবিচল। তিনি সকল সমালোচনা উপেক্ষা করে অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়ে তোলার চেষ্টা করে গেছেন।

বঙ্গবন্ধুর অসাম্প্রদায়িকতা নিয়ে কথা বলতে গিয়ে নোবেল বিজয়ী অধ্যাপক অমর্ত্য সেন বলেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যে ধর্মনিরপেক্ষতার ধারণা পোষণ করেছিলেন তা হল মানুষের ধর্ম পালনের স্বাধীনতা থাকবে, এর রাজনৈতিক ব্যবহার রোধ করা হবে যা ধর্মনিরপেক্ষতার পশ্চিমা ধারণা থেকে একেবারেই আলাদা। ভারতীয় উপমহাদেশের দেশগুলি বঙ্গবন্ধুর ধর্মনিরপেক্ষতার ধারণা থেকে শিখতে পারে। অধ্যাপক অমর্ত্য সেন যুক্তরাজ্যে বাংলাদেশ হাইকমিশন এবং লন্ডন স্কুল অফ ইকোনমিক্স এর দ্যা সাউথ এশিয়ান সেন্টার আয়োজিত 'বঙ্গবন্ধু এবং বাংলাদেশের রূপকল্প' শীর্ষক বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী আলোচনায় এই কথা বলেছিলেন। অমর্ত্য সেন আরও বলেন, বঙ্গবন্ধু ছিলেন একজন মহান রাজনৈতিক নেতা এবং বাংলার মানুষের কাছে সবচেয়ে বেশি প্রশংসিত। ধর্মনিরপেক্ষতা, সাম্য এবং নেতৃত্বের তাঁর ধারণাগুলি ১৯৪৭ সাল থেকে যখন ভারত ও পাকিস্তান ধর্মের ভিত্তিতে বিচ্ছিন্ন হয়েছিল তখন থেকে এবং পাকিস্তানি শাসনামলে যারা দমন-পীড়নের মুখোমুখি হয়েছিল তাদের প্রতি তার ভালবাসা থেকে উদ্ভূত হয়েছিল (দ্য ডেইলি স্টার ২৮ জানুয়ারি, ২০২১)।

পাকিস্তান আমলে এবং বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরে বঙ্গবন্ধুর ধর্মনিরপেক্ষতার ধারণাকে একটি গোষ্ঠী ধর্মের বিরুদ্ধাচারণ বলে জনগণের মধ্যে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করার চেষ্টা করেছে। কিন্তু, প্রকৃতপক্ষে, বঙ্গবন্ধু ধর্মনিরপেক্ষতার ভিত্তি ছিল সকল ধর্মের সহাবস্থান এবং সকলের ধর্ম পালনের অধিকার। কিন্তু এ বিষয়টিকে একটি গোষ্ঠী ভুল ভাবে উপস্থাপনের মাধ্যমে জনগণকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করে চলেছে যা সত্যিই একটি ঘৃণ্য অপরাধ। এই কারণেই ১৯৭৫ পরবর্তী সময়ে সেনাবাহিনী শাসিত সরকারগুলো সংবিধানের মূলনীতি হিসেবে ধর্মনিরপেক্ষতাকে মুছে দিয়েছিল। তবে আশার বিষয় হচ্ছে বঙ্গবন্ধুকন্যা বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতা বিষয়টি প্রতিস্থাপনের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর দর্শনকে হৃদয়ে ধারণ করেছেন।