আন্তর্জাতিক আইন এবং কূটনীতিকদের দায়ভার

বিভিন্ন সময়ে বাংলাদেশের রাজনীতি নিয়ে এখানে অবস্থানরত বিভিন্ন দেশের দূত ও কূটনীতিবিদদের কথা বলতে দেখা যায়। এ বিষয়ে আন্তজার্তিক আইন কী?

শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিকশামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক
Published : 4 Dec 2022, 07:35 AM
Updated : 4 Dec 2022, 07:35 AM

বাংলাদেশে কর্মরত বেশ কয়েকটি দেশের রাষ্ট্রদূত কর্তৃক আমাদের রাজনীতিতে নগ্নভাবে নাক গলানোর ঘটনা সকল সচেতন নাগরিককে শুধু অবাকই নয় বরং ক্রোধান্বিত করেছে। কেননা এ ধরনের কর্মকাণ্ড থেকে বিরত থাকার নির্দেশনা রয়েছে কূটনীতি সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক আইনে।

সভ্যতার আদিকাল থেকেই পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে অবস্থিত বিভিন্ন দেশের মধ্যে বাণিজ্য করতে হয়েছে, যার প্রমাণ পাওয়া গেছে মহেঞ্জোদারো এবং হরপ্পায় প্রাপ্ত ধ্বংসাবশেষ থেকে। মেসোপটেমিয়ায় আবিষ্কৃত, প্রাচীন চীনে পাওয়া দক্ষিণ আমেরিকার মায়ার সভ্যতার ধ্বংসাবশেষ থেকে, ময়নামতি, তক্ষশিলা এবং মহাস্থান গড়ের ধ্বংসাবশেষ থেকেও। পরবর্তীতে ইংল্যান্ড, ফ্রান্সসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশের সাথে ভারতের বাণিজ্যের প্রমাণ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। এসব কোম্পানি দূতের মাধ্যমেই ভারত শাসকদের কাছে ব্যবসার প্রস্তাব পাঠাতো। তবে সে সব দূতেরা স্থায়ী বসবাস করতেন না, ছিলেন বিশেষ কাজে বিশেষ প্রস্তাব নিয়ে আসা। মৌর্য আমলের বিখ্যাত পণ্ডিত কৌটিল্য তার যুগেই বিভিন্ন দেশের মধ্যে দ্বন্দ্ব উপশমে কূটনৈতিক আলাপের ওপর গুরুত্ব আরোপ করেছিলেন। একইভাবে আন্তর্জাতিক আইনের জনক ডাচ জুরিস্ট হিউগো গ্রসিয়াস বিশ্বের বিভিন্ন দেশের দ্বন্দ্ব নিরসনে দূতের মাধ্যমে আলোচনার কথার উল্লেখ করেছেন। ইতিহাস বলছে, তিব্বত চেঙ্গিস খানের কাছে দূত পাঠিয়েছিল। চীনে প্রতিষ্ঠিত চেঙ্গিস খানের দৌহিত্র কুবলাই খানও বৌদ্ধ ধর্মে দীক্ষা নেওয়ার জন্য কোনও ধর্ম গুরুকে পাঠানোর অনুরোধ করে তিব্বতে দূত পাঠিয়েছিলেন। মিশর খ্রিস্টপূর্ব ১৪ শতকেই দূতের মাধ্যমে অন্য দেশের সাথে আলোচনা চালাতো বলে জানা যায়। মধ্য আমেরিকার মায়া সভ্যতার ভগ্ন প্রাচীরের লেখনি থেকে আঁচ করা যায় যে প্রাচীনকালে মায়া সভ্যতার শাসকরা বিভিন্ন দেশে প্রতিনিয়ত কূটনৈতিক প্রতিনিধি পাঠাতেন। দক্ষিণ আমেরিকায় ইনকা শাসকরাও দূত পাঠাতেন বলে তথ্য পাওয়া গেছে। খ্রিস্টপূর্ব ২৮৫০ শতকে মেসোপটেমিয়ার নগর রাজ্যগুলোর মধ্যে কূটনৈতিক আদান-প্রদান ছিল। আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ১২৮০ সালে মিশর রাজ দ্বিতীয় রামেস- এর সাথে হিট্টাইট রাজাদের কূটনৈতিক আলোচনার নজির পাওয়া যায়। চীনের প্রাচীন দলিল থেকে দৃশ্যমান যে সে দেশের পণ্ডিত ধুয়াংজি কূটনীতিকদের জন্য নীতিমালা তৈরি করেছিলেন।

প্রথমে কুইং রাজদের এবং পরে হ্যান সাম্রাজ্যের সময়ে চীন বাণিজ্য এবং নিরাপত্তাজনিত বিষয় আলোচনার জন্য প্রতিবেশি দেশগুলোর দূতদের গ্রহণ করতেন।

কৌটিল্য লিখেছেন, একজন দূতের দায়িত্ব হচ্ছে তার নিজ দেশের রাজার কাছে তথ্য পাঠানো, রাজার সম্মান রক্ষা, বন্ধু লাভ, বন্ধু ভাবাপন্ন দেশগুলোকে শত্রু ভাবাপন্নদের বিরুদ্ধে জোটবদ্ধ করা, গুপ্তচর প্রেরণ করা, গোপন তথ্য সংগ্রহ করা। মৌর্য রাজা অশোক গ্রিক নিয়ন্ত্রিত রাজ্যগুলো থেকে দূত গ্রহণ করতেন এবং পশ্চিম, মধ্য এবং দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ায় দূত পাঠাতেন মূলত বুদ্ধের বাণী প্রচারের জন্য। প্রাচীন গ্রিসের কূটনৈতিক কর্মকাণ্ডের কথা মহাকবি হোমারের ইলিয়াড এবং ওডিসিতে পাওয়া যায়। খ্রিস্টপূর্ব ৭৭৬ সালে অলিম্পিক খেলার মাধ্যমে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক সৃষ্টি হয়েছিল। গ্রিস-ইরান যুদ্ধের সময়ও দূতিয়ালির মাধ্যমে আলোচনা চলতো।

প্রাচীন রোমেও দূত গ্রহণ এবং পাঠানোর ব্যবস্থা ছিল, যা নিয়ন্ত্রণ করতো রোমের পররাষ্ট মন্ত্রক। পরবর্তীতে বাইজেনটাইন সাম্রাজ্যেও রোম প্রতিষ্ঠিত কূটনীতিক প্রথা প্রচলিত থাকে। 

মূলত বাইজেনটাইনেই শুরু হয় প্রথম পেশাদার কূটনীতির প্রচলন। বাইজেনটাইন সাম্রাজ্যের পতনের পর তাদের প্রতিষ্ঠিত কূটনীতির প্রচলন চলে যায় অটোমেন সাম্রাজ্যে এবং রেনেসাঁর ইতালিতে। বাইজেনটাইন রাজ্যের পতনের পর রোমের পোপ ইউরোপে শান্তি স্থাপনে যে ভূমিকা রেখেছিলেন সেটিও মূলত দূত হিসেবেই। অতীতে কূটনৈতিক সম্পর্ককে ‘লিগেশন’ নামে অভিহিত করা হতো।

বর্তমানে প্রচলিত স্থায়ী দূতের প্রচলন শুরু হয় ইতালির নগর রাষ্ট্রগুলোর পদ্ধতি থেকে। ১৪ এবং ১৫ খ্রিস্টাব্দে ভেনিস, মিলান এবং মন্টুয়া এই তিন দেশের মধ্যে এবং পোপের দরবার  স্থায়ী দূত পাঠাতে শুরু করে। ১৪৬৩ খ্রিস্টাব্দে মিলান ফরাসি সম্রাট লুই ১১- এর দরবারে স্থায়ী দূত পাঠান।

খ্রিস্ট পরবর্তী ১৬ শতকে ‘অ্যাম্বাসেডর’ শব্দের প্রচলন শুরু হয়, যেটি শুধু রাজা এবং রাষ্ট্র প্রধানদের প্রেরিত দূতদের বেলায় প্রযোজ্য ছিল। ম্যাকিয়াভেলি, যিনি নিজে ছিলেন ফ্লোরেন্স- এর কূটনীতিক, তার লেখনি দ্বারা ইউরোপে কূটনীতির জগতে অনেক প্রসার ঘটিয়েছিলেন। খ্রিস্টীয় ১৬ শতকে ইতালিতে যুদ্ধ এবং প্রটেস্ট্যান্ট ধর্ম বিদ্রোহের ইতালিয়ান রেনেসাঁর সমাপ্তি ঘটালেও তাদের প্রতিষ্ঠিত কূটনৈতিক পদ্ধতি বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়ে। ব্রিটিশ রাজ সপ্তম হেনরি ইতালিয়ান পদ্ধতি গ্রহণ করেছিলেন। ১৬২০ খ্রিস্টাব্দে ব্রিটিশ টিউডর রাজ অষ্টম হেনরির চ্যান্সেলার কার্ডিনাল উলসি ইংলিশ ডিপ্লোমেটিক সার্ভিসের প্রতিষ্ঠা করেন। কাছাকাছি সময়ে রাজা প্রথম ফ্রান্সিসের অধীনে ফরাসি দেশও ইতালিয়ান পদ্ধতি গ্রহণ করে, যে সময় ‘এনভয় এক্সট্রা অর্ডিনারি’ শব্দটির প্রচলন শুরু হয়। ১৬২৫ খ্রিস্টাব্দে হুগো গ্রটিয়াস তার বই ‘অন দি ল অব ওয়ার অ্যান্ড পিস’ প্রকাশ করেন, যাতে প্রত্যেক রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্বের তত্ত্ব উল্লেখিত হয়, যা কিনা বর্তমানে প্রচলিত কূটনৈতিক পদ্ধতির অন্যতম মূল কথা। ১৬২৬ খ্রিস্টাব্দে ফরাসি ধর্মযাজক কার্ডিনাল রিশেলিউর কূটনৈতিক সাফল্যের ফলেই ‘ওয়েস্টফেলিয়া চুক্তি’ সম্পন্ন হয়েছিল, যার ওপর ভিত্তি করেই বর্তমান স্থায়ী দূতাবাস প্রথার প্রবর্তন।

খ্রিস্ট্রীয় ১৮ শতকের ইউরোপের অন্যান্য দেশসমূহ যে সকল অ্যাম্বাসেডর পাঠাতেন তারা ছিলেন প্লেনিপোটেনসিয়ারি, যারা নিজ কর্তৃত্বে চুক্তি স্বাক্ষরের ক্ষমতা রাখতেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠার পর বেঞ্জামিন ফ্র্যাঙ্কলিন এবং থমাস জেফারসন ইউরোপিয়ান পদ্ধতি গ্রহণ করলেও তারা রাষ্ট্রদূতদের ‘ইউর এক্সেলেন্সি’ বলার প্রথা মানেননি। ফলে আজও মার্কিনিরা রাষ্ট্রদূতদের ‘ইউর এক্সেলেন্সি’ সম্বোধন করে না। সে জায়গায় তাদের মধ্যে শুধু ‘মিস্টার অ্যাম্বাসেডর’ বলার রীতি বিরাজমান। ১৬৭৯ খ্রিস্টাব্দে ডাচ কূটনীতিক আব্রাহাম ডি উইকিফোর্ট দূতগণকে ‘সম্মানিত গুপ্তচর’ এবং ‘শান্তির দূত’ বলে উল্লেখ করেছিলেন।

খ্রিস্টীয় ১২ শতকের শেষ দিকে ইতালীতে প্রথম ‘অ্যাম্বাসেডর’ শব্দটির সূচনা ঘটে, যা  ১৩ শতকে ইংল্যান্ডেও পরিচিতি পায়। ১৫ শতকে ইতালিতে বিভিন্ন রাজ্যের মধ্যে যুদ্ধের কারণে কূটনৈতিক তৎপরতার প্রয়োজনীয়তা বেড়ে যায় এবং তার প্রেক্ষিতেই স্থায়ী আবাসিক দূতের প্রথা সৃষ্টি হয়। রোম হয়ে উঠে ইতালির কূটনীতির প্রাণকেন্দ্র আর পোপের দরবারে গড়ে উঠে প্রথম কূটনৈতিক কোর। কয়েক বছর ইউরোপে শান্তি বিরাজমান থাকার পর ফরাসি বিপ্লবের পর নেপোলিয়ন সেটি ইউরোপে সম্প্রসারিত করতে চাইলে এবং ইউরোপ দখল করতে চাইলে শান্তিতে ব্যাঘাত ঘটে। নেপালিয়নের পরাজয়ের পর ১৮১৪ খ্রিস্টাব্দে ভিয়েনা কংগ্রেসে বিভিন্ন বিষয়ের মধ্যে কূটনৈতিক পদ্ধতি নিয়েও সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। ১৮১৮ খ্রিস্টাব্দে আইলা চ্যাপেল কংগ্রেসে কূটনীতির জনস্বার্থের দিক নিয়ে আলোচনা হয়। ১৮৫৬ খ্রিস্টাব্দে প্যারিস কংগ্রেসে আন্তর্জাতিক আইনে উল্লেখযোগ্য বিধান সম্বলিত হয় যাতে কূটনৈতিক দিকে বিশেষ আলোকপাত করা হয়। ১৯ শতকে গোটা বিশ্বে গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক পরিবর্তনের সাথে সাথে কূটনৈতিক জগতেও পরিবর্তন ঘটে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ এবং রুশ বিপ্লব কূটনৈতিক পদ্ধতিতে বহু পরিবর্তন ঘটায়। যুদ্ধের পর ভার্সাই চুক্তিতে গুরুত্বপূর্ণ কূটনৈতিক তৎপরতা পরিলক্ষিত হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালে কূটনৈতিক সম্মেলনের নতুন সূচনা ঘটে। ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দে ৫১ সদস্য নিয়ে জাতিসংঘের সৃষ্টি হয়। উপনিবেশ প্রথার পতনের পর বহু নতুন সার্বভৌম রাষ্ট্র জন্ম নিলেও তাদের অধিকাংশ শুধু তাদের পুরোনো উপনিবেশিক রাষ্ট্রেই দূত পাঠাতো।

‘লিগেশন’ নামে পরিচিত কূটনৈতিক পন্থায় অ্যাম্বাসেডররা স্বাগতিক দেশে কিছু প্রতিরক্ষা ও সুবিধা ভোগ করতেন। তবে স্থায়ী রাষ্ট্রদূত পদ্ধতির প্রচলন হয় মধ্যযুগের শেষ দিকে, যদিও এর আগে রোমান পোপের স্থায়ী প্রতিনিধিরা কনস্টান্টিনেপলে স্থায়ী আসনে থাকতেন। ১৩ শতকে ইতালি এবং ভেনিস একে অন্যের দেশের রাজধানীতে স্থায়ী দূতের অবস্থান তৈরি করে। পরে ১৫ শতকে এই দুই দেশ স্পেন, জার্মানি, ফ্রান্স এবং ইংল্যান্ডে স্থায়ী দূতাবাস খোলার পর অন্যান্য ইউরোপীয় দেশ তা অনুসরণ করে। অনেক ক্ষেত্রে স্থায়ী দূতাবাস খোলা হতো দ্বিপক্ষীয় চুক্তির মাধ্যমে। তবে ১৭ দশকের শেষে স্থায়ী দূতাবাস প্রথা চিরাচরিত অবস্থান প্রাপ্ত হয়।

আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী কোন রাষ্ট্রই স্থায়ী দূত পাঠাতে বা গ্রহণ করতে বাধ্য নয়, এটি নিজ নিজ ইচ্ছা অনিচ্ছার ব্যাপার। জাতিসংঘ কোন রাষ্ট্র না হলেও, এটি একটি আন্তর্জাতিক ব্যক্তিত্ব হিসেবে এটিও স্থায়ী দূত পাঠাতে পারে।

আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে একটি দেশের রাষ্ট্রদূত সে দেশের রাষ্ট্রপ্রধানের প্রতিনিধি।

আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী, কোনও রাষ্ট্রই কূটনৈতিক সুবিধাদির অপব্যবহারকারী কোনও রাষ্ট্রের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক বজায় রাখতে বাধ্য নয়। প্রতিটি রাষ্ট্রদূত তার নিজ দেশের রাষ্ট্র প্রধানের প্রতিনিধি বলে তিনি স্বাগতিক দেশে বিশেষ সম্মান প্রাপ্ত হন এবং স্বাগতিক রাষ্ট্রের কর্মকর্তাদের কাছ থেকে ‘এক্সেলেন্সি’ হিসেবে ঘোষিত হওয়ার অধিকার চাইতে পারেন।

আন্তর্জাতিক আইনে কূটনীতি সংক্রান্ত বিধানসমূহ বহু বছরের প্রচলিত নিয়ম-কানুন দ্বারাই গড়ে উঠেছে। বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন সময়ে প্রণীত কূটনীতি সংক্রান্ত আইনের এবং আদালত সমূহের রায়ের প্রতিফলন, যথা যুক্তরাজ্যে ১৭০৮ সালে প্রণীত ডিপ্লোমেটিক প্রিভিলেজেস অ্যাক্ট। পরিবর্তিত বিশ্ব পরিস্থিতিতে এসব প্রচলিত বিধান সমূহকে  লিখিতভাবে বিধিবদ্ধ করার জন্য হার্ভার্ট রিসার্চ সংস্থা এবং আন্তর্জাতিক ল কমিশনের চিন্তা-চেতনার আলোকে ১৯৬১ সালে ভিয়েনায় এক সম্মেলনে ‘ভিয়েনা কনভেনশন অন ডিপ্লোমেটিক রিলেশনস’ প্রণীত হয়। উক্ত কনভেনশনের উপর রায় দেওয়ার সময়ে ১৯৮০ সালে ‘ইউনাইটেড স্টেটস ডিপ্লোমেটিক অ্যান্ড কনস্যুলার স্টাফ ইন তেহরান’ মামলায় আন্তর্জাতিক বিচার আদালত বলেছিল- উক্ত কনভেনশন- এর বিধান মান্য করা ইরান শুধু চুক্তিগত ভাবেই বাধ্য নয়, বরং আন্তর্জাতিক আইন দ্বারাও বাধ্য। 

বাংলাদেশসহ উক্ত কনভেনশন ‘রেটিফাই’ করা সকল দেশই কনভেনশন- এর বিধান সমূহ নিজ নিজ দেশে প্রয়োগযোগ্য করার জন্য প্রয়োজনীয় আইন প্রণয়ন করেছে। তবে ‘ফিলিপাইনস অ্যাম্বাসি’ মামলায় আন্তর্জাতিক বিচার আদালত এই মর্মে রায় দিয়েছে যে, কনভেনশন সত্ত্বেও কূটনীতি সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক আইনের সে সব বিধান সচল থাকছে যেগুলোর কথা কনভেনশন- এ অনুপস্থিত। কনভেনশন- এর তৃতীয় অনুচ্ছেদে দূতাবাসগুলোর ৫টি কর্মকাণ্ডের স্বীকৃতি রয়েছে। যেগুলো হলো- (ক) স্বাগতিক রাষ্ট্রে নিজ দেশের প্রতিনিধিত্ব করা, (খ) আন্তর্জাতিক আইনের সীমারেখার ভেতরে থেকে স্বাগতিক রাষ্ট্রে নিজ রাষ্ট্রের এবং সেই রাষ্ট্রের নাগরিকদের স্বার্থ রক্ষায় কাজ করা, (গ) স্বাগতিক দেশের সরকারের সাথে আলোচনা করা, (ঘ) আইনের আওতার মধ্যে থেকে স্বাগতিক দেশের অবস্থা এবং উন্নয়ন পর্যালোচনা করে নিজ দেশে তা জানানো, (ঙ) স্বাগতিক দেশের সাথে নিজ দেশের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক উন্নয়নের চেষ্টা। যার মধ্যে থাকবে অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক এবং বিজ্ঞান সংক্রান্ত বিষয়সমূহ।

প্রচলিত আন্তর্জাতিক আইনে অত্যন্ত জোরালোভাবে এটি প্রতিষ্ঠিত রয়েছে, যা ১৯৬১ সালের কনভেনশন খর্ব করেনি, যে কোনও দূতই স্বাগতিক দেশের আভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক বিষয়ে নাক গলাবেন না। স্বাগতিক দেশের ঘটনাবলি পর্যবেক্ষণের অধিকার তাদের রয়েছে সেগুলো নিজ দেশের সরকারের কাছে পাঠানোর জন্য। কিন্তু অবশ্যই তাদের কোন অধিকার বা ক্ষমতা নেই স্বাগতিক দেশের রাজনীতির সাথে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সম্পৃক্ত হওয়ার অথবা কোন বিশেষ রাজনৈতিক দলের পক্ষে বা বিপক্ষে কথা বলার বা অবস্থান নেওয়ার, বা তাদের কাউকে অনুপ্রেরণা প্রদানের। কোনও দূত বা দূতাবাস এসব করলে তা হবে কূটনৈতিক মর্যাদার স্পষ্ট খেলাপ। কোন কূটনীতিক এগুলো তার নিজ উদ্যোগে করছে না তার দেশের সরকারের নির্দেশে করছে, সে প্রশ্ন অবান্তর এবং কোনও রাষ্ট্রই একজন বিদেশি দূতকে এ ধরনের সুবিধা এবং মর্যাদার অপব্যবহার সহ্য করবে না এবং এমনকি বেশি বাড়াবাড়ি হলে সংশ্লিষ্ট দূতকে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করতে পারে। তবে তার আগে প্রেরণকারি সরকারকে তা জানাবে। এ কারণে ১৯৮৮ সালে লর্ড সেকভিলকে মার্কিন সরকার সে দেশ থেকে বিতাড়িত করেছিল মার্কিন নির্বাচনে নাক গলানোর জন্য। ১৯২৭ সালের অক্টোবর মাসে ফরাসি সরকার সোভিয়েত সরকারকে তাদের দূত রাকভস্কিকে সরিয়ে নেয়ার জন্য অনুরোধ করেছিল। কেননা তিনি ফ্রান্সে অবস্থান করে ‘পলিটিক্যাল মেনিফেস্টো’ নামে এক দলিলে দস্তক্ষত করেছিল। স্বাগতিক দেশসমূহ বিদেশি দূতদের বিতাড়নের জন্য যেসব পদক্ষেপ, তা আন্তর্জাতিক আইনের অবিচ্ছেদ্য অংশ বটে। একটি স্বাগতিক দেশে বিদেশি দূতদের দ্বারা কূটনৈতিক মর্যাদা এবং অধিকার লংঘনের প্রশ্নটি আন্তর্জাতিক বিচার আদালত বিশদভাবে আলোচনা করেছে ইউনাইটেড স্টেটস ডিপ্লোমেটিক অ্যান্ড কনস্যুলার স্টাফ ইন তেহরান মামলায় ১৯৭৯ সালে। আন্তর্জাতিক বিচার আদালত সে মামলার রায় প্রদানকালে উল্লেখ করেছেন কোন বিদেশি দূত বা দূতাবাস তাদের মর্যাদা লংঘন করে তার অপব্যাখ্যার করলে স্বাগতিক রাষ্ট্রের পূর্ণ অধিকার রয়েছে সংশ্লিষ্ট দূত বা দূতাবাসের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার, যা প্রচলিত আন্তর্জাতিক আইন স্বীকৃত। কূটনৈতিকদের ব্যাপারে ফৌজদারি দায়মুক্তির ব্যবস্থা সত্ত্বেও ১৯৮৫ সালে ব্রিটিশ আদালত ইউসুফু নামক এক নাইজেরিয়ান কূটনীতিককে কারাদণ্ডে দণ্ডিত করেছিল। ইউসুফুর বিরুদ্ধে বিলেতে রাজনৈতিক আশ্রয়ে থাকা এক প্রাক্তন নাইজেরিয়ান মন্ত্রীকে অপহরণের অভিযোগ ছিল।

আমাদের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ভারতে কর্মরত মার্কিন দূতরা মুক্তিযুদ্ধবিরোধী বিভিন্ন অবস্থান নিয়েছিলেন, যার একটি ছিল কলকাতায় কর্মরত মার্কিন কনসুলেটে। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের উপর লেখা ভারতের এক ব্রিগেডিয়ার তার বই ফ্রম পাকিস্তান টু বাংলাদেশ- এ লিখেছেন, ১৯৭১ সালের জুলাই মাসের শেষ সপ্তাহে কাজি জহুরুল কাইয়ুম নামক এক তথাকথিত আওয়ামী লীগ নেতা কলকাতায় কর্মরত মার্কিন কনসুলেট জর্জ গ্রিফিথ- এর সাথে খন্দকার মোশতাকের পক্ষ হয়ে যোগাযোগ করে পাকিস্তানের সাথে মিলিত হওয়ার জন্য প্রভাব বিস্তারের পরামর্শ দেন। জর্জ গ্রিফিথ নামের কলকাতাস্থ মার্কিন কনসুলেটের সেই কর্মকর্তাকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল খন্দকার মোশতাকের সাথে যোগাযোগ এবং আলোচনা করতে। কিন্তু সেপ্টেম্বর- এর মাঝামাঝি গ্রিফিথ জহুরুল কাইয়ুমকে জানান, তার পক্ষে এ বিষয়ে আর অগ্রসর হওয়া সম্ভব নয় কেননা ভারতের গোয়েন্দারা বিষয়টি জেনে ফেলেছে এবং তারা গ্রিফিথকে অনুসরণ করছে। তাছাড়া ভারত সরকার বাংলাদেশ সংক্রান্ত বিষয়ে ভারতকে না জানিয়ে কিছু করার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। বিষয়টি বর্ণনা করে আন্তর্জাতিক খ্যাতিমান মার্কিন সাংবাদিক লরেন্স লিপসুলৎজ বিষদভাবে লিখেছিলেন। তাছাড়াও ৪ অগাস্ট যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবশালী দৈনিক টেলিগ্রামের নামজাদা রিপোর্টার ক্লেয়ার হেলিংওয়ার্থ ভারতে অবস্থিত মার্কিন দূতদের মাধ্যমে আওয়ামী লীগের এক ক্ষুদ্র অংশের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের গোপন অভিসারের কথা ফাঁস করে দেন। এসব খবর পেয়ে ভারত সরকার চরম সাফল্যের সাথে মার্কিন ষড়যন্ত্র নস্যাৎ করেছিল। ভারত সরকার মার্কিন দূতদের রাজনৈতিক কার্যকলাপে বাধা সৃষ্টি করতে যে পদক্ষেপ নিয়েছিল তা সম্পূর্ণরূপে আন্তর্জাতিক আইনের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ।

২০১৫ এবং ২০১৬ সালে বাংলাদেশ থেকে দুইজন পাকিস্তানি কূটনীতিককে বহিষ্কার করা হয়েছিল আমাদের দেশের আভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপের কারণে। তার আগে পাকিস্তানের এক উপরাষ্ট্রদূতকেও অবাঞ্ছিত ব্যক্তি হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছিল। সেই উপরাষ্ট্রদূত আমাদের মুক্তিযুদ্ধকে কটাক্ষ করে বক্তব্য দিয়েছিলেন। যার ফলে সেই উপরাষ্ট্রদূতকে বাংলাদেশ থেকে বিতাড়িত করা হয়েছিল। এই সকল সিদ্ধান্তই কূটনীতি সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক আইন দ্বারা স্বীকৃত।

স্বাগতিক দেশের রাজনীতিতে বা দ্বন্দ্বে নাক না গলানোর বিধান সম্পর্কে  আন্তর্জাতিক আইনের বিশ্ববিখ্যাত লেখক অধ্যাপক ওপেনহেইম পরিস্কার ভাষায় বলেছেন, এ বিষয়ে বিতর্কের কোন অবকাশ নেই। এছাড়াও জাতিসংঘের সকল সদস্য রাষ্ট্রই জাতিসংঘের সনদের প্রতিটি বিধান মানতে বাধ্য বিধায় সে সকল রাষ্ট্রের দূতরাও তা মানতে বাধ্য। জাতিসংঘ সনদের একটি অন্যতম নির্দেশনা হচ্ছে এই যে- “বর্তমান সনদ জাতিসংঘকে কোন রাষ্ট্রের নিছক আভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপের অধিকার দিচ্ছে না বা সেরূপ বিষয়ের নিষ্পত্তির জন্য কোন সদস্যকে জাতিসংঘের দ্বারস্ত হতে হবে না” {১(৭) অনুচ্ছেদ}। এমতাবস্থায় বাংলাদেশে কর্মরত কয়েকজন রাষ্ট্রদূত প্রত্যক্ষভাবে আমাদের দেশের রাজনীতিতে নাক গলিয়ে এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা ও সদস্যদের সাথে গোপন বৈঠকে মিলিত হয়ে, রাজনৈতিক সভায় বক্তৃতা দিয়ে, তাদের মতামত প্রকাশ করে কূটনীতি সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক আইন লংঘন করছেন, জাতিসংঘ সনদের ১(৪) অনুচ্ছেদ বিরোধী কাজ করে তাদের কূটনৈতিক মর্যাদার অপব্যবহার করছেন।

যেসব দেশের রাষ্ট্রদূতরা আমাদের দেশের রাজনীতিতে এভাবে নগ্ন ভূমিকায় নেমেছেন, তাদের দেশের রাজনীতিতে নিশ্চয়ই তারা আমাদের দূতদের নাক গলানো সহ্য করবে না। রাষ্ট্রদূতরা বলছেন, আমাদের রাজনীতিবিদদের আমন্ত্রণেই তারা এসব করছেন। কিন্তু সেটি কোনও যুক্তি হতে পারে না। তারা আন্তর্জাতিক আইন এবং জাতিসংঘের সনদ অনুসরণ করতে বাধ্য বটে, যে কথাটি সম্প্রতি আমাদের মাননীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী প্রকাশ্যেই বলেছেন।