স্বাধীনতার মানে

স্বাধীনতার অর্থ হলো, স্বাধীনতার কোনো সীমানা টেনে দেয়া যাবে না। কারো জন্যই না। স্বাধীনতার কেন্দ্রে যেহেতু মানুষ, আর তার মুক্তি ও স্বাধীনতার অবারিত উদযাপন, তাই সকলের সকল সম্ভাবনার বিকাশেই স্বাধীনতাকে মুক্ত রাখতে হবে।

সৈকত শুভ্র আইচসৈকত শুভ্র আইচ
Published : 28 March 2023, 01:15 PM
Updated : 28 March 2023, 01:15 PM

এবারের স্বাধীনতা দিবসে একটি জাতীয় দৈনিকে জনৈক দিনমজুরের ‘মাছ-মাংস আর চাইলের স্বাধীনতা’ বিষয়ক দাবির প্রকাশ নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে বেশ আলোড়ন তৈরি হয়েছে। স্বাধীনতা দিবসে আবার নতুন স্বাধীনতার দাবি বিষয়টিকে মহলবিশেষের জন্য স্পর্শকাতর করে তুলেছে। এক পক্ষ সংবাদটিকে দুঃশাসনের প্রকৃত চিত্র বলে, অপরপক্ষ এটিকে ষড়যন্ত্র বলে প্রমাণে জোরদার অনুসন্ধান ও প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছে। বিবিধ বিবেচনায় দৈনিকটি প্রথমে সংবাদটি প্রত্যাহার এবং পরে সংশোধনী ও ব্যাখ্যাসহ আবার প্রকাশ করেছে।

কিন্তু স্বাধীনতা দিবসে ‘মাছ-মাংস আর চাইলের স্বাধীনতা’ দাবি কেন স্পর্শকাতর হয়ে দাঁড়ায়? স্বাধীনতার মানে কী? ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা’ শুনে শুনে বেড়ে উঠেছে একটা প্রজন্ম। ছাত্রাবস্থায় মার্চ এবং ডিসেম্বরে ছাত্র সমাবেশে দাঁড়িয়ে ছাত্রকর্মী যখন বলে, ত্রিশ লক্ষ শহীদের প্রাণের বিনিময়ে আমরা একটি মানচিত্র পেয়েছি, পেয়েছি একটি পতাকা, পেয়েছি পৃথিবীর মধ্যে বাঙালির নিজের ঘর, আমার আপন ঠিকানা– তখন বক্তা এবং শ্রোতা দুয়ের মধ্যেই সম আবেগের সঞ্চলন অনুভব করা যায়। একই কথা যখন সেই একই কর্মী পরবর্তীতে কর্মজীবনে মাঠপর্যায়ের প্রশিক্ষণে বলে এবং সারি সারি শূন্যদৃষ্টি তাকে হতাশ করে, তখন জনৈক শুভাকাঙ্ক্ষী হয়তো তাকে পরামর্শ দিয়ে থাকে– “আপনার এইসব মারফতি কথা মাইনষে বোঝে না। বাংলা কথা কইন।” অর্থাৎ, মানচিত্র-পতাকা-ঠিকানার মতো বিমূর্ত কথাবার্তার বাইরে যদি মূর্ত কোনো কিছু দিয়ে স্বাধীনতার তাৎপর্য বোঝানোর থাকে তো বলেন।

‘রবিঠাকুরের অজর কবিতা, অবিনাশী গান’ বললে স্বাধীনতার অর্থ হয়তো সবার কাছে মূর্ত হয় না। কারও কাছে হয়তো ফসলের মাঠে কৃষকের হাসিতে, কখনও রোদেলা দুপুরে মধ্যপুকুরে গ্রাম্য মেয়ের অবাধ সাঁতারে, বা পিতার কোমল জায়নামাজের উদার জমিনে স্বাধীনতা অর্থবহ হয়ে ধরা দেয়। আর তো রয়েছেই ‘যেমন ইচ্ছে লেখার আমার কবিতার খাতা’।

তো স্বাধীনতা বুঝি কী উপায়ে? ১৭৭৬ সালে যুক্তরাষ্ট্রের স্বাধীনতার ঘোষণা গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের জন্য বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত ও অনুসৃত এক দলিল। সেখানে স্বাধীনতার সংজ্ঞায় বলা আছে, “That all men are by nature equally free and independent, and have certain inherent rights, of which, when they enter into a state of society, they cannot, by any compact, deprive or divest their posterity; namely, the enjoyment of life and liberty, with the means of acquiring and possessing property, and pursuing and obtaining happiness and safety.”

এই ঘোষণা মানুষকে স্বাধীনতার ধারণার কেন্দ্রে নিয়ে এসেছে, ভূগোলকে নয়। সকল মানুষ প্রকৃতিগতভাবে মুক্ত এবং স্বাধীন। এই মুক্তি ও স্বাধীনতাকে সে অবারিতভাবে উদযাপন করবে। তার জন্য প্রয়োজনীয় সুখ-সমৃদ্ধি-শান্তির সন্ধান ও তা অর্জনের সে দাবিদার। এইগুলো মানুষ হিসেবে তার অবিচ্ছেদ্য অধিকার, যেই অধিকারে কেউ বাগড়া দিতে পারবে না।

পরবর্তীতে ১৯৪১ সালে প্রেসিডেন্ট রুজভেল্ট মানুষের স্বাধীনতার চারটি অপরিহার্য অনুষঙ্গ হিসেবে তুলে ধরেছেন বাক ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা, ধর্মের স্বাধীনতা, অভাব থেকে মুক্তি ও ভয় থেকে মুক্তিকে।

এখন ‘মাছ-মাংস-চাইলের স্বাধীনতা চাই’– এই দাবি করা এবং করেও নিরাপদ থাকা কি স্বাধীনতার এই সংজ্ঞার মধ্যে পড়ে? এই সংজ্ঞানুসারে অভাব থেকে মুক্তি এবং acquiring and possessing property, and pursuing and obtaining happiness and safety যদি স্বাধীনতার অংশ হয়ে থাকে, তবে মাছ-মাংস ও চালের দাবি স্বাধীনতাকে অস্বীকার করা নয় বরং তাকে পরিপূর্ণ করারই দাবি।

মানুষের মৌলিক মানবিক চাহিদাকে চারটি ভাগে দেখার ধারণা জনপ্রিয় হয়েছে গত শতকে। এই চারটি ভাগ হলো– অস্তিত্ব রক্ষা, কল্যাণ, আত্মপরিচয় এবং স্বাধীনতা। অস্তিত্ব রক্ষার আওতায় পড়ে খাদ্য, পানীয় ও আশ্রয়ের মতো নেহাত প্রাণটা টিকিয়ে রাখতে যা যা লাগে সেসব। পরের ধাপটায় হচ্ছে একটু ভালোভাবে বাঁচার স্বপ্ন– দু-বেলা শুধু ডাল-ভাতই নয়, একটু মাছ আর মাংসও, আর যা যা কিছু লাগে ভালো থাকার জন্য। আর সমাবেশে যে পতাকা, ভূখণ্ড ইত্যাদি ধারণার কথা বলা হয়েছে তা পড়ে আত্মপরিচয়ের আওতায়, যা কিছু মানুষকে সংলগ্নতা, নিরাপত্তা, মর্যাদা, জীবনের সার্থকতার অনুভূতি দেয়। আর শেষটি হলো স্বাধীনতা– চিন্তার আর তৎপরতার।

এই চারটি চাহিদা আসলে অবিভাজ্য। এখানে একটি আরেকটির বিকল্প নয়। ‘ভাত চাই, না ভোট চাই’ কোনো সৎ প্রস্তাব নয়। সবগুলোই লাগবে। এবারের অস্কার পাওয়া সিনেমার নামের মতো ‘Everything, Everywhere, All at Once’. কিন্তু দৃশ্যত সেটা সম্ভব হয় না। পরিস্থিতির সাপেক্ষে মানুষ তাই অগ্রাধিকার নির্ধারণ করে। যেমন এক-এগারোর সামরিক বাহিনী সমর্থিত সরকার এসে রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলায় অতিষ্ঠ মানুষকে নিরাপত্তার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল তার স্বাধীনতার বিনিময়ে। শুরুতে এই বিনিময় মানুষ মেনেও নিয়েছিল। স্বাধীনতার পরিবর্তে তারা অগ্রাধিকার দিয়েছিল নিরাপত্তা ও শৃঙ্খলাকে। কিন্তু দু-বছরের মধ্যেই সে তার নিরাপত্তা অগ্রাহ্য করে স্বাধীনতার জন্য বিদ্রোহ করে বসে।

সংবাদের এই দিনমজুরটিও তার অগ্রাধিকার প্রকাশ করেছে। মাছ-মাংস আর চালের সুলভ প্রাপ্তি ছাড়া এই স্বাধীনতার কী মূল্য আছে তার কাছে! এতে আক্রান্ত বোধ করার কিছু নেই। তার মতোই অন্য কেউ বাক-স্বাধীনতাকে অগ্রাধিকার দিচ্ছে, ভোটকে দিচ্ছে, কেউ দিচ্ছে নিরাপত্তাকে অগ্রাধিকার। অগ্রাধিকারের এই বৈচিত্র্য অস্বাভাবিক নয় মোটেও। প্রত্যেকেই যার যার অবস্থান থেকে, যার যার যাপন থেকে অগ্রাধিকার নির্ধারণ করে, এবং সে অগ্রাধিকারও পাল্টায় পরিস্থিতির সাপেক্ষে।

স্বাধীনতার অর্ধশতক পেরিয়ে বাংলাদেশ এই কৃতিত্ব দাবি করতেই পারে যে, তার অধিকাংশ নাগরিকের জন্য মৌলিক মানবিক অধিকারের প্রথম স্তরটি সে অতিক্রম করে আসতে পেরেছে। দারিদ্র্য পরিস্থিতির উন্নয়ন ঘটেছে। আশির দশকের গোড়াতেও মফস্বলের গড়পড়তা মধ্যবিত্তের বাড়িতে সেদ্ধ ডিম অর্ধেক করে কেটে রান্না করা হতো। কারও বাসায় আস্ত ডিমের তরকারি দেখলে তা হতো আলোচনার বিষয়। মাংস বড়জোর সপ্তাহান্তে একদিন। বাংলাদেশ ওই দিন পাড়ি দিয়ে এসেছে। তাই এটা নিশ্চিত, আগামী নির্বাচনে শুধু ডাল-ভাতের অধিকার নিশ্চিত করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে কোনো রাজনৈতিক দল ভোটারের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারবে না। তাকে প্রতিশ্রুতি দিতে হবে বাকি তিনটি অধিকারকে লক্ষ্য করে।

সমস্যা হলো, আনুষ্ঠানিক স্বাধীনতা অর্জনের পরও একটা রাষ্ট্রের সকল মানুষের মৌলিক মানবিক চাহিদাগুলো সমানতালে বাস্তবায়ন হয়ে ওঠে না। কোনগুলো বাস্তবায়িত হবে তা নির্ভর করে রাষ্ট্র কীভাবে অগ্রাধিকার নির্ধারণ করে তার ওপর। ব্রিটিশ শাসন থেকে মুক্ত হওয়ার অব্যবহিত পরেই পুরো ভারতবর্ষ কেঁপে উঠেছিল, ‘ইয়ে আজাদী ঝুটা হ্যায়, লাখো ইনসান ভুখা হ্যায়’ স্লোগানে। যুক্তরাষ্ট্রের স্বাধীনতার যে ঘোষণা দুনিয়ার আদর্শ, ওই ঘোষণার শতবর্ষ পরেও আব্রাহাম লিংকনকে সংগ্রাম করতে হয়েছে দাসপ্রথা বিলোপে। নারী অধিকার আন্দোলন করতে হয়েছে নারী আর পুরুষ সমান এই দাবিতে। তারও শতবর্ষ পরে কালো মানুষের সমানাধিকার অর্জনে মার্টিন লুথার কিংকে বলতে হয়েছে, ‘আই হ্যাভ এ ড্রিম’।

স্বাধীনতার অর্থ হলো, স্বাধীনতার কোনো সীমানা টেনে দেয়া যাবে না। কারো জন্যই না। স্বাধীনতার কেন্দ্রে যেহেতু মানুষ, আর তার মুক্তি ও স্বাধীনতার অবারিত উদযাপন, তাই সকলের সকল সম্ভাবনার বিকাশেই স্বাধীনতাকে মুক্ত রাখতে হবে। আর বাংলাদেশের সংবিধান তো তার সকল নাগরিককে এই প্রতিশ্রুতি দিয়েছেই– “Further pledging that it shall be a fundamental aim of the State to realise through the democratic process a socialist society, free from exploitation a society in which the rule of law, fundamental human rights and freedom, equality and justice, political, economic and social, will be secured for all citizens.”

মানুষের স্বাধীনতার স্বপ্ন আর সংগ্রাম অটুট থাকুক।