“ধানের তুষ থেকে কিংবা নেট মিটারিং পদ্ধতিতে বিদ্যুৎ উৎপাদনে সরকারের বিনিয়োগ কম হওয়ায় মোটা অঙ্কের কমিশন বাগানোর সুযোগও কম থাকে। এ কারণেই সম্ভবত নীতিনির্ধারকসহ সংশ্লিষ্ট আমলা-প্রকৌশলীরা এ দিকে মনোযোগ দিতে আগ্রহ বোধ করেননি।” –লিখেছেন আজাদুর রহমান চন্দন।
Published : 06 Aug 2022, 08:29 PM
দ্রুত বিদ্যুৎ পাওয়ার আশায় সরকার ডিজেল ও ফার্নেস অয়েলভিত্তিক রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল পাওয়ার প্লান্ট স্থাপন করার প্রতি বেশি মনোযোগ দেওয়ায় জ্বালানি বাবদ বেশি খরচের ভারে দফায় দফায় বিদ্যুতের দাম বাড়াচ্ছে বেশ কয়েক বছর ধরেই। রাশিয়া-ইউক্রেইন যুদ্ধের কারণে বিশ্বে জ্বালানি তেলের সংকটের মুখে এখন ত্রাহি অবস্থা সরকারের। কৃচ্ছ্রসাধন করেও সমস্যার সমাধান হয়নি। অবশেষে জ্বালানি তেলের রেকর্ড পরিমাণ দাম বাড়িয়েছে সরকার। এর পরিণাম হিসেবে এখনই বাড়তে যাচ্ছে পরিবহন খরচ, যা ব্যাপকভাবে প্রভাব ফেলবে জনজীবনে। অথচ কম সময়ে কম খরচে বিদ্যুৎ উৎপাদনের সুযোগ ছিল। তুষ থেকে সস্তায় সহজে বিদ্যুৎ উৎপাদনের উপায় বাংলাদেশেই উদ্ভাবিত হয়েছে। ব্যক্তি পর্যায়ে তুষ থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন হচ্ছেও। তুষ দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে সরকারের তেমন বড় অঙ্কের বিনিয়োগেরও প্রয়োজন হতো না। বেসরকারি উদ্যোক্তাদের দিয়েই এ ধরনের প্লান্ট চালু করা যায়। সেক্ষেত্রে সরকারকে শুধু সাব-স্টেশনের মাধ্যমে ওই বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে সরবরাহের সুযোগ করে দিতে হতো।
যশোরের শিল্প-শহর নওয়াপাড়ায় ২০১১-১২ সালের দিকেই তৈরি হচ্ছিল তুষ দিয়ে বিদ্যুৎ। ওখান থেকে ৪০০ কিলোওয়াট বিদ্যুৎ তৈরি হচ্ছিল। ওই বিদ্যুৎ একটি শিল্প-প্রতিষ্ঠান ব্যবহার করে প্রতিমাসে সাশ্রয় করছিল ৩ লাখ টাকা। ধানের তুষ দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন প্রথম শুরু হয় গাজীপুরের কাপাসিয়ায়। কাপাসিয়া উপজেলার বারিষাব ইউনিয়নের গিয়াসপুর গ্রামে নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ প্লান্ট বায়োম্যাস সিফিকেশন সিস্টেমে ধানের তুষ থেকে গ্যাস উৎপাদন করে তা দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন হচ্ছে। ২০০৩ সালে ওই গ্রামের আসাদুজ্জামান মানিক বিশ্ব ব্যাংকের সহায়তায় এ কার্যক্রম শুরু করেন। ২০০৭ সালের ৩১ ডিসেম্বর ৪০০ কেভিএ ক্ষমতাসম্পন্ন বায়োম্যাস প্রজেক্ট ড্রিম্স পাওয়ার লিঃ উদ্বোধন করেন তখনকার জ্বালানি উপদেষ্টা তপন চৌধুরী। বায়োম্যাস গ্যাসিফিকেশনের মাধ্যমে ধানের তুষকে অর্ধেক পুড়িয়ে গ্যাস উৎপাদন করার পর ওয়াটার প্রুফ ট্যাংকের মধ্যে প্রবাহিত করে পর্যায়ক্রমে কাঠের শুকনো গুঁড়া ভর্তি চারটি ফিল্টার অতিক্রম করিয়ে ফাইনাল ফিল্টারে শতভাগ ঠাণ্ডা ও বিশুদ্ধ গ্যাসে পরিণত করা হয়। পরে একে ডিজেল ইঞ্জিনে প্রবাহিত করে উৎপাদন করা হয় বিদ্যুৎ। এখান থেকে প্রথমে মেইন ডিস্ট্রিবিউশন বোর্ডে যায়, পরে পর্যায়ক্রমে ৪৪০ থেকে ২২০টি লাইনে প্রবাহিত করে বাসাবাড়ি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, সেচ প্রকল্প, আঁখ মাড়াই, পোল্ট্রি ফার্ম, মসলা উৎপাদন মেশিন, ডিশ লাইন, মোবাইল টাওয়ারসহ বিভিন্ন স্থানে সরবরাহ করা হয়। ২০১২ সালের দিকে ড্রিম্স পাওয়ারের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শেখ আসাদুজ্জামান মানিক বলেন, ওই সময় আশেপাশের সাতটি গ্রামে প্রায় ১৫ কিলোমিটার লাইন টেনে ৪৫০ জন গ্রাহককে বিদ্যুৎ দেওয়া সম্ভব হচ্ছিল। ওই স্টেশনের মোট উৎপাদন ক্ষমতা ৪০০ কেভিএ হলেও মাত্র ৫২ কেভিএ বিদ্যুৎ ব্যবহারে আসছিল যা মোট উৎপাদনের ২০ ভাগ। বাকি ৮০ ভাগ বিদ্যুৎই অব্যবহৃত থেকে যাচ্ছিল। তিনি বলেন, পুরো মাত্রায় এ স্টেশন সচল করে শতভাগ বিদ্যুৎ ব্যবহার করতে না পারলে স্টেশনটি টিকিয়ে রাখা সম্ভব হবে না। সরকার যদি জাতীয় গ্রিডে অথবা নিকটবর্তী ট্রান্সফরমারে পিক আওয়ারে বিদ্যুৎ ঘাটতি পূরণের লক্ষ্যে এখান থেকে বিদ্যুৎ নিয়ে অফপিক আওয়ারে সমপরিমাণ বিদ্যুৎ ফেরত দেয়, তবে সরকার এবং এ প্রতিষ্ঠান উভয়ে লাভবান হবে। মানিক আরও দাবি করেন মাত্র আড়াই কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত এরকম স্টেশন স্থাপন করে সরকার যদি স্থানীয় উদ্যোক্তাদের দিয়ে পরিচালনা করে তবে সারা দেশের বিদ্যুৎ সংকটের স্থায়ী সমাধান সম্ভব। সেই সংকটের সমাধান হওয়ার কোনো খবর আর পাওয়া যায়নি।
ভৌগলিক অবস্থানের কারণে বাংলাদেশে নবায়নযোগ্য জ্বালানির সবচেয়ে সম্ভাবনাময় উৎস হচ্ছে সৌর শক্তি। সৌর শক্তি কাজে লাগিয়ে দেশে এ পর্যন্ত প্রায় ৩২৬ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন সম্ভব হয়েছে বলে উল্লেখ আছে টেকসই ও নবায়নযোগ্য জ্বালানি উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (স্রেডা)-এর ওয়েবসাইট থেকে। তবে ওই বিদ্যুতের বেশিরভাগই এসেছে প্রত্যন্ত অঞ্চলে অফগ্রিড (জাতীয় গ্রিডের সঙ্গে সংযোগবিহীন) এলাকায় স্ট্যান্ড অ্যালোন হিসেবে স্থাপিত সোলার হোম সিস্টেম থেকে। প্রতি মেগাওয়াট সৌর বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য তিন একরের বেশি ভূমির প্রয়োজন হওয়ায় বড় আকারের সৌর বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন করার জন্য ভূমির সংস্থান দুরূহ। এ কারণে গ্রিডে সংযুক্ত বিভিন্ন স্থাপনা যেমন বাসা-বাড়ি, শিল্প কারখানার অব্যবহৃত ছাদে সোলার সিস্টেম স্থাপনের মাধ্যমে বিদ্যুৎ উৎপাদনের বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা হচ্ছে। স্রেডার মতে, ছাদে সোলার হোম সিস্টেম স্থাপন করা হলে বিদ্যুৎ উৎপাদনের ক্ষেত্রে নবায়নযোগ্য জ্বালানির অবদান বাড়বে।
সূর্যালোক থেকে বিদ্যুৎ তথা সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদনের সহজ পদ্ধতি হলো নেট মিটারিং বা রুফটপ সোলার ও জাতীয় গ্রিডের সমন্বিত ব্যবস্থা। এর মাধ্যমে ভবনের ছাদে স্থাপিত সোলার প্যানেলের সঙ্গে সংযোগ ঘটানো হয় জাতীয় গ্রিডের। নেট মিটারিং পদ্ধতিতে বিদ্যুৎ গ্রাহক নিজ স্থাপনায় স্থাপিত নবায়নযোগ্য জ্বালানিভিত্তিক সিস্টেমে উৎপাদিত বিদ্যুৎ নিজে ব্যবহার করে উদ্বৃত্ত বিদ্যুৎ বিতরণ গ্রিডে সরবরাহ করেন। এভাবে সরবরাহ করা বিদ্যুতের জন্য সংশ্লিষ্ট গ্রাহকের বিদ্যুৎ বিল সমন্বয় করা হয় পরবর্তী মাসের বিলের সঙ্গে।
উন্নত বিশ্বে অনগ্রিড সোলার সিস্টেম চালু হয়েছে বহু বছর আগেই। ভারত, শ্রীলঙ্কাসহ বিশ্বের অর্ধশতাধিক দেশে নেট মিটারিং পদ্ধতি চালু আছে। দেশে নেট মিটারিং পদ্ধতি এসেছে বেশ কয়েক বছর আগে। কিন্তু বগুড়া জেলায় খাদ্য অধিদপ্তরের একটি ভবনের ছাদে স্থাপিত সোলার সিস্টেমকে বিতরণ গ্রিডের সঙ্গে সংযুক্ত করে নেট মিটারিং প্রক্রিয়ায় বিদ্যুৎ আমদানি-রপ্তানি করা ছাড়া এখনো দেশের সরকারি অন্যান্য ভবনে নেট মিটারিং স্থাপন করা হয়নি। সরকারি ভবনে এ পদ্ধতি চালু না করলে ব্যক্তি পর্যায়ে চালু হবে কি করে! এ ছাড়া সরকারি সংস্থা স্রেডাই বলছে, সোলার সিস্টেম স্থাপনের জন্য অনগ্রিড বিদ্যুৎ গ্রাহককে প্রণোদনা দেওয়ার ব্যবস্থা করা হলে তা নবায়নযোগ্য জ্বালানিভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদনকে উৎসাহিত করবে। কিন্তু সেই প্রণোদণা দেওয়ার কোনো উদ্যোগ দৃশ্যমান নয়। অথচ শুধু নেট মিটারিং চালু করেই ডিজেল-নির্ভর বিদ্যুৎ উৎপাদন থেকে পরিত্রাণ পাওয়া সম্ভব। ২০১৯ সালের মাঝামাঝি সময়ে দুই মাসের টার্গেট দিয়ে ২০ জন করে নেট মিটারিং গ্রাহক সৃষ্টি করতে বলা হয়েছিল প্রতিটি বিদ্যুৎ বিতরণ কোম্পানিকে। কিন্তু পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড (আরইবি) ছাড়া সবাই ব্যর্থ হয় সেই লক্ষ্য পূরণ করতে। প্রধানমন্ত্রীর বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিষয়ক উপদেষ্টা ড. তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী বীর বিক্রম ২০২০ সালের ৩০ ডিসেম্বর অনলাইন মাধ্যমে এক কর্মশালায় বলেছিলেন, নেট মিটারিং সিস্টেম গ্রাহকবান্ধব করতে মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তাদের সমন্বিতভাবে কাজ করতে হবে। রুফটপ সোলার ও নেট মিটারিং সিস্টেম ব্যবহারকারীর প্রযুক্তিগত সহযোগিতা বাড়ানো প্রয়োজন। অথচ দেশের বেশিরভাগ মানুষ জানেই না নেট মিটারিং আসলে কী!
২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট ক্ষমতায় আসার পর নিয়ম করেছিল বাসা-বাড়িতে বিদ্যুৎ সংযোগ পেতে হলে বাধ্যতামূলকভাবে সোলার প্যানেল লাগানোর। কিন্তু ওইসব বাসা-বাড়িতে উৎপাদিত সৌরবিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে যুক্ত করার ব্যবস্থা রাখা হয়নি। এতে সৌরবিদ্যুতের অপচয়ই হচ্ছিল এক ধরনের। এ ছাড়া অনেক গ্রাহক ভবনে বিদ্যুৎ সংযোগ পাওয়ার আশায় সোলার প্যানেল স্থাপন করলেও ব্যাটারিজনিত জটিলতার কারণে তা আর ব্যবহার করেনি বেশিদিন। অথচ জাতীয় গ্রিডের সঙ্গে সংযোগের মাধ্যমে নেট মিটারিংয়ের ব্যবস্থা করা গেলে আবাসিক ভবনে নতুন বিদ্যুৎ সংযোগ পেতে হোম সোলার সিস্টেম স্থাপনের বাধ্যবাধকতাটি অনেক কার্যকর হতো।
রাজধানীসহ সারাদেশে চলাচল করছে কয়েক লাখ ব্যাটারিচালিত রিকশা ও ইজিবাইক। এক লাখ ইজিবাইক বা রিকশার ব্যাটারি চার্জ দিতে জাতীয় গ্রিড থেকে প্রতিদিন অন্তত ১১০ মেগাওয়াট তথা মাসে ৩৩০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ খরচ হওয়ার কথা। বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী, শতকরা ৮০ ভাগ গ্যারেজ অবৈধভাবে বিদ্যুৎ ব্যবহার করে ব্যাটারি রিচার্জ করায় সরকার প্রায় ২৬০০ মেগাওয়াট বিদ্যুতের রাজস্ব আয় থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। সৌরবিদ্যুতের মাধ্যমে ওইসব যানবাহনের ব্যাটারি রিচার্জ করার ব্যবস্থা করা হলেও বিপুল পরিমাণ জ্বালানি সাশ্রয় করা সম্ভব।
ধানের তুষ থেকে কিংবা নেট মিটারিং পদ্ধতিতে বিদ্যুৎ উৎপাদনে সরকারের বিনিয়োগ কম হওয়ায় মোটা অঙ্কের কমিশন বাগানোর সুযোগও কম থাকে। এ কারণেই সম্ভবত নীতিনির্ধারকসহ সংশ্লিষ্ট আমলা-প্রকৌশলীরা এ দিকে মনোযোগ দিতে আগ্রহ বোধ করেননি। এক কথায় বলা যায়, সহজ সমাধানে মনোযোগই নেই সরকারের।